#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ৩৬,৩৭

0
584

#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ৩৬,৩৭
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

(৩৬+৩৭)
তূর্যয় জগিংয়ে গিয়েছে।রাণী রান্নার কাজে ব্যস্ত। কাজের লোকেরা তারা নানান কাজ করে যাচ্ছে।রাণী চায়ের পাতিলে চিনি দিয়ে চামচের সাহায্যে অনবরত নাড়ছে।তার স্থির চোখজোড়া চায়ের পাতিলের দিকে আছে।কিন্তু মনটা যেনো অন্য কোথাও।রাণী আর তূর্যয়ের বিয়ের প্রায় পনেরো দিন কেটে গেলো।কিন্তু,
রাণী এখনো সালেহার কাহিনী আর তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যু রহস্যের অতি জরুরী কথাগুলো তূর্যয়কে বলতে পারলো না। বলবেই বা কিভাবে?তূর্যয় সদা ব্যস্ত থাকে।সারাদিন তার অফিসে কেটে যায়।সুযোগ পেলে সে বিকালে বা দুপুরে মাঝে মাঝে বাসায় আসে।নাহলে সেই যে সকালে বেরুই তূর্যয় একেবারে আসে রাতে।রাণী তার সময় কাটাতে বাড়িতে নিজের কাজকর্ম সেরে তার মাটির দোকানে গিয়ে ঘুরে আসে।অবশ্য এই ব্যাপারে তূর্যয়কে অনেক কষ্ট রাণী রাজি করিয়েছিল।নাহলে তূর্যয় কোনো কালেই রাণীকে দোকানে যেতে অনুমতি দিচ্ছিলো না।রাণীকে হ্যারি তার দোকানে দিয়ে আসার এবং নিয়ে আসার দায়িত্ব হ্যারিকে দিয়ে,তবেই তূর্যয় নিজের সিদ্ধান্ত বদলালো। এতে রাণী বেজায় খুশি,কারণ তার সারা দিনটা তো একটু আনন্দে কাটে!তাছাড়া দোকানের সামনেও কড়া সিকিউরিটি রাখা আছে।তাই ক্রেতারাও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে নিরাপত্তার।
কিন্তু,রাণীর মনে এখনো সালেহা আর তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যু রহস্যের কথা তূর্যয়কে জানাতে না পারার কষ্টটা থেকেই গেলো।

–“বৌমনি,চা তো পইড়া যাইতাছে।”
রুসার কথায় ধ্যান ভাঙলো রাণীর।পাতিলের দিকে তাকানো তার ঝাপসা চোখটা যেনো এখন পরিষ্কার হলো।দ্রুত চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে রাণী মলিন হাসলো রুসার দিকে তাকিয়ে,
–“আপনি চা ফ্লাস্কে ঢেলে রাখুন,রুসা খালা।আমি ভাজি গরম করে নিই।”
–“আইচ্ছা।”
রাণীর কথায় রুসা বলে উঠলো।
রাণী ফ্রিজ থেকে ভাজির পাতিল বের করে চুলার উপর রাখলো।অন্য পাশের চুলায় তূর্যয়ের জন্যে কফির পানি বসিয়ে দিলো।রাণীর চা পছন্দ আর তূর্যয়ের কফি।সেই হিসেবেই রাণী দুইজনের জন্যে আলাদা করেই সবকিছু তৈরি করে।আবারও অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করতে শুরু করলো সে।একটু পরেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলে রাণী তার চিন্তা জগৎ থেকে ফিরে এলো।রাণী সেদিকে এগিয়ে গেলো না।এই ঘরে বিপদজনক কোনো মানুষের প্রবেশ একেবারে অসম্ভব এটা রাণী বেশ জানে।একটু পরে একজন কাজের লোক এসে রাণীকে জানালো,
–“ম্যাডাম, একজন হুজুর আইছে সাথে একটা মাইয়্যা আইছে।”
রাণী নিজের হাত মুছে দ্রুত পায়ে লিভিংরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।হুজুর মানুষের কথা তার কানে যেতেই তার সর্বপ্রথম মাথায় এলো মোল্লা সাহেবের কথা।রাণীকে দেখে মোল্লা সাহেব নিজ থেকেই সালাম দিলো,
–“আসসালামুয়ালাইকুম,মা।কেমন আছিস?”
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম,মোল্লা সাহেব।এইতো আলহামদুলিল্লাহ্।আপনি কেমন আছেন?”
মোল্লা সাহেব বুকে হাত রেখে একটু হেলে বললো,
–“আল্লাহ্ রাখছে ভালই।তো মা,তূর্যয় কোথায়?”
