#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩২
#লিখা_তানজিলা
সীমান্তর পিছু পিছু দ্রুত বেগে চলার চেষ্টা করলো আইজা। পরক্ষনেই পিচ্ছিল কাদা পানি চোখে পড়তেই মত পাল্টে নিলো ও।মাথায় ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে সীমান্তর বলা কথা।
-“সম্পূর্ণ নিরপরাধ হয়তো আপনার পাপা-ও না!”
সীমান্তর বলার ভঙ্গি বারবার আঘাত করছে ওর মস্তিষ্কে। যা কিছু হচ্ছে এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে। বালুচর প্রজেক্ট তো শুধু একটা বাহানা মাত্র! এতো ভাবনার মাঝে কখন যে একটা পিচ্চি এসে আইজার আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে দৌড় লাগালো টেরই পেলো না ও। পিচ্চিটা করিডোর থেকে সোজা বেজমেন্টের দিকে যাচ্ছে।
-“এই পিচ্চি, দাঁড়াও!”
বাচ্চা ছেলেটা আইজার ডাক উপেক্ষা করেই ছুটে যাচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে পিচ্চিটাকে হয়তো জামিল পাঠিয়েছে। বেজমেন্টের দিকেই তো এম্বুলেন্স রেখেছিলো ওরা। ধীর পায়ে একটু সামনে যেতেই আইজা অদ্ভুত কিছু টের পেলো। বেজমেন্টের অগ্রভাগে পিনপতন নীরবতা। পিচ্চিটাকেও কোথাও দেখছে না!
হঠাৎ গলায় তীক্ষ্ণ কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই আঁতকে ওঠে আইজা। এই হয়তো গলার রগ ভেদ করে যাবে সেই ধারলো অস্ত্র! একটু সামনেই ফ্লোরে দু’জন ব্যাক্তি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ক্লিনিক স্টাফ ছিলো।
-“মুখ দিয়ে যাতে একটা আওয়াজও না বের হয়! নইলে আগে তোর বাচ্চা মরবো তারপর তুই!”
এম্বুলেন্সের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশ পরিহিত ব্যাক্তি আইজার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠলো। আর তার হুমকির গুরুত্ব প্রকাশ করতেই হয়তো আইজার গলায় চাকু ধরে থাকা লোকটা সেই চাকু ওর গলায় আরো জোরালো ভাবে চেপে ধরলো! চুপচাপ এম্বুলেন্সে চড়তে ইশারা করলো তারা!
***
-“ডিপ ডার্ক সিক্রেট” নামক ক্লাবে আজ তৃতীয়বারের মতো পা রাখলো আইজা। লোকগুলো যে সীমান্ত অথবা জামিলের পরিচিত ছিলো না সেটা আগেই টের পেয়েছিলো আইজা। অন্ধকার একটা ঘরে চেয়ারে হাত বাঁধা অবস্থায় বসে আছে ও। মুখ স্কচটেপ দ্বারা বন্ধ। ক্রমাগত শব্দ করার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। সামনে বসে আছে মাঝবয়েসী এক ব্যাক্তি। আইজাকে পাত্তা না দিয়ে আনমনে একটা ছুরিতে ধার দিয়ে যাচ্ছে সে। যেন এই মুহুর্তে এর চেয়ে বেশি জরুরি আর কিছুই না।
লোকটাকে এর আগেও দেখেছে আইজা। প্রথমে মনে না পড়লেও এখন পড়ছে। এই ব্যক্তিই সে রাত উবারে আইজাকে এই ক্লাব পর্যন্ত এনেছিলো। লোকটাকে ঐদিনই সন্দেহ হয়েছিলো আইজার! মুখ বন্ধ থাকায় কিছু বলতেও পারছে না এখন!
-“আরমানকে এখানে রেখে আর কোন লাভ হচ্ছিলো না। তাই তোমাকে আনা!”
