#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪১(বিষাক্ত)
#লিখা_তানজিলা
-“আমার বাচ্চা..!”
দীর্ঘ এক মিনিটের অস্বস্তিজনক নিরবতার পর সীমান্তর মুখনিঃসৃত শব্দমালায় আইজার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। তারওপর শেষে প্রশ্নবোধক ভঙ্গির রেশ। কটমট করে তাকালো ও। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“না!”
আইজার জবাবে এবার সীমান্ত শক্ত চোখে তাকালো।
-“আপনি নিজেও জানেন আপনার মুখ থেকে কী বের হচ্ছে!!!!”
সীমান্তর ক্রোধমিশ্রিত মুখমণ্ডল উপেক্ষা করেই তার কলার চেপে ধরলো আইজা। ব্যঙ্গার্ত্বক গলায় আরো বলে উঠলো,
-“রাতভর আমার সাথে চুম্বকের মতো চিপকে থেকে এখন যদি প্রশ্ন করেন যে এটা আপনার বাচ্চা কি না, তাহলে আমার কাছ থেকে আর কী জবাব আশা করেন আপনি!!!
-“সব কথার ত্যাড়া জবাব!”
কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো সে।
-“আপনি প্রশ্নই এতো ক্রিয়েটিভ! আমার মুখ থেকে ত্যাড়া কথা ছাড়া আর কিছুই আসে না!”
ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে আঁখি জোড়া বন্ধ করলো সীমান্ত। এক হাত কপাল অব্দি নিয়ে সেখানে আঙ্গুল বুলিয়ে যাচ্ছে সে।
-“তিন মাস কম মনে হচ্ছে আপনার আইজা! প্লিজ, এসব নিয়ে মজা করবেন না।”
সীমান্তর চাহনি পূর্বের তুলনায় নরম হয়ে এসেছে। তার কলার হতে নিজ হাত ধীর গতিতে সরিয়ে নিলো আইজা। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলো শুধু।
আপাতদৃষ্টিতে তিন মাস যেমন কারো কাছে কম তেমনি কারো কাছে অনেক দীর্ঘ। আইজা এখানে দ্বিতীয় পরিস্থিতির মানুষ। ব্যপারটা মনে হলেও বুক চিরে একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। ও যদি প্রথম থেকেই ওর প্রেগনেন্সির বিষয়ে জানতো তাহলে হয়তো ওর মা-ও তার জীবদ্দশায় এটা জানতে পারতো। কতটা খুশী হতো সে!
-“আমার কথা শুনতে পারছেন আপনি!”
সীমান্তর অধৈর্য রাঙা কন্ঠে টনক নড়লো আইজার।
-“আমি এসব নিয়ে কেন মজা করতে যাবো! আপনার যা ইচ্ছে ভাবুন, আমি আর কিছু বলবো না।”
আইজার বলা শেষ বাক্যে মিশে থাকা চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তৎক্ষনাৎ সীমান্তর চাহনি জুড়ে একরাশ স্তব্ধতার রেশ ভর করলো। যেন এতক্ষণ আইজার বলা কোন কথাকেই গুরুত্ব সহকারে নেয়নি সে।
-“আপনি আগে বলেননি কেন? তার ওপর এ শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন? আপনার স্পর্ধা দেখলে…!”
টর্চের মৃদু আলোয় সীমান্তর রক্তলাল চোখ মুখ দেখে কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠলো আইজা। তবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির সম্মুখে তা প্রকাশ করলো না। বরং শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো ,
-“আমি নিজেই গতকাল জানতে পেরেছি। নইলে আরো আগে চলে যেতাম!”
-“আইজা, আপনি অলরেডি আমার ধৈর্যের অনেক পরীক্ষা নিয়েছেন। আর না। নইলে আমি এমন কিছু করে বসবো, যাতে আপনি ভয়ংকর ভাবে পস্তাবেন!”
