#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২৯
পার হলো আরও দুই বছর। দুই বছরে অনেকটা বদলেছি আমি। একটু একটু করে। এই যেমন এখন চোখে মাঝারি পাওয়ারের একটা মোটা ফ্রেমের চশমা পরি, চুলগুলো আগের মতো বড় নেই, যত্ন করার ইচ্ছে হয় না বলে ছোট করে কেটে রাখি। বাইরে বের হলে শাড়ি পরি, মেয়েলিপনা আবেগ ছেড়ে কথা বলি একদম সোজাভাবে। অনেক সময় নিজেরই মনে হয়, যন্ত্র হয়ে গেছি। তবে এখন কলেজের ম্যাম হিসেবে বেশ সমীহ করে সবাই।
বয়স এবার উনত্রিশ হলো। একটা মেয়ে হিসেবে খুব বেশিও না আবার কমও না। বিধবা হিসেবে হয়তো একটু কমই? নাকি আগের দিনে এরচেয়েও অনেক ছোট মেয়েরা বিধবা হয়ে যেত? তাদের তবুও বাচ্চা থাকতো। আমার কিচ্ছু নেই। ব্যাস, শুধু নিজের মতো বেঁচে থাকা। সাতটা বছর সে আমার জীবনের সাথে লেপ্টে ছিল। আমায় কুসুম ফোটা একটা নাজুক ফুল থেকে পরিণত মানুষ করে দিয়ে গেছে।
তার মৃত্যুর ছয় মাস পর এক রাতে আমি হঠাৎ করেই যেন সবকিছু মেনে নিয়েছি। তার আগে প্রচুর কান্নাকাটি করতাম। পাগলের মতো লাগতো। ইচ্ছে করতো ছাদে গিয়ে এক লাফ দিয়ে জীবনের সব ঝামেলা শেষ করে ফেলি। আমার এমনিতেও কোনো পিছুটান নেই। কিন্তু কেন যেন পারতাম না। প্রেম, ভালোবাসা, ত্যাগ, স্মৃতি সবকিছু যন্ত্রণার জলে মিশে আমার হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠতো! সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম সে একটা ব্রিজের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে আমি। সামনে যতদূর চোখ যায় পানি। ওপরে চাঁদটা চকচকে আলো দিচ্ছে। সে বলল, “তোমাকে ভালো রাখার জন্যই আমি সব করলাম। তুমি ভালো নেই কেন?”
আমি ছুটে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। সে আটকে দিল। বলল, “কাছে এসো না। আমাকে ছোঁয়া যাবে না।”
“কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে চাই!”
“আমার সাথে থাকার অনেক কষ্ট। তুমি নিতে পারবে না।”
“পারব।”
“পারবে না। কথা দাও, ভালো থাকবে?”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে।”
সে মৃদু হাসলো। চাঁদের আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম তার অপরূপ মুখটি। সে বলল, “আমার শেষ ইচ্ছে, তুমি ভালো থাকবে? প্লিজ কথা দাও?”
আমি কথা দিলাম। সে আমার দিকে তাকালো না। উল্টো ঘুরে হেঁটে চলে গেল। আমি দৌড়ে পিছু নিলাম। তাকে ধরতে পারলাম না। কোথায় হারিয়ে গেল সে!
যখন জেগে উঠলাম তখনও হাঁপাচ্ছি। উঠে জানালার পাশে চলে গেলাম। সেই চাঁদটাই তো! চাঁদের আলোতে কদমগাছটা থেকে ভুতুড়ে পেঁচারা ডাকতে শুরু করল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, “আমি আর কাঁদব না। ভালো থাকব। তারপর থেকে চাইলেও সেভাবে কাঁদতে পারি না৷ নিজেরও অবাক লাগে, সে কি সত্যি স্বপ্নে এসেছিলো? নাকি সব আমার কল্পনা? হয়তো আমার নিজের সত্তাই চাচ্ছে না আর খারাপ থাকতে। এবার একটু শান্তি মিলুক নাহয়!
