#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৫৪
#লিখা_তানজিলা
অনেকদিন পর হাতুড়িটা কাজে লাগাচ্ছে সীমান্ত! সাদিকের মুখ স্কচটেপ দ্বারা বন্ধ! মৃদু হেঁসে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় থাকা ব্যাক্তিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত। অত্যন্ত ধীরতার সাথে পা ফেলছে ও! যেন সময়ের কোন কমতি নেই!
সীমান্ত যত এগোচ্ছে সাদিকের চাহনিতে ততই ভয়ের রেশ বেড়ে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে চোখগুলো এক্ষুনি বেড়িয়ে আসবে কোটর থেকে! সাদিকের এক হাতের বাঁধন খুলে সে হাত টেবিলের ওপর রাখলো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“ভয় পাচ্ছেন কেন! আমি কিন্তু আপনাকে প্রাণে মা*রবো না! তবে আপনি এক্ষুনি মুখ খুললে আমাদের দু’জনেরই কষ্টটা কম হবে!”
লোকটা অনবরত দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্যে সীমান্তর ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে এলেও পরক্ষণেই কৃত্রিম হতাশা জনক কন্ঠে বলে উঠলো,
-“দুঃখিত! আমিতো খেয়ালই করিনি!”
সাদিকের মুখে থাকা স্কচটেপ একটানে খুলে ফেললো ও। বাঁকা হেঁসে বললো,
-“এখন বলুন, যা শুনলে আমার আপনাকে এ জায়গায় আর আটকে রাখতে ইচ্ছে করবে না!”
-“আপনি কী জানতে চান! আমি তো কিছুই বুঝতে…. আ….!”
সীমান্তর হাতে থাকা হাতুড়িটা সাদিকের আঙুল বরাবর পড়তেই বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলো সে। তার চিৎকার থামতে না থামতেই একই স্থানে দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত করে বসলো সীমান্ত!
-“এখনই এ অবস্থা! এটা তো মাত্র শুরু! ধীরে ধীরে ডোজ আরো বাড়বে! আর সত্যি বলতে আপনার এই তাকানোর ভঙ্গিটা না আমার ভিষণ বিরক্ত লাগছে! কাল যেন কিভাবে তাকিয়েছিলেন আপনি আমার স্ত্রীর দিকে!”
মুখে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গি বজায় রাখলেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে সীমান্ত। গতকাল রাতে আইজা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় নিজের ঘরে গিয়েছিলো ও। মেয়েটা পুরোদিন চশমা চোখে না পড়ে সোয়েটারের পকেটে ভাজ করে রেখেছিলো। এই গুরুত্বহীনতার জন্য তো আইজার সাথে পরে কথা বলবে সীমান্ত! যদিও চশমা যেভাবেই সেট ছিলো না কেন এর দ্বারা সাদিকের গতকালের ব্যবহার সম্পর্কে যতটুকু দেখার দেখে নিয়েছে ও!
সাদিকের মুখভঙ্গিতে লেপ্টে থাকা ভয়ের রেখা যেন সীমান্তর কথাগুলো শুনে আরো বেড়ে গেলো। কম্পিত গলায় বলে উঠলো,
-“বিশ্বাস করুন! জাফর স্যার আমাকে যা বলতে বলছে আমি তাই বলছি!!!”
***
বোতামটা রিজার জামার অংশ পর্যন্ত না! বস্তুটা খুলে নিতেই সেটা বুঝতে পারলো আইজা। ইচ্ছে তো করছে এখনই গিয়ে রিজার মাকে কথা শুনিয়ে আসতে! কোনমতে নিজেকে সামলে নিলো ও। আগে এই ক্যামেরাটা চেক করবে! আইজার ওপর নজর রাখার জন্য একটা বাচ্চাকে পর্যন্ত ছাড়া হলো না!!
মিনি ক্যামেরা থেকে ছোট মেমোরিকার্ডটা খুলে নিলো ও! সীমান্তর ল্যাপটপটা ঘরেই পড়ে ছিলো। দরজা ভেতর থেকে আটকে নিলো আইজা। রিজা এই মুহুর্তে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে! আবারও নিজের খেলনা গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত সে! আর আইজা এ ক্যামেরার ফুটেজ দেখার চেষ্টায় ব্যস্ত!
