#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৫২ (অতীত

0
719

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৫২ (অতীত)
#লিখা_তানজিলা

পাঁচ মিনিট হলো ঘরে পায়চারি করে যাচ্ছে আইজা। পেনড্রাইভটা তো এমনি ঐ ফ্ল্যাটের এক কোণায় ফেলে রেখেছিলো! হঠাৎ এসব কে করলো! এক মিনিট! ফাহাদ তো এখনো ধরা পড়েনি! ঐ লোকটাই এসব করেনি তো! এতোক্ষণ সবকিছু শুনশান থাকলেও আবারও কিছু একটা ভাঙার শব্দে আঁতকে উঠলো আইজা! ধ্যাত! এতো ভাঙচুরের মধ্যে কিছু ভাবা যায় না-কি! বিরক্তিকর!

বিছানায় শান্ত হয়ে বসলো আইজা। এক কি দুই মিনিটের মাথায় রুমের দরজা খুলে যাওয়ায় ওদিকে দৃষ্টি গেলো ওর! সীমান্তর চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। যদিও সেটা তেমন নজর কারেনি আইজার। লোকটার ডানহাতের তালু থেকে কব্জির এক সাইডে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে! বিছানা থেকে হুট করে উঠে দাঁড়ালো ও! সীমান্তর হাত ধরতে চাইলেই নিজেই হাত সরিয়ে নিলো সে। তার কঠোর মুখভঙ্গি আইজার ওপর নিবন্ধ!

আইজা কী যেন ভেবে নিজের বাড়িয়ে রাখা হাত গুটিয়ে ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে তুলে ধরলো সীমান্তর সামনে।
-“আপনি না চাইলে আমি আপনাকে ধরবো না! কিন্তু আপনার…!”
আইজার মুখনিঃসৃত বাক্য শেষ হওয়ার আগেই ওর হাত থেকে ছো মেরে ফাস্ট এইড বক্সটা কেড়ে হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে! আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে! ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছাড়লো ও!

গরম মাথায় কথা বললে সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশিই হয়ে যায়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সীমান্তর হাত নিজের বাহু থেকে সরিয়ে তার কথা মতো ঘরে পা বাড়িয়েছিলো ও। ঠান্ডা মাথায় সীমান্তর সাথে কথা বলাই ছিলো আইজার উদ্দেশ্য। লোকটা কিছু না জেনেই কী করে সন্দেহ করছে ওকে! নাজিম আইজাকে নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে আইজার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সীমান্ত!!!

আইজা যেটা করেইনি সেটা নিয়ে কেউ কথা শোনালে ওর প্রচন্ড রাগ হতো! ইচ্ছে হতো সামনে থাকা ব্যক্তির মাথায় থাকা সব চুল টেনে ধরতে! তবে সেটা ছিলো অতীত! এখন আর এরকম আকাঙ্খা তেমন একটা জমে না ওর কাছে। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। সেই মানুষগুলো যে আইজাকে রাগিয়ে ওর রাগ প্রদর্শনী উপভোগ করতো সেটা তখন বোধগম্য না হলেও এখন ঠিকই হয়!

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে নিঃশব্দে আইজার পাশে বসে পড়লো সে! কারো মুখে কোন কথা নেই। সীমান্তর হাতে পেঁচানো ব্যান্ডেজে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইজা। একটু আগেও যখন নিচ থেকে এলো তখন তো হাত ঠিক ছিলো!

-“সীমান্ত আমি…!”

-“আইজা প্লিজ! এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না!”
আগেরবারের মতো এবারো আইজার কথা মাঝপথেই আটকে দিলো সে!

-“আপনি বললেই তো হবে না!”

-“আইজা!

-“আমি জানি আমার নাম আইজা!”

-“চুপ করুন নইলে…!”
সীমান্তর কন্ঠে স্পষ্ট অধৈর্য্যের রেশ।

-“নইলে কী! মারবেন আমাকে!!”

মুহূর্তেই আইজার দিকে শক্ত চোখে তাকালো সে!
-“আমি নিজে আপনার মুখ বন্ধ করবো!”

-“আপনার পাশেই তো বসে আছি! করুন আমার মুখ বন্ধ!”
ক্রমাগত ফুঁসছে আইজা। ড্রইংরুমে নিজেকে সামলে নিলেও এই মুহুর্তে সীমান্তর সামনে ক্রোধ দমাতে ব্যর্থ ও! হয়তো অতটাও পরিবর্তন আসেনি আইজার মাঝে!

সীমান্তর ক্ষোভ তার চোখ উপচে পড়ছে। আইজার মস্তিষ্ক এক অদ্ভুত বিভ্রান্তে জড়িয়ে পড়লো। মানুষটার ক্ষোভের কারণ কী হতে পারে! আইজার ওপর সন্দেহ হচ্ছে এই কারণে না-কি তার কথা অনুযায়ী ও নিজের মুখ বন্ধ রাখছে না এই কারণে!

