#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৬
“মেঘের পালক, চাঁদের নোলক
কাগজের খেয়া ভাসছে…
বুক ধুকপুক চাঁদপনা মুখ চিলেকোঠা থেকে হাসছে…
মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায় তা-থৈ তা-থৈ বরষা…
কাকভেজা মন জল থৈ থৈ রাত্তির হলো ফরসা…
আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে…
মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে..কে যে নাচে….”
গান ভেসে আসছে বড় ভাবীর ঘর থেকে। কেমন ফুরফুরে লাগছে মনটা! ভাবীটা ভারি শৌখিন। গান শোনে আবার গাইতেও পারে, হাতের কাজ খুব ভালো পারে, দারুণ সুন্দর করে ছবি আঁকে। প্রায়দিন সকালের কাজ সেরে বিশ্রাম নেয়ার আধঘন্টা মৃদু শব্দে গান শোনে। আমাদের ঘর পাশাপাশি বলে আমি শুনতে পাই। আজ খুব ইচ্ছে হলো ভাবীর সাথে গল্প করতে।
ভাবী খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হেসে বলল, “ননদিনী, কী দরকার গো? ইদানিং তো কারো কথা মনেই পড়ে না তোমার!”
“ভাবী গল্প করতে আসলাম।”
“করো করো, তোমার তো দিন। রসিয়ে রসিয়ে বরের গল্প বলবা!”
“ধুর! করার মতো গল্প আছে আমার কোনো?”
ভাবী আমার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসালো। “বরের সাথে কথা হয় না?”
“তা হয়। জানো, ওর মায়ের ভালো হওয়ার নাম নেই। ও অনেক মন খারাপ করে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় ওর বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
ভাবী আমার থুতনিতে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। বর দেখলে কী বলবে, যত্ন নেই না আমরা একটুও। তুমি আগেই এত ভাবলে চলবে? দেখো না কী হয়।”
“কেমন করে বিয়েটা হলো, আমার ভয়ই করে।”
ভাবী হেসে বলল, “প্রেম তো কোনোদিন করোনি। এইযে বিয়ের প্রথম প্রথম মিষ্টি প্রেম, দূরে দূরে থাকার সুখের বেদনা এসব উপভোগ করো। টেনশন সারাজীবন থাকবে, কিন্তু একবার সংসারে ঢুকে গেলে এই সময়টা ফিরে পাবে না।”
“আচ্ছা ভাবী ওর মা মেনে না নিলে?”
“আবার! যা হবে পরে দেখা যাবে। সবাই আছি তো আমরা। আর তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ না মেনে পারে?”
“ঠিক বলছ?”
“হ্যাঁ রে বাবা। এখন শক্তি সঞ্চয় করো পরবর্তীতে যা হবে সেটা সামাল দেয়ার জন্য। অকারন আশঙ্কা খুব খারাপ জিনিস, বিশেষ করে এমন ব্যাপারে যেটা হয়ে গেছে, শুধু ফলাফল দেখার বাকি। তোমার সাথে তো তোমার বর আছেই, তবে চিন্তা কী এত!”
“আচ্ছা।”
“তেঁতুল খাবে? কাল তোমার ভাই কাঁচা তেঁতুল এনেছে। চলো ভর্তা করি।”
ভাবী কাঁচা তেঁতুলের ভর্তা বানিয়ে এনে বারান্দায় বসে খেতে খেতে গল্প শুরু করলো! তার বেশিরভাগ গল্প বড় ভাইয়াকে নিয়ে। আজ কিছুদিন ভাবীকে একটু বেশি খুশি লাগছে। আজ যেভাবে টক খাচ্ছে! আমার মনে পড়ল গতকাল খাবার সময় ডালের চামচ পড়ে গিয়েছিল। ভাইয়া ভাবীকে নিচু হয়ে তুলতে দিল না কিছুতেই। তবে কী…
এ পর্যন্ত এমন অনেক দেখেছি, তবুও হঠাৎই ব্যাপারটা ভেবে আমার চোখে পানি চলে আসলো। বুকের কোথাও সুক্ষ্ম ব্যথা উঠলো। আচ্ছা এমন একটা দিন আমারও আসবে? একটা ছোট্ট নতুন মানুষ নিজের মধ্যে…! ভাবীর মতো সুখের সংসার আমার কপালেও আছে? আশা মানুষ অনেক কিছুই করে, তবে ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? বিধাতা কত রকমের রঙতুলি নিয়ে বসে আছেন। একেকজনের জীবন একেকভাবে রাঙিয়ে দেবেন বলে। শুধু একটাই প্রার্থনা, সেই রঙটা যেন ফ্যাকাসে না হয়!