হঠাৎ করেই বলে উঠলো লোকটি। তবে তার হাত এখনো সেই ছুরিতেই ব্যস্ত। আইজা মুখ চালানোর চেষ্টা করেও স্কচটেপের জন্য ব্যর্থ হচ্ছে। লোকটা মৃদু হেসে বলতে লাগলো,
-“এতো উত্তেজনা কিন্তু বাচ্চার জন্য ভালো না। আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। কী করার বলো! পুরো জগৎটাই তো রহস্যে ঘেরা। এই রহস্যের শতভাগ উন্মোচন কখনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না। তবে তোমাকে মেরে ফেলার আগে আমার সাধ্যমতো তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো আমি।”
কথাগুলো শুনতেই থেমে গেলো আইজা। মেরে ফেলার আগে! কী করবে বুঝতে পারছে না ও। পেট টা মোচর দিয়ে উঠছে, সাথে মস্তিষ্কও! ওর বাচ্চা! না! ওকে এখান থেকে বের হতে হবে। তবে চিৎকার চেচামেচিতে যে কোন লাভ হবে না সেটা ভালো করেই জানে আইজা। তাই নিজেকে ধীরে ধীরে শান্ত করে নিলো সে।
আইজাকে শান্ত দেখে সাথে সাথে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ইশারা করলো লোকটা। সে এসে আইজার মুখের স্কচটেপ খুলে দিতেই জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো ও। এতোক্ষণ যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো,
-“আমি তো আপনাকে চিনি পর্যন্ত না। আমাকে মেরে ফেললে আপনার কী লাভ?”
কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো আইজা।
-“কারণ সীমান্ত তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। তোমাকে মারলে ওর জখমে লবণ একদম স্বাদমতো পড়বে। বেচারা! এখানেই ধরা খেয়ে গেলো ও। তোমার প্রতি দূর্বল হওয়া সীমান্তর প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত ছিলোই না। সে তো শুধু তোমাকে ব্যবহার করে আরমানকে কাবু করতে চেয়েছিলো, যাতে আরমান চাপে পড়ে আমার ব্যপারে সীমান্তকে জানিয়ে দেয়। সীমান্তর সাথে তোমার বিয়ের সময় আমি এখানে ছিলাম না, নইলে তখনই এই বিয়ে আটকে দিতাম। আরমান যে এতো বোকা হবে জানতাম না!”
মাথা ধরে আসছে আইজার। সামনে থাকা ব্যক্তির সব কথাই যেন ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে জমেছে ভয়ের স্তুপ। কেন যেন মন বলছে এই মুহুর্তে আইজাকে যা বলা হবে তা ও কিছুতেই শুনতে চায় না। অন্তত লোকটার মুখভঙ্গি দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।
-“আপনার খোঁজ করতে সীমান্ত আমাকে বিয়ে করেছে! সীমান্তর সাথে পাপার আর আপনার কিসের শত্রুতা?”
আইজার প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে উঠলো লোকটি। ছুরিতে ধার দিতে দিতে বলতে লাগলো,
-“সে অনেক বছর আগের কথা। সীমান্ত আর ওর মাকে খুন করার উদ্দেশ্যে এই ক্লাবে আমিই ওদের এনেছিলাম। যদিও সেসময় পুরোপুরি সফল হইনি!”
লোকটার আফসোস ভরা কন্ঠ কানে যেতেই কয়েকবার পলক ফেললো আইজা। সীমান্তর মা যে সে ছোট থাকতেই মারা গেছে সেটা জানতো আইজা। কিন্তু কীভাবে তা জানা ছিলো না। শিকদার বাড়িতে কেউ কখনো সীমান্তর মাকে নিয়ে কোন কথা ওঠায় না! আইজা মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“পাপা এসবে কী করে এলো?”
আইজার নিম্নস্বরে করা প্রশ্নে সশব্দে হেসে উঠলো সে।
-“নিজের পাপার ওপর অনেক ভরসা না তোমার!”
