#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০৯

0
1050

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০৯

#মিদহাদ_আহমদ

আমার ননদ অন্য ছেলের সাথে রাত কাটাবে, আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো যেনো এইটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি। বাসার কাওকে যেনো না জানাই। আর কোণে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেলো আসিফ। আমি রুমে যেতেই আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি মাকে জানিয়েছিলে এই কথাগুলো?’

‘হুম’

‘তারপর মা কী বললো?’

‘মা বলেছেন যে আমি এসব মিথ্যাচার করছি।’

‘হুয়াট? আর ইউ সিরিয়াস? তুমি সত্যি বলছো?’

‘আমি মিথ্যা বলি না।’

‘তারমানে মা এসব জেনেও এসবে সায় দিচ্ছে?’

আমি নীরবে থাকলাম। এবার আর জবাব দিলাম না আসিফকে। ননাস এসে ডাক দিয়ে বললো,

‘ইফতারের সময় হয়ে গিয়েছে। বাইরে আসো এবার রুম থেকে। লোকজন সবাই বলাবলি করছে যে নতুন বউ কোথায়। আর আসিফ, তুই তো ইফতার করবি না সবার সাথে। অন্তত সিগারেট টিগারেট এখন ধরাস না। লোকের অসুবিধা হবে।’

আমাকে ধরে নিয়ে গেলো আমার ননাস। ডায়নিং রুমে সব সাজানো গোছানো আগেই। হুট করে কোথা থেকে আমার খালাশাশুড়ির জাল আমার শাশুড়িকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এই টেবিল এসেছে বুঝি? আজকালকার দিনে গ্লাসের টেবিলের চল। এই কাঠের টপ ওয়ালা টেবিল এখনও কেউ তার বোন ভাগ্নিকে দেয় বিয়েতে?’

আমার শাশুড়ি দেখলাম হাসতে হাসতে জবাব দিলেন,

‘আরে না। এসব তারা দিয়েছে জোরেই। আমরা আনতে চাইনি। আমাদের ঘরে কম আছে নাকি? ডায়নিং রুমে একসাথে বিশ চেয়ারের ডায়নিং টেবিল আপনি কয় বাসায় দেখেছেন? বসেন বসেন। ইফতারের সময় হয়ে গেলো।’

ওনাকে বসাতে বসাতে আমার কাছাকাছি এসে শাশুড়ি আমাকে কানে কানে বললেন,

‘ছোটলোকের মেয়ে, মাথার ঘোমটা একটু টেনে সামনে আনো। দেখছো আমার সব জায়গায় বেইজ্জতি হতে হচ্ছে তোমার জন্য।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সব আয়োজন শেষ হলো। বাসার ছাদে সব পুরুষ মেহমানরা আছেন৷ আমার বাবাও সেখানে আছে। ইমাম সাহেব এসে দোয়ায় বসলেন। আজান দিয়ে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমিও টেবিলের এক কোণে বসা আছি সবার সাথে। হুট করে খেয়াল করলাম এমন সময়ে আসিফ তার রুম থেকে বের হয়ে এলো৷ তার পরনে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। আমার চোখ যেনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসলো। একী দেখছি আমি! যে আসিফকে আমি আজ পর্যন্ত পরিবারের কারো সাথে খেতে দেখিনি সেই আসিফ আজ বের হয়েছে রুম থেকে? তাও টু-কোয়ার্টার ছাড়া? পাঞ্জাবি পরে?
এই মানুষটাকে এভাবে আমি দেখিনি কখনো। লম্বা ছিমছাম দেহ, গালভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, মাথার লম্বা চুল, গালের টোল আর মুখে লাগা হাসি, টানটান চোখের আসিফকে দেখতে কোন অংশেই কোন রাজকুমারের চেয়ে কম লাগছে না। সব সময় সেন্ডু গেঞ্জি পরা থাকে তাই তার মাসল দেখা গেলেও ওভাবে চোখে পড়েনি আমার। এখন পাঞ্জাবির ভেতর থেকে তার পেটানো বড় মাসল যেনো আরও আকর্ষণীয় হয়ে বের হয়ে এসেছে। আমি আমার জীবনে এমন সুন্দর পুরুষ আর দ্বিতীয়টা দেখিনি। আমাদের সামনে দিয়েই আসিফ দরজা খুলে ছাদের দিকে গেলো৷ মানে সে সবার সাথে বসে ইফতার করবে! আমার ভেতরের আনন্দ আর দেখে কে। আমি যারপরনাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। আজান দিয়ে দিলো মসজিদে। খেজুর আর পানি খেয়ে আমি রোজা ভাঙ্গলাম। ননাস বললো