যা ভেবেছিলো, জাফর শিকদার রিজার জামায় এই এক্সট্রা বোতামরূপী মিনি ক্যামেরা সেট করে আইজার রুমে পাঠিয়েছে। কালও হয়তো একই কাজ করেছিলো সে! রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিলো ওর। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেঁসে উঠলো আইজা। জাফর শিকদার নিশ্চয়ই আইজাকে নিয়ে ভয়ে আছে!
-“আ…দা!”
-“আমার নাম আইজা!!”
-“আদা…আদা….আদা…..!”
রিজার কন্ঠস্বরে রাগী ভাব। যেন আইজার তাকে সঠিক করে দেয়াটা একদমই পছন্দ হয়নি রিজার! চোখ বড় করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সে! রিজার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আইজা! ইদানিং কোন বাচ্চাকে দেখলে কেন যেন অস্বস্তি হয় ওর!
ল্যাপটপটা রেখে রিজাকে কোলে নিলো আইজা। উদ্দেশ্য ওর মায়ের সাথে কথা বলবে। তবে ঘর থেকে বেড়োতেই কিছুটা দূরে জাফর শিকদারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে যায় ও। লোকটা রিজার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে!
-“আপনি যা খুঁজছেন তা ওর কাছে পাবেন না!”
জাফর শিকদার ক্রোধ দৃষ্টিতে আইজার দিকে তাকালেও মুখে কিছু বললো না। তখনই তার পিছু পিছু রিজার মা এসে হাজির হলো। আইজা জাফরকে ছেড়ে ফারহানাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-“এই লোকটার কথা বাদই দিলাম! আপনি আপনার বাচ্চাকে ব্যবহার করতে কেন দিচ্ছেন! এটা একটা ক্রা*ইম জানেন না!”
ফারহানা, আইজার তীক্ষ্ণ কথাগুলো শুনে প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালেও পরক্ষণেই জাফর শিকদারের দিকে একবার কড়া নজরে তাকিয়ে রিজাকে আইজার থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। ছোট্ট করে সরি বলে হনহন করে চলে গেলো সে!
-“মায়ের মতোই মুখ চলে তোর! একারণেই তোর মাকে একদম সহ্য হতো না আমার!”
-“এজন্যই আমার মাকে খু*ন করেছিলি তুই!!”
কর্কশ গলায় বলে উঠলো আইজা। যে করেই হোক জাফরের মুখ থেকেই সবটা শুনতে চায় ও!
জাফর শিকদার কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। চারিদিকে একবার সতর্ক ভঙ্গিতে চোখ বুলিয়ে নিলো সে! অতঃপর নিঃশব্দে চলে গেলো আইজার সামনে থেকে! তীক্ষ্ণ নজরে সেদিকে তাকিয়ে রইলো আইজা। কাজটা যতটা সহজ মনে হয়েছিলো ততটাও সহজ নয়!
***
মেইন গেইটের বাইরে রিয়াদকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো আইজা। লোকটা একটা পুরোনো শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আইজা সামনে যেতেই ওর দিকে ব্যাগটা তুলে ধরলো সে!
-“এই শাড়ি আপনি কোথায় পেলেন?”
শপিং ব্যাগে রাখা লাল শাড়িটা নেড়েচেড়ে দেখছে আইজা। এটা তো ওরই শাড়ি! সীমান্ত ঐদিন বারান্দা থেকে ছুড়ে মে*রেছিলো!”
-“শাড়িটা ঐদিন আমার মাথায় ল্যান্ড করেছিলো! আপনাকে ফেরত দেবো দেবো ভেবে পরে ভুলে গেছিলাম! আপনি যেটা চেয়েছিলেন সেটাও আছে ব্যাগে! কিন্তু সীমান্ত যদি…!”
রিয়াদের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই শপিং ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে এলো আইজা। রিয়াদ এতোক্ষণে বেশি বলে ফেললে তো সমস্যা! ওর ওপর নজর তো কম নেই!!!