অনেকে অবশ্য পেছনে সেজন্য অনেক কথাও বলে, বরটা মরে গেল, তবুও শোকতাপ নেই আমার। কেমন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি! আমার সেসব শুনলে কেন যেন অনেক মজা লাগে। এরাও হয়তো অনেক অসুখী। অন্যকে ভালো থাকতে দেখলে ভালো লাগে না।
সে মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমার শ্বশুর আমার স্বামীর অংশের সম্পত্তি আমার নামে করে দিল। আমি নিতে চাইনি, জোর করে দিয়ে গেল। আমি অনেকবার বললাম, ” আমার দরকার নেই, অর্না, অনুভবকে সমানভাবে ভাগ করে দিন, উনি রাজি হলেন না।
আমি অবশ্য পরে এই অজস্র সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা করে ফেললাম। বেশ কিছু টাকা দিয়ে মেয়েদের জন্য একটা ঋণদান সংস্থা খুলে ফেললাম। তারা এখান থেকে প্রয়োজনে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিনা সুদে ঋণ নিতে পারবে।
কিছু টাকা মানসিক হাসপাতালে দান করলাম। আর বাকিটা দিয়ে বাড়ির পাশে একটা স্কুল খুলে ফেললাম। স্কুলটা গরীব বাচ্চদের জন্য। যারা টাকার অভাবে পড়তে পারে না। ভালো বেতনে কিছু শিক্ষকও রেখে দিলাম। স্কুলের টাকার একটা অংশ ব্যাংকে জমা থাকলো, যেখান থেকে শিক্ষকদের বেতনের টাকাটা উঠে আসে। এসব করতে সাহায্য করল ইভা। অনেক বুঝদার এই মেয়েকে পাশে পেয়ে আমার অর্ধেক কষ্টই কমে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর অদৃশ্য আরও দশটা হাত আছে, যেগুলো দিয়ে সব সামলায়। এমনই তো হওয়া উচিত একটা মেয়ের। আমার মতো কম গুণ নিয়ে জন্ম হলে জীবনটা কষ্টেই কাটে!
.
আমি এখন প্রচুর লেখালেখি করি। আমার একক বই বের হচ্ছে গত দুই বইমেলায়। অনেকেই আমায় চেনে। প্রতি বৃহস্পতিবার সাহিত্য সংঘের আসর বসে আমাদের পাশের এলাকায়। অনেক জ্ঞানীগুণী কবি সাহিত্যিকরা আসেন। আবার অনেক নতুন লেখকরাও যোগ দেয় তাতে। আড্ডা হয়, আবৃত্তি হয়, প্রতিযোগিতা হয়, সমালোচনা হয়। বেশ লাগে এই সময়টা! সব ভুলে অন্য জগতে চলে যাই।
সেখান থেকেই আবিষ্কার করেছি আমি ভালো আবৃত্তি করতে পারি। ছোটবেলায় স্কুল কলেজে সংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করতাম, অনার্সে ওঠার পর আর চর্চা হয়নি। তবুও আবৃত্তি সুন্দর হয়। মনপ্রাণ ঢেলে একেকটা কবিতা পড়ি। কবিতা আবৃত্তির সময় সবসময় আমার মনে হয় সামনে এখানকার কেউ নেই, শুধু আমি আছি, আর সামনে শ্রোতা সে। আমি প্রাণ দিয়ে জোর গলায় কবিতা শোনাচ্ছি, সে হাততালি দিয়ে বলছে, “বাহ, কি সুন্দর আবৃত্তি করো গো তুমি!”
সে শুধু এখানেই না, অনেক সময় আমার আশেপাশে চলে আসে। যেমন ভালো রান্না করলে, সে উদয় হয়ে চেখে দেখে বলবে, “ফার্স্টক্লাস!”। ভালো গল্প লিখলে পড়ে বলবে, ” চমৎকার হয়েছে।” কখনো সুন্দর করে সাজলে এসে দাঁত বের করে হেসে বলবে, “ভালোবাসি।”
কেউ না জানলেও আমি জানি, সে আছে৷ আমার খুব কাছেই সে এখনো বাস করে। তার দাদীর সেই আংটিটা এখনো আমার হাতে পরি। কখনো খুলিনি৷ এটার ইতিহাস সে বলেছিলো। আমার দাদী শ্বাশুড়ি আমার শ্বাশুড়িকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। তবে বড় নাতি ছিল তার চোখের মণি। তিনি এই আংটিটা খুব শখ করে মৃত্যুর আগে বড় নাতবউ এর জন্য বানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন দিয়ে দিলে যদি আমার শ্বাশুড়ি পরে ফেলে, তাই তাকে কখনো এটা দেখাননি। চুপি চুপি নাতিকে দিয়ে বলেছিলেন, আংটিটা তার বউকে পরিয়ে দিতে, তবে মাকে যেন না দেখায়।
আংটির ওপর ছোট্ট দুটো অক্ষর খোদাই করা- এ.এস। ডিজাইনের ভিড়ে চোখে পড়ে না। আমি অনেক পরে সেটা দেখেছি৷ এ.এস তার ভালো নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। তবে আমার কাছে এটার মানে অপূর্ব-সমাপ্তি!
.
সন্ধ্যাবেলা আমার কাজ হলো এক মগভর্তি চা নিয়ে পড়তে বসা। লেকচার তৈরি করা, তারপর সময় ধরে কিছু পড়াশোনা করা, শেষে লেখালেখি। পুরো চা টা গরম থেকে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়, তখনও একটু একটু করে চুমুক দিয়ে যাই।
পড়ছি আমি, এমন সময় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। ধরতেই একটা ছেলেকন্ঠ সালাম দিলো। আমি উত্তর দিলাম৷ ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
“ভালো। আপনি কে বলছেন?”