ঠান্ডা কন্ঠস্বরে বলে উঠলো সে। সীমান্তর কথা কানে যেতেই এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আইজার মুখ থেকে।
-“আপনার কী মনে হয়, আমরা একসাথে কোন বাচ্চাকে সামলানোর যোগ্যতা রাখি? আমাদের মধ্যে কোন বিষয়টা স্বাভাবিক! তবে চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে আপনার বাচ্চার থেকে আলাদা করবো না। কিন্তু আমার পক্ষে এই বিষাক্ত সম্পর্কে থাকা আর সম্ভব না।”
***
সীমান্তকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেখানে প্রবেশ করতেই ফ্লোরে ছটফট করতে থাকা ব্যাক্তির দিকে নজর গেলো আসিফের। বাকা হেসে মুখের ওপর রাখা কাপড় সরালো ও। মুহূর্তেই ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি মিলিয়ে গেলো।
-“তুই এখানে কেন? সীমান্ত কোথায়?”
মুখ বন্ধ থাকায় লোকটা আর কিছু বলে উঠতে পারলো না। রাগান্বিত চোখে সাথে সাথে লোকটার বুক বরাবর দুই তিনটে লা*থি বসিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো আসিফ। মেঝেতে পড়ে থাকা ব্যক্তিকে ওখানে ফেলেই ক্ষীপ্র গতিতে বেরিয়ে এলো ও।
আইজাও রুমে নেই। মেঝেতে শুধু আইজাকে দেয়া ঐ ব*ন্দুক পড়ে আছে। প্রথমে পাওয়ার কাট আর এখন!! এক মিনিট! এই পাওয়ার কাট কোন এক্সিডেন্ট ছিলো না! মাথার ওপর টর্চ সেট করে হাতে থাকা পি*স্তলের ট্রি*গার সতর্ক ভঙ্গিতে ধরলো ও। সীমান্ত আর আইজা নিশ্চয়ই আশেপাশে আছে। সেই রুম থেকে বের হতেই আসিফের ফোন বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে ভেসে আসা কন্ঠে পা থেমে গেলো ওর।
-“ভাই ঝামেলা হইয়া গেছে! বাইরে পুলিশ!!!”
****
বাইরে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার রেশ এই ছোট ঘরটায় বসেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ঘরটাতে শুধু একটা বিছানা ছাড়া কিছুই নেই। রাত গভীর প্রায়। তবে ঘুম কারো চোখে নেই। এভাবে কিডন্যাপিং এর শিকার হলে কারই না ঘুম হবে!
পাখি নির্লিপ্ত চোখে বিছানায় পা উঠিয়ে বসে আছে। রাজিয়া ভ্রু কুঁচকে মেঝেতে পড়ে আছে। দরজা খোলার এতো চেষ্টা করলো সারাদিন, কোন লাভ হলো না।
-“এমনে বইসা আছে লাগে কালই তোর বিয়া! ডর লাগে না!”
রাজিয়ার খিটখিটে কন্ঠে মিটমিটিয়ে হেঁসে উঠলো পাখি। তার মধ্যে কোন অনুভূতিই যেন আর বাকি নেই।
-“তুই শিকদার বাড়িতে কাজ কেন করতি?”
হুট করে করা পাখির প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে উঠলো রাজিয়া। শুকনো গলায় বলে উঠলো,
-“এডা আবার কেমন প্রশ্ন! আমার কাম দরকার আছিলো। আমি তো আর তোর মতো টেন পাশ না! টাকার দরকার আছিলো, এ বাড়িতে কাম নিছি। অন্তত শরীর বেঁচার থেইকা ভালো। আর আমার বাপ তো আর মরার আগে কম মানুষের থেইক্কা টাকা নেয় নাই! কিন্তু তুই এহন এগুলা কেন জিগাস?”
-“তুই কিছু জানোস না!”
পাখির কন্ঠে স্পষ্ট ক্ষুব্ধতা।
-“জানলেই কী! আর তুইও তো ঐ বাড়িতে কাম করতি! কেন? ঐ নাজিম তো কোন বিচার বিবেচনা না কইরা তোর বাপরেও হাজতে পাঠাইছিলো। তোর কী ঐ বাড়িতে কাম করার পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছিলো না-কি!!”
পাখি রাজিয়ার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। মাথায় চলছে অসংখ্য চিন্তা। সীমান্ত হয়তো ওর আর রাজিয়ার ব্যপারে ইতোমধ্যে জেনে গেছে!
