#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৫১
#লিখা_তানজিলা
আজ অফিস থেকে ছুটি নিতে কোন ঝামেলা হয়নি। লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামতেই সামনে রিয়াদকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। ওকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হলো না। রিয়াদ হেঁচকা টানে আইজাকে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলো!
-“কী হচ্ছে এসব! আপনার সাহস কী করে হলো আমার হাত…!”
-“খু*ন হতে না চাইলে চুপচাপ চলুন!”
রিয়াদের কন্ঠে অধৈর্য্যর রেশ। তবে আইজার হাত ছেড়ে দিলো সে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্যাক্সির দিকে ইশারা করে হনহন করে সেদিকে পা বাড়ালো।
-“আপনাকে সীমান্ত পাঠিয়েছে?”
আইজার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না রিয়াদ। লোকটাকে প্রচন্ড সন্দেহ হচ্ছে ওর।
হঠাৎ মেইন গেটের বাইরে নাজিম শিকদারের ড্রাইভারকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো আইজা। রিয়াদের চোখে ফুটে উঠলো চাপা আতঙ্ক।
-“এখানে কিছু বলার সুযোগ নেই! ট্যাক্সিতে গিয়ে বসুন! তখন যা ইচ্ছে জিজ্ঞেস করবেন!”
এই মুহুর্তে রিয়াদের সাথে ট্যাক্সিতে ওঠার কোন ইচ্ছে ছিলো না আইজার। তবুও নাজিম শিকদারের ড্রাইভারের চোখ এড়িয়ে ঐ ট্যাক্সিতে বসে পড়লো ও। নাজিম তো আর এমনি এমনি নিজের ড্রাইভারকে এখানে পাঠাবে না!
ট্যাক্সি স্টার্ট হতেই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সীমান্তকে কল করলো আইজা। নাজিম শিকদারের ড্রাইভার যে ওদের ফলো করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে ও। লোকটা হয়তো আজ আইজাকে খু*ন করেই ক্ষান্ত হবে!
-“সীমান্ত জানে তার বাবা কী করছে?”
সীমান্ত ওর কল রিসিভ না করায় অনেকটা তিক্ত গলায় প্রশ্ন করে বসলো আইজা!
-“অবশ্যই না! এমন হলে আমার আগে তো সীমান্ত এখানে চলে আসতো! সে এখন রায়হানকে নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি আমারও ফোন তুলছে না!”
-“আপনি নিজ থেকে এখানে এসেছেন!! সীমান্ত তার বাবার ব্যপারে কিচ্ছু জানে না অথচ আপনি জানেন! মশকরা করছেন আপনি আমার সাথে!”
কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো আইজা।
রিয়াদ ঠান্ডা চোখে তাকালো। কঠোর গলায় বলে উঠলো,
-“আপনিও তো প্রমান ছাড়া নিজের পাপার কুকীর্তির ব্যপারে বিশ্বাস করেননি! নাজিম শিকদার এতোটাও কাঁচা খেলোয়াড় না! তার বিরুদ্ধে না আমার কাছে কোন প্রমান আছে আর না আপনার কাছে! তাই সীমান্তকে কিছু বলা মানে অযথা সময় নষ্ট ছাড়া কিছু না!”
কিঞ্চিত দমে গেলো আইজা। পরক্ষনেই ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনি কী করছেন বলুন তো!” আইজার চোখ ভর্তি সংশয়। রিয়াদ কিছু একটা তো লুকোচ্ছে।
-“আপনি কী সীমান্তকে ধোঁকা দিচ্ছেন!”
হুট করেই বলে বসলো ও। তবে এবার রিয়াদ কোন জবাব দিলো না। তার শূন্য চোখ জোড়া বাইরে গিয়ে ঠেকলো।
-“এখানেই থামুন!”
ট্যাক্সি ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো আইজা। ও প্রথমে ভেবেছিলো সীমান্ত হয়তো রিয়াদকে পাঠিয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে রিয়াদের হাবভাব বলছে অন্য কথা!
