#আলো-আঁধার🖤পর্ব৬
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
৬.
দুইদিন যাবত রাণী খুবই ব্যস্ত ছিলো নিজের কাজে।এই দুইদিনে রাণীর অনেক ভালই ইনকাম হলো।কিন্তু হাতের ব্যথায় আগের তুলনায় কাজ একটু কম করেছে সে।তবে, তার সখীগণ মিলে সবাই সব কাজ ভালোভাবেই শেষ করেছে।আজ তাদের আর কোনো কাজ নেই।দুপুরের ভাত খেয়ে সবাই যার যার বিছানায় শুয়ে আছে।কেউ কেউ হয়তো ঘুমিয়েও আছে। রাণীর চোখে ঘুম নেই।এই দুইদিন যতবারই রাণীর হাতে জ্বালা করেছে, ততবারই তার তূর্যয়ের কথা মনে এসেছে। রাণী নিজেও জানেনা,এই দুইদিন সে কত বার তূর্যয়ের কথা মনে করেছে।এখনো সে তূর্যয়ের কথা ভেবে যাচ্ছে।রাণীর কাছে তূর্যয়কে এক বিরাট রহস্যের ভান্ডার মনে হয়।সেদিন রাণী তূর্যয়কে অনেক কথা শুনালেও রাণীর মনে এখন তূর্যয়ের জন্যে অনুশোচনা বোধ হচ্ছে।কারণ;তূর্যয় যদি অনেক বেশি খারাপ লোক হতো,তাহলে সে রাণীকে কখনোই সেদিন বাঁচাতো না।বরং সেই গভীর জঙ্গলে তাকে একাই রেখে আসতো।এমনটা ভাবতে আজও রাণীর মনটা নাড়া দিয়ে উঠলো।কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো,”উফ রাণী!কেনো ঐ মানুষটাকে নিয়ে এত ভাবছিস? ঐ তূর্যয় একটা খারাপ লোক।দেখলি না সেদিন,কিভাবে ঐ মহিলাদের মেরে দিলো চোখের সামনেই?তুইও না,মানুষের হালকা ভালো দিক দেখে তার বিশাল খারাপ দিকটা দেখতে ভুলেই যাচ্ছিস। ঐ সন্ত্রাসীর কথা ভুলে যা।দেখ গিয়ে,আজ কার না কার জান নিয়ে নিয়েছেন এই লোক!চুপচাপ শুয়ে থাক।মাথা থেকে ঐ সন্ত্রাসীর কথা একেবারে ফেলে দে।” নিজের মনে কথাগুলো ভেবে রাণী তার মাথায় অল্প চড় দিলো।চোখজোড়া তীব্রভাবে বন্ধ করে রাণী ঘুমানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু পরক্ষণে ফারিয়ার চিৎকার শুনে রাণী দ্রুত চোখ খুলে ফেললো।রাণীর কানে ফারিয়ার কথা স্পষ্টভাবে প্রবেশ করছে,”ওহো,ভালই হলো তূর্যয় এই লোককে মেরেছে।বড্ড শয়তান ছিল এই লোক।কতো মেয়ের জীবন যে নষ্ট করেছে এই লোক, আল্লাহ্ ভালো জানেন।যাক,শেষ পর্যন্ত দা গ্রেট তূর্যয় এই লোকের কাজ শেষ করে দিলো।” রাণী,কলি বিছানা থেকে উঠে ফারিয়ার কাছে গেলো।ফারিয়ার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে রাণী চোখ পাকিয়ে মোবাইলের মধ্যে চালুরত ভিডিও দেখতে লাগলো।যেখানে তূর্যয় কোনো এক লোককে সবার সামনেই মারধর করছে।এইসব দেখেও চারদিকের লোকজন কেউ সাহায্য করতে আসছে না তাদের।এই ভিডিও দেখে মুহুর্তেই রাণীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।রাণীর মাথায় আসে না,এই লোকের কি এইসব ছাড়া আর কাজ নেই?রাণী মোবাইল হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো,”যতোই আমার মন আপনাকে ভালো মানুষ মনে করুক না কেনো,আসলেই তো আপনি একটা খুনী,সন্ত্রাসী।মারপিট ছাড়াও তো সব কিছু সমাধান করা যায়, তাই না?”কিন্তু রাণীর মনোযোগ ভাঙলো অন্য লোকের কথায়।আবারও মোবাইলের দিকে তাকাতে রাণী দেখতে পেলো একটা লোক মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আছেন।