মোল্লা সাহেবের কথা শুনার পাশাপাশি রাণী অপর সোফায় বসে থাকা একটা কিশোরী মেয়েকে দেখতে পেলো।ছিমছাম গঠনের মেয়েটার মুখে প্রফুল্লতায় ভরপুর।রাণী সেই মেয়ের থেকে নজর সরিয়ে মোল্লা সাহেবকে উত্তর দিলো,
–“উনি তো বাহিরে।আপনারা বসুন।তবে,এই মেয়েটিকে তো চিনলাম না।”
মোল্লা সাহেব চাপা হাসলেন,
–“তূর্যয় আসলে বলবে তোকে।”
রাণী মাথা নেড়ে সোফায় বসলো।মেয়েটা থেকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা তার নাম “হায়া” বললো।রাণীর “হায়া” নামটি বেশ পছন্দ হয়েছে।মেয়েটির সাথে রাণী একটু কথা বলেই বুঝতে পারলো হায়া বেশ মিশুক প্রকৃতির একটা মেয়ে।একটু পরে তূর্যয় লিভিং রুমে আসলো।তার মুখে রাগ স্পষ্ট।রাণী তূর্যয়কে দেখে ভেতরে গিয়ে তূর্যয়ের প্রোটিন শেইক নিয়ে তার হাতে দিলো।ততক্ষণে মোল্লা সাহেব আর তূর্যয় কথায় মগ্ন হয়ে গিয়েছে।রাণী তূর্যয়ের পাশে বসে তাদের কথা বুঝার চেষ্টা করছে।মোল্লা সাহেব তার ছোট ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে তূর্যয়কে দিয়ে বললো,
–“এই নে,এইখানে রাণীর এতিমখানার ছাড়পত্র আছে।”
তূর্যয় হাতে নিয়ে কাগজগুলো চেক করলো।রাণী এখনো জানেনা “হায়া” কেনো এসেছে এই বাসায়। তবে রাণীকে আর বেশি কিছু চিন্তা করতে হলো না এর আগেই তূর্যয় রাণীকে বললো,
–“এই মেয়েটা আজকে থেকে এইখানে থাকবে।সারাদিন একাই থাকো।তাছাড়া কেউ একজন তোমার সাথে থাকলে আমার জন্যে চিন্তা কমবে।অনেকদিন রাতের মিশন স্কিপ করেছি আমি।কিন্তু,এখন আবারও তা শুরু করছি।গভীর রাতে তোমাকে এই বাড়ির ভেতর একা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।যদিও বাহিরে গার্ড আর কড়া সিকিউরিটি আছে।তাও,বাড়ির ভেতর তোমার যত্ন নেওয়ার জন্যে একজনকে দরকার।”
রাণী অবাক হওয়ার সাথে মনে মনে খুশিও হলো।আসলেই দোকানে না গেলে সারাদিনই রাণী বাসায় একা থাকে। রাণী হেসে তাকালো হায়ার দিকে। হায়াও রাণীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো।এইবার মুখ খুললো মোল্লা সাহেব,
–“তূর্যয় আমাকে অনেক আগেই বলেছিলো একটা কিশোরী মেয়ের খোঁজ করতে যে তোর সাথে সবসময় থাকবে।আমার মাথায় এমন কোনো মেয়ের কথা স্মরণ ছিল না।তাই আমি খুঁজতেই লাগলাম এমন এক বিশ্বস্ত মেয়ে। পরে কিছুদিন আগে আমার মনে এলো মায়া এতিম খানার দারোয়ানের ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে।যার পরিবারে সে আর তার বাবা ছাড়া কেউ নেই।এই মেয়েই হলো হায়া।হায়ার বাবা রিক্সা চালক।সারাদিন বাসায় বসে এমনিই হায়ার দিন কেটে যায়।তার বুড়ো বাবা এই বয়সে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে।তাই ভাবলাম হায়া এইখানে থাকলে মাস শেষে টাকাও পাবে,এতে তার বাবার কাজ করা লাগবে না।আর আমাদের রাণী মায়েরও এখন সঙ্গী হবে।তাই তূর্যয়ের নির্দেশে আজ নিয়ে এলাম হায়াকে এইখানে।”
–“বাহ্!এটা খুবই ভালো করেছেন আপনি,তূর্যয়।আমি সত্যি অনেক খুশি।আর মোল্লা সাহেব আপনাকেও ধন্যবাদ আমার জন্যে এতো মায়াবী একটা সঙ্গী খুঁজে দেওয়ার জন্যে।”
রাণী হেসে জবাব দিলো।
তূর্যয় নিজের ঠোঁট থেকে শেইকের বোতল সরিয়ে রাণীর মাথায় হাত রেখে বললো,
–“তোর সুরক্ষার জন্যে সব করতে পারি আমি।”
রাণী ভালোবাসার নজরে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয়ের চোখে নিজের জন্যে এতো যত্ন আর ভালোবাসা দেখে রাণীর বুকটা ভরে গেলো।রাণী তূর্যয়ের দিক থেকে নজর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।সবার উদ্দেশ্যে সে বলে উঠলো,
–“হায়া আমার সাথে চলো।মোল্লা সাহেব আর তূর্যয় নাস্তা করবেন,চলুন।”
তূর্যয় উঠে পড়লো রাণীর কথায়।কিন্তু সে ডাইনিং এ না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো।হাতে থাকা রাণীর ফাইলটা আবারও দেখতে লাগলো তূর্যয়।রাণী বুঝতে পারছে,তূর্যয় এখন তার অফিসের জন্যে তৈরি হতে যাচ্ছে।মোল্লা সাহেব তূর্যয়ের যাওয়া দেখে থেমে গেলো। তা দেখে রাণী মোল্লা সাহেবকে বলে উঠলো,
–“উনি আসবেন।আপনি আসুন,এসেছেন তো অনেক্ষণ হলো।”
ডাইনিং এ এসে মোল্লা সাহেব চেয়ারে বসলেন।রাণী আর হায়া রান্নাঘরে গেলো। হায়াকে দেখে রুসা রাণীকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এই মাইয়্যা কে বউমনি?”
–“ও হায়া,আমার সাথেই থাকবে বাসায়।আপনার বড় স্যার এর নির্দেশ এটা।”
রুসা রাণীর উত্তর পেয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো।রাণী নাস্তা বাটিতে নেওয়া অবস্থায় হায়াকে জিজ্ঞেস করলো,
–“পড়ালেখা করো তুমি?”
