#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৫৩ (রিজা)
#লিখা_তানজিলা
কয়েক ঘন্টা আগে
——————————–
এতোকিছুর পরও শিকদার বাড়িতেই ফেরত এলো আইজা। ভয় হচ্ছিলো যদি ঐ ফ্ল্যাটে ফেরত গেলে আরফান আর সিমির দিকেও নজর যায় নাজিমের! সে রিস্ক নিলো না ও! পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছে একটু পর পর। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি! শেষপর্যন্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো আইজা। এমনিও কতক্ষণ এক ঘরে ব*ন্দী থাকবে!
নাজিম শিকদারের সেই ড্রাইভারকে নাজিমের রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে দেখে থেমে গেলো ও। লোকটার নাম জানা নেই আইজার। সত্যি বলতে ছয় মাস পর এ বাড়ির সব ওয়ার্কারই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এমনকি রিয়াদকেও দেখা যায় না ইদানিং। আইজা সেই লোকটিকে উপেক্ষা করেই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।
-“আপনার ভাগ্যটা খুব ভালো! নইলে আপনার সাথে যে কী হতো আপনি সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না!”
লোকটার চোখ আইজার ওপরই নিবদ্ধ! কথাটা যে আইজাকেই উদ্দেশ্য করে বলা সেটা বুঝতে সময় লাগেনি ওর।
-“একটু ধীরে বলুন! এতোটা মুখ পাতলা হলে তো আপনার ঐ বস্ ধরা খেয়ে যাবে! না-কি তিনি নিজেই আপনাকে এসব বলতে বলেছে!”
আইজার কন্ঠে বিদ্রু*পের রেশ! মানুষটার কতো সাহস হলে এভাবে আইজার দিকে তাকিয়ে এ কথা বলে বসলো!
তবে আইজার চোখের দিকে তাকিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সে। বাঁকা হেঁসে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত বেহায়া ভঙ্গিতে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে!
-“সেদিন যদি সীমান্তর ভাড়া করা লোকগুলোর চোখ এড়িয়ে আপনাকে কিড*ন্যাপ করা যেতো তাহলে এই শিকদার বাড়িতে নিয়ে আসা হতো না আপনাকে!”
-“কি বলতে চাইছেন আপনি!”
লোকটা কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
-“খুবই নোং*রা একটা জায়গায় ফেলে আসতাম তোকে! যেখানে মেয়েদের পণ্যের মতো বিক্রি করা হয়। সেখানে প্রবেশ করা তো সহজ কিন্তু বের হওয়া না!! এখনো সময় আছে! নাজিম স্যার যা বলছে সেটা কর! পারলে এসব সীমান্তকেও বলিস! সীমান্ত যদি তার বাপের বিরুদ্ধেও যায় তার পরোয়া নাজিম শিকদার করে না!”
তীক্ষ্ণতার সুরে বললো সে। আইজা নিশ্চিত নাজিম শিকদারই লোকটাকে এসব বলতে বলেছে। নইলে তার কোন এমপ্লয়ি নিজের থেকেই তো আর আইজাকে ভেতরের খবর বলে দেবে না!
কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো আইজা। পরক্ষণেই নিজের মুখভঙ্গি শক্ত করে নিলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির গাল বরাবর কষিয়ে চ*ড় বসিয়ে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো ও। কঠোর গলায় বলে উঠলো,
-“আমি সীমান্তর সাথেই থাকবো! যা করার করে নিস্! কথাগুলো আপনার বসকে বলে দেবেন!”
প্রথম দুটো বাক্যে আইজার মুখে তিক্ততার ছাপ থাকলেও শেষের বাক্যটা হাসিমুখেই বলে উঠলো ও!
-“আদা…!”
লোকটা আর কিছু বলার আগেই রিজা এসে হাজির হলো। ওকে দেখতেই লোকটা হনহন করে বেরিয়ে গেলো। তবে যাওয়ার আগে আইজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মা*রতে ভুললো না সে!
পিছু পিছু হেটে আসা রিজাকে উপেক্ষা করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো আইজা। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে দেহের সকল শক্তি নিমিষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। পা টাও কেমন নড়বড়ে হয়ে আসছে! ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো ও। ভরা পেটে বমি করার থেকে খালি পেটে বমি করা যেন বেশি কষ্টকর! অনবরত কাঁপছে আইজা। মনে হচ্ছে পুরো পাকস্থলীটাই যেন বেড়িয়ে আসবে ওর মুখ থেকে!
বর্তমান
—————-
-“আপনার কোন ধারণা আছে আপনি কী বলছেন! লজ্জা করে না আপনার…!”
-“না! লজ্জা আপনাদের হওয়া উচিত। আপনার বাবা সেদিন আমার অফিসের সামনে থেকে আমাকে এ বাড়িতে আনার জন্য উঠিয়ে আনেনি সীমান্ত। বরং কোন নোং*রা গলিতে….!”
-“আইজা!!!”
সীমান্ত আইজার গালে চ*ড় মারার উদ্দেশ্যে হাত উঠালেও মাঝপথেই থেমে গেলো সে হাত! আইজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটা। যদিও সীমান্ত ওর চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না! পরক্ষনেই আইজার থেকে সরে বিছানার শেষ প্রান্তে গিয়ে নিঃশব্দে বসে পড়লো সে। চোখ জোড়া বারান্দার দিকে নিবন্ধ!
