#অপ্রিয়_প্রেয়সী শেষপর্ব (ট’ক্সি’ক)
#লিখা_তানজিলা
সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। ছোটবেলা থেকেই প্রবাদটা শুনে আসছে আইজা। সত্যি ইদানিং সময় যে কি করে চোখের পলকে চলে যাচ্ছে বুঝা মুশকিল! সেদিনের ঘটনার পর ইতোমধ্যে দেড় মাস হয়ে এলো! ঐদিন নাজিম আর জাফরের পাশাপাশি ফাহাদকেও পাওয়া গেছিলো। তবে লাশ হিসেবে! ফ্রিজারে রাখা ছিলো তার দেহ!
সীমান্ত সেদিনের পর থেকে যেন পূর্বের তুলনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবসময় নিজের বাবার অফিসে কাজ করে আসার পর এখন না-কি তার আর কোন চাকরির ইচ্ছে নেই। চাকরি করতে পারবে না সে! নাজিমের গ্রেপ্তা*রের পর সীমান্ত আর শিকদার বাড়িতে ফেরত যায়নি! কোথায় যে ছিলো লোকটা আইজাও জানতো না। পরে রিয়াদের কাছ থেকে শুনলো সে না-কি নিজ থেকেই ব্যবসায় জগতে নামতে চায়। আইজা এ ক্ষেত্রে সীমান্তর ইচ্ছে নিয়ে তেমন কিছু বলেনি। লোকটার মেধা কম না। আল্লাহ চাইলে এখানেও সফল হবে সে!
এই মুহুর্তে ভীর বাসে দাঁড়িয়ে আছে আইজা। ওর বাবাকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিলো আজ। কয়েকদিন আগে জ্ঞান ফিরলেও হাত পা নাড়াতে বেশ কষ্ট হয়। তার ওপর বেশিক্ষণ থাকার অনুমতিও পায়নি আইজা!
বাসটা কিছুক্ষণ পর পর যেন আরো জনবহুল হয়ে পড়ছে। পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই! তবুও মানুষকে ব্লেন্ডারে পি’ষে হলেও যেন আরো লোক উঠানো হবে বাসে! গা জ্বলছে ওর! তবে মাথায় পুরোপুরি রক্ত তো তখন চড়লো যখন এক পুরুষালী হাতের স্পর্শ নিজ হাতে টের পেলো আইজা! ক্ষীপ্র গতিতে একটা সেফটিপিনের ধারালো দিক দ্বারা সেই ব্যক্তির হাতের উল্টো পিঠে আক্রমণ করে বসলো ও!
-“এই প্রথম আ’ঘা’ত পেয়ে ভালো লাগছে!!”
নিজের হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো সে! পরিচিত কন্ঠ টের পেতেই সাথে সাথে পেছনে ঘুরে তাকায় আইজা। সীমান্ত ওর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখতেই ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছেড়ে সামনে ফিরলো ও। যখন যা ইচ্ছে তাই করবে! এই দেড় মাসে একটা ফোনও করেনি সে! ভাবতেই ক্রমাগত ফুঁসছে আইজা!
পুরো বাস জার্নিতে সীমান্তও আর কিছু বললো না। চুপচাপ আইজার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ও! এরপর থেকে তো আর কখনো লোকাল বাসে চড়তে দেবে না আইজাকে সে! অতঃপর সেই বাস থেকে নেমে আইজার পিছু পিছু একটা পার্কে গিয়ে পৌছালো সীমান্ত। লম্বা একটা বেঞ্চের শেষপ্রান্তে বসে পড়লো আইজা! সীমান্তও নিঃশব্দে বসলো তার পাশে।
-“আসলে…!”
-“আসলে কী..! আপনার আমাকে ছাড়তে সমস্যা! আবার যখন ইচ্ছে না বলে যোগাযোগ বন্ধ রেখে কোথায় যেন চলে যান! পেয়েছেনটা কী আমাকে! মাস শেষে একাউন্টে টাকা পাঠালেই কী দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়….!”
-“আপনার সামনে আসতে ইচ্ছে করছিলো না!”
আইজার রুক্ষতার সাথে বলা কথাগুলোর মাঝেই মৃদুস্বরে বলে উঠলো সীমান্ত!
-“তো এখন কী করছেন? এখন অস্বস্তি হচ্ছে না!!”
আইজার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না সীমান্ত। বেশ অনেকক্ষণ নিরবতার মাঝেই ডুবে রইলো দু’জন। শেষপর্যন্ত এই নিস্তব্ধতার সমাপ্তি সীমান্তই ঘটালো।
-“আমি আপনার সাথে একটা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চাই আইজা! তাই আপনাকে আর জোর করতে চাই না! আপনি যদি এ সম্পর্ক থেকে মুক্তি..!”
-“নতুন কাউকে পেয়েছেন?”
ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে কপালে আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছে আইজা। দেড় মাস আগেও ওকে ছাড়তে চাইছিলো না সে! আর এখন..! হুট করে তীক্ষ্ণ নজর ফেললো সে পাশে বসে থাকা লোকটার ওপর। কঠোর গলায় বলে উঠলো,
-“প্রেমিকা হিসেবে কিন্তু আমিও কম জ’ঘ’ন্য না! আর একবার মুক্তি শব্দটা উচ্চারণ করলে আমি কিন্তু আপনাকে মনে করিয়ে দেবো যে, একসময় আমি আপনার অপ্রিয় কেন ছিলাম!”
একদমই মজা করছে না আইজা। যখন ও এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছিলো তখন সীমান্তই ওকে নিজের জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মতো অনুভব করিয়েছিলো! আর এখন যদি সে মুক্তির কথা বলে কী করে সহ্য করবে আইজা!
-“আপনি কখনো আমার কথা বুঝতে চান না! আমি আপনাকে ছাড়তে চাইছি না! শুধু এ সম্পর্কটা নিয়ে আপনার মত জানতে চেয়েছি!”
-“আমার মত আমি আপনাকে অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি! বিয়ের সময়ই তো কবুল বললাম! তাও আবার তিনবার!”
নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে উঠলো আইজা!”
-“হঠাৎ এতো পরিবর্তন কেন বলুন তো? আমাকে তো সহ্যই হতো না আপনার!”
সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করলো সে!
-“সত্যি বলতে আপনার জীবন মুশকিল করার মধ্যে যে এন্টারটেইনমেন্ট আছে; সেটা মিস করতে চাই না!”
আইজার গলায় ব্যঙ্গাত্মক ভাব।
সাথে সাথেই সীমান্তর ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো।
-“আপনি কতটা টক্সিক একজন মানুষ জানা আছে আপনার!”
-“এজন্যই তো আমি আপনার জন্য পারফেক্ট! টক্সিক প্লাস টক্সিক! ইন্টারেস্টিং একটা কম্বিনেশন!”
আইজার মিহি গলায় বলা কথাগুলো কানে যেতেই এক ভ্রু উঁচু হয়ে গেলো সীমান্তর! ঠোঁটে ফুটে উঠলো সুক্ষ্ম হাসির রেখা! ফিসফিস কন্ঠে বলে উঠলো,
-“কী করে যে আপনার প্রেমে পড়লাম আল্লাহ জানে!”
-“অনেক ভালোবাসেন আপনি আমাকে! তাই তো এই দেড় মাসে আমার সাথে যোগাযোগ না রাখলেও ফিহাকে ঠিকই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে নাচতে নাচতে চলে গেলেন! কী ভেবেছিলেন, আপনার কোন খবর রাখিনি আমি!”
-“কথায় কথায় ফিহাকে কেন টানছেন! আপনি কোথায় কী শুনেছেন আমি জানি না। কিন্তু ফিহার সাথে আমার কখনোই প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না। আমরা এক সময় ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম! ব্যস্! আর আমি ওকে পৌঁছে দিতে যাইনি! আমার পারসোনাল কিছু কাজ ছিলো ওখানে! শুধু শুধু মানুষের কথায় জেলাস হওয়া বন্ধ করুন!”
-“জেলাস! না সীমান্ত ; আমার একদম জেলাস ফিল হচ্ছে না! রাগ হচ্ছে আমার!!!”
ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠছে আইজার কন্ঠস্বর। এমনটা তো কথা ছিলো না। ভেবেছিলো সীমান্ত যখন সামনে আসবে কোন কথা বলবে না ও তার সাথে। দরকার হলে মুখে সুপার গ্লু লাগিয়ে রাখবে! কিন্তু মানুষটা সামনে আসতেই গিরগিটির মতো বদলে গেলো আইজার মন!
প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে সীমান্তকে। অনেক কষ্টে তার ড্রি’ঙ্কিং প্রবলেম সেরেছিলো। আজকাল না-কি আবারও সে সমস্যা বেড়েছে! তাই হয়তো আইজার সামনে আসতে চায় না সে! আইজা খুব ভালো করেই চেনে লোকটাকে! তবুও মনে জমে থাকা পাহাড় সমান অভিমান আর ক্রোধকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না ও!
এই সম্পর্কের বীজ সম্পর্কে আইজা সম্পূর্ণরূপে অবগত। তাও সে সজ্ঞানে এই বিষাক্ত অনুভুতিকে গ্রহন করবে। আইজার এ সিদ্ধান্ত ওকে কোথায় নিয়ে যাবে জানে না ও। শুধু এতটুকু বোধশক্তিতে গিয়ে ঠেকছে, ভালোবাসে আইজা সীমান্তকে। প্রচন্ড ভালোবাসে। আইজার কাছে এই ভালোবাসা হলো বিষাক্ত কাঁটার ন্যায়। না পাচ্ছে স্বস্তি, না পাচ্ছে শান্তি। তবুও কেন যেন এই অপ্রিয় অনুভূতিই ভিষণ প্রিয় আইজার কাছে!