‘নুপুর বন প্লেইট নিয়ে আসো তো কয়েকটা। এখানে নাই দেখছি।’

ইফতার রেখে আমি উঠে গেলাম বন প্লেইট আনতে৷ প্লেইটের পোলাও যেনো আমার দিকে মুখিয়ে আছে তার পরও আর মুখে তুলতে পারলাম না৷ মিনিট দুয়েক পর এসে বসতেই আমার শাশুড়ি নাকি গলায় বলাবলি করতে লাগলেন,

‘ওসব মাল্টা মনে হয় পুরানা অনেক দিনের। কেমন জানি একটা ঝাঝালো গন্ধ বের হচ্ছে! আপেলেও স্বাদ নাই৷ জানি না ওসব কোথা থেকে যে কিনে এনেছে ওর বাবা!’

টেবিল ভর্তি সবার সামনে শাশুড়ি আমার বাবার বাড়ি থেকে আসা ইফতারির অপমান করলেন। আমার আর খাবার রুচি রইলো না। পাশ থেকে ননদ কানে কানে বললো

‘কী? মানুষ সামনে বসা। খাবার খাও। নাহলে সবাই অন্যকিছু ভাববে। এসব কেন করছো তুমি? তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই ভাবি?’

তামান্নার কথা শুনে বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো আমি পোলাও গিলতে লাগলাম৷ ইফতার শেষ করে উঠার সময়ে শাশুড়ি বললেন,

‘নুপুর, নামাজ পড়ে চা বানিয়ে নিও। সবাই অপেক্ষা করবে।’

‘আচ্ছা।’

আমি চলে এলাম। রুমে এসে দেখলাম আসিফ চলে এসেছে। কাপড় চেইঞ্জ না করেই একটা সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় বসে বসে ধূয়া ছাড়ছে। আমি আসিফকে বললাম,

‘তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লেগেছে। আর থ্যাঙ্কিউ সবার সাথে বসে ইফতার করার জন্য।’

আমার কথা আসিফ শুনলো ঠিকই কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আশা করেছিলাম হয়তো একটা হাসি মুখে এনে ধন্যবাদ জানাবে। কখনো দেখিনি মানুষটার হাসি দেখতে কেমন লাগে!

নামাজ পড়েই রান্নাঘরে গিয়ে চা বানালাম ত্রিশ কাপ। সবাইকে চা দিতে গেলাম। ইতোমধ্যে দেখলাম তামান্না রেডি হয়ে আছে। শাশুড়িকে বলে সে বাইরে যাচ্ছে। আমি সবার সামনে সাহস নিয়ে তামান্নাকে বললাম,

‘কোথায় যাচ্ছো এখন? মাত্রই না ইফতার শেষ হলো?’

খেয়াল করলাম তথমথ খাওয়া আমার ননদের চোখ মুখ থেকে যেনো আগুন ঝরছে। আমি সাহস করে বললাম

‘চা হয়ে গিয়েছে তামান্না। চা খেয়ে যাও।’

বাসাভর্তি লোকের সামনে কিছু বলতে পারলো না সে আমাকে। তবুও অপারগ হয়ে বসলো টেবিলে। আমি হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য তাকে আটকাতে পেরেছি। কিন্তু বাইরে যাওয়া থেকে? ভেতরে ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, মা হয়ে নিজের মেয়েকে এভাবে একা খারাপ পথে যাচ্ছে যেনেও কীভাবে কেউ ছেড়ে দেয়? মানুষ কীভাবে পারে এসব?

চা খেয়েই তামান্না বাইরে চলে গেলো। আমি রুমে এলাম। আসিফকে বললাম,

‘তামান্না বাইরে চলে গিয়েছে। তুমি কি এবারও কোনকিছু বলবে না? আমি নাহয় মাকে বলে বুঝাতে পারলাম না। তুমি? তুমি অন্তত বলতে একবার। ও তোমার বোন হয় না?’