নিচের দিকে লোকটির নাম দেখা যাচ্ছে “রিপোর্টার আতিক মাহমুদ”।লোকটি হাসিমুখে বলে উঠলো,”যতোই আতঙ্কের নাম তাশরীফ তূর্যয় হোক না কেনো,এমন কুলাঙ্গার দূর করতে এমন দুঃসাহসী তূর্যয়েরই দরকার ছিল।যদিও প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেছে এই বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া নবাবকে আয়ত্বে আনতে,কিন্তু কেনো সেটা অসম্ভব ছিল তা আমাদের কারোই অজানা নয়।যাক এই ব্যাপারটা এখানেই শেষ করছি।তবে একটা জিনিস নিশ্চিত হলো,এতদিনের এই বখাটের অত্যাচারে অতিষ্ট হওয়া মেয়েরা এখন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।আবেদীন কলেজ মোড় থেকে রিপোর্ট করছিলাম আমি, আতিক মাহমুদ।” ব্যস ভিডিও শেষ।রাণীর চোখ এখনো মোবাইলে আটকে রইলো।ফারিয়া আস্তে করে রাণীর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল।রাণী এখনো তার মনের সাথে পাল্লা দিয়ে নানান কথা ভেবে চলেছে।এর মধ্যেই কলি ফারিয়াকে বলতে লাগলো,”এই কি হয়েছে রে?” কলির প্রশ্নে ফারিয়া বলতে লাগলো,”আরে আপু,এই লোকটা বেশ শয়তান একটা লোক।মেয়েদের উত্যক্ত করা, সাথে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এর কাজ ছিল।তার পরিবারের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেনি।পুলিশও একবার তাকে গ্রেফতার করলেও,ক্ষমতার সাহায্য সে ছুটে আসতো জেল থেকে।তবে তার বেহায়াপনার লেভেল বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকেরা তূর্যয়ের কাছে নালিশ করে।আর তূর্যয় আবারও দেখিয়ে দিলো কিভাবে মাইরের সাহায্য শয়তান লোকদের বিনাশ করা যায়। আজকে তূর্যয়ের মারের পর সে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।বেশ ভালই করেছে তূর্যয়।” রাণী ফারিয়ার কথা মন দিয়ে শুনলো।যদিও ফারিয়ার কথা শুনে রাণীর মনে তূর্যয়ের ভালো গুণ ভেসে আসলেও,পরক্ষণে রাণী চিন্তা করলো,” লোকটাকে সবাই যেহুতু ভয় পায়,তাই ভয় দেখানোর মাধ্যমেই তো ঐ লুচ্চাকে ঠিক করা যেতো।কিন্তু না!উনার তো মারপিট না করলে পেটের ভাত হজম হয় না।অসহ্যকর।” নিজের মনে কথাগুলো বলে ফারিয়ার কথায় রাণী বলে উঠলো,” বিচার শুধু মারামারি করে করলে হয় না।বিচার করতে হলে সুষ্ঠুভাবে করতে হয়।আর তূর্যয় জাস্ট একটা সন্ত্রাসী।যে শুধু মারপিট করতেই জানে। এইখানে উনাকে বাহ্ বাহ্ দেওয়ার মতো কিছুই দেখছি না।” কলি রাণীর কথার উত্তরে বললো,”তুই কি পাগল হয়েছিস?তোর মতো মেয়ের মুখে এইসব কথা একদমই মানা যাচ্ছে না।যেখানে তুই জানিস, দোষ ঐ নিচু লোকটার।তারপরও তুই তূর্যয়কে কেন দোষ দিচ্ছিস?” রাণী নিজেও একটু আগে তার বলা কথায় অবাক হলো।কিন্তু পরক্ষণে তার মুখ আবারও বলতে শুরু করলো,” দেখ,কুকুর আমাদের কামড় দিলে আমরাও কি কুকুরকে কামড় দিতে পারবো?মোটেও না।তাই,গুন্ডার সাথে যে গুন্ডামি করতে হবে সেটাও তো ঠিক না।অবশ্য,তূর্যয় নামক লোকটা নিজেও এক বড় সন্ত্রাসী।” রাণীর কথায় সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।