***
সেদিন রাত নয়টায় ড্রেসিং টেবিলের ওপর ওর প্রিয় এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল চোখে পড়তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো আইজার। তার পাশেই র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট্ রাখা। এই সময়ে এগুলো কে রাখবে! আইজার মনে চলতে থাকা এ প্রশ্নের জবাব মৃদু হেসে দরজায় ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে দুই হাত ভাজ করা। আঁখি জোড়ায় অজস্র কৌতুহল!
-“আপনি এখানে কী করছেন?”
আইজার কন্ঠে দৃঢ়তার রেশ। ওর করা প্রশ্নটা যেন সীমান্তর অপেক্ষাকে অপমান করে বসলো। কৌতুহলী মুখটাতে ছেয়ে গেলো মৃদু অভিমানী ছাপ। তা দেখে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে আইজার! লোকটার অভিমানী মুখভঙ্গি বেশ উদ্ভট লাগছে ওর কাছে!
আইজা সীমান্তর থেকে নজর সরিয়ে ফুলগুলো হাতে নিয়ে পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দিলো। পুরোটা সময়ই আইজার মুখে অনুভূতির কোন রেশ ছিলো না! সীমান্তর এই উদ্ভট মুখভঙ্গি দেখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছিলো না ও!
কিন্তু আইজার এ ইচ্ছে পূরণ হলো না। সীমান্তর মলিন হয়ে যাওয়া চাহনি মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
-“উপহারগুলো তাহলে ম্যাডামের পছন্দ হয়েছে!”
-“আমি কখন বললাম পছন্দ হয়েছে!”
-“আপনার মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজন নেই! ঐ চাহনিই যথেষ্ট!”
-“আপু আমার হোমওয়ার্ক!!!”
সীমান্তর কথার বিপরীতে আইজার কিছু বলার আগেই সিমি ছুটে এলো এ ঘরে! আইজার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হয়তো অধৈর্য্য হয়ে গেছিলো সে!
-“এমন করলে কী করে চলবে! আমি তো কালই আপনার আপুকে নিয়ে যাবো!”
সীমান্তর দৃঢ় কন্ঠ শুনে ভীত চোখে তাকালো সিমি!
-“সীমান্ত!”
আইজার তীক্ষ্ণ কন্ঠে হেঁসে উঠলো সে। সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
-“ভয় পেতে হবে না! আপনি চাইলে আপনাকেও প্যাকেট করে নিয়ে যাবো!”
-“তুই ঐ ঘরে যা! আমি আসছি!”
আইজার কথা শুনে দ্রুত বেগে চলে গেলো সিমি। সীমান্ত এখনো হাসছে! আর আইজা কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
-“আমি আর ওদের একা ছাড়তে পারবো না!”
শক্ত গলায় বলে উঠলো ও।
-“আপনাকে ছাড়তে বলেছে কে! আপনি চাইলে ওরাও আমাদের সাথে যাবে। তবে আমি জোর করবো না। আগেরবার জোর করে বেশ শিক্ষা হয়েছে!”
সীমান্তর কথায় না চাইতেও হেঁসে দিলো আইজা। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা, আপনি কী বাচ্চাদেরও আপনি করে বলেন?”
সীমান্তর মুখের হাসি হুট করেই কিছুটা মিইয়ে গেলো! বেশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য শান্ত হয়ে রইলো সে!
-“আমার প্রশ্নটা হয়তো আপনার পছন্দ হয়নি!”
-“মা সবসময় সবাইকে আপনি করে সম্বোধন করতেন। তাকে দেখে আমিও এমনটা করতাম। একসময় ধীরে ধীরে সেটা অভ্যেসেই বদলে যায়।”
আইজা আর কথা বাড়ালো না। সীমান্তর মুড খারাপের দিকে যেতে দেখে দ্রুত র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট এর প্যাকেটটা খুলতে শুরু করলো ও!
সীমান্ত মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছে আইজাকে! রঙবেরঙের চুড়িগুলো আইজার চোখে পড়তেই তার ঠোঁট জোড়ায় ফুটে উঠলো স্বচ্ছ হাসি! আইজার এ প্রফুল্ল মুখ দেখে মনের অজান্তেই মৃদু হাসলো ও! মেয়েটা সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ নিজের হাত জোড়া সাজিয়ে নিলো সেই চুড়ির বাহারে!
তার মোহনীয় চাহনি আর হাতে বেজে যাওয়া চুড়ির অনবরত টুংটাং শব্দে মুগ্ধতার সাথে তাকিয়ে থাকা সীমান্তর কাছে এটুকু তো স্পষ্ট যে এই নি’ষ্ঠু’র মানবী সত্যিই ওর জীবনটাকে বেশ ভয়াবহ উপায়ে মুশকিল করতে সক্ষম!
সমাপ্ত…
(অবশেষে গল্পটা শেষ হলো! ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের মন্তব্য জানালে খুশি হবো।)