হায়া মাথা নাড়ালো।সে হেসে রাণীকে উত্তর দিলো,
–“না ম্যাডাম।আমি পড়ালেখা করতে পছন্দ করি না।ক্লাস নাইন ফেল করেছি গতবছর।এরপর আর পড়ালেখা করা হয়নি।”
–“ওহহ।আজকাল পড়ালেখা ভালোবাসে এমন মানুষ খুব কম।তবে আমাকে তুমি ভাবী বা আপু ডাকতে পারো।ম্যাডাম ডেকো না হায়া।”
রাণীর সহজ জবাব।
হায়া রাণীর কথায় খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
–“আচ্ছা।আমি আপনাকে ভাবী ডাকবো।বড় স্যারের ব্যাপারে শুনেছিলাম উনি বেশ রাগী আর হিংস্র।কিন্তু উনাকে দেখে আমার এমন কিছুই মনে হয়নি।আমার কাছে তো উনাকে বেশ ভালই মনে হলো।দেখতেও আমার বড় স্যার মা শাহ্ আল্লাহ্।একেবারে সিনেমার নায়ক নায়ক লাগে।”
রুসা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকলো।সে অবাক হয়ে হায়াকে বলে বললো,
–“কি কয় মাইয়্যা? বড় স্যার খালি বউমনির সামনে একটু শান্ত থাকে।নাইলে হের রাগ দেখলে তুই অজ্ঞান হই যাবি মাইয়্যা।”
হায়া ভয়ে চোখ বড় করলো।রাণী মুচকি হেসে রুসাকে বলে উঠলো,
–“আহ,খালা কেনো ভয় লাগাচ্ছেন মেয়েটাকে।এই নাস্তাগুলো দিয়ে আসুন টেবিলে।”
রুসা নাস্তার ট্রে নিয়ে রান্নাঘর প্রস্থান করলো।রাণী হায়ার দিকে তাকিয়ে তাকে বললো,
–“তুমিও নাস্তা করতে যাও।”
হায়া মাথা নাড়লো।রাণী চললো তূর্যয়ের কাছে।সে আজ দোকানে যাবে না,কিন্তু হ্যারি যেনো তাও নাস্তা করতে আসে এইখানে;এই কথাটি তূর্যয়কে বলার জন্যে যাচ্ছে রাণী।রাণী যেদিন দোকানে যায় না,সেদিন হ্যারি নাস্তা করতে আসে না।এই ব্যাপারটা রাণীর একেবারে ভালো লাগে না।তিনজনের একসাথে নাস্তা করাটা রাণীর সবচেয়ে বেশি পছন্দ।রাণী রুমে গিয়ে দেখে তূর্যয় তাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে আবারও সেই লাল রঙের ফাইলটা দেখছে।রাণী অবাক হয়ে তূর্যয়কে বললো,
–“এই ফাইলে এতো কি দেখছেন?”
তূর্যয় ফাইল থেকে নজর সরিয়ে রাণীর দিকে তাকালো,
–“এমনিতেই দেখছিলাম।”
রাণী ছোট্ট করে “ওহ” বললো।পরক্ষণে সে তূর্যয়কে বলতে লাগলো,
–“হ্যারি ভাইকে বলুন এইখানে এসে নাস্তা করে নিতে।ইদানিং উনি বেশ কম আসে আমাদের বাড়িতে।কিন্তু কেনো?”
–“তুমি বুঝবে না।”
তূর্যয়ের সোজা জবাব।
রাণী আসলেই বুঝলো না তূর্যয়ের কথা আর হ্যারির না আসার কারণ।রাণী নিজের অক্ষিযুগল ঘুরিয়ে তূর্যয়কে আবারও বলে উঠলো,
–“আমি আজ যাচ্ছি না দোকানে।”
তূর্যয় ফাইলের দিকে তাকিয়েই রাণীকে উত্তর দিলো,
–“আচ্ছা।”
রাণীর খুব বিরক্ত লাগছে।আজ যেনো তূর্যয় তাকে একটু বেশি অবহেলা করছে।এমনি তো রাণীকে তার সাথে সারাক্ষণ মিশিয়ে রাখে যতক্ষণ বাসায় থাকে।কিন্তু আজ একেবারে তাকে দেখারই যেনো সময় নেই তূর্যয়ের।রাণী রেগে তূর্যয়ের হাত থেকে ফাইল ছিনিয়ে নিলে তূর্যয় বিরক্ত নিয়ে তাকে ধমকিয়ে উঠলো,
–“কি করছো কি রৌদ্র? ফাইল ছিঁড়ে যাবে!”
রাণী ফাইল দেখিয়ে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“ছিঁড়ে যাক।আজ তো এই ফাইলের জন্যে নিজের বৌকেই ভুলে গেলেন।বাহ্,সন্ত্রাসী বাহ্!কি আছে এই ফাইলে?”
রাণী ফাইল পড়ে দেখলো তারই এতিম খানার ছাড়পত্র এটা।অন্যদিকে তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাঁকা করে রাণীর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের গলা থেকে তাওয়াল নিয়ে তূর্যয় সেই তাওয়ালের সাহায্যে রাণীর কোমরে টান দিয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিলো।আচমকা এমন হওয়াতে রাণী অবাক হয়ে তূর্যয়ের দিকে তাকালে তূর্যয় বেশ ঝুঁকে রাণীর কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো,
–“এতো হিংসা?সামান্য একটা ফাইলকেও কি হিংসা করা লাগে,রৌদ্র?”
রাণী তূর্যয়ের বুকে হাত দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তাকে উত্তর দিলো,
–“হ্যাঁ,করা লাগে।আপনি শুধু আমার দিকে মনোযোগী হবেন।আর কারো দিকে না।”
তূর্যয় হাহা করে হেসে উঠলো।রাণীর অধর জোড়ায় একটা লম্বা চুম্বনের মাধ্যমে রাণীর মুখ বন্ধ করে দিলো তূর্যয়।রাণীর সব বিরক্তি যেনো মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো।
–“তোরই তো আমি।আর কারো না।”
তূর্যয়ের আদরমাখা কণ্ঠ।
তূর্যয় রাণীর আরো গভীরে যেতে নিলে রাণী তাকে থামিয়ে বললো,
–“হয়েছে হয়েছে।এইসব বন্ধ করুন।নিচে চলুন।আর ভিনদেশী ভাইকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি।”
রাণী কথাটা বলে তূর্যয় থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে নামলো।রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিজের মোবাইল নিয়ে নিলো সে।হ্যারিকে ফোন করে জানালো তার মনের সকল কথা। হ্যারিও নিজের বোনের সাথে দেখা করার জন্যে জলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।

মোল্লা সাহেব আর হায়া নাস্তা করে উঠে পড়লো।তূর্যয় নিচে আসার আগেই মোল্লা সাহেব রাণীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন কোনো এক জরুরী কাজ আসার কারণে।হায়া রান্নাঘরে রুসার সাথে।রাণী এইবার টেবিলে নিজ হাতে সবকিছু সাজিয়ে নিলো তার ভিনদেশী ভাই আর প্রিয় সন্ত্রাসীর জন্যে।টেবিলের সবকিছু ঠিক করে নিয়ে সামনে তাকাতেই রাণী দেখলো তূর্যয় টেবিলের দিকেই আসছে।পড়নে তার ছাই রঙের শার্ট আর সেই রঙেরই কোট।মাথার ঘন চুলগুলো একেবারে শক্ত হয়ে তাদের জায়গায় বসে আছে।বুকের উপর তিনটা বোতাম খোলা থাকার কারণে বুকের উপর ঝুলন্ত চেইন দেখা যাচ্ছে তার।রাণীর চোখ জুড়ে যায় তূর্যয়কে দেখে।তূর্যয়ের সবকিছুতে অদ্ভুত ভালোলাগা যেনো গ্রাস করল ফেলে রাণীকে।তার উপর তূর্যয়ের গভীর চোখের মায়ায় নিজেকে বারবার হারিয়ে ফেলে সে।তূর্যয় ঠোঁট চোখা করে রাণীকে ইশারা করতেই রাণী চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো।চেয়ারে বসে রাণীর হাত ধরে শব্দ করে চুমু খেলো তূর্যয়।রাণী চোখ বুঁজে তূর্যয়ের স্পর্শটা অনুভব করলো।পরক্ষণে সে নিজের হাত ছুটিয়ে নিজে তূর্যয়কে বললো,
–“বাড়িতে মানুষ আছে।”
–“এতে আমার কি?”