.
বিয়ের দুই সপ্তাহ পর তার সাথে দেখা হলো। কলেজে গিয়েছিলাম, বের হয়ে দেখি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে একেবারে। গলার হাড় বের হয়ে গেছে। আমি কাছে যেতে হেসে বলল, “আহারে, লোকে বিয়ের পর প্রতিদিন বউ এর মুখ দেখে ঘুম থেকে ওঠে। আমার কি কপাল! কতদিন পর দেখলাম!”
“বাদ দাও ওসব। তোমার এই চেহারা হয়েছে কেন?”
“ভালো নেই গো! মা অসুস্থ বলে বাবাও কাজে ঢিল দিয়েছে, অফিসে চাপ এত, তার ওপর মা’কেও সময় দিতে হয়। আমি না থাকলে খেতেও চায় না ঠিকমতো। তোমার সাথে দেখা করার সময়টা বের করতে পারি না বোঝো তবে!”
“আমি বুঝি। তুমি দায়িত্ব পালন করো ঠিক করে।”
সে আমার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো। হাঁটতে থাকলাম ফুটপাথ ধরে। সে বলল, “তুমি এত ভালো কেন?”
“আমি ভালো নই। তোমার মনটা ভালো।”
সে অকারনে হো হো করে হাসলো। আমার জন্য কোথা থেকে একটা শুকনো বকুল ফুলের মালা এনেছিলো। সেটা পরিয়ে দিল গলায়। খুব বেশি সময় দিতে পারলো না। আমায় অনেক অনেক বার বুঝিয়ে, ক্ষমা চেয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিল সে। ইচ্ছে করছিলো ওখানেই বসে কাঁদি। কিন্তু পারিনি। বোধহয় শক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
বাবা মা আমাকে কিছুই বলেন না। ওর সাথে তাদের কথা হয়। কী বলে সেই জানে। আমি এমনভাবে থাকি যেন বিয়ে থা হয়নি। আগের মতোই আছে সব।
.
আগামীকাল আমাদের বিয়ের একমাস পূর্ণ হবে। রাতে সে ফোন করে বলল, “আমাদের বিয়ের কথাটা সবাই জেনে গেছে।”
আমি ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে বললাম, “তারপর কী হলো?”
“শুরু থেকেই কানাঘুষা চলছিলো। সবাই ভেতরে ভেতরে জানতো, তবে আজ একেবারে সামনাসামনি কথা হয়েছে। আমিও স্বীকার করেছি।”
“তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?”
“নাহ।”
“তোমার মা?”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মায়ের ব্যাপারটা জানি না। আমাকে কিছুই বলল না। সুন্দরভাবে রাতে খেয়ে নিল আমার সাথে। অন্য কথাও বলল, তবে বিয়ের কথা তুলল না। যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। তবে এত সহজভাবে মেনে নেবেন না জানি। কী যে করবেন বুঝতে পারছি না।”
আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে বলব আগামীকাল দেখা করার কথা। কিন্তু বলতে পারলাম না শেষ পর্যন্ত। সে ফোন রাখার আগে বলল, “ভয় পেও না। আমি সামলে নেব সব।”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। আজ আবার বৃষ্টি। ভারি বর্ষন হচ্ছে। ভাবীর কথামতো আমি চেষ্টা করছি চিন্তা না করতে। ভাবী সত্যি প্রেগনেন্ট। অসুস্থও খানিকটা। শুয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। তার ঘর থেকে গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে–
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন..