ট্যাক্সিটা আইজার কথায় থামলো না। ড্রাইভারের কান অব্দি যেন ওর কোন কথাই পৌঁছাচ্ছে না। না রিয়াদ কিছু বলছে আর না ড্রাইভিং সীটে বসা লোক কিছু বলছে! মনের এককোণে খানিকটা ভয় এসে জড়ো হলো। একবার পেছনে ফিরে তাকালো আইজা। আরেকটা গাড়ি এখনো ফলো করে যাচ্ছে ওদের!
বুঝতে পারছে না আইজা। এক বিপদ থেকে পালাতে গিয়ে আরেক বিপদে পড়লো না তো! মৃদু কম্পিত হাতে এবার নিজের মামার নাম্বারে ডায়াল করলো ও। সীমান্তকে কিছু বলে আসলেই লাভ নেই!
-“ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না!”
নিঃসংকোচে বলে উঠলো রিয়াদ। তার চোখ জোড়া আইজার হাতে থাকা ফোন স্ক্রীনে নিবন্ধ!
আইজা রিয়াদের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিঃশব্দে ফোন কানের কাছে ধরতেই সাথে সাথে ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো রিয়াদ! মুহূর্তেই চোখ বড় বড় হয়ে এলো আইজার। রিয়াদের হাত থেকে নিজের ফোন ফেরত নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরার চেষ্টা করলো ও। ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিয়াদের দিকে!
-“আগে আমার কথা শুনুন! তারপর যাকে ইচ্ছে ফোন দেবেন!”
-“আমি কোন কথা শুনবো না! আমার ফোন ফেরত দিন!”
এতোক্ষণ আইজার কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া হচ্ছিলো না! আর এখন ফোনটাও কেড়ে নেয়া হলো! ও আসলেই একটা গাধী! কিছু না ভেবে রিয়াদের কথায় ট্যাক্সিতে ওঠা একদম উচিত হয়নি আইজার!
-“দেখুন আপনাকে ওরা হাতের নাগালে পেলেই মে*রে ফেলবে! আর এখন থামলে হয়তো আপনার সাথে সাথে আমরাও ফেঁসে যাবো! পরে দেখা যাবে, তিনজনের লা*শই গুম!! দেখুন, আমাদের লক্ষ্য কিন্তু আলাদা না! আপনি যেমন তাদের বিরুদ্ধে প্রমান জোগাড় করতে চান, তেমনটা আমিও চাই!”
-“সোজা ভাষায় আপনি এতোদিন সীমান্তকে ব্যবহার করছিলেন!”
শক্ত গলায় বললো আইজা।
সাথে সাথেই রিয়াদের শান্ত চাহনি রাগান্বিত রূপে পরিবর্তিত হয়ে গেলো!
-“এমনভাবে বলছেন যেন এই কাজটা আপনার দ্বারা কখনো হয়নি…!”
-“পার্থক্য এই যে সীমান্ত আমার ব্যপারে জানে! কিন্তু আপনার ব্যপারে না!”
শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো আইজা। তাদের এখনো ফলো করা হচ্ছে! আইজা রিয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরো বলে উঠলো,
-“আপনি যদি আমাকে সাহায্য করতেই চান তাহলে শিকদার বাড়িতে নিয়ে চলুন!”
-“আপনি কী পাগল! নাজিম তো..…!”
-“আপনিই তো বললেন নাজিম শিকদার কাঁচা খেলোয়াড় না! এই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে নিজের বাড়িতে নিজেরই ছেলের বৌকে খু*ন করার মতো কাজ নিশ্চয়ই তিনি করবেন না!”
বিভ্রান্ত চোখে তাকালো রিয়াদ।
-“আপনি কী করতে চাইছেন!”
রিয়াদের এরূপ প্রশ্নে আইজার মুখে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসি। স্থির গলায় বলে উঠলো,
-“আর আগে আমাকে এটা বলুন; আপনি কে!!”
***
ট্যাক্সিটা আইজার কথামতো শিকদার বাড়ির সামনেই থামলো। শুনশান রাস্তাটা এই মুহুর্তে কোলাহলপূর্ণ। বাইরে বেশ কিছু মানুষের ঢল। ওদের পিছু নেয়া গাড়িটাও তৎক্ষনাৎ উল্টো ঘুরে চলে গেলো! বিস্ময়ের কোন ছাপ নেই আইজার মুখে। আইজা জানতো এমনটাই হবে!