তূর্যয়ের সোজা জবাব।
–“আজিব! কেউ দেখলে তো আমারই লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।আপনার মাঝে তো লাজ-লজ্জার ‘ল’ ই নেই।”
রাণীর কথায় তূর্যয় নিঃশব্দে হাসলো।রাণীর এমন লজ্জা এর রাগ মিশ্রিত চেহারা তূর্যয়ের সবসময়ের প্রিয়।সে আবারও রাণীর হাত টেনে নিয়ে আলতো করে কামড় দিলো। এতে রাণী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,
–“নাস্তা আছে সামনে,সেটা খান।আমাকে কেনো কামড় দিচ্ছেন?”
তূর্যয় রাণীর কামড় দেওয়া হাতে ঠোঁট বুলিয়ে বললো,
–“তোর দানব সন্ত্রাসী আমি,তাই।”
রাণীর হাসি আসলেও সে হাসলো না।নিজেকে একটু সিরিয়াস মুডে নিয়ে রেখেছে সে।রাণী মুখ খোলার আগেই হ্যারি এসে হাজির হলো।রাণী জোরপূর্বক নিজের হাতটা নিয়ে নিলো তূর্যয়ের হাতের মুঠো থেকে।হ্যারিকে দেখে তূর্যয় তাকে প্রশ্ন করলো,
–“এতো জলদি এসেছো কিভাবে?”
–“বাইকে করে।আমার সিস কল দিয়েছে আর আমি আসবো না? বাট,সিস আজকে তুমি দোকানে যাবে না কেনো?”
হ্যারির কথায় রাণী তাকে জবাব দিলো,
–“ভালো লাগছে না,ভিনদেশী ভাই।ইচ্ছা করছে সারাদিন বাড়িতে থাকি।”
–“ওহহ, ইটস ওকে। হোমে থেকে রেস্ট নাও।”
হ্যারির কথায় রাণী মাথা নাড়লো।রাণী,তূর্যয়,হ্যারি তিনজন নাস্তা করছে।নানান আলাপ জুড়ে দিলো হ্যারি আর রাণী।সবসময়ের মতো তূর্যয় সেখানের নিরব দর্শক।মাঝে মাঝে টুকটাক দুই একটা উত্তর দেয় সে।অথচ রাণীর সামনে থাকলে রাণীর মুখটা বন্ধ থাকে আর তূর্যয়ের কথার খই ফুটে।তূর্যয়ের কাছে যে এতো কথার সমাহার আছে এটা শুধুমাত্র রাণী জানে।নাস্তা সেরে হ্যারি আর তূর্যয় বসে আলাপ করছে বিজনেসের ব্যাপারে।রাণী রান্নাঘরেই আছে।হায়া আর রুসা টেবিল পরিষ্কার করতে গেলে হ্যারি হায়াকে দেখে বলে উঠলো,
–“আজকে থেকেই ওয়ার্কে জয়েন করেছে,হায়া?”
হায়া হ্যারিকে জবাব দিলো,
–“জ্বী,হ্যারি স্যার।”

ডাইনিং রুমে রাণী আসলো,তূর্যয়কে জিজ্ঞেস করতে; সে কখন ফিরবে বাড়িতে।রাণী এসেই হ্যারি আর হায়ার কথা শুনে অবাক হয়ে হ্যারিকে প্রশ্ন করলো,
–“আপনারা একে অপরকে চিনেন কিভাবে?”
–“সিস,ব্রো এর কথায় মোল্লা সাহেবের সাথে আমি হায়ার সবকিছু সার্চ করতে গিয়েছিলাম।এইভাবেই পরিচয়।”
–“ওহহ আচ্ছা। ভালোই তো হলো।”
রাণীর হাস্যোজ্বল জবাব।

রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকালেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।রাণীর বুকটা ধক করে উঠলো তূর্যয়ের এইভাবে তাকানো দেখে।কেমন যেনো নেশার মতো কাছে টানে রাণীকে,তূর্যয়ের এই চোখজোড়া।রাণী একসাথে তিন চারবার পলক ফেলে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“কবে ফিরবেন?”
–“কাজ যখন শেষ হয়!”
কথাটা বলে তূর্যয় উঠে দাঁড়ালো।তূর্যয়ের নজর এখনো রাণীর দিকে।রাণী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে তূর্যয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তূর্যয় মাথা বাঁকিয়ে হ্যারিকে বললো,
–“চলো,দেরী হচ্ছে।”
হ্যারি হাত নাড়িয়ে হায়ার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিলো,
–“আমার সিসের টেইক কেয়ার করবে।একটা লিটল গার্ল আরেকটা লিটল গার্লের টেইক কেয়ার করবে,
হাহা।”

–“সাবধানে থাকিস।”
রাণীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে তূর্যয় সবার সামনেই রাণীর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে ধপধপ পা ফেলে চলে যাচ্ছে।হ্যারিও হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো হায়া আর রাণীকে।রাণী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হায়া আর হ্যারির সামনে এমনটা করবে তূর্যয়,এটা রাণী দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।হায়া এসে রাণীর হাত ধরে তাকে বললো,
–“বড় স্যার তো আপনাকে ঝাক্কাস ভালোবাসে,ভাবী।”
রাণী একটু লজ্জা পেলো ছোট একটা মেয়ের মুখে এই কথাটি শুনে।রাণী তাকে চোখ বড় করে লজ্জামাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“এই মেয়ে,বড়দের এইসব বলে?”
