#নিভৃতে_যতনে Part_16
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
তপ্ত ঘেমে উঠা শহর আনাচেকানাচে। ভ্যাপসা গরম আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠা রৌদ আড়াআড়ি ভাবে বিরাজমান।রৌদ্রতপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে ছুটে চলা মানুষের ব্যস্ততা দুপুরের প্রগাঢ়তা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তার ন্যায় ঝলমল করছে। রুম জুড়ে বিচরণ করছে আমার পা যুগলটি। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার হৃদস্পন্দনের ধুকধুকানি। মাথায় চড়ে বসেছে চিন্তা-ভাবনার অতি গুরুত্বপূর্ণ সভা। নয়নে ভীতি, মনে আশঙ্কা নিয়েই প্রত্যেকটা প্রহর অতিক্রম হচ্ছে আমার। বার বার নয়ন দুইটি চলে যাচ্ছে ঘড়ির সরু দুইটি কাটার উপর। একটু আগেই লম্বা সরু কাটাটি বারো সংখ্যার ঘরটি অতিক্রম করে ঠেকেছে দুইয়ের ঘরে আর ছোট সরু কাটাটি স্থির হয়েছে তিনের ঘরে। সেটা দেখা মাত্র আমি পুনরায় অস্থিরতা জড়ানো গলায় রোয়েনকে জিজ্ঞেস করে উঠি,
— রেজাল্ট দিয়েছে?
বিছানার উপরই রোয়েন ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। আমার কথা শুনেও তার মধ্যে ভাবান্তর হলো না। সে তাঁর দৃষ্টি অটল রেখে শীতল কন্ঠে জবাব দিলেন,
— সাভার এখনো লোড হচ্ছে।
কথাটা শুনার সাথে সাথে একরাশ হতাশা ঝেঁকে ধরলো আমায়। তাও আমি হাল ছাড়লাম না। নিজের মনকে শক্ত করার জন্য আয়তুল-কুরসি পাঠ করতে থাকলাম। এই রেজাল্ট যে কখন দিবে আল্লাহ মালুম। পাশের রুমেই শ্বাশুড়ি মা তবজি হাতে নিয়ে বসেছেন। দোয়া করছেন আমার ভালো ফলাফলের জন্য। রোয়েনও আজ লাঞ্চ টাইমে ছুটি নিয়ে বাসায় এসে পড়েছে একমাত্র আমার রেজাল্টের জন্য। কিন্তু এইটা সে স্বীকার করেনি৷ বরং চেপে গিয়েছে। অতঃপর মা এসে বলেছিলেন কারণটা। বিষয়টা জানার পর মুহূর্তেই ক্ষণেকের জন্য আমার ভালোলাগা সৃষ্টি করলেও রেজাল্টের টেনশন মাথায় চড়ে উঠায় তা স্থির হতে পারেনি।
বেশ কিছুক্ষণ পর পায়চারী করার পর রোয়েনের গম্ভীর কণ্ঠ আমার কানে ভেসে আসলো।
— রেজাল্ট এসেছে!
কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি তড়িৎগতিতে রোয়েনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই। কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করি,
— সত্যি!
রোয়েন ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকেই নজর রেখে উত্তর দেন,
— হুম।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। আমি দৃষ্টি অস্থির হয়ে আসে। এইদিক-সেদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। গলা ও ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। শরীরে স্বল্প পরিমাণে কম্পন সৃষ্টি হতে থাকে। এইদিকে রোয়েনের সুক্ষ্ম দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে। তাঁর দৃষ্টি একবার উপর থেকে নিচে যাচ্ছে তো আবার নিচ থেকে উপরে উঠে আসছে। হয়তো আমার রোলই খুঁজছেন। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পরও যখন কোন সারা-শব্দ পেলাম না তখন আমি স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠি,
— আমার রোল আছে কি?
কথাটা বলতেই রোয়েন উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। মুখশ্রী জুড়ে ছেয়ে যায় গাম্ভীর্য ভাব। যা ক্ষণেই আমার ভীতিটা কয়েকশো গুন বাড়িয়ে দিলো। আমি তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে গম্ভীর গলায় বলে,
— নিজে দেখে নাও।
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি ধরেই নিলাম, হয়তো তিনি আমার নাম খুঁজে পান নি। তাই এখন আমায় দেখতে বলছে। হঠাৎই মনটা বিষাদে গুড়িয়ে গেলো। মলিন হয়ে আসলো মুখ। আমি আর কোন কথা জিজ্ঞেস না করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই ল্যাপটপের দিকে। ল্যাপটপটার সামনে বসে নিজের নাম ও রোল খোঁজার প্রস্তুতি নিতেই হঠাৎ চোখের সামনে ‘সিয়াশা ইয়াসমিন’ নামটা জ্বলজ্বল করে উঠে। নামটা দেখার সাথে সাথে আমি স্থির হয়ে যাই। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রই নিজের নামের দিকে। তাও আমি সিউর হওয়ার জন্য পাশে রোলটা দেখেনি। না ঠিকই আছে৷ এইটা আমার রোলই। আমি চটজলদি রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখি তার ঠোঁটের কোনে সরু এক হাসির রেখা৷ তা দেখে আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,
— এইটা সত্যি আমি?