সীমান্তর ফোন এখনো লাগেনি! লোকটা ওকে অপবাদ দিয়েই কেটে পড়লো! একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ পর্যন্ত করলো না! রিয়াদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই গাড়ি থেকে নেমে শিকদার বাড়ির মেইন গেইটের সামনে দাঁড়ালো আইজা। গেইট ভেতর থেকে আটকানো। দারোয়ান আইজাকে দেখতেই শুধুমাত্র ওর জন্য খুলে দেয়া হলো গেইট!
আইজা পেছনে ফিরে রিয়াদের দিকে একবার তাকালো মাত্র। তার চোখের ভঙ্গি দেখে রিয়াদ স্পষ্ট করেই বুঝতে পারছে সে কী বলতে চাইছে! ভ্রু কুঁচকে এলো রিয়াদের। মানুষটার ব্ল্যাক*মেইলিং দক্ষতা চমৎকার! এতোদিনে সীমান্তর কষ্টটা বোধগম্য হচ্ছে ওর!
নিজের পাশে একটা বাইকের অস্তিত্ব টের পেতেই টনক নড়লো রিয়াদের। সীমান্ত শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,
-“আইজা আপনার সাথে কী করছে?”
সীমান্তর কথার ভঙ্গিতে কিঞ্চিত থতমত খেয়ে গেলো রিয়াদ। লোকটা প্রচন্ড বাজে ভাবে না রাগলে কখনোই এতো ঠান্ডা গলায় কথা বলে না!
-“ভাবি আপনাকে ফোন করে পাচ্ছিলো না। তাই আমাকে ফোন করেছিলো। আমি ভাবলাম পরিস্থিতি খারাপ তাই ভাবিকে পৌছে দেই!”
-“আপনাকে ভাবতে কে বলেছে!”
সীমান্তর তীক্ষ্ণ কন্ঠের বিপরীতে কিছু বললো না রিয়াদ। তার কঠোর মুখভঙ্গি দেখে তর্ক করতে ইচ্ছে করলো না। শার্টের হাতা ভাজ করে পুনরায় ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো ও। পাখিকে এতো বোঝালো! তারপরও মেয়েটা শেষ পর্যন্ত যা করতে চেয়েছিলো করেই ছাড়লো!!
***
মনে সাহস যুগিয়ে শিকদার বাড়িতে চলে তো এসেছে। কিন্তু ভেতরে ভাঙচুরের আওয়াজে সহসা কেঁপে উঠলো আইজা। ড্রইংরুমের ফ্লোর জুড়ে ভাঙা জিনিসপত্রের অংশবিশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অতি সাবধানে পা না ফেললে পা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
টিপ টিপ পায়ে এগোতেই নিজের দিকে একজনের রক্তচক্ষু টের পেলো আইজা। নাজিমের হাতে লাঠি জাতীয় কিছু একটা আছে। কিন্তু সেটা কী তা ভালো করে দেখার সুযোগ পেলো না আইজা। মুহূর্তেই সেই বস্তুটি আইজার দিকে ছুড়ে মারলো নাজিম নামক উ*ন্মাদ ব্যক্তি! ঘটনার আকস্মিকতায় সাথে সাথে দু’হাতে মাথা আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো ও!
এভাবেই কাটলো কয়েক সেকেন্ড। কোনরূপ ব্যথা অনুভব না হওয়ায় ধীরে ধীরে চোখ খুললো আইজা। তার বাহুডোরে নিজেকে বন্দী দেখে কিঞ্চিত বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠলো চাহনি জুড়ে। আসার পথে তো সীমান্তকে দেখলো না!
লোকটা শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নাজিমের ছোড়া বস্তুটা সোজা সীমান্তর পিঠ বরাবর লেগেছে হয়তো!
-“ঘরে যান।”
দুই শব্দের বাক্যটা দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো সে। যার মধ্যে ক্রোধের কোন চিহ্ন নেই। আইজা কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাজিমকে। কিন্তু সীমান্তর জন্য কিছু বলতে পারলো না। মানুষটার চেহারা দেখে বুঝাও যাচ্ছে না যে সে বেশি আঘাত পেয়েছে কি-না! বরং এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আইজা কিছু বললে এবার ওকেই গলা চেপে ধরা হবে!
চলবে…