হায়া এক হাতে কান ধরে রাণীকে হেসে জবাব দিলো,
–“সরি ভাবী।”
রাণী সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে হায়ার সাথে রান্নাঘরের দিকে এগুলো।
.
মিটিং রুমে বেশ রমরমা পরিবেশ।তূর্যয়ের মেজাজ বেজায় চটে আছে।আজ একসাথে চার পক্ষ মিটিং করছে।তারা সবাই একেক জনের মত একেক রকম জানাচ্ছে।সবার কিচিরমিচির শব্দে তূর্যয় টেবিলে চড় দিয়ে চিল্লিয়ে বললো,
–“চারটা কোম্পানি একসাথে কাজ করলে আমাদের লাভটা বেশি হবে।বাহিরের দেশে এখন কালো বাজারের ব্যবসাটা বেশি বিখ্যাত।তাই এইসব অস্ত্র পাচারের দিকটা চিন্তা না করে কালো বাজারের কিছু প্রজেক্ট নিয়ে ভাবা যাক।যেভাবে প্রজেক্টটা হলে বিদেশের বিখ্যাত কোম্পানির সাথে আমাদের চুক্তি করা সম্ভব হবে।”
তূর্যয়ের কথাটা সবার বেশ পছন্দ হলো।সবাই চুপ হয়ে আছে।তূর্যয় এইবার তাদের নির্দেশ দিলো,
–“আধা ঘণ্টা সময় দিলাম।প্রত্যেক কোম্পানি তাদের ম্যানেজার বা সহকারীকে বলে দিন একটা প্রজেক্ট তৈরী করে নিতে।একটু পরেই সবার প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।আমার কোম্পানি থেকে কাজ করবে ‘হ্যারি’।”
তূর্যয়ের কথায় হ্যারি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।এরপর বাকি তিন কোম্পানির ম্যানেজার তাদের পরিচয় দিয়ে কাজে লেগে পড়লো।

বেশ শান্তভাবে তূর্যয়ের করা প্ল্যানে সবাই কাজ করছে।বিশাল একটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মিটিং শেষ হলো।তূর্যয়ের কোম্পানির সবাই সাথে বাকি তিনটা কোম্পানির সকলে বেজায় খুশি।তূর্যয়ের পরিচিত আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া ‘স্টিফেন লর্ড’ এর সাথে তূর্যয় একটা ডিল তৈরি করে ফেললো।সেই খুশিতে একটা বিরাট ভোজের আয়োজন করা হলো শহরের বিখ্যাত পাঁচ তারকা হোটেল “রেড ভেলভেট রেস্টুরেন্ট” এ।সবাই যারযার মতো উপভোগ করছে পার্টি ।তূর্যয় একপাশে গিয়ে রাণীর সাথে ফোনে কথা বলে নিলো।মোবাইল পকেটে রেখে সামনে যেতেই একজন লোক তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“তাশরীফ তূর্যয়,সদ্য বিবাহিত একজন মাফিয়া। তা বিবাহিত জীবন কেমন যাচ্ছে?”
তূর্যয়ের পা থেমে গেলো।অন্য লোকের মুখ থেকে বিয়ের কথাটা শুনে অবাক হলো না সে।ইতোমধ্যে শহরের টপ নিউজে তার বিয়ের খবরটা খোলাসা হয়ে গিয়েছে। এমনটা হওয়ারই কথা।কারণ,তূর্যয়ের উপর বেশ কিছু মানুষের নজর থাকে।তূর্যয় ঘাড় বাঁকিয়ে পিছু ফিরলো,
–“তূর্যয়ের জীবন ভালো যায় সবসময়।নতুন কিছু বলবেন?”
লোকটা হেঁটে এসে তূর্যয়ের হাতে শেম্পেইনের একটা গ্লাস দিলো।কিন্তু তূর্যয় হাত এগিয়ে না দেওয়ার কারণে গ্লাস পড়ে গেলো ফ্লোরে।মুহূর্তেই কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে গুড়িয়ে গেলো।তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে নিলো।তূর্যয় পিছন ফিরে চলে আসতে নিলে লোকটা তাকে বলে উঠলো,
–“এখন তো সবাই তোমাকে রেখে তোমার বউয়ের পেছনেই লাগবে।শুনেছি,তোমার বউ নাকি ভীষন সুন্দরী?তাকেই রাখবে সারাজীবন নাকি আবার চেঞ্জ করে ফেলবে?দেখো চেঞ্জ করলে আমাকে একটু তোমার এক্স বউয়ের মুখটা দেখতে দিও।”
কথাগুলো বলে লোকটা হেসে মদ ভর্তি গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো তখনই তূর্যয় সেই গ্লাসে জোরে ঘুষি দিলো। ফলস্বরূপ গ্লাস ভেঙে লোকটার মুখে কাঁচ গেঁথে গেলো।সাথে সাথে শোনা গেলো লোকটার আর্তনাদ। আশে পাশের সবাই এগিয়ে আসার আগেই তূর্যয় নিজের বাহু দিয়ে লোকটার গলা পেঁচিয়ে ধরলো।লোকটা বাঁচার জন্যে হাসফাস করছে।তূর্যয় তার দানবরূপে সজ্জিত এখন।লোকটার গলায় তার বাহু দিয়ে আরো জোরে চেপে ধরে সে লোকটিকে বললো,
–“আমার বউ শুধু আমার,সারাজীবনের জন্য আমার।আমার বউয়ের ব্যাপারে কথা বলার সাহস কে দিলো তোকে?বয়স তো কম হয়নি!তাও মাথায় বুদ্ধি নেই?তূর্যয় কি জিনিস জানিস না?তোর আজকে মৃত্যু নিশ্চিত।”
কথাটা বলে আরো জোরে চেপে ধরলো লোকটার গলা।হ্যারি এবং বাকি সবাই এসে তূর্যয়কে ছুটানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু তূর্যয় তার কাজে অটল।শেষে লোকটার মরে যাওয়ার উপক্রম হলে হ্যারি জোর করে ছাড়িয়ে নিলো তূর্যয়কে সেই লোক থেকে।লোকটা বসে পড়লো ফ্লোরে।তূর্যয় লোকটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে হুমকি দিয়ে বললো,