“আমি অপূর্ব।”
নামটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য হৃৎপিণ্ড থেমে গেল! পরক্ষণেই আবার সামলে নিলাম। এ নামে অনেক মানুষই আছে পৃথিবীতে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কেন ফোন করেছেন?”
“ধন্যবাদ দিতে।”
“কিসের জন্য?”
“আজ এত সুন্দর করে আমার কবিতা আবৃত্তি করলেন, তখনই দিতাম, কিন্তু এখন রাত এত দ্রুত হয়ে যায়, সবাই কেমন হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল, আপনাকে আর পেলামই না!”
“কিন্তু আমি অপূর্ব নামের কারো কবিতা আবৃত্তি করিনি।”
“কার কবিতা পড়লেন তাহলে?”
“সেটা মনে নেই, তবে নামটা অপূর্ব ছিল না।”
“শিওর?”
“হ্যাঁ!”
ওপাশের ছেলেটা হো হো করে হেসে বলল, “ঠিক ধরেছেন। ওখানে নাম ছিল শাহরিয়ার কবির।”
“হ্যাঁ এটাই!”
“ওটা আমার ভালো নাম।”
“ওহ।”
“জানেন, আমার কবিতা এত সুন্দর করে কেউ কখনো আবৃত্তি করেনি। আমি জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেছি।”
“আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?”
“সাহিত্য সংঘের রেজিস্টারে সবার নাম্বারই থাকে ম্যাডাম।”
“ওহ হ্যাঁ।”
“আপনাকে এখন ফোন করার আরেকটা কারন অবশ্য আছে।”
“কী?”
“মা বিরিয়ানি রান্না করছে। ঘ্রাণে টিকতে পারছি না। অথচ রান্না শেষ হয়নি। তাই অন্যদিকে মন ঘোরতে আপনাকে কল করা৷”
“ও আচ্ছা!”
“আপনার বিরিয়ানি পছন্দ না বুঝি?”
“অনেক পছন্দ।”
“আমারও। একেবারে পাগল পাগল লাগে নাম শুনলে।”
আমি হেসে ফেললাম। ছেলেটা বলল, “আপনাকে প্রথম দেখে খুব চেনা লাগছিলো। কোথায় যে দেখেছি মনেই পড়ছিলো না। পরে একদিন মনে পড়ল। গতবছর কোলকাতায় গিয়ে মার্কেটে একটা মেনিকুইন খুব চমৎকার লেগেছিলো। আমি ছবি তুলে রেখেছিলাম। আপনার চেহারা অনেকটা সেরকম।”
“কি আজব!”
“আজবই তো বটে! আরও মজার কথা শুনবেন? সেবার বাবার সাথে বাজারে গেছি….”
ছেলেটা কথা বলতেই থাকলো, কোথা থেকে কোথায় গেল নিজেও বোধহয় জানে না। আমারও এমন আজগুবি, সহজ সরল কথাগুলো শুনতে খুব মজা লাগতে লাগলো। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দশটা বাজে। প্রায় দেড় ঘন্টা কথা বলেছি। আমি বললাম, “রাখছি। কত্তো কথা বলে ফেললাম! আপনার বিরিয়ানি হয়নি?”
“হয়ে গেছে। তবে আপনার সাথে কথা বলতে বিরিয়ানির চেয়ে মজা লাগছে।”
“আপনি তো ভারি অসভ্য!”
“উচিত কথা বললে অসভ্য হই কী করে? আপনার সাথে কিন্তু দেখা হচ্ছে পরের সপ্তাহে…”
“ঠিক আছে।”
“ভালো থাকবেন।”
“আপনিও।”
ফোন রাখার পর মনটা ফুরফুরে লাগতে লাগলো। খুশবুর কাছে চলে গেলাম। ওর সাথে দুষ্টুমি করলাম কিছুক্ষণ। ওকে জ্বালাতন করলে চোখমুখ লাল করে ফেলে। কি যে সুন্দর লাগে! ইভা রান্নাঘরে কাজ করছিলো। ঘরে এসে আমাদের হাসতে দেখে বলল, “আজ এত খুশি কেন তুমি?”
“কোথায় খুশি?”
ও মুখ টিপে হাসলো। আমাকে কথা বলতে দেখে উল্টোপাল্টা কিছু ভাবছে নাকি!
ও বলল, “খেতে চলো। বিরিয়ানি রান্না করেছি।”
“তুমিও বিরিয়ানি রেঁধেছ?”
“অন্য কে রাঁধলো?”
“না কেউ না, চলো।”
(চলবে)