***
অবশেষে দিন পেড়িয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা। আইজা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সীমান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। হাতের ঘা টাও তেমন সুবিধার লাগছে না। রুমের একপাশে থাকা ছোট টেবিলে খাবারের ঢাকা প্লেট রাখা। হয়তো সীমান্ত রেখেছে!
-“খাবার টেবিলে ফেলে রেখেছেন কেন?”
আইজার প্রশ্নের উত্তরে নিজের কাটা হাতটা তুলে ধরলো সে! আগের তুলনায় বেশিই কেটে গেছে মনে হচ্ছে!
-“আপনার হাতে খেতে ইচ্ছে করছে!”
সীমান্তর নিঃসংকোচ আবেদন! চোখজোড়া ভয়ঙ্কর ঘোলাটে হয়ে আছে তার!
প্রচন্ড ক্লান্তি ভর করেছে আইজার শরীরে। তবুও সীমান্তর বিধ্বস্ত চাহনি দেখে তার আবদার নাকচ করতে মন সায় দেয়নি। আইজা তো আইজাই! মন যা চায় তাই করে বসে সবসময়। এজন্য জীবনে ধরাও তো কম খায়নি!
কিঞ্চিত অস্বস্তি নিয়ে সীমান্তর মুখের সামনে খাবারের লোকমা তুলে ধরলো ও। সীমান্ত নিতান্ত ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ আইজার হাতেই ভাত খেয়ে যাচ্ছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার মতো ভদ্রলোক যেন এ বাড়িতে আর দু’টো নেই! ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। খানিকটা সন্দেহই হোক অথবা বিরক্তি মুখ ফুটে কিছু বললো না ও। বলে কী লাভ! ঐ আগের মতো পালিয়ে বেড়াবে! আজ পুরো দিন আইজার সামনে আসেনি সে!
হঠাৎ আঙুলে ব্যথা অনুভব হওয়ায় অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো ও। ক্রোধান্বিত আঁখি জোড়া সামনে বসে থাকা ব্যক্তির ওপর গিয়ে পড়লো। লোকটা নিজের ধারালো দাঁতের ছাপ আইজার আঙুলে বসিয়ে বেহায়ার মতো শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে যেন তার দ্বারা এই মুহুর্তে কিছুই হয়নি!!!
নিজের বাম হাতে কাঁধ ঝেড়ে যাচ্ছে সে। সীমান্তর হাবভাবে প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও পরক্ষণেই বুঝতে পেরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালো আইজা। তার কাঁধের এই জায়গাটাতেই একদিন আইজা নিজের দাঁতের ছাপ বসিয়ে ছিলো!
-“সরি!”
আইজা রাগের মাথায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই মৃদুস্বরে বলে উঠলো সীমান্ত। অদ্ভুত ভাবে জ্বলজ্বল করছে তার শুষ্ক চোখ জোড়া।
-“আমি ভেবেছিলাম আপনার সত্যি সাহায্য প্রয়োজন! এক সেকেন্ডের জন্য তো আপনার স্বভাবটাই ভুলে গেছিলাম!”
তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো আইজা। সীমান্তর এসব খাপছাড়া ব্যবহারকে মাথায় নেয়ার সময় নেই ওর কাছে!
-“আমি এর জন্য সরি বলিনি!”
আইজার আঙুলের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো সে!
-“আপনি যেই কারণেই সরি বলেন না কেন; এপোলজি নট এক্সেপ্টেড!”
আইজার মুখভঙ্গি শক্ত হয়ে আছে।
-“আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
-“আমি না বললে কী আপনি থেমে থাকবেন!”
মৃদু হেসে উঠলো সীমান্ত। যেন আইজার এমন বাঁকা ভঙ্গির জবাব দেয়ার অভ্যেসে অভ্যস্থ সে! তবে লোকটার মুখের এ হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মুহূর্তেই তার চাহনি সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন হয়ে পড়লো,
-“আপনি যখন আপনার পাপার ক্রা*ইম সম্পর্কে জানলেন ; কেমন লাগছিলো আপনার?”