–“ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিবো,শালা বুড়ো খাটাশ। শেষ বার এই তূর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে গেলি,শালা।”
হ্যারি তূর্যয়কে নিয়ে সেই জায়গা থেকে প্রস্থান করলো।

বাকি লোকেরা সেই লোকের কাছে গিয়ে তূর্যয়ের এমন রেগে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকটা সব খুলে বললো।এরমধ্যে অন্য অফিসের একজন তাকে ধিক্কার জানিয়ে বললো,
–“ভালোই হয়েছে।তূর্যয় কি জিনিস আপনারা কি জানেন না?তাও তার বউকে নিয়ে কথা বলেছেন?এই যাত্রায় তো বেঁচে গিয়েছেন,পরের যাত্রায় তূর্যয় থেকে বাঁচতে পারবেন না।অনেকেই ভাবছে তার বউকে মেরে তূর্যয়কে হাত করতে পারবে।কিন্তু কেউ এটা জানে না,কতো লোককে গত কয়েকদিনে মেরেছে তূর্যয় শুধুমাত্র তার বউকে টার্গেট করেছে বলে।তাই সবার উদ্দেশ্যে বলছি, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেওয়া শিখুন। তূর্যয়ের সাথে লাগতে গেলেও তার বউকে নিয়ে কিছু বলবেন না।মেরে গুম করে দিবে সে।আর তূর্যয়ের মতো শক্তিশালী লোকের সাথে আমাদের মাথা নিচু করে চলায় ভালো।তূর্যয়ের ক্ষতি না করলে সে যেঁচে কারো ক্ষতি করে না।আপনি একটা বাজে লোক।”
ফ্লোরে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে সেই লোকটা এবং বাকি সবাই ফ্লোরে বসা লোকটা থেকে সরে গেলো।আর আহত অবস্থায় লোকটা নিজের গলায় হাত রেখে আল্লাহ্কে শোকরিয়া করছে এই যাত্রায় সে বেঁচে গিয়েছে তাই।পরবর্তীতে তূর্যয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসটা হারিয়েছে এই লোক।
.
কেটে গেলো অনেকদিন।রাণী এখনো তূর্যয়ের সাথে সালেহার কাহিনী আর তার মায়ের মৃত্যু রহস্যের কথা জানাতে পারলো না।তূর্যয় এখন মহা ব্যস্ত।রাতের মিশন চালু করার পর গভীররাতে বাসায় আসে সে।রাণী ততক্ষণে ঘুম কাবু থাকে।যদিও তূর্যয়ের গভীর স্পর্শে রাণীর ঘুম ভেঙে যায়,তবে তূর্যয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে অতিরিক্ত কোনো চিন্তায় ফেলতে চাই না রাণী।রাত বা দিনের বেলায় একটু সময় পেলেই তূর্যয় রাণীকে নিজের ভালোবাসায় মুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।কাজের চাপে তূর্যয়ের রাণীকে ভালোবাসার সময় কমলেও ভালোবাসার পরিমাণ বেড়েছে হাজার গুণে।তূর্যয়ের এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে সাড়া না দেওয়ায় ক্ষমতা রাণীর নেই।সবকিছু মিলিয়ে রাণীর সময় পাচ্ছে না তূর্যয়ের সাথে এইসব ব্যাপারে কথা বলার।এই কিছুদিনে হায়ার সাথে রাণীর একটা বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো।তূর্যয়ের রাতের মিশন থাকলে, হায়া রাণীর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।রাণী ঘুমিয়ে গেলে এরপর সে নিশ্চিন্তে নিজের রুমে যায়।হায়া সারাক্ষণ রাণীর সাথেই থাকে।ঘরে,দোকানে সব সময় একসাথে থাকে তারা দুইজন।শুধু তূর্যয় বাসায় এলেই হায়া নিজেকে নিজের রুমে আটকে নেয়।তূর্যয়কে সম্মান করার পাশাপাশি বড্ড ভয় পায় হায়া।তাই তূর্যয়ের ধমক থেকে বাঁচতে সারাক্ষণ সে রাণীর খেয়াল রাখে আর তার প্রতি রাণীর স্নেহ দেখে হায়া তার সর্বোচ্চ দিয়ে রাণীর যত্ন নেয়।

কিছুদিন আগেই রাণী জানতে পারলো হ্যারি আর সিমির মধ্যকার কোনো সম্পর্ক নেই।এর কারণ অবশ্য রাণী জানেনা।তবে,সিমির বিচক্ষণতার কারণে হ্যারি ভেবে নিলো,সিমি খারাপ কেউ না,রাণীর ক্ষতি করতে চাই না সে।যেহুতু হ্যারি কিছু অনুভব করে না এখন সিমিকে নিয়ে তাই সে সিমির সাথে দেখা করে শেষ করে দিলো তাদের দুইজনের মধ্যেকার মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক।যদিও সিমি চেয়েছিল হ্যারিকে বরবাদ করতে।কিন্তু সেদিন হ্যারির হিংস্রতা প্রথমবার দেখে সিমির মাথা থেকে হ্যারিকে বরবাদ করার সাহস পালিয়েছে।সিমি আপাতত অত্যন্ত সুশীল একটা পরিকল্পনা করছে সাবিনার সাথে,যেনো সাপ মরে যায় আর লাঠিও না ভাঙে। অর্থাৎ,সিমি এমন পরিকল্পনা করছে যাতে রাণী দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে যায় আর সিমির নামটাও যেনো না আসে।এই যেনো এক ভয়ংকর পরিকল্পনা!
.