-“আমার প্রশ্নের জবাব দিন! আপনিই আমার পাপার এ অবস্থা করেছেন!!”
শক্ত গলায় বললো আইজা। লোকটা এবার আইজার দিকে চোখ তুলে তাকালো। স্থির কন্ঠে বললো,
-“আরমানের সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে সীমান্ত আর ওর মাকে কিডন্যাপ করা সহজ হতো না। তোমার সহজ সরল পাপা নিজের বন্ধুকে ধোঁকা দিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানের কিডন্যাপিং এ আমাকে সাহায্য করেছে!”
-“মিথ্যা বলছেন আপনি!”
আইজার মনে হচ্ছে ওর পা থেকে আস্তে আস্তে মাটি সরে যাচ্ছে। কিছুতেই এ লোকের কথা হজম হচ্ছে না ওর। থরথর করে কাঁপছে ওর পুরো শরীর। লোকটার ওপর আইজার এ প্রতিক্রিয়ায় কোন প্রভাব পড়লো না। সে নিজের মতো করে বলতে লাগলো,
-“নাজিমের সাথে আরমানের বন্ধুত্ব অনেকটা ব্যবসায়িক কারণেই হয়েছিলো। নাজিম খুব ভরসা করতো আরমানকে। সে পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু সমস্যা তখন হলো যখন নাজিম আমার বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই যে ক্লাব দেখছো, এটা আগে একটা কার ক্লাব ছিলো। আর এ ক্লাব ছাড়াও আমার আরো একটা বিজনেস ছিলো। ট্রান্সপোর্ট বিজনেস। একদিন রাতের আঁধারে ভুলবশত নাজিমের গাড়ির সাথে আমার এক গাড়ির মৃদু এক্সিডেন্ট হয়। নাজিমের স্ত্রী তখন আঘাত পেয়েছিলো বলে লোকটা উঠেপড়ে লেগেছিলো আমাকে বরবাদ করার জন্য! আমার এই ক্লাব বন্ধ করিয়েছে ও! ট্রান্সপোর্ট বিজনেসে পর্যন্ত তালা লাগিয়েছে। কিন্তু আফসোস, নাজিমের আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলো না। বাহিরে থেকে শুধুমাত্র একটা কার ক্লাব বন্ধ হয়েছে! কিন্তু এর ভেতরে যে গোপন আরেকটা ক্লাব ছিলো সেটা ওরা বন্ধ করতে পারেনি!
আরমানের সাথে আমার বন্ধুত্ব একটা বিশেষ কারণে আমরা সবসময় গোপন করে যেতাম। নাজিম এ ব্যপারে কিছু জানতোই না। তাই কৌশলে আরমানের সাহায্যে আমি সীমান্ত আর ওর মাকে এ ক্লাবেই কিডন্যাপ করে আনি। যদিও পরবর্তীতে একটা ঝামেলা হওয়ায় সীমান্ত আর ওর মায়ের নিথর শরীরটা অন্য কোথাও ফেলে আসতে হয়েছিলো।
অন্য একটা জায়গা থেকে ওদের উদ্ধার করায় সীমান্ত এ ক্লাব এখনো খুঁজে পায়নি। আর আমিও কোন ক্লু রাখতে চাইনি নাজিমের জন্য। কিন্তু এতো বছর পর নাজিম কিভাবে যেন আরমানের ব্যপারটা যেনে যায়। নিজের বন্ধুর কাছ থেকে ধোঁকা সহ্য করতে না পেরে আরমানকে সবার সামনে ছোট করে সম্পূর্ণভাবে অকেজো করার পরিকল্পনা করে। নাজিমের ধারণা সবকিছু আরমানের কারসাজি ছিলো। তিলে তিলে মারতে চাইছিলো সে আরমানকে। নিজের প্রতিশোধ সে শুরু করেছিলো তোমার পাপাকে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে। যেহেতু তোমার চাচার সাথে আরমানের সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ ছিলো তার ফায়দা উঠায় নাজিম। আর আরমান বোকার মতো শুধু নিজের ভাইকেই দোষারোপ করে যায়। নাজিমের পরবর্তী টার্গেট ছিলো তোমাকে নিয়ে। সাহিলের সাহায্যে তোমাকে বদনাম করে নিজে ভালো সাজতে চেয়েছিলো নাজিম। তুমি যদি সেদিন সাহিলের সাথে পালাতে তাহলে সাহিল তোমাকে কখনোই বিয়ে করতো না।
