#আলো-আঁধার🖤পর্ব৩৪
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
৩৪.
জ্বরের প্রকোপে তূর্যয় রীতিমত কাঁপছে।সাথে আবোল তাবোল নানান কথা বলে যাচ্ছে সে।রাণীর একটু চোখ লেগে এসেছিল।কিন্তু,তূর্যয়ের এমন গোঙানো শুনে রাণীর ঘুম ছুটে গেলো।তূর্যয়ের গায়ের সংস্পর্শে রাণী থাকায় রাণী বুঝতে পারলো তূর্যয়ের জ্বর আবার বেড়েছে।তূর্যয়ের ঠোঁট জোড়া ঠকঠক করে কাঁপছে।রাণী অস্থির হয়ে উঠলো।রাণী বুঝতে পারছে তূর্যয়ের সেলাইয়ে নিশ্চয় যন্ত্রনা হচ্ছে যার কারণে তূর্যয়ের জ্বর আবারও বাড়লো।রাণী বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলের উপর থেকে বাটি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো।এরপর তাতে ছোট একখানা কাপড় ডুবিয়ে নিয়ে আবারও জ্বর পট্টি দিচ্ছে সে তূর্যয়কে।রাণীর চোখে পানি চলে আসছে তূর্যয়ের এমন অবস্থা দেখে।তূর্যয়ের মতো এমন হিংস্র মানুষটাকে জ্বরে কাবু করে নিয়েছে,এটা ভাবতেই রাণীর বুক ভার হয়ে এলো।রাণী তূর্যয়ের চুলের গভীরতায় হাত বুলিয়ে অন্য হাত দিয়ে তূর্যয়ের কপালে জ্বর পট্টি দিচ্ছে।তূর্যয় জ্বরের প্রকোপে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
–“রৌদ্র,সরি।আমার কাছে আসো।আর কখনো কষ্ট দিবো না।ভালোবাসি অনেক তোমায়।”
রাণী তূর্যয়ের ঠোঁট এর কাছে কান নিয়ে তূর্যয়ের বিড়বিড় করা কথাগুলো শুনতে লাগলো।রাণী কান্নার মধ্যেও হেসে উঠলো তূর্যয়ের কথায়।রাণী তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“রাগের জন্যে, সরাসরি সরি বলতে পারলেন না। আর এখন কি সুন্দর করে সরি, ভালোবাসেন একসাথে দুইটা বলছেন।এমন কেনো আপনি রাগী সন্ত্রাসী? এখন জ্বর হয়েছে তাই নিজের হুঁশ নেই আপনার। না হলে আপনি আমাকে সেদিনের জন্য সরি কখনোই বলতেন না।যায় হোক,সরি তো বলেছেন।এটাই আমার জন্য অনেক।আর হ্যাঁ,আমি কিন্তু আপনাকে বেশি ভালোবাসি।”
তূর্যয় জ্বরের প্রকোপে নানান কথা বকে যাচ্ছে।রাণীর কথাটাও তার শোনা হলো না।আবারও তূর্যয়ের জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসলে রাণী পূর্বের ন্যায় তূর্যয়ের পাশে শুয়ে পড়লো।দুইজনের গায়ের উপর চাদর দিয়ে রাণী হালকা করে তূর্যয়ের বুকে হাত রাখলো।এই ভোরবেলায় রাণীর চোখ ঘুমের জন্যে হাহাকার করছে।রাণী তার ভারী চোখের পাতা বুজে নিলো তূর্যয়কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।
পেটের চিনচিন ব্যাথায় ঘুম ভাঙ্গলো তূর্যয়ের।হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই তার প্রথমেই মনে আসলো রাণীর কথা। কাল রাতে তাদের বিয়ে হয়েছিল,রাণীকে সে এই বাড়িতে এনেছে এতটুকু মনে আছে তূর্যয়ের।এরপর তার আর কিছু মনে নেই।রাণীর জন্যে দুশ্চিন্তা করে তূর্যয় উঠতে নিলে, সে নিজের গায়ে একটা নরম হাতের অস্থিত্ব টের পেলো।তূর্যয় তার পাশ থেকে চাদর সরাতেই দেখলো রাণী তার বুকের পাশে মাথা রেখে এক হাত তূর্যয়ের গায়ের উপর আলতো করে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।বালিশ ছেড়ে রাণী বিছানায় মাথা রেখেছে।রাণীকে দেখে তূর্যয় স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।তূর্যয় এক পাশ হয়ে শুয়ে রাণীর মুখের উপর চলে আসা চুল সরিয়ে দিলো।রাণীর গায়ের আঁচল আপাতত তার গায়ে নেই। তার শরীরের দিকে চোখ যেতেই তূর্যয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।