সীমান্তর কন্ঠে নিঃসংকোচতার রেশ! যেন মাত্রই সে কোন কাটা ঘা’য়ে লবণ দেয়ার মতো প্রশ্ন করে বসেনি! যে জন্মদাতাকে জন্মের পর থেকে সম্মান আর ভরসার মাঝেই রেখে এসেছে তার প্রতি মনে তিক্ততা আসার অনুভূতি কতটা জঘন্য তা হয়তো কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যদিও ঘৃণা করতে পারেনি মানুষটাকে আইজা! যতই হোক বাবা তো!
কোন জবাব দিলো না আইজা। শুকনো মুখেই উঠে দাঁড়ালো! সীমান্তর এ প্রশ্নের জবাব তাকে কখনোই দেবে না ও! প্রত্যেকটা মানুষের অনুভূতির পাল্লা ভিন্ন! সীমান্ত নিজে থেকেই হয়তো একদিন তার করা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে! অথবা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে! সীমান্তর কথা বলার ভঙ্গি দেখে যা মনে হচ্ছে ; এমনটা হলেও বিস্মিত হবে না আইজা!
-“আপনি আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন?”
কিছুটা সন্দেহজনক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো আইজা।
-“এখানে আপনার জিনিসপত্র তো তেমন নেই; যা’ই আছে প্যাক করে রাখবেন!”
বরাবরের মতো আইজাকে ধোঁয়াশায় রেখে সীমান্ত হনহন করে বেরিয়ে গেলো! আজও হয়তো ঘরে আসবে না সে!
সকালেও সীমান্তকে দেখেনি আইজা। লোকটা শুধু ওকে টেক্সট করে জানিয়েছে দুপুরের মধ্যে প্যাকিং সেরে ফেলতে! আজও সে আইজার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে! বেশি সময় নেই ওর কাছে। তখনই হঠাৎ ফোনে কল আসায় না দেখেই ফোন রিসিভ করে নিলো আইজা!
-“তোর মামা কোথায় জানিস!”
কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলো ওর মামী ইনসিয়ার কল!
-“না!”
সাথে সাথেই ফোন কেটে দিলেন তিনি! আইজাও আর এ নিয়ে মাথা ঘামালো না। ওর চিন্তা অন্যদিকে। এমনি এমনি এ বাড়ি থেকে চলে
যেতে একদমই প্রস্তুত না আইজা!
***
ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো ফিহা। জাফরের তীক্ষ্ণ নজর যে কখন থেকে তার ওপর খেয়াল করেনি সে। ফিহার কথা বলার ভঙ্গি সহ্য হয়নি জাফরের। ছো মেরে ফিহার কানের কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো ও। শক্ত হাতে এক চ*ড় বসিয়ে দিলো ফিহার গালে।
-“তোকে কতবার সাহিলের সাথে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছি!”
গালে হাত রেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ফিহা। তবে জাফরের কথার বিপরীতে কিছু বললো না ও। ফিহার ভাষ্যমতে জাফরের সাথে কথা বলার ওপর নাম দেয়ালের সামনে অযথা গলার স্বর নষ্ট করা!
-“এখন চুপ কেন! তোকে বলেছিলাম আইজার সাথে বন্ধুত্ব করে ওর ওপর নজর রাখতে! আর তুই..!”
-“আইজার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না আমার! সহ্য হয়না ওকে!”
-“তোর ভালো লাগা জানতে চাইনি ! দাড়া! আগে ঐ সাহিলের ব্যবস্থা করছি; তারপর তোর ব্যবস্থা করবো!”
কথাটা বলেই হনহন করে চলে গেলো জাফর শিকদার। ফিহা কিছু বলতে চাইলেও কান দিলো না সে! উল্টো যাওয়ার আগে ফিহার ফোনটা ফ্লোরে আছাড় মে*রে গেলো লোকটা! রুক্ষ মেজাজে সে ভাঙা ফোন হাতে তুলে নিলো ফিহা।
-“জাফরের কথার সাথে সচরাচর একমত হই না আমি! কিন্তু আজ একটা কথা বলতেই হচ্ছে; সাহিল তোকে ভালোবাসে না বরং ব্যবহার করছে!”