-“আ…দা…!”

সজ্ঞানে কয়েকবার চোখের পলক ফেললো আইজা। সীমান্তর দৃষ্টিও ওর থেকে সরে দরজার কাছে গিয়ে পড়লো। প্রায় এক বছরের মতো একটা বাচ্চা মেয়ে আইজার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মুখের একপাশে খাবারের অবশিষ্ট লেপ্টে একাকার!

-“আ..দা!”

আধো আধো গলায় সেই শব্দটা আবারও বলে উঠলো সে। আইজা প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও পরক্ষণেই ব্যপারটা বুঝতে পেরে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ও! সীমান্ত হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে। কিছু বলছেও না!

-“ও কে?”
বাচ্চাটা নিজের পরিচয় বলার অবস্থায় না থাকায় বাধ্য হয়ে সীমান্তকেই প্রশ্ন করে বসলো আইজা।

-“রিজা।”

-“রিজা কে?”

-“ফারহানা আপার মেয়ে।”

ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। বাচ্চাটা এখনো আইজার দিকে তাকিয়ে আদা আদা করে যাচ্ছে! তারওপর এই লোকটাও ঠিকমতো কিছু বলছে না! মনে হচ্ছে এখানে কোন নামতা প্রতিযোগিতা চলছে!
-“এই ফারহানা আপা কে?”

-“ফিহার বোন! আর প্রশ্ন করবেন না তো! ভালো লাগছে না!”
সটান করে বিছানায় শুয়ে পড়লো সীমান্ত। হাতটা চোখের ওপর রেখেছে!

-“আদা!”
নিজের নামের ওপর হওয়া এমন জঘন্য অত্যাচারেও চুপ করে তাকিয়ে আছে আইজা! এক বছরের বাচ্চাকে কীইবা বলবে ও!!

-“রিজা!!”
বাইরে থেকে এক মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসতেই রিজার চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠলো। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়লো সে!

রিজা চলে যেতেই পেছনে ফিরে তাকালো আইজা। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
-“আমি জানি আপনি জেগে আছেন!”

নিস্তব্ধতা ব্যতীত আর কোন জবাব পেলো না ও।
-“আমি আগেই বলেছি রায়হানের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই! আমি এসব করিনি…!”

-“জানি!”

আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো আইজা। কিছু সীমান্তর মুখনিঃসৃত ছোট্ট শব্দটা কান অব্দি পৌঁছাতেই হুট করে চুপ হয়ে গেলো ও। জানে মানে!

-“তাহলে কেন বললেন আপনি ভরসা করেছিলেন আমাকে?”

এবার আর কোন জবাব দিলো না সীমান্ত। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। আজব মানুষ তো! ফোনটা পুনরায় হাতে নিলো আইজা। আবারও চেক করলো সেই মাথা খারাপ করা মেসেজ। এক মিনিট! রায়হানকে গ্রে*প্তার করা হয় সাড়ে দশটায়। সীমান্তর ফোন থেকে প্রায় পঞ্চাশটার মতো কল আসে এগারোটার দিকে।

কিন্তু তার নাম্বার থেকে আসা সেই অদ্ভুদ মেসেজ রিসিভের সময় তো সকাল নয়টা। সে সময় নিজের ফোন চেক করা হয়নি আইজার। সীমান্ত কী আগে থেকে খবর পেয়েছিলো না-কি সে অন্য কোন বিষয়ে কথা বলছিলো! অন্তত রায়হানের ব্যপারে আইজার ওপর সন্দেহ করা হয়নি। কিন্তু নাজিম এরকম কেন করলো তখন বুঝতে পারছে না ও!

মাথা ধরছে আইজার। ইচ্ছে করছে সীমান্তকে জোর করে হলেও সবটা জেনে নিতে! কিন্তু সীমান্ত যেমন মানুষ, লোকটা এই মুহুর্তে কিছুই বলবে না ওকে! হয়তো এখন আবার নিজের ঐ স্টাডি রুমে পড়ে আছে!

***

-“ছেলে কিন্তু তোর নিয়ন্ত্রণে আর নেই! আগেই বলেছিলাম আইজার একটা ব্যবস্থা করতে!”
জাফরের ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে গা জ্বলে উঠছে নাজিমের। সোফায় বসে ক্রমশ ফুঁসছে ও!
-“আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজের মেয়েকে সামলান! সে-ও কিন্তু আপনার কন্ট্রোলে নেই! আমার ছেলেদের আমি সামলে নেবো!”

জাফর শিকদার আর কিছু বললো না। যখন থেকে নাজিম, ফাহাদের কাছ থেকে ওর করা খু*নের প্রমান যোগাড় করেছে তখন থেকেই নাজিমকে কিছুটা সমীহ করে চলে ও! কারণ নাজিম সে প্রমান জাফরের হাতে রাখতে নারাজ। নিশ্চয়ই এক না একদিন জাফরের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করার উদ্দেশ্য আছে নাজিমের!