রাণী কেনো যেনো তূর্যয়ের এই মারপিট,খুন এই জিনিসটাই হজম করতে পারছে না।সবার অবাকের সীমা আরো চরম পর্যায়ে পৌঁছালো যখন সালেহার ঝাঁঝালো কণ্ঠ তারা শুনতে পেলো,”সমস্যা কি তোর রাণী?তূর্যয়কে বারবার সন্ত্রাসী কেন ডাকিস তুই?যেটা জানিস না সেটা নিয়ে বারবার কথা বলবি না।তূর্যয় কোনো পরিষ্কার কারণ ছাড়া কারো গায়ে হাত তুলে না।সবাই এখন তূর্যয়ের ব্যাপারে কোনো কথায় বলবে না।এই রুম থেকে আমি যেনো কোনো শব্দ না পায়।” কথাগুলো রাগী মাখা কন্ঠে বলে সালেহা চলে গেলো।কলি,ফারিয়া সবাই শুয়ে পড়লো নিজ জায়গায়।তবে রাণীর আর শোয়া হলো না।সালেহার কথা যেনো বড্ড কষ্ট দিলো রাণীকে।সালেহার কাছে রাণীর চেয়ে তূর্যয় যেনো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা মনে হলো রাণীর কাছে।অভিমানে রাণীর চোখজোড়া ভরে এলো।রাণী তো খারাপ কিছু বলেনি।শুধু শান্তির কথা বলেছে।কিন্তু না;রাণীর মনে হলো,সালেহার কাছে রাণীর শান্তির কথার চেয়ে তূর্যয়ের মারপিটের দাম অনেক বেশি। রাণী নিজের চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দিলো না।এর আগেই সে তার চোখ মুছে নিলো।আর মনে মনে ভাবতে লাগলো,”আজ থেকে আমি ঐ সন্ত্রাসীর কথা ভাববো না একদমই।কোনো দরকার নেই এই লোকের কথা চিন্তা করার। ঐ সন্ত্রাসীর যা ইচ্ছা তাই করুক।মানুষকে মারুক,কাটুক যা মন চাই তাই করুক,আমি আর কখনোই কিছু বলবো না এই সন্ত্রাসীর কথায়।” রাণী নিজের মনে কথাগুলো ভেবে চুপ করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।না চাইলেও এখনো রাণীর মনে তূর্যয়ের সেদিনের পাঞ্জাবি পড়া,আর ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখখানা বারবার আঁকিবুকি করছে।আর রাণী বারবার মুখ কুঁচকেচকে তূর্যয়কে “জাহিল,সন্ত্রাসী,
হিটলার” এইসব বলে বকে যাচ্ছে।
‘
মাঝখানে একটা বড় টেবিল।তার দুইপাশে বসে আছে দুই দলের লোক।এক দল হলো তূর্যয়ের,আরেক দল হলো অন্য এক বড় গ্যাংস্টার এর।অন্য দলটি অবশ্য অন্য জেলা থেকে এসেছে এইখানে তূর্যয়ের সাথে মিটিং করতে।কালো বাজারের বিখ্যাত দুই দল আজ মুখোমুখি হলো।তূর্যয় চেয়ারে স্থির হয়ে বসে আছে।আর চোখ বলছে অন্য কথা।তার চোখ আপাতত সামনে থাকা গ্যাংস্টার লিডার এর দিকে।তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে অন্য গ্যাংস্টার লিডার এর সহকারী একজন মেয়ে।মেয়েটির তীক্ষ্ণ নজর তূর্যয়ের বুকের উপর।সাদা শার্টের উপর কালো কোট পড়েছে তূর্যয়।শার্টের তিনটা বোতাম খোলা থাকায় নিঃসন্দেহে তূর্যয়ের বুক দেখা যাচ্ছে।হঠাৎ করে সামনের মেয়েটির দিকে নজর যেতেই তূর্যয়ের চোখে ভেসে এলো সেদিনের তার দিকে রাণীর নজরটা।তাকে ঘুম মনে করে রাণী কিসব বলেছে সবই এখন তার মনে আসছে।সাথে মনে আসছে তার, রাণীর নিষ্পাপ মুখখানা।তবে এই মেয়ের মুখে সে দেখতে পাচ্ছে এক প্রকার লালসা। ঐ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তূর্যয় সাথে সাথে নিজের গলায় জোরে আওয়াজ করলো রেগে। এতে মেয়েটি একটু আতংকিত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।