-“থামলেন কেন? মা*রুন! সত্যি বলতে আপনার সামনে কোন কিছু প্রমান করতে ইচ্ছে করছে না আমার! আমিও তো মানুষ। আর কতো খেলার পুতুলের মতো এদিক থেকে ওদিক ছুড়ে মা*রা হবে আমাকে! একেবারে মে*রেই ফেলছেন না কেন!!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্রমশ কম্পিত হয়ে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে আইজার কন্ঠস্বর থেকে। যেন এতোক্ষণ সমস্ত ক্ষোভ দলা পাকিয়ে আটকে ছিলো গলায়!
সীমান্ত কোন জবাব দিলো না। এমনকি আইজার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। উল্টো উঠে গিয়ে সোজা ঘরের বাইরে চলে গেলো। পালিয়ে যাওয়াই যেন তার কাছে একমাত্র সমাধান!
***
রাত পেড়িয়ে ভোর হতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো আইজা। এমনিও কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এ বাড়িতে না খেয়ে ম*রে গেলেও তো দেখার কেউ নেই। নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে!
নিজের খাবার প্লেটে নিয়ে রুমে ফেরত আসতে না আসতেই বিছানার ওপর একজন ছোট্ট মানবীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার! রিজা আনমনে নিজের এক খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলে যাচ্ছে। আশেপাশের কোন খেয়াল নেই তার! অবাক হয়নি আইজা। গতকাল প্রায় অনেকক্ষনই রিজা এ রুমে ছিলো।
সচরাচর আইজা থাকতে এ ঘরে তেমন কেউ আসে না। রিজার মাকেও তো দেখেনি আইজা। সে সারাদিন ঘরে থাকে। আর রিজা টইটই করে ঘুরে বেড়ায়!
পুরোটা সময় নিঃশব্দেই কেটে গেলো। না রিজা কিছু বলেছে আর না আইজা। খাওয়া শেষ করেই ওয়াশরুমে চলে গেলো ও। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে চুলগুলো শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আইজা। মনে করেছিলো ততক্ষণে রিজা হয়তো চলে গেছে। কিন্তু তা হয়নি। মেয়েটা এখনো বিছানার ওপর বসে আছে! তবে এখন আর আগের মতো চুপচাপ নেই।
মৃদু আওয়াজ করছে সে। যার পুরোটাই বুঝতে আইজা অক্ষম! তখনই হাতের ইশারায় ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা ফিডার দেখিয়ে দিতেই সেটা নিয়ে রিজার হাতে ধরিয়ে দিলো ও। মেয়েটা হয়তো ওর মায়ের কাছে যেতে চাইছে। তাই নিজেই নেমে আসছিলো বিছানা থেকে।
নামতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে গেলো রিজার। আইজা ধরতেই চিৎকার জু্ড়ে দিলো সে। চিৎকার বলতে ভয়ানক চিৎকার। আইজার কান ফেটে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত রিজাকে কোলে নিতে গিয়েই ওর জামার বোতামের দিকে নজর গেলো আইজার।
অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে ওর কাছে! আইজা কোলে নিতেই রিজার কান্না থেমে গেলেও আইজার মনে চলা উশখুশ অনুভূতি মোটেও শান্ত হচ্ছে না। অতঃপর সেই বোতামটা একটু কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো ও। আইজার মনে সন্দেহ কেনই বা আসবে না। বাচ্চাদের এমন অনেক জুতো দেখেছে যেগুলো লাইটের মতো জ্বলে ওঠে। তবে এরকম অদ্ভুদ রকমের লাইট জামার বোতামে তেমন একটা দেখা হয়নি আইজার! একটা বাচ্চার জামায় হিডেন ক্যামেরা!!!
***
গত ছয় মাস যাবৎ সাদিক, নাজিম শিকদারের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে। সীমান্তর এর আগে লোকটার সাথে তেমন কথা হয়নি। আজ নিজ থেকেই সাদিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ও। লোকটা সীমান্তর বাবার গাড়ির সামনেই সিগা*রেট ফুঁকছিলো!
-“আপনি ফ্রি আছেন আজ?”
স্বাভাবিক কন্ঠেই প্রশ্ন করে বসলো সীমান্ত। ওকে দেখে লোকটার চোখে কিঞ্চিৎ ভয়ের রেখা ফুটে উঠলেও বেশ চতুরতার সাথে সে মুখভঙ্গি আড়াল করে ফেললো সে। যদিও সীমান্তর চক্ষুগোচর হয়নি তা!
-“কেন? কোন দরকার?”
সাদিকের প্রশ্নে মৃদু হেসে উঠলো সীমান্ত। নিজের ব্যান্ডেজ লাগানো হাত সামনে তুলে ধরে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“আসলে এই হাতে ড্রাইভ করা কষ্ট হয়ে যাবে! তাই আপনার সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো!”
একটা লম্বা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো সে! মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-“জি স্যার! বলুন কোথায় যাবেন?”
সাদিকের মুখে হাসি দেখে সীমান্তও হেঁসে উঠলো মুহূর্তেই। তবে সেটা যেই সেই হাসি না। রহস্যময় শীতল হাসি!
চলবে…