আমার কথাগুলোর কোন প্রভাব আসিফের উপর পড়লো না। সে আরেকটা সিগারেট ধরালো। বারান্দায় গিয়ে গিটার হাতে নিলো। গিটারের সুরে সুরে গান তুললো,

বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে
সইগো বসন্ত বাতাসে

***

মন নিলো তার বাঁশির সুরে, রূপে নিলো আঁখি
তাইতো বাউলা আবদুল করিম আশায় চেয়ে থাকি
সইগো বসন্ত বাতাসে।।

আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনলাম আসিফের গান। তারপর পাশে গিয়ে বললাম,

‘কী? নিজের বোনের বিষয়ে যে বলছি…’

আসিফ এবার উঠে গেলো। আমাকে বললো,

‘আমি দেখছি। বাসায় মেহমান সব চলে গেলে আমি কথা বলছি মায়ের সাথে।

‘কিন্তু ততক্ষণে যদি…’

‘ততক্ষণে যদি কী? যদি কিছু হয়ে যায় তো হয়ে যাক’

আসিফের এই কথাটা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে নিজের বোনকে নিয়ে এমন বলার প্রশ্নই আসে না। আমার ভাবুক মন নিজেকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে তুললো।

ঘন্টা দুয়েক পর। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। ডায়নিং রুমে চিল্লাচিল্লি শুনে আমি বেরিয়ে এলাম। এসে দেখি মা ছেলের সে কী যুদ্ধ! যেনো এক মহাযুদ্ধ হতে চলেছে। শাশুড়ি সমানে বলছেন,

‘বউ শিখিয়ে দিয়েছে না? এখন এসব বউ করতে বলেছে তাইতো? আমার মেয়ের উপর তুই কোন সাহসে এসব বলছিস? আরে ও তোর বোন না? একটা বাইরের মেয়ে বলে দিলো আর তুই মেনে নিলি এসব?’

আসিফ তার মায়ের কথায় ধরল। বলল,

‘বাইরের মেয়ে মানে? কে বাইরের মেয়ে? ও? নুপুর? নুপুর বাইরের মেয়ে? তাহলে কেন ওকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছিলে আমার সাথে? কেন? জবাব দাও।’

শাশুড়ি চুপ করে গেলেন। আমাকে হাতে ধরে সামনে নিয়ে এলো আসিফ। আবার বলতে লাগলো,

‘কে ও? কে?’

এবার তেড়ে সামনে এলো আমার ননাস। সে বললো,

‘তুই বড় মাতব্বরি করতে এসেছিস এখন! এত জীবন তো এসবে কোন খেয়াল ছিলো না। তাহলে আজ কেন এতো দরদ উতলে উঠছে বোনের জন্য? এতদিন কি বোন ছিলো না?’

ননাস তারপর আমার দিকে তাকালো। আবার বললো,

‘ওই মেয়েটাই তো মাথা খেয়েছে। তাইনা? সব ওই নষ্টের মূলে গরীব ঘরের মেয়েটা।’

আসিফ চিৎকার করে উঠলো। হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসের স্ট্যান্ড ফেলে দিলো নিচে। তারপর রুম থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে এসে বললো,

‘কই গিয়েছে তোমার বোন? আমাকে নিয়ে চলো। বান্ধবীর বাসায়? ওকে কোথায় লোকেশন আমাকে বলো আপা।’

ননাস এবার বললো,

‘সব বললো। তবে শুনে রাখ আসিফ, আজ যদি তুই মিথ্যা হোস, তোর বউয়ের লাগানো এই কথাটা মিথ্যা হয় তাহলে এর পরিণাম কী হবে?’

শাশুড়িও জিজ্ঞেস করে বসলেন তার ছেলেকে,

‘কী হবে এর পরিণাম?’

‘পরিণাম?’

‘হ্যাঁ।’

‘যদি নুপুর মিথ্যা হয়, তাহলে আমি নিজে গিয়ে একেবারে আজীবনের জন্য তাকে তার বাড়িতে রেখে আসবো। বলে দিলাম এই আমি। এবার বলো কোন ফ্রেন্ডের বাসায় তোমার তামান্না? আমাকে লোকেশন দাও। আর মা, আপা দুজন আসো আমার সাথে গাড়িতে। আর তোমাকে বলছি নুপুর, যদি আজ তোমার ধারণামতো কিছু না হয়ে থাকে, তাহলে এই পরিণতি তোমার ভালো হবে না। যেই রাস্তা দিয়ে এই ঘরে এসেছিলে, একেবারে সেই রাস্তা দিয়েই নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে।’

অনুমতি ছাড়া গল্প কপি করে অন্য কোথাও কেউ পোস্ট দিবেন না। গল্পটা সর্বপ্রথম আমার গ্রুপ midhad’s monograph এ প্রকাশ হয়। আর কোথাও গল্পটা সর্বপ্রথম পাওয়া যায় না৷ প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টায় গ্রুপে গল্প পোস্ট করা হয়৷ আপনারা গল্পটা শেয়ার দিতে পারেন৷ এতেকরে অন্যরাও পড়তে পারবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here