তূর্যয় নিজের গলার চেইনে হাত দিয়ে সেটিকে একটু নাড়া চাড়া করে আবারও সামনের দিকে তাকালো সেই লোকের দিকে।মিটিং শুরু হতেই দুই পক্ষ নানান কথা বলতে লাগলো।মিটিং প্রায় শেষের দিকে।এর মধ্যেই অন্যপক্ষের লিডার হেসে তূর্যয়কে বললো,”আপনাদের মধ্যে একজনকে দেখতে পাচ্ছি না।উনি কি অসুস্থ?” লিডারের এমন কথা শুনে হ্যারি হেসে বললো,”হ্যাঁ,একটু বেশি সিক ছিল। সো,রাইট নাও সে এখন কবরে।” এমন কথা শুনে অন্য পক্ষের লিডারের মুখটা একেবারে আঁধারে ছেয়ে গেলো। সে ঐ মেয়েটার কানে কিছু বলতেই মেয়েটা মুহূর্তেই সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে পড়লো।কিন্তু মেয়েটির বাহিরে যাওয়া হলো না।এর আগেই তূর্যয় এর দলের লোকেরা মেয়েটিকে আটকে ফেললো।কিন্তু তূর্যয় ইশারা দিতেই মেয়েটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো।আর মেয়েটি নিজের পায়ের গতি বাড়িয়ে চলে যেয়ে লাগলো।তূর্যয় এইবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। কোটের খোলা বোতামে আঙ্গুল চালিয়ে দুইটি বোতাম লাগিয়ে নিল সে।এরপর টেবিলের উপর বসে বলতে লাগলো,”সতেরো কোটি পঞ্চান্ন লাখ তেষট্টি হাজার টাকার একটা ফাইল মিসিং আমার কালো বাজারির কোম্পানি থেকে।মিস্টার দুবিন,আপনার কাছে কি আমার এমন এমাউন্টের কোনো ফাইল গিয়েছে?” মিস্টার দুবিন নড়ে বসলো তূর্যয়ের কথায়। সে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,” নাহ।কি বলছেন এইসব?আমি কিভাবে আপনার ফাইল পাবো?” হ্যারি নিজের চেয়ার থেকে উঠে মিস্টার দুবিনের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললো,” নো মোর ড্রামা!আমরা সব জানি।তূর্যয় ব্রোকে সত্যি কথাটা বলে দিন।দেন,আপনার শাস্তি একটু কমতে পারে।” মিস্টার দুবিন মুখ না খুলে তার পাশের লোক জনদের কিছু ইশারা করলো।আর তারা কিছু অস্ত্র বের করার আগেই তূর্যয়ের দলের লোকেরা সবাই তাদের আটক করে নিল।তূর্যয়ের মুখে বাঁকা হাসি।সবটাই যেনো তার আগের জানা আছে।সবটাই যেনো সে আগে থেকে প্ল্যান করে রেখেছে। তূর্যয় বাঁকা হেসে মিস্টার দুবিনকে বললো,”আমার দলের কেউ একটু কম নিঃশ্বাস নিলেও সেটা আমার জানা হয়ে যায়।আর এইখানে তুই আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিস তাও আবার আমার লোক দিয়ে।হ্যারি বলেছিল তোকে প্রথমেই সত্যিটা বলতে। সত্যি বললে একটা চান্স দিতাম আমি তোকে।বাট, এখন নিজেই তুই নিজের আপদ টেনে এনেছিস।তূর্যয় কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না।” মিস্টার দুবিন কিছু বলতে নিলে,তূর্যয় তার দিকে গুলি তাক করলো।মিস্টার দুবিন মুখ খুলতে নিলেই তূর্যয়ের গুলির বুলেট ততক্ষণে মিস্টার দুবিনের কপাল ভেদ করলো।মিস্টার দুবিনের প্রাণ অতটুকুতেই শেষ।তূর্যয়ের কড়া কণ্ঠ এইবার আরো কড়া রূপ ধারণ করলো।তূর্যয়ের চিৎকারে সেই রুমের সবাই একদম চুপ হয়ে গেলো।অন্য দলের সবাই ভয়ে একেবারে চুপসে আছে।তূর্যয় নিজের মেজাজকে শান্ত করে চেয়ারে বসে পড়লো।