দুপুরের খাবার শেষ করতে অনেকটা দেরী হলো রাণীর।তূর্যয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই তার দেরী হয়ে গেলো। রুসা খালা সব গুছিয়ে নিচ্ছে টেবিলের।হায়া রাণীর জন্যে আমার আচার বানাচ্ছে। কাল রাতে কম ঘুম হওয়ার কারণে রাণীর মাথা ব্যাথা করছে প্রচুর।তাই রাণী প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করতে ছাদে গেলো।রাণীর ধারণা প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে মগ্ন হয়ে গেলে রাণীর মাথা ব্যাথা পালাবে। ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো রাণী।ঠান্ডা বাতাস ঝাপটে পড়ছে তার গায়ে।শিরশির এক অনুভূতি হচ্ছে রাণীর সত্তায়।রাণী নিজের উড়ন্ত চুলে খোঁপা করে নিলো।সমুদ্র দেখা যাচ্ছে একদম স্পষ্ট।রাণী মুগ্ধ নয়নে দেখছে সমুদ্রের একের পর এক জোয়ারের প্রতিযোগিতা।সাথে রাণীর চোখে ভাসছে তার আর তূর্যয়ের গভীর মুহূর্তের ভালোবাসার সব চিত্র।এই যেনো অন্যরকম এক শিহরণ। সারাদিনে তূর্যয় নামক লোকটাকে অনেক বেশি মিস করে রাণী।

–“ভাবী!”
হায়ার ডাকে রাণী পেছনে ফিরলো।হায়া মুখে হাসি ঝুলিয়ে হাতে আচারের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।আচার রাণীর অন্যতম দুর্বলতা।রাণী আচারের বাটি নিয়ে দোলনায় বসে পড়লো।হায়া ছাদের উপর থাকা তার নির্ধারিত টুল নিয়ে রাণীর সামনে বসলো।দুইজন মিলে টক,মিষ্টি,ঝাল স্বাদের আচার উপভোগ করছে।এতগুলো আচার এই দুই মেয়ে মিলে নিমিষেই হজম করে ফেললো।রাণী আঙ্গুল চাটছে।তার মাথাব্যাথা এতক্ষণ কমলেও আবারও তার মাথায় ধীরে ধীরে ব্যাথা হওয়া শুরু করলো।রাত জাগলে এই এক সমস্যা হয় তার।কিন্তু, কিছু বলে না সে তূর্যয়কে।তূর্যয়ের ভালোবাসাময় স্পর্শ যে রাণীর সারাজীবনের প্রিয়!

রাণী মুখ কুঁচকে হায়াকে বললো,
–“ভাবীর মাথাটা একটু ম্যাসাজ করে দেও না।”
হায়া দ্রুত মাথা নাড়ালো। ছাদের উপর থাকা ট্যাপ থেকে হাত ধুয়ে নিয়ে রাণীর মাথায় ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করা শুরু করলো।হায়া রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“ভাবী,হঠাৎ মাথা ব্যাথা করছে কেনো?”
রাণী কি জবাব দিবে ভাবছে।সে মনে মনে বলছে,
–“এই নির্লজ্জ দানবের কাহিনী তো তোমায় বলা যাবে না,হায়া।এই দানবের ভালোবাসার লোভেই তো আমার রাত জাগতে হয়।”
রাণী নিজের মনের কথা ঝেড়ে ফেলে হায়াকে উত্তর দিলো,
–“কিজানি।হঠাৎ দেখি মাথা ধরেছে।”
রাণী আর কিছু বললো না।হায়া তার জীবনের কিছুর মজার কাহিনী বলছে আর রাণীর মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে।রাণী সেইসব শুনে হাসতে হাসতে কুপোকাত।
,
তূর্যয় অফিস থেকে ফিরে রাণীকে না পেলো না।বাসায় কোথাও হবে সে,এই ভেবে তূর্যয় গোসল সেরে নিলো।আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু জলদি ফিরেছে তূর্যয়।গোসল সেরে বের হয়েও রাণীকে দেখলো না সে। টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে তূর্যয় ছাদের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। এতদিনে তূর্যয় এটাই জানে,রাণীকে বাসায় কোথাও পাওয়া না গেলে ছাদে পাওয়া যাবে।তূর্যয় সিঁড়ি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো রাণী আর হায়া কথা বলছে।হায়া রাণীর মাথা ম্যাসাজ শেষ করে আবারও রাণীর সামনে টুলে বসে পড়েছিলো।যার কারণে সিঁড়ি ঘরে তূর্যয়কে স্পষ্ট দেখতে পেলো হায়া।তূর্যয়কে দেখে হায়া রাণীকে একটা বাহানা দিয়ে এক দৌড়ে ছাদ ত্যাগ করলো।রাণী কিছু বললো না,নড়লো না।দোলনায় মাথায় রেখে রাণী আগের ন্যায় আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।তূর্যয় ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।রাণীর পাশে বসতেই রাণী চমকে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় রাণীর দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো রাণীকে।রাণী তূর্যয়ের বুকে মাথা রেখে তার বুকের ধুকধুক শব্দ শুনছে।আকাশে এখন আঁধার নেমেছে।রাণী এলোমেলো কণ্ঠে তূর্যয়কে বললো,
–“আপনাকে দেখেই হায়া পালালো তাহলে।”
তূর্যয় রাণীর বাহুতে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
–“হয়তো।”
রাণী চুপ হয়ে আছে। সন্ধ্যার এই মনোরম পরিবেশে তূর্যয়ের সঙ্গটা রাণীর কাছে অতি ভালো লাগায় পরিণত হলো।তূর্যয় রাণীর অন্য হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল গুঁজে রেখেছে।একটু পরে একেবারে আঁধার নেমে এলে ছাদে মৃদু আলো জ্বলে উঠলো নিজে নিজে।তূর্যয় রাণীকে আলতো করে নিজের কোলে বসালো।রাণী পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো তূর্যয়ের কোলে।তূর্যয়ের হাত রাণীর শাড়ির আড়ালে উন্মুক্ত উদর জড়িয়ে আছে।মাঝে মাঝে তূর্যয়ের এলোমেলো স্পর্শ রাণীকে অস্থির করে তুলছে।হঠাৎ রাণীর মনে এলো তূর্যয়কে আজ এই মুহূর্তে সবকিছু বলতে হবে তার।তাই সে তূর্যয়কে নরম সুরে বলতে লাগলো,
–“একটা কথা বলি?”