রাণীর পেছন থেকে শাড়ির আঁচল নিয়ে তূর্যয় আলতো করে তা রাণীর বুকের সামনে এনে দিলো।একপাশ হয়ে শোয়ার কারণে তূর্যয়ের পেটে চাপ পড়ছে।কিন্তু তাও সে রাণীর ঘুমন্ত মুখটা দেখার লোভ সামলাতে পারছে না।তাই নিজের ব্যাথা সহ্য করে সে একপাশ হয়ে তার রাণীকে দেখে যাচ্ছে।একটু পরে এই অল্প ব্যাথার জন্যে তূর্যয় উঠে ওষুধ খেয়ে নিলো।রাণীর ঘুমন্ত মুখ উপভোগ করার মাঝে তূর্যয় কিছুকেই আসতে দিতে চাই না।তার ব্যাথাকেও না।ওষুধ খেয়ে তূর্যয় আবারও রাণীর পাশে শুয়ে পড়লো।রাণীর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তূর্যয় রাণীকে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে নিলো। আঁকড়ে ধরলো সে রাণীর কোমর।রাণী ঘুম কাতর।টেবিলের উপর বাটি,কাপড় দেখে তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে নিলো। তূর্যয় কিছু একটা আন্দাজ করে আপনমনে বলতে লাগলো,
–“ইস,আমাদের বিয়ের প্রথম দিনেই অনেক কাজ করিয়েছি আমি তোমাকে দিয়ে,তাই না!কালকে তুমি হয়তো একটুও ঘুমাওনি আমার সেবা করার জন্যে।আসলেই আমি একটা দানব।যে শুধু তোমায় কষ্ট দিয়ে যায়।এখন থেকে আর কোনো কষ্ট দিবো না আমি তোমায়।শুধু বেশি জ্বালাবো তোমাকে। যাতে রেগে গিয়ে তুমি আমাকে আরো বেশি ভালোবাসো।”
তূর্যয় রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।দুর্বলতার কারণে তূর্যয় আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।
মোবাইলের রিংটোন এর শব্দে রাণী এবং তূর্যয়ের ঘুম ভেঙে গেলো।কিন্তু,মোবাইল কোথায় বাজছে এটাই তারা বুঝছে না।রাণী নিজের চোখ খুলতেই তূর্যয়ের উদোম বুক দেখতে পেলো।রাণী ভ্রু কুঁচকে মাথা উঠাতেই দেখলো, নিভু নিভু চোখ খুলে তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা খোঁজার জন্যে হাত নাড়ছে।রাণী তূর্যয়ের পেটের সেলাইয়ের কথা ভাবতেই তূর্যয়ের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ঘুম কণ্ঠে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“এই আপনার না পেটে সেলাই করা আছে।আপনি এইভাবে এক পাশ হয়ে শুয়ে আছেন কেনো?”
রাণী কথাটা বলে উঠে বসতে নিলেই সে টের পেলো তূর্যয়ের চেইনের সাথে রাণীর চুল আটকে আছে।তূর্যয় ইচ্ছা করে সোজা হয়ে শুতেই রাণীর চুলে টান পড়ে একেবারে ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো।রাণী তাই নিজের চুল বাঁচাতে তূর্যয়ের দিকে এগিয়ে বসলো।এই সুযোগে তূর্যয় রাণীর কোমরে হাত পেঁচিয়ে নিলো।রাণী তূর্যয়ের চেইন থেকে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিতে নিতে তূর্যয়কে রাগী চোখে বললো,
–“অসভ্য একটা,কথা বলে না আমার সাথে।আবার আমার কোমরে হাত দিচ্ছেন কোন সাহসে?”
তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“আঁচল কই?”
আঁচলের কথা শুনতেই রাণীর শরীর শীতল হয়ে এলো।তূর্যয়ের গাল ধরে তার মাথা সোজা করে দিলো রাণী।নিজের আঁচল ঠিক করতে নিলে রাণী দেখলো তার আঁচল ঠিকই আছে।রাণী বুঝতে পারলো,তূর্যয় নিতান্তই তাকে বোকা বানাচ্ছে।তূর্যয় হেসে উঠলো।এই দেখে রাণীর যেনো রাগ আরো বেশি বাড়লো।কিন্তু রাণী কিছু বলার আগে আবারও তূর্যয়ের মোবাইল বেজে উঠলো।তূর্যয় উঠে বসলো।রাণীকে সে বলে উঠলো,
–“মোবাইল কোথায় আমার?”