তার সামনে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি নিয়ে নিজের মাথায় ঢেলে দিলো সে।এরপর নিজের চুলের উপর হাত বুলিয়ে নিয়ে হ্যারির দিকে তাকালো।সাথে সাথে হ্যারি অন্য দলের বাকিদের বলে উঠলো,”ইফ, অল অফ ইউ ওয়ান্ট টু সার্ভাইভ,দেন টেল আস দা ডিটেইলস অফ ইউর বস’স প্রপার্টি।নাহলে, সবার অবস্থা তোমাদের বসের মতোই হবে।” হ্যারির কথা শুনে সবাই চুপ করে গেলো।এটা দেখে তূর্যয় টেবিলের উপর জোরে একটা চড় দিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো,”আমার যতো না ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে হাজার ক্ষতি তোদের বসের হবে।আমি তাশরীফ তূর্যয়,আমার ক্ষতি করানোর চেষ্টা মানে নিজের জানের ক্ষতি করা।” তূর্যয়ের কথায় তাদের মধ্যে একজন লোক বলে উঠলো, “আমরা রাজি।সব ডিটেইলস দিতে রাজি।” তূর্যয়ের কুঞ্চিত ভ্রু এইবার সোজা করে নিল সে।হালকা হেসে বলে উঠলো,” হ্যারি কাজ সব দ্রুত হয়ে যাওয়া চাই।আমি এখন বেরুচ্ছি।মনি আমার অপেক্ষা করছে।” হ্যারি তার হাত উঁচু করে বলে উঠলো,”ওকে ব্রো।নিশ্চিন্তে যাও। এদের সামলানো আমার বাম হাতের খেলা।সি ইউ সুন,ব্রো।” হ্যারির কথায় তূর্যয় হাত দুলালো।এরপর সে নিজের কোট খুলে সেটি কাঁধের সাথে ঝুলিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। সাবিনা বাসায় না থাকায় এতদিন সে রাতে মনির রান্নায় খেয়েছে।তূর্যয় জানে,
আজও মনি তার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে।তাই সে তার আদরের বোনের সাথে রাতে খাওয়ার জন্যে দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
‘
মাটির নানান কাজে ডুবে রয়েছে রাণী।তার বেশ টাকা ইনকাম হচ্ছে।এই কারণে তার মনের আশা যেনো আরো বাড়তে লাগলো।এই কয়দিন সে একবারও এতিম খানা থেকে বাহির হয়নি।এতো কাজে ব্যস্ত থাকলেও তার মনে তূর্যয়ের কথাটা একবারের জন্যে হলেও ঘুরপাক খেয়েছে। রাণী নিজেও তূর্যয়ের রহস্যে ঘেরা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই প্রচন্ড।তবে রাণী নিজেও জানে না এই জনমে তার তূর্যয়ের জীবন সম্পর্কে জানা হবে কিনা।এইসব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিয়ে রাণী তার বানানো জিনিস খবরের কাগজে মোড়াতে গিয়ে দেখতে পেলো আজকের তারিখ।আজকের তারিখ দেখে তার মনে এলো, “আজ মে মাসের সাত তারিখ।তার মানে আজ ম্যাডামের জন্মদিন!আল্লাহ্,কাজের চাপে এইবার তো এই দিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।” রাণী দ্রুত পূর্বের ন্যায় অন্যদের সাথে পরামর্শ করে দ্রুত নাজিমের সাথে বেরিয়ে গেলো বাজার করতে।বাজারের ব্যাগ ধরে আগে হাঁটছে নাজিম।আর পিছে পিছে যাচ্ছে রাণী।দুইজনের হাতে দুটি ছাতা।আকাশে কালো মেঘ জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে।তাই সাবধানতার জন্যে ছাতা নিয়ে নিলো দুইজন।বাজারে গিয়ে রাণী তার ম্যাডামের পছন্দের খাবার আর কেক বানানোর জন্যে যতো রকম জিনিসের দরকার হয় সব নিয়ে নিল। নাজিম এক হাতে ছাতা নিয়ে অন্য হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগ নিলো।