#নিভৃতে_যতনে Part_22
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ তাকিয়ে আছি ধূসর রাঙ্গা আকাশে দিকে। আকাশের বুকে ভীড় করেছে একরাশ বিষন্নতা। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে এলোমেলো হয়ে উড়ে চলেছে আমার অবাদ্ধ চুলগুলো। আমি স্বযত্নে সেগুলো আগলে কানে পিঠে গুঁজে দিচ্ছি। মনের দুয়ারে বার বার উঁকি দিচ্ছে কংলাক ঝর্ণার স্মৃতিগুলো। তখন রোয়েনের কথার পিঠে আমি কিছু বলতে পারি নি। বরং লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ সেখানে ছিলাম নতজানু হয়েছিলাম। লজ্জায় আর আড়ষ্টতার প্রবলে তার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক চোখে চোখও রাখতে পারি নি আমি। বস্তুত, তার সাথে থাকাকালীন আমার লজ্জা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এত লজ্জা কোথা থেকে আসে আল্লাহই জানে। এই যে এখনো তার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছি। চোখে-মুখে ছেঁয়ে আছে রক্তিম লালাভ আভা। মনের ভিতর বইছে ভালোলাগা হাওয়া। মনের অজান্তেই জন্ম নিচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির অজস্র কণা। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেই। বিষন্ন প্রকৃতির দিকে চোখ যেতেই দৃষ্টি স্থির হয় আমার। আনমনেই গুনগুন করতে থাকি,
“এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?”
ক্ষণেই পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আমি গান গাওয়া বন্ধ করে দেই৷ তৎক্ষনাৎ পিছে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কাঙ্ক্ষিত চেহেরাটি। তাঁর শ্যামবর্ণ মুখশ্রী আজ দেখতে বড্ড সরল। চুলগুলো বাতাসের দোলে দুলতে দুলতে কপালে এসে পড়েছে। তাঁর অদ্ভুত নয়ন দুইটি আমাতেই নিবদ্ধ। আকস্মিকভাবে চারটি চোখ এক হতেই আমি দৃষ্টি সরিয়ে নেই। নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁর এই চোখে তাকানোর শক্তি আমার নেই। রোয়েন ধীর পায়ে আমার দিকে আসে। আমার পাশে এসে একটু বেঁকে কাঠের রেলিং এর উপর দুই হাত রেখে নিজের ভর ছেড়ে দেন। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলেন,
— গান আর কথা কখনো অসম্পূর্ণ রাখতে নেই। এতে অতৃপ্তি ছাড়া কিছুই মিলে না।
কথাটা শোনে আমি রোয়েনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলি,
— না মানে..
আমার কথার মাঝে তিনি ফোঁড়ন দিয়ে বলে উঠেন,
— আমার সামনে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যেমন তেমনই থাকো। আমাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না দেখে বন্ধুর চোখে দেখো। দেখবে সম্পর্কটা দুইজনের কাছেই সহজ হয়ে যাবে।
আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে সরু হাসির রেখা টেনে বলি,
— আর আপনি গুটিয়ে থাকলে বুঝি সম্পর্ক সহজ হবে? ফ্রি হতে হলে দুইজনকেই হতে হবে। একা আমি আর কত দূর এগুতে পারবো? আপনাকেও তো ফ্রি হতে হবে নাকি?
রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— চেষ্টা তো করছি এই।
— আন্ডা করচ্ছেন! একে চেষ্টা করা বলে? হুহ! আমাকে যা বললেন তা নিজের উপরও এপ্লাই করুন মিস্টার। বন্ধুত্বটা শুধু আমার দিক দিয়ে হবে কেন? দুইজনের দিক দিয়েই হতে হবে।
আমার কথাগুলো শুনে রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর হালকা হেসে বলে,
— আচ্ছা।
তাঁর হাসি চোখে পড়তেই আমি স্থির হয়ে যাই। কি স্নিগ্ধ তাঁর হাসি। হালকা হাসির মাঝেও তাঁর গজদাঁত প্রদর্শিত। যা তার হাসির মাধুর্যতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমি কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকাই। মানুষটিকে পূর্ণভাবে দেখার অধিকার আমার আছে কিন্তু তাও কোথাও যে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। যা ক্ষণেই আমায় দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য করে। কিছুক্ষণ বাদেই কানে ভেসে আসে অনুভূতিপ্রবণ কিছু টুকরো টুকরো বাক্য,
— আকাশটা আজ বিষন্ন যে,
মেঘ করেছে কালো-
বিষন্নতায় মন ভরেছে
ক্যামনে লাগে ভালো?
কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে চকিতে চাই। রোয়েনের এই রুপ থেকে সম্পূর্ণভাবে অবগত আমি। তিনি আকাশের পানে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বলেন,
– যার মিষ্টি কন্ঠে এতক্ষণ কাটছিল বিষন্নতা সে কি পারে না কাটাতে সম্পূর্ণ বিষন্নতা?
আমি রোয়েনের কথা অর্থ বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মানুষটার আবদার করার ধরণও নিরালা। আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়ে গলা ঝেড়ে গানের সুর তুলে বিষন্নতাকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানাই।
____________________
আজ সাজেকে আমাদের শেষ দিন। কাল ভোরেই রওনা দিবো আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে। পুনরায় সকলের পায়েই লেগে যাবে যান্ত্রিক জীবনের শিকল। ব্যস্ততায় ঢুবে যাবে সকলে। তাই সকলেই আজকের দিনটা মন খুলে উপভোগ করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতির এক অপার ক্ষমতা হলো সে নিমিষেই সকলের ক্লান্তি চুষে নিয়ে উপহার দিতে পারে এক ঝাঁক প্রশান্তি। মানসিক প্রশান্তি৷ যা মানুষকে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার শক্তি দেয়।
আজ আমাদের শেষ গন্তব্য হলো কংলাক পাহাড়। উঁচু ঢালের উঁচু-নিচু এঁকেবেঁকে যাওয়া পথের শেষ সীমানায় এর আসল সৌন্দর্য নিহিত। আর সেই সৌন্দর্য দেখার লোভেই ছুটেছি আমরা সকলে। হাতে এক মাঝারি সাইজের কচি বাঁশ নিয়ে যে যার মত উপরের দিকে উঠে চলেছি। অনেকে আবার একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিয়ে পানি পান করছে তো কেউ মুঠোফোনে এই সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বন্দী করছে। আমিও হাতে মুঠোফোন নিয়ে হাতের তর্জনী দিয়ে সমানতালে তুলে চলেছি নির্মল প্রকৃতির ছবি। নিজেকে এই প্রকৃতির মাঝে বন্দী করার চেয়ে প্রকৃতিকে নিজের কাছে বন্দী করতে চাইছি। আমি প্রকৃতির মাঝে এতটাই বিভোর ছিলাম যে কখন আমার শুভ্র রঙ্গের ওড়নাটি মাটির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজের রঙ বদল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তা টেরই পাইনি। হঠাৎ ওড়নায় টান পড়তে স্থির হয়ে যাই আমি। এক হাত দিয়ে নিজের ওড়না টেনে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে পুছে তাকাতেই দিকে রোয়েনের হাতের ভাজে আমার ওড়নার এক অংশ৷ আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বলে উঠেন,
— ওড়নাও ঠিক মত সামলাতে পারো না। ডাফার!
কথাটা বলেই তিনি নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে স্বযত্নে আমার ওড়নার এক অংশে লেগে থাকা ময়লাগুলো পরিষ্কার করে দিতে থাকেন। যা দেখা মাত্র মুহূর্তেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। কখন যে নিজের অজান্তেই মুঠোফোনটি উঁচু করে দৃশ্যটি এর মাঝে বন্দী করে ফেলি কে জানে? রোয়েন নিজের কাজ শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— ওড়না ঠিক করে নাও।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা দুলিয়ে ওড়নাটা টেনে নেই। আশেপাশে চোখ যেতেই দেখি অনেকেই আমাদের দেখে মিটিমিটি করে হাসছে। দূরেই কিছু মেয়ে রোয়েনকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গীকে শাসানো ভঙ্গিতে কিছু একটা বলছে। বিষয়টা যেন আমার মধ্যে এক গৌরবময় আনন্দ বয়ে আনছে। আমি ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে পড়ে রক্তজবার একটি গাছ। যাতে ফুটে আছে রক্তিম লাল জবার দল। আমি সেদিকে কিছু প্রহর তাকিয়ে থেকে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে মিইয়ে গলায় বলি,
— শুনেন!
রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি আড়ষ্ট কন্ঠে বলি,
— ওইখান থেকে কি একটা জবাফুল নেওয়া যাবে?