কথাটা শুনার সাথে সাথে রোয়েনের হাসি প্রসস্থ হয়ে আসে। প্রদর্শিত হয়ে উঠে তাঁর দুই ধারে থাকা গেজ দাঁতটি। কি অনামিক সেই হাসিটি। উনি ঠোঁটের কোনে সেই হাসির রেখা বিদ্যমান রেখে ‘হ্যাঁ সূচক’ মাথা দুলায়। যা দেখা মাত্র আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই৷ কথাটা যেন আমার বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। হঠাৎ আমার কি হলো জানি না আমি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরি। তার বুকে মাথাতেই চোখ কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে দুই ফোটা নোনাজল। ঘটনাক্রমে আর আমার এমন এহেন কান্ডে রোয়েন বেশ ভড়কে যায়। আমাকে নিয়েই দুই কদম পিছিয়ে যায়। বিষ্ময়ে ভর্তি আঁখিদুটি নিবদ্ধ হয় আমার মুখপানে। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ তার হাত দুটো প্রসারিত হয়ে আসে এবং আবদ্ধ করে নেয় আমায় তাঁর আলিঙ্গনে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঘটনাক্রমে বুঝতেই আমি চিটকে দূরে সরে আসি। গালের মাঝে ফুটে উঠে রক্তিম এক আভা। লজ্জায় যেন মাথা হেট যাচ্ছিল আমার। ইচ্ছে করছিল মাটির সাথে একদম মিশে যেতে। রোয়েনের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম সে আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো কিছু বলতেও নিচ্ছে। কিন্তু আমি কি আর সে কথা শুনার জন্য বসে থাকি? তাঁর কিছু বলার আগেই আমি এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসি।
____________________
বাসায় এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। আমি ঢাবিতে চান্স পেয়েছি তা শোনামাত্র মা আমার কপালে একটা চুমু খেলেন এবং আল্লাহর নিকট কোটি কোটি শুকরিয়া জানালেন। জট চলদি রোয়েনকে দিয়ে দুই বক্স মিষ্টিও আনিয়ে নিলেন এবং আমার মুখ মিষ্টি করিয়ে দিলেন। সেই সাথে শ্বশুরবাবাকেও জানিয়ে দিলেন খবরটা। খবরটা পেয়ে যেন সেও বড্ড খুশি হয়েছেন। ওইদিকে হৃদিপু আর মা কথাটা শুনে খুশিতে আত্মহারা। মা নাকি খুশির চোটে কেঁদেই দিয়েছেন। পারছে না তো এখনই ছুটে আসতে। কিন্তু চাইলে কি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হুটহাট উঠা যায়? আর এইদিকে হৃদিপু তো ইতিমধ্যে ফোনেই খোঁচা মারা শুরু করে দিয়েছে,
— কে জানি বলেছিল সে চান্স পাবে না। তার চান্স হবেই না সে নিশ্চিত।
আমি স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলি,
— আপু!!
হৃদিপু ব্যঙ্গ করে বলে,
— আপু!! চান্স পাবি না, পাবি না বলে চান্স পেয়ে বসে আছিস। তাও আবার মেরিট লিস্টের প্রথম একশ জনের মধ্যে আছিস। চাপাবাজ কোথাকার! এই ছিল তোর মনে?
— বইন আর কত খোঁচাইবা? আমি সত্যি ভাবি নি যে চান্স পেয়ে যাবো। বিশ্বাস করো।
— এএ বিশ্বাস করো! আমার যেনো বিশ্বাস করতে বয়ে গিয়েছে। হুহ! আজ তোদের মত চাপাবাজ স্টুডেন্টদের জন্যই হাজারো বেকবেঞ্চারস ঠকে যাচ্ছে। সারাবছর বলস কিছু পারি না! পারি না! অথচ ঠিকই রেজাল্টের সময় ছক্কা মেরে বসে থাকোস। বেয়াদব গুলা!