রাণী এইবার মাথায় ছাতা ধরে আগে আগে হাঁটছে।হঠাৎ করে রাণীর চোখ সামনে থমকে গেলো।দূরে কবরস্থানের সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে তার তূর্যয়ের মতো লাগছে।মোনাজাতের ভঙ্গিতে তূর্যয় দাঁড়িয়ে আছে।তার মাথার উপর অন্য একজন লোক ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।পাশে হ্যারিকে দেখে রাণী নিশ্চিত হলো, সেই লোক তূর্যয়।তূর্যয়কে দেখতে দেখতে রাণী কখন নিজেই তূর্যয়ের দিকে এগিয়ে গেলো এটা সে খেয়ালই করলো না। রাণীর বেখেয়ালি ভাবনার কারণে নাজিমের ডাক পর্যন্ত তার কানে প্রবেশ করলো না।তূর্যয় পেছনে ফিরতেই থমকে গেলো।কারণ, রাণীকে তার খুব কাছেই দেখতে পেলো সে।রাণীর ধ্যান এইখানে নেই,এটাও তূর্যয় ঠিক বুঝতে পারছে।তূর্যয় কিছু বলার আগে হ্যারি রাণীকে বলে উঠলো,”হেই বিউটিফুল, হাউ আর ইউ? জ্বর কমেছে?” হ্যারির কথায় রাণীর হুঁশ ফিরলো।সে চোখ পাকিয়ে একবার হ্যারিকে দেখছে আর আরেকবার দেখছে তূর্যয়কে।তূর্যয়কে কবরস্থানে দেখে রাণী যেনো তার নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেললো।হ্যারি রাণীর সামনে আবারও চুটকি বাজালে রাণী অস্থির হয়ে বলে উঠলো,”জ্বী।ঠিক আছি।আসলে আমি ভুলে এইদিকে চলে এসেছি।সরি।” রাণীর এমন অস্থির চোখজোড়া দেখে আবারও তূর্যয়কে যেনো তার অতীত নাড়া দিলো।রাণীর এই অস্থির চোখজোড়া খুব পরিচিত লাগছে তূর্যয়ের কাছে।কিন্তু, সে এখনো বুঝতে পারছে না।আসলে রাণীকে কবে সে কোথায় দেখেছিল!আপনা আপনি তূর্যয় রাণীকে বলে উঠলো,”কিছু বলতে চাস?” তূর্যয়ের এমন গম্ভীর কণ্ঠে শুনে রাণীর মনটা কাঁপতে লাগলো।রাণী মাথা নাড়িয়ে “না” বললো।এরমধ্যেই নাজিম ভয়ে ভয়ে রাণীকে তাড়া দিয়ে বললো,”চল না ভাই।এইখানে কি কাজ তোর!” তখনই খুব জোরে একটা গাড়ি বেগতিক ভাবে ছুটে আসলো কোথা থেকে।এমনটা দেখে তূর্যয় রাণীকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে নিলো।আর রাণী গিয়ে লেপটে গেলো তূর্যয়ের বুকে।রাণীর এমনিও এ’কদিন সব অদ্ভুত লাগছিল নিজের মনের কাজকর্ম।তার উপর এখন তূর্যয়ের এমন কান্ড দেখে তার মনটা আরো জোরে লাফালাফি করছে।তূর্যয়ের বুকের ধুকধুক আওয়াজটা রাণীর কানে স্পষ্ট আসছে।পরক্ষণে তূর্যয় নিজের বুক থেকে রাণীকে সরিয়ে নিয়ে হ্যারিকে বললো,”ফলো করো এই গাড়িকে।” হ্যারি তূর্যয়ের কথায় বলে উঠলো,” কুল ব্রো! ইটস জাস্ট এ ব্রেইক ফল, আই গেস।” তূর্যয় কোনো শব্দ করলো না।সে ভীতভাবে দাঁড়ানো রাণীকে প্রশ্ন করলো,”ঠিক আছিস?” রাণী বড় বড় চোখে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”জ্বী”। এরপরই সে নাজিমের হাত ধরে বলে উঠলো,”নাজিম ভাই,জলদি চলো।” কথাটা বলে ধপ ধপ পা ফেলে রাণী নাজিমের আগেই দৌড় দিয়ে চলে যাচ্ছে।আর রাণীর এমন কান্ড দেখে তূর্যয় বলে উঠলো,”এমন অদ্ভুত কেনো এই মেয়েটা?” হ্যারির কানে এই কথাটা যেতেই হ্যারি বলে উঠলো,”বাহ্!তুমি কোনো মেয়েকে লক্ষ্য করেছো তাহলে?