তবে সীমান্তর ব্যপার আলাদা। ও এ ক্লাবের লোকেশন না জানলেও আমার ব্যপারে ঠিকই সবকিছু মনে রেখেছে। এমনকি কৈশোরে পা দিতেই ও আমার খোঁজ করা শুরু করে ওর বাবার অগোচরে। সীমান্ত তখনও আরমানের ব্যপারটা জানতো না। পরবর্তীতে যখন আমাকে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলো প্রায়, তখনই নাজিম আরমানের ধোঁকার কথা জানতে পারে। তবে নাজিম সীমান্তর মতো ওর কাছে কিছু লুকোয়নি।
বেচারা সীমান্ত অনেক চেষ্টা করেছিলো আমাকে খোঁজার। কিন্তু পারেনি। তাই শেষমেশ রাগের মাথায় নিজের বাপের প্ল্যানের সর্বনাশ করে বিয়ে করেছে তোমাকে। হয়তো সীমান্ত বুঝে গিয়েছিলো যে সোজা পথে আমার খোঁজ পাওয়া ওর জন্য কতটা কঠিন হবে। তোমাদের বিয়ের কথা জানতে পেরেই আরমানকে আমি এখানে আশ্রয় দেই। নাজিমের ব্যপারে তাকে সবটা জানাই। সীমান্ত যখন আমার জন্য এতোটা উতলা হয়েই গেছে তাই আমার মনেও ওকে নিয়ে আবারও লুকোচুরি খেলার ইচ্ছে জেগে গেলো!
আরমান তো পাগল হয়ে গেছিলো তোমাকে ঐ বাড়ি থেকে বের করতে। কিন্তু আমি চাইনি তুমি এভাবেই এ ক্লাবে আসো। কারণ সীমান্ত নিশ্চয়ই তোমার ওপর নজর রেখেছে। তাই আমি কৌশলে কম ভাড়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাহিলকে এই বিল্ডিংএর একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি। এজন্যই তুমি যেদিন তোমার পাপার সাথে এখানে দেখা করতে এসেছিলে সেদিন সীমান্ত ভেবেছিলো তুমি সাহিলের সাথে গোপন সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছো! এ এলাকায় যে কোন ক্লাবের অস্তিত্ব আছে সেটা জানতে পারেনি সে!
পরপর এতো বোকামির পর আমার তো ইচ্ছে হচ্ছিলো এখানেই আরমানকে মেরে ওর লাশও গুম করে দেই। কিন্তু তাতে তো কোন মজাই হতো না। আর এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে সে !
এতোক্ষণ নিঃশব্দে দাঁতে দাঁত চেপে সবটা শুনে যাচ্ছিলো আইজা। লোকটা নিজের কথা থামাতেই ও রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,
-“শেষ হয়েছে কাহিনী বলা! যা মুখে আসবে বলবেন আর আমি মেনে নেবো! আমার পাপা এসব কখনোই করবে না!! কিসের ভিত্তিতে এতোকিছু বলছেন আপনি? কোন প্রমান আছে আপনার কাছে!”
আইজার কথা শেষ হতে না হতেই লোকটা ছুরিতে ধার দেয়া হুট করে থামিয়ে দিলো। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালো সে। আইজার গলায় সেই ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“প্রমানের কোন অভাব নেই আমার কাছে। কিন্তু তোমার সেগুলো দেখার সাহস আছে তো!”
চলবে…