আমি হৃদিপুর কথা শুনে হু হু করে হেসে উঠি।
_____________________
রাতে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছি। ভিতরে যাব কি-না তা নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি। কেন না বিকেলের ঘটনার পর আমার রোয়েনের সামনে যেতে প্রচন্ড লজ্জা করছে। বলতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত পরিমানেই লজ্জা করছে। এমন এক এহেন কান্ড করার জন্য মনে মনে নিজেকে শ’খানেক গালি দিলাম। এমন হতচ্ছাড়া কর্মকাণ্ড কিভাবে করলাম আমি আল্লাহই জানে। এখন এই মুখ কিভাবে দেখাই? কই যাই এই নিয়ে? কথাটা ভেবেই মিছেমিছি কাঁন্না এলো। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে গলা উঁচু করে রুমে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগলাম। দেখার জন্য রোয়েন ঘুমিয়েছে কি-না। কিন্তু না খাটাশ ব্যাটা বিছানায় পা মেলে কোলে ল্যাপটপ নিয়ে আরামসে নিজের কাজ করে চলেছে। মনে মনে এইবার তাকেও বকা দিতে লাগলাম। হঠাৎই রোয়েনের কন্ঠ কানে ভেসে আসে,
— আমাকে এত না বকে রুমে এসে ঘুমিয়ে গেলেই পারো। আমি ভ্যাম্পায়ার নাকি যম্বি যে তুমি রুমে আসলে তোমার উপর হামলে পড়বো।
কথাটা শোনার সাথে সাথে আমি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবতে থাকি, “এই ব্যাটা আমার উপস্থিতি বুঝলো কিভাবে? তার উপর বুঝলো কিভাবে আমি তাকে মনে মনে বকাও দিচ্ছি? হাও? ” কথাগুলো ভেবে চারপাশে তাকাতেই দেখি ডায়নিং এর লাইট এখনো অন৷ আর সেই লাইট আমার পিছে হওয়ায় দরজার সামনে আমার ছায়া এসে পড়ছে। নিশ্চিত সে আমার ছায়া দেখে নিয়েছে৷ তার যা দৃষ্টি। মাশাআল্লাহ। আমি আর কিছু না ভেবে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই রুমের দিকে। রুমে এসে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখি রোয়েন নির্বিকার ভঙ্গিতে ল্যাপটপে কাজ করেই চলেছে। আমি চুপচাপ গিয়ে তার পাশে পিঠ করে শুয়ে পড়লাম। টু শব্দ পর্যন্ত করলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েন বলে উঠেন,
— ফিল ফ্রি! আমি কিছু মনে করেনি।
কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। অতঃপর বিনয়ী সুরে বলি,
— থেংক ইউ! থেংক ইউ ফোর এভ্রিথিং।
প্রত্যুত্তরে সে বললেন,
— ঘুমাও রাত হয়েছে।
____________________
ভর্তির সকল কার্যক্রম প্রায় শেষ। এখন একদম নিশ্চিন্ত। না আছে পড়ালেখা প্যারা আর না আছে এডমিশনের প্যারা। আমি এখন একদম স্বাধীন। কিন্তু করার মত কিছুই নেই। মা চলে গিয়েছে সেই কবে৷ সারাদিন বাসায় এখন আমি আর পলি আন্টি। সন্ধ্যার পরে দেখা মিলে রোয়েনের। তাও বেশির ভাগ সে পড়ে থাকে ল্যাপটপ বা ফোনের মাঝে। এখন তো এই ল্যাপটপ আর মোবাইলকে নিজের সতীন মনে হয়। এমন একটা মনোভাব আসে যেন আমি দুই সতীনের মাঝে তৃতীয় পক্ষ হয়ে সংসার করছি। বিষয়টা সাংঘাতিক না? অবশ্যই সাংঘাতিক বিষয়।হুহ!
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধ বাতাসের হিম শীতল ছোঁয়া উপভোগ করছি। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উঁড়চ্ছে অবাদ্ধ চুলগুলো। বারান্দার সিকের মাঝ দিয়ে এলোমেলো ভাবে প্রবেশ করছে জ্যাৎস্নার নরম আলোর। যার এক ভাগ এসে পড়েছে আমার মুখের উপর। আমিও তা নিভৃতে পরম যত্নে নিজের গায়ে মেখে নিচ্ছি। নাকে এসে বারি খাচ্ছে কেমন এক গাছালি গন্ধ৷ বেশ লাগছে পরিবেশটা আজ। বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে আমি চোখ পেলে তাকাই। রোয়েনকে দেখে ছোট একটা সৌজন্যমূলক হাসি দেই। সে একপলক আমার দিকে চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলে,
— ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রেখো। পরশু আমরা সাজেক যাচ্ছি।
#চলবে
আমি হয়তো বেশ কিছুদিন নিয়মিতভাবে গল্প দিতে পারবো না। আর দিলেও বড় করে দেওয়া সম্ভব হবে না। কালকে থেকে আবার আমার এভুলেশন এক্সাম শুরু। যার ফলে পড়ার চাপটা এখন বেশি। আশা করি বুঝবেন।
আর গল্পের মাঝে থাকা ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন। এতে আমি উপকৃত হবো।