তূর্যয় রাণীর খোঁপা খুলে দিয়ে তার চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে বললো,
–“হাজারটা বলো।”
–“সালেহা ম্যাডামের ব্যাপারে।”
মুহূর্তেই তূর্যয়ের চোখজোড়া যেনো অগ্নিরুপ ধারণ করলো।তূর্যয় কড়া কণ্ঠে রাণীকে সতর্ক করে বললো,
–“কোনো কথা না ঐ মহিলার ব্যাপারে।”
কিন্তু,রাণী আজ থামেনি।গলগল করে জোরপূর্বক সবটা জানালো সে তার তূর্যয়কে।এমনকি তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যু রহস্যের কথাটাও রাণী তূর্যয়কে বুঝিয়ে বললো।তূর্যয়ের শরীর রাগে টগবগ করছে।সে পারছে না এখনই গিয়ে হাসানকে নিজ হাতে খুন করতে!এইদিকে সালেহার কথা শুনে বেশ কষ্ট অনুভব করলো তূর্যয়।সে একপাক্ষিক ঘটনা আন্দাজ করে সবটাই বিবেচনা করে এসেছে এতদিন।তূর্যয়ের এমন বেশামাল অবস্থা দেখে রাণী তূর্যয়ের গালে হাত রেখে বললো,
–“আমরা দুইজন মিলে সবটা ঠিক করবো।কোনো চিন্তা করবেন না।”
–“তুমি এইসবের মাঝে এসো না।আমি সব সামলে নিবো।”
–“উহু,আপনি প্রমাণ ছাড়া কিছু করবেন না।আগে আমাদের প্রমাণ জোগাড় করা লাগবে।তাই আমাদের ‘শান্তি মহল’ যেতে হবে।”
রাণীর কথায় তূর্যয় চিল্লিয়ে উঠলো,
–“কখনো না।আমি ঐ নরকে তোকে নিয়ে যাবো না।পাগল পেয়েছিস আমাকে?”
রাণী চমকালো না।তার এখন সময় তূর্যয়কে বুঝানো,
চমকানো নয়।রাণী তূর্যয়ের চুলের ভাঁজে আঙ্গুল চালিয়ে বললো,
–“আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।আপনি থাকতে আমার কিছু হতে পারে কি?আমার সাথে আপনার এই বিশাল বড় গার্ড আছে,হায়া আছে,আর সবচেয়ে বড় কথা; আপনি আছেন।আপনার সাথে থাকাটা আমার সবচেয়ে বেশি জরুরি।আর মায়ের মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করতে আমাদের সেই বাড়িতে যেতে হবে। আমাকেই এই কাজ করতে হবে।তাদের গোপন কথা জানতে হবে।নাহলে আপনার সামনে উনারা এইসবের নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলবে না।আপনি কি চান না,মায়ের মৃত্যুর রহস্য আমরা বের করি?দোষীদের শাস্তি দিই?আমি জানি আপনি মায়ের ওয়াদা মনে রেখে তাদের অত্যাচার করবেন না বিনা কারণে।তাই আমাদের কাছে এই একটাই উপায় আছে,সেই বাড়িতে যাওয়া।আমার বিশ্বাস, আপনি আমাকে রক্ষা করার সবটাই ব্যবস্থা করে রাখবেন।”
তূর্যয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।রাণীর বলা প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।আর এটাও সত্যি আজ পর্যন্ত নিজের মায়ের ওয়াদা সে পালন করে এসেছে।আর এখন তো রাণীর সেই বাড়িতে যাওয়ার জিদটা তূর্যয়ের কাছে তার মায়ের ওয়াদা পূর্ণ করারই আহ্বান জানাচ্ছে।তূর্যয় রাণীকে আরো কাছে টেনে নিলো।নির্দ্বিধায় সে রাণীকে বলে উঠলো,
–“নিশ্চিন্তে থাক তুই,আমি থাকতে তোর কিছু হতে দিবো না আমি।অতি দ্রুত সব বের করে এদের আমি দুনিয়া ছাড়া করবো।একজনকেও ছাড়বো না আমি।”
রাণী তূর্যয়ের গলা জড়িয়ে বললো,
–“আমি জানি। কবে যাবো আমরা সেখানে?”
–“আগে মোল্লা সাহেব আর সালেহার মধ্যে সবটা ঠিক করি?অতিরিক্ত গার্ড লাগবে আমার,তুই ঐ বাড়ি গেলে।”
–“জ্বী,মহাশয়।আপনার জন্যে এই দেশের গার্ডের অভাব পড়বে।”
কথাটা বলে রাণী খিলখিল করে হেসে উঠলো।এই রঙিন আলোতে রাণীর হাসিটা চুম্বকের মতো আকর্ষন করছে তূর্যয়কে।মুহূর্তেই তূর্যয় রাণীর কাছাকাছি এসে তাকে বেশ কয়েকটা চুমু দিলো।এরপর সে রাণীকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে নিচে নামার জন্যে পা আগালো।ভালোবাসার স্পর্শের সুখের পাশাপাশি রাণীর মন থেকে আজ সবচেয়ে বড় বোঝাটা নেমে গেলো।রাণী মনে মনে দোয়া করছে,”এইবার যেনো সবটাই ঠিক হয়;অপরাধীরা যেনো তাদের যোগ্য শাস্তি পায়।”

চলবে….
চোখের অবস্থা করুণ।মোটামুটি ব্যাথা আর লাল ভাবটা কমেছে চোখের।তারপরও অনেকদিন গল্প না দেওয়ার কারণে, বেশ গিল্ট ফিল হচ্ছিলো।তাই আজ দুই পর্ব একসাথে দিয়ে দিলাম।এই এক পর্ব মিলেই দুই পর্বের সমান।গল্প কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই।আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখলে আবারও শনিবার নতুন পর্ব পাবেন ইন শাহ্ আল্লাহ্।মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই,গল্প শেষ হতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here