পাখি আর রাজিয়ার বাবা আগে শিকদার বাড়িরই কর্মচারী ছিলেন।
নাজিম শিকদারের স্ত্রী আর সন্তানের অপহরণের পর পরই ওদের জীবনটাও বদলে গেলো। কোন এক অজানা কারণে আইজার বাবা আরমান, পাখি আর রাজিয়ার বাবার ওপর দোষ চাপিয়ে দিলো। তারা না-কি সীমান্ত আর তার মায়ের অপহরণে জড়িত ছিলো!
আরমান আজাদ আর নাজিম শিকদারের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো বেশ গভীর। নাজিম আরমানের কথাতেই ভরসা করে। পাখির বাবা তো নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। হাজতেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তার।
আর রাজিয়ার বাবা জেলে থাকা কোন এক প্রভাবশালী ক্রিমিনালের সাথে যোগ দেন। রিমান্ড নিশ্চিত যেনে আগেই জেল থেকে পালান তিনি। এক জঘন্য ক্রিমিনাল গ্যাঙের সদস্য হয়ে যান। মেয়ের অস্তিত্বই যেন ভুলে যান তিনি। এর পুরো প্রভাব রাজিয়ার ওপর পড়ে। বাবা ছাড়া কেউই ছিলো না ওর। তারওপর কয়েকদিন পর পর পুলিশ জেরা। কোনমতে বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে দিন পাড় করেছে। শেষমেষ বাবার নেয়া ঋণের ঝামেলায় পড়লো ও। আর একদিন হুট করেই নিজের বাবার খুনের খবর পেলো রাজিয়া।
মারা যাওয়ার আগে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো সে। তারমধ্যে একজন দেহ ব্যবসায়ীও ছিলো। সেখানকার মহিলা সর্দার রাজিয়ার মায়ের কোন এককালের বান্ধবী ছিলেন হয়তো। তাই রাজিয়াকে তিনি একটা সুযোগ দিয়েছিলেন। কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার।
রাজিয়া বেশ কিছু বাড়িতে কাজ করলেও কিস্তির টাকা যোগার হচ্ছিলো না। অতঃপর নাজিম শিকদার সেই মহিলার পুরো টাকা শোধ করে রাজিয়াকে শিকদার বাড়িতে কাজ করার অফার দেয়। রাজিয়াও আর না করে না। তবে ঐ মহিলার জন্য হয়তো মনে মায়া রয়ে গেছে। তাই ছুটিতে তার সাথেই দেখা করতে যায় রাজিয়া।
পাখি আর রাজিয়ার মধ্যে ঐ বাড়িতে কাজ করার প্রায় তিন বছরে একবারও এ বিষয়ে কথা হয়নি। পাখি প্রথমে মনে করেছিলো রাজিয়ারও হয়তো ওর মতো অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু না, মেয়েটা প্রচন্ড বোকা। কেউ একটু ভালো করে কথা বললেই মোমের মতো গলে যায়। প্রথমে নাজিম আর তারপর রায়হান। কত বোঝালো মেয়েটাকে, রায়হান ওর সাথে টাইম পাস করছে! না! এই মেয়ে তাতে কানই দিলো না।
রাজিয়ার মতো পাখির পক্ষে নাজিম শিকদারের মিষ্টি কথায় গলা সম্ভব ছিলো না। তিনি না-কি তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। এতো সহজ! তার এই ভুলে কতগুলো মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে গেলো। শেষপর্যন্ত ঐ আরমানই বাটপার বের হলো। পাখি এখন শুধু দেখে যাচ্ছে। তবে শেষ চাল টা তো ও-ই চালবে!
-“রাজিয়া!”
পাখির প্রফুল্ল কন্ঠে রাজিয়ার কুঁচকে থাকা চোখ জোড়া আরো এক ধাপ কুঁচকে গেলো। পাখি তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে বলে উঠলো,
-“মন খারাপ করিস না। কাল থেকে রায়হান কাউকে মুখ দেখানোর অবস্থায় থাকবে না!”
চলবে…