কবে যাব কাছে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ…”
গান শুনতে শুনতে আনমনা আমার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে তার কাছে চলে যাই..বিয়ের একমাস পূর্তিতে ভাবছিলাম কিছু করি। কী করব? বৃষ্টিতে ভিজে সব উত্তেজনা ছড়িয়ে দেব প্রকৃতিতে?
তাকে ফোন করব কি না ভাবতে ভাবতে সেই ফোন করে বলল, “শোনো বৃষ্টিতে ভিজো না আজকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তোমাকে কে বলল ভিজব?”
সে গলায় কৃত্রিম বিষ্ময় ফুটিয়ে বলল, “এইমাত্র কানে কানে বলে গেলে ভুলে গেছ?”
আমি হেসে ফেললাম। মাঝে মাঝেই সে বলে আমি নাকি তার সাথে বাতাসে ভেসে গিয়ে কথা বলে আসি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি যেসব কথা মনে মনে ভাবি সেসব কথাই সে পরে আমাকে শোনায়। আমি অবাক হলেও কখনো তাকে এই কথাটা বলে দেই না। তার সাথে আমার এত বেশি গভীর পরিচয়ও নেই মনের কথা বোঝার মতো। দুজনের ছোট ছোট স্বভাবগুলো পর্যন্ত দুজন ঠিকভাবে জানি না। অথচ সে আমাকে অন্তর থেকে বুঝতে পারে ভাবলেই অজানা শিহরন হয়। গর্ব হয় ভীষণ। সাথে ভয়ও!
দুপুরের পর ঘুমিয়েছিলাম। মায়ের অস্থির ডাকাডাকি শুনে উঠে গেলাম। “কী হয়েছে?”
“বেয়াইন সাহেবা এসেছেন।”
“মানে? কে এসেছে?”
“তোর শ্বাশুড়ি!”
আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। মা আলমারি থেকে শাড়ি বের করে বললেন, “তাড়াতাড়ি পরে নে। একটু সুন্দর হয়ে তার সামনে আয়।”
আমি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে। মা হা হা করে উঠলেন, “আরে অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার আপনি এলেন কেন? ও ই তো যাচ্ছিলো।”
শ্বাশুড়ি মা বললেন, “আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু কিছু কথা বলে চলে যাব। আপনি একটু বাইরে যাবেন? আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই।”
মা চলে গেলে শ্বাশুড়ি মা আমার পাশে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন, “জানো, আজ সকালেও উঠে মনে হয়েছিল বাঁচবো না। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। শরীর এত দুর্বল যে মনে হয় ঘুরে পড়ে যাব যে কোনো মুহূর্তে। তার ওপর বুকে ব্যথা শুরু হয় যখন তখন। বেডরেস্টে থাকার কথা আমার। তবুও ছুটে এসেছে। কেন বলতে পারো?”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। উনি বলে গেলেন, “তুমি কী করে আমার ছেলেকে এত পাগল করেছ তা তুমিই জানো। এমন অবস্থা যে সে আমাকে না জানিয়ে বিয়ের মতে একটা কাজ করে ফেলল। প্রথম থেকে কখনোই তোমাকে আমার পছন্দ নয়। কিছু মনে করো না, একটা সত্যি কথা বলি, আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার নেই। তবুও সে তোমাকে এত ভালোবাসে কেন জানো? সে অনেক ভালো মনের মানুষ।
তোমার ইনিয়ে বিনিয়ে বলা দুঃখের কথাগুলো তার মন দুর্বল করে দিয়েছে। ছেলের এত রিকোয়েস্টে আমি তোমার সাথে তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার এত অসুস্থতার মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের দিন যে আমার ছেলেকে ফুসলিয়ে বিয়ে করাতে পারে সেরকম ছলনাময়ী মেয়ে আমি আমার ছেলের পাশে সারাজীবন কিছুতেই দেখতে পারব না।”
আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। চোখের পানিগুলো কখন বাঁধ ভেঙে বইতে শুরু করেছে! আচ্ছা, মানুষ সহজভাবে কেন ভাবে না?
উনি আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কান্না জমিয়ে রাখো। আসল কথা এখনো বলিনি।”
(চলবে)