হঠাৎ কারো কঠোর গলায় টনক নড়লো ফিহার। ফারহানা রিজাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
-“জানি!”
ফিহার ছোট্ট জবাবে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফারহানা।
-“তাহলে ঐ ছেলের সাথে এতো কিসের কথা তোর!”
-“সাহিল বলছিলো শেষবারের মতো দেখা করতে চায়!”
-“আর তুই কী বলেছিস?”
-“এইবারই শেষ! এরপর আর তার সাথে দেখা করবো না!”
-“এবার কিন্তু আমি তোর গালে চ*ড় লাগাবো!”
ফারহানার হু*মকি এক প্রকার উপেক্ষাই করলো ফিহা। আমতাআমতা কন্ঠে বললো,
-“তোর ফোনটা একটু দিবি আপু?”
-“কেন?”
-“পাপা হয়তো সাহিলকে কিছু করবে! ওকে আগে থেকেই সতর্ক…!”
-“না!!!”
মাথায় রক্ত চড়ে গেছে ফারহানার। এই মেয়েকে বোঝানোর ক্ষমতা হয়তো নেই ওর!
***
অনেকক্ষণ যাবৎ থমথমে ভাব বিরাজ করছে শিকদার বাড়িতে! নাজিমের ড্রাইভারকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারওপর নাজিম আর জাফরের মধ্যেও কিঞ্চিত মনোমালিন্যের আভাস। যদিও কারণ আইজার অজানা। দু’জনই না-কি কোথাও বেড়োবে!
তাদের এই যাত্রা আইজার চোখে এক সুযোগ মনে হচ্ছে। নিজের হাতে সুন্দর একটা আংটি পড়ে নিলো ও! সীমান্ত হয়তো এসেই এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে ওকে! তার আগেই যা করার করবে আইজা!
নাজিম আর জাফর গাড়িতে চড়ার আগেই গাড়ির ডিকিতে নিজেকে সেট করে নিয়েছে ও! তবে একদমই প্রস্তুতি ছাড়া যাওয়া আরো বড় বোকামি! তাই গাড়ির ডিকিতে প্রবেশের আগে সীমান্তকে সহ আরো দু’জনকে মেসেজ করে দিয়েছে আইজা! কাজটা যে কতটা বোকামি হয়ে যাচ্ছে জানে ও! তবুও নিজেকে এই রিস্ক নেয়া থেকে আটকাতে পারলো না আইজা!
আশেপাশ হতে ট্রেনের হুইশেলের শব্দ ভেসে আসছে। জায়গাটা হয়তো কোন রেললাইনের পাশে হবে। ডিকি কিঞ্চিত খুলে বাইরের পরিবেশ দেখার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা আর করা হলো না আইজার। তৎক্ষনাৎ থেমে গেলো গাড়িটা। বেশ কিছু মানুষের পায়ের আওয়াজ শুনতে পারছে ও। এখন ডিকি খুললেই বিপদ।
প্রায় আধা ঘন্টা ওভাবেই পড়ে রইলো ও। এতোক্ষণ নাজিমের ধমকানির শব্দ ভেসে আসছিলো। বাইরে থেকে কেউ এখানে আসার চেষ্টা করেছিলো সে কারণে। প্রথমে তো ভয়ই পেয়েছিলো আইজা। ওকেই না টের পেয়ে গেছে এই ভেবে! তবে তা হয়নি। নাজিম শিকদারের চিল্লাচিল্লিতে যা বুঝতে পারলো সতর্কতার কারণে গাড়ি আজ কোন এক গোডাউনের ভেতর পার্ক করা হয়েছে!
নাজিম শিকদারের আদেশে লোকগুলো যখন হুরমুরিয়ে বাইরে চলে গেলো সেটাও টের পেলো আইজা। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে আশেপাশে নাজিম আর জাফর ছাড়া কেউ নেই। বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেলো নিস্তব্ধতায়!