-“আরে রাগছিস কেন! সীমান্ত কিন্তু এসব তোর থেকেই শিখেছে। বউ পাগল একটা! মনে নেই, নেহার জন্য কত পাগলামী করতি তুই! সামান্য কারণে খু*ন পর্যন্ত…!”

নাজিমের রক্তচক্ষু দেখতেই চুপসানো বেলুনের মতো চুপ হয়ে গেলো জাফর। কেন এসব মনে করাচ্ছে সে! নাজিম ওর স্ত্রীকে নিয়ে কোন অতীতই মনে রাখতে চায় না! কিন্তু অবাধ্য মস্তিষ্ক তো আর ওর মর্জিমতো চলে না! কোন কিছুই ভুলা হয়নি নাজিমের!

অতীত
—————–

গোলাপ প্রচন্ড প্রিয় ছিলা নেহার। প্রায়ই তার খোপায় সে ফুল শোভা পেতো! আজ নাজিম নিজেই গোলাপ গুচ্ছ নিয়ে এসেছে। কিন্তু ঘর খালি দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো ওর। কতবার বলেছে এ সময় কোথাও না যেতে! বিছানার ওপর রায়হান একা বসে খেলছে। ক্ষুব্ধতার সাথে ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফুলগুলো ছুড়ে মারলো নাজিম।

বাড়ির পেছনে থাকা বাগানের একসাইডে নিজের স্ত্রী আর বড় ছেলে সীমান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হনহন করে সেদিকে এগিয়ে গেলো ও। নেহা তার হাতে থাকা ছাতাটা এ বাড়ির মালি আশরাফকে দিচ্ছে। আর লোকটা কী সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। রাগে দুই হাত মুঠ হয়ে এলো ওর। কিন্তু কিছু করলো না নাজিম। ওদিকেই দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে নেহার অপেক্ষা করতে লাগলো।

-“আরে! আপনি এতো আগে চলে এলেন আজকে!”
নাজিমকে খেয়াল করতেই বলে উঠলো নেহা।

-“সীমান্ত ভেতরে যা!”
নাজিমের বলতে দেরি সীমান্ত এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। তার পিছু পিছু আশরাফের ছেলে রিয়াদও গেলো।

-“আশরাফের সাথে কী কথা হচ্ছিলো তোর!”

নাজিমের মুখে তুইতোকারিতে মনোক্ষুণ্ণ চাহনিতে তাকালো নেহা। মৃদু গলায় বললো,
-“আপনাকে তো বলেছি, আজ আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবো!”

-“তো!!”

-“হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিলো। তখনই আশরাফ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তার দেয়া ছাতাটা ফেরত দিতেই…!”

-“গাড়ি নিয়ে গেলে হতো না!”

-“এতো কাছে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন!!”

ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ফেললো নাজিম। কোনমতে নিজেকে সামলে নেহার গালে হাত রাখলো ও। নরম গলায় বলে উঠলো,
-“তোমাকে কতবার বলেছি, ফাহাদ তোমার ক্ষতি করতে পারে। এরপর থেকে বাড়ির বাইরে যাবে না তুমি! অন্তত যতদিন না আমি ফাহাদকে তিন হাত মাটির নিচে পুঁতে আসছি!”

-“নাজিম! দয়া করে এসব বন্ধ করুন। আমার ভালো লাগে না আর!”
নেহা নিজের গাল থেকে নাজিমের হাত সরিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো।

নাজিম কঠোর চোখে তাকিয়ে আছে। নেহাকে আটকালো না ও। ফাহাদকে পরে দেখবে। এই মুহুর্তে আশরাফের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নাজিমের হৃদয়ে বি*ষাক্ত কাঁটার ন্যায় বিঁধছে!

দুইদিন পর ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়ি ফিরলো নাজিম। তার বাড়ির সোফায় বসেই আশরাফের ছেলে রিয়াদ কেঁদে যাচ্ছে। নাজিমকে দেখতেই নেহা চিন্তিত চাহনিতে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আশরাফ ভাইয়ের এক্সি*ডেন্ট হয়েছে। অবস্থা না-কি খুব ক্রিটিকাল!”

নেহার শুকনো মুখটা এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে নাজিম। তার এতো মাথা ব্যথা কেন আশরাফকে নিয়ে!
-“চিন্তা করো না! আমি খবর নিচ্ছি!”

অনিচ্ছা স্বত্বেও নেহাকে ভরসা দিয়ে সে জায়গা থেকে সরে এলো নাজিম। অনেক কাজ ওর। দুই ঘন্টা আগে আশরাফকে গাড়ি চাপা দিয়ে এসেছে। বিষয়টা ধামাচাপা দেয়া হয়তো অতটাও সহজ হবে না!!!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here