কথাটা বলেই আমি হাতের তর্জনী দিয়ে সেদিকে ইশারা করলাম। রোয়েন আমার হাতের তর্জনীর দিকটার অনুসরণ সামনে তাকিয়ে অকপটে বলেন,
— না।
কথাটা বলে তিনি আমার দিকে তাকান। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,
— প্রকৃতির সৌন্দর্য হরণ করা অন্যায়। যেখানে যার থাকা উচিৎ সেখানেই তাকে মানায় বেশি।
কথা কর্ণপাত হওয়া মত আমার চোখ-মুখে ছেঁয়ে যায় কালো মেঘ। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। অতঃপর বিরতি শেষে সকলের সাথে পুনরায় হাটা শুরু করি। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর হাতে টান অনুভব করি। আমি পিছে ঘুরে তাকিয়ে রোয়েনকে দেখতে পেয়ে বলি,
— কি হয়েছে?
রোয়েন কিছু না বলে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ান। অতঃপর কিছু বুঝার আগেই তাঁর হাতে থাকা রক্তজবাটি খুবই সপ্তপর্ণে আমার কানে গুঁজে দেন তিনি। সাথে সাথে আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি৷ তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হালকা হেসে বলেন,
— তাঁর মুখে এই মিষ্টি হাসিটা ফুটাতে মাঝেমধ্যে এমন অন্যায় করতে দোষ নেই।
___________________
কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়াতেই এক ঝাঁক শীতল বায়ুর দল ছুঁয়ে দিল মন। উপরে প্রগাঢ় নীলাভ আকাশ আর নিচে উঁচু নিচু ছোট বড় পাহাড়ের সারি প্রিয় সবুজ চাদরে মোড়ানো। তাদের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘবালিকাদের দল। মেঘদলের উপরে হাসছে সূর্য। রোদ ঠিকরে পড়ছে মেঘের গায়ে। কি অপরুপ সেই সৌন্দর্য। সকলেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত তখন রোয়েন আমায় নিয়ে বসে আছে টঙ ঘরের ছাওনিতে। দুইজনের হাতেই বেম্বো টি। সরু বাঁশের নলের ভিতর আসে এই চা। দেখতে আকর্ষণীয় হলেও স্বাদ অন্যান্য সাধারণ চায়ের মতই। চা খাওয়া শেষে রোয়েন নিয়ে আসে এক হালি পেয়ারা। আমাকে দুটো দিয়ে বাকি দুটো উনি নিয়ে নেন। আমি একটা পেয়ারে নিয়ে কামড় দিতেই দেখি পেয়ারার ভিতরে অংশ সম্পূর্ণ গোলাপি। দৃশ্যটি দেখামাত্র আমি ভড়কে যাই। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করি,
— এমন কেন এইটা?
রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,
— এইগুলো এমনই হয়। তাই এত ভাবার কিছু নেই।
কথাটা বলে তিনি পেয়ারা খাওয়ায় মন দিলেন। আমিও আর কিছু না বলে আমার হাতে থাকা পেয়ারায় কামড় বসাই।
________________________
ভোর হতে না হতেই আমরা রওনা দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। তাও সকাল প্রায় নয়টার বেশি বেজে যায় খাগড়াছড়ি আসতে। খাগড়াছড়ি এসে আমার সকালের নাস্তাটা শেষ করেই উঠে পড়ি বাসে। বাস চলছে আপন গতিতে। বাসের মধ্যে চলছে হৈচৈ। নীলয় নামের ছেলেটি হাতে গিটার। সে হাতের তর্জনী তুলছে সুর। তারই সাথে কয়েক জোড়া পুরুষালী আর মেয়েলী কন্ঠ একত্রি হয়ে গাইছে গান। বাতাসে ভাসছি সেই গানের সুর।
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
আমার মনের ঘরে চাঁন্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে”
গানটা কেন জানি না কিন্তু আমার বুকে গিয়ে বিঁধছিল। গানের প্রত্যেকটা লাইন সপ্তপর্ণে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমার মন ও হৃদয়। ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ ঘোর থেকে বেরুতেই আমি রোয়েনের দিকে দৃষ্টি স্থির করি৷ তখন কর্ণধারে ভেসে আসে দ্বিতীয় সুর,
” দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন তো আর মানে না
কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসোরে বন্ধু আমায় যতনে”
ক্ষণেই রোয়েনের দৃষ্টি স্থির হয় আমার মাঝে। চার চোখ এক হতেই আমি প্রত্যেকবারের মত দৃষ্টি সরিয়ে নেই৷ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই আকাশের পানে। কেন না তাঁর সেই নয়ন যুগলে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা আমার নেই। একদম নেই!
#চলবে
এখন থেকে রেগুলার উপন্যাসটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।