চেয়ারে বসে ম*দপানে ব্যস্ত জাফর শিকদার। ফলস্বরূপ তার ওপর পড়া নাজিম শিকদারের তীক্ষ্ণ নজর চোখে পড়ছে না জাফরের!
-“রায়হানের সাথে কাজটা কে করেছে জানি আমি!”
জাফরের দৃষ্টি নে*শায় আসক্ত। ভঙ্গুর কন্ঠে তার গলা থেকে একটি শব্দই বের হলো,
-“কে!!”
-“আপনি!”
মুহূর্তেই উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো জাফর। ইতোমধ্যেই ড্রা*ঙ্ক সে। নাজিমও ম*দ খেতে বাধা দেয়নি তাকে। শত্রু যত দূর্বল জেতার সুযোগ তত বেশি!
-“তুই ভেবেছিলি আমাকে যেখাবে ইচ্ছে নাচাবি! এতো সোজা না-কি! তোর এক ছেলেকে জেলে ঢুকিয়েছি! এরপর তোর পালা!”
কথা শেষ করতে গিয়েও বারবার আটকে যাচ্ছে জাফর! নাজিম শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে!
-“আপনি জানেন, আরমানের সাথে আমি যা করেছি কেন করেছি!”
জাফর কোন জবাব দিলো না। বলতে গেলে পারছে না! কারণ সে যেই ম*দ গিলে যাচ্ছে তা যেই সেই পানীয় না! নাজিমই জাফরকে খেতে দিয়েছে সেই রহস্যজনক পানীয়! কয়েক সেকেন্ড পর নাজিম নিজেই বলে উঠলো,
-“কারণ সে ফাহাদের সাথে হাত মিলিয়ে আমার সাথে প্রতারণা করেছে! তুই জানিস, আমি প্রতারণা শব্দটাকে কতটা ঘৃণা করি!”
নাজিমের মুখে থাকা শান্ত ভাবটা তৎক্ষনাৎ মিলিয়ে গেলো। রক্তচক্ষু নিয়ে সামনে ঢুলে পড়া ব্যাক্তিতে দেখে যাচ্ছে সে। নাজিম, জাফরের পাশে রাখা চেয়ায়টায় বসে পড়লো। ওর চোখ মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। যেন কোন হুশ নেই!
-“তুই আরমানকে ফাঁসানোর জন্য এতোকিছু করলি কারণ সে তোর বৌ বাচ্চাকে কিড*ন্যাপ করিয়েছে। আরে বেচারা অন্তত অপরাধবোধে হলেও সীমান্ত আর নেহাকে ওখান থেকে বের করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তুই কী করলি! হাসপাতালে গিয়ে নিজের জ্যান্ত বৌকে নিজেই মে*রে ফেললি! খু*ন তো তুইও কম করিসনি নাজিম!”
নে*শার ঘোরে একনাগাড়ে বলে গেলো জাফর!
জাফরের বলা শেষ কথাগুলোর জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না আইজা। সাথে সাথে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলো ও। তবে বিপত্তি ঘটলো অন্য দিকে। একটু নড়েচড়ে ওঠার কারণে ওর হাতের কনুই গাড়ির একাংশে ধাক্কা খেয়ে বসলো! শী*ট! স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইজার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো শব্দটা।
নাজিমের কন্ঠও আর শুনতে পারছে না ও! আর না কোন আওয়াজ কানে ঢুকছে। ব্যপারটা সুবিধার না। চশমাটা চোখেই পড়ে ছিলো ও! সীমান্তকে তো মেসেজ করে বলেছিলো ট্র্যাক করতে! লোকটা সীন করেনি না-কি! ফোনটা বের করে সীমান্তর নাম্বারে ডায়াল করলো আইজা!
কিন্তু এতোক্ষণ থাকা শুনশান নিরবতার ভাঙন ঘটলো গাড়ির ডিকি খোলার শব্দে! নাজিম শিকদার ওর দিকে সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন চাহনি ছুড়ে মারছে! অতঃপর নিজ অসাবধানতায় ধরা খেয়ে স্তব্ধতার সাথে তাকিয়ে আছে আইজা।
চলবে…