দা গার্ল ইজ সো কিউট,জাস্ট লাইক ইউ ব্রো।” তূর্যয় চোখ রাঙালো হ্যারিকে,”আমি কিউট? ফ্রম হুইচ এঙ্গেল?আমাকে দেখলে ভালো ভালো মানুষ স্ট্রোক করে।আর তুমি বলছো আমি কিউট?আমি ডেঞ্জারাস, নট কিউট।”কথাগুলো বলে তূর্যয় তার গাড়িতে উঠে যাচ্ছে আর হ্যারি চিল্লিয়ে বলতে লাগলো, ” তুমি হট,কিউট,হ্যান্ডসাম সব,ব্রো।” হ্যারির এমন পাগলামো দেখে তূর্যয় হাসলো। গাড়িতে বসে সে হ্যারির অপেক্ষা করছে।রাণী তখন তার বুকের উপর পড়ার কারণে তার বুকে এক অদ্ভুত অনুভূতির আভাস পেলো সে।যে অনুভূতির কারণে এখনো তূর্যয়ের মন ধুকধুক করছে।সে তার আপন মনে বলে উঠলো,”স্টপ!” কিন্তু নাহ,
তূর্যয়ের মন তার কথা শুনলো না।তার মন এখনো রাণীর কথা ভেবে ধুকধুক করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে,একটু আগের গাড়িটা ছিল আহমেদ হকের।সাবিনার একমাত্র ছেলে সে।তূর্যয়ের সৎ ভাই।রাণীকে তূর্যয়ের বাঁচাতে দেখে আহমেদ যেনো একটা পরিকল্পনা এঁকে নিলো নিজের মাথায়।সে তার হাতে থাকা ড্রাগস সেবন করার আগেই তার ম্যানেজারকে বললো,” তূর্যয়ের প্রেমিকার সব ডিটেইলস আমার চাই।এতো বড় মাফিয়া প্রেম করছে আর আমরা জানি না!মেয়েটাকে দেখে তো ফকির মনে হলো।এমনি সুন্দর অ্যান্ড হট মেয়েটা। ঐ তূর্যয় যেমন ফকির তেমনি তার প্রেমিকাও ফকির।বাট,রাতের আঁধারে তো আমার শুধু মেয়েটাকে চায়।উফফ,বড্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে আমার।তূর্যয়ের প্রেমিকার তৃষ্ণা।” আহমেদের ম্যানেজার তার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,”পেয়ে যাবেন স্যার।আপনি আপাতত এই নিউ আইটেম ট্রাই করুন।” আহমেদ তার নাক দিয়ে তার হাতে থাকা ড্রাগস শুকতে লাগলো।একটু পরেই ধীরে ধীরে সে এক বদ্য উম্মাদে পরিনত হবে।
রাতের আঁধারে আকাশ ছেয়ে আছে।মধ্যরাতে প্রায় সবাই এখন ঘুমন্ত।তবে,ঘুম নেই তূর্যয় আর রাণীর চোখে।তূর্যয় বসে আছে আঁধারে, তার হাতে মদের গ্লাস নিয়ে।আর রাণী বসে আছে বুকে বালিশ জড়িয়ে।সালেহার জন্যে আয়োজিত বড় এক পার্টির, এতো খাটনির পরও রাণীর চোখে ঘুম নেই।আজ তাদের দুইজনের সাক্ষাৎ যেনো, তাদের রাতের ঘুমটাই কেড়ে নিয়েছে।তূর্যয় ভাবছে,”আমার আঁধার জীবনে কেনো ঐ মেয়ের বারবার আগমন হচ্ছে?আমার আঁধার জীবনের সাথে আমি আর কাউকে জড়াতে চাই না।কিন্তু এই মন আর মস্তিষ্ক কিছুতেই ঐ মেয়ের চোখ আর তার চোখের রহস্য আমাকে সেই মেয়ের কথা ভুলতে দিচ্ছে না।”আর রাণী ভাবছে,” এই সন্ত্রাসী,উফ না।এই তাশরীফ তূর্যয়ের দুইমুখো দিক আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে।এমন হিংস্র লোক আবার কবরস্থানে কার জন্যেই বা যায়?উনার এই হিংস্র রূপ আর এই রহস্যময় রূপ দুইটায় আমাকে উনার ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করছে।আজকের উনার সেই স্পর্শ যেনো এখনো আমার হাতে লেগে আছে।” রাণী নিজের হাত সামনে নিয়ে সেটি দেখতে লাগলো।রাত বাড়ছে, সাথে সময়ও।কিন্তু তূর্যয় আর রাণীর মনের ভাবনার শেষ যেনো হবে না আজ।
চলবে….
কপি করা নিষেধ।