রাণী তূর্যয়ের কথায় এদিকে সেদিকে খুঁজতে লাগলো মোবাইল। পরে রাণী তূর্যয়ের মোবাইল উদ্ধার করলো তার পায়ের পাশ থেকে।স্ক্রিনে “হ্যারির” নাম ভেসে আসছে।রাণী মোবাইল ধরিয়ে দিলো তূর্যয়কে।বিছানা থেকে নেমে রাণী ব্যালকনিতে গেলো।হ্যারির সাথে তূর্যয় কথা বলে জানলো,হ্যারি তাদের জন্যে নাস্তা বানিয়ে অফিসে চলে গিয়েছে।মোবাইলে কথা বলা শেষে তূর্যয় বিছানা থেকে নামলো। পেটে নতুন ব্যান্ডেজ দেখে অবাক হলো না সে।তূর্যয় বুঝতেই পারছে,তার সেলাই ঠিক করানো হয়েছে। অবশ্য এখন তূর্যয় তার পেটে আর ব্যাথা অনুভব করছে না।তূর্যয় উঁকি দিলো ব্যালকনির দিকে।রাণী ব্যালকনির রেলিং এ হাত রেখে উল্টো দিকে ফিরে আছে।অতিমাত্রার বাতাসে রাণীর চুল, শাড়ীর আঁচল উড়ছে।শাড়ি একটু লুস হয়ে থাকায় রাণীর উন্মুক্ত কোমরটাও চোখ এড়ালো না তূর্যয়ের।রাণীর দিকে ভালোবাসার নজরে তাকিয়ে নিজের কাপড় নিয়ে তূর্যয় বাথরুমের দিকে গেলো।রাণীর ঐ কাজের জন্যে তূর্যয়ের মনে রাণীর জন্যে বরাদ্দ করা শাস্তি এখনো তূর্যয়ের মনে আছে।তাই তূর্যয় আর রাণীর কাছে গেলো না।কারণ,রাণীকে সে এমন একটা শিক্ষা দিতে চাই;যেনো রাণী কখনো ভুলেও তার ভালোবাসাকে অসম্মান না করে।
এইদিকে রাণী তূর্যয়ের অপেক্ষা করছিল ব্যালকনিতে।তূর্যয় না আসার কারণে রাণী পুনরায় রুমে আসলো।তূর্যয়কে রুমে না দেখে রাণী বাথরুমের দিকে তাকালো।বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় রাণী বুঝলো,
তূর্যয় রাণীর সাথে এখনো রেগে আছে।নাহলে সে ঠিকই রাণীর কাছে আসতো ব্যালকনিতে।রাণী বিছানা গুছিয়ে নিলো।তূর্যয় এখনো রাণীর সাথে রেগে আছে ভেবে রাণীর মন খারাপ হলো।সে তূর্যয়ের মোবাইল নিয়ে সিমিকে ফোন করলো।রাণীর জন্যে দোকানের খবর নেওয়াটা এখন জরুরি,সাথে রাণী তার বান্ধুবিদের অনেক মিস করছে।আর সিমিকে পঙ্গু ভেবে সবসময় রাণী তাকে বেশি দেখতে পারে।কয়েকবার রিং হওয়ার পরে সিমি ফোন রিসিভ করে ভালো মানুষের ভং ধরে বলে উঠলো,
–“আরে নতুন বউ! কেমন আছো?”
–“এইতো আছি।তোদের কি অবস্থা।সবার কথা অনেক মনে পড়ছে।দোকানে এসেছে কলিরা?”
রাণী সিমিকে বললো।
–“হ্যাঁ,ভালো আছি।আর কলিরা সবাই দোকানে গিয়েছে।তুই দোকানের ল্যান্ড লাইনে ফোন করলেই তো হতো।”
সিমি খোঁচা মেরে বললো রাণীকে।
–“হুম পারতাম।তবে,তোকে মিস করছিলাম বেশি।তাই তোকেই ফোন দিয়েছি।বেড়াতে আসিস এইখানে।”
রাণী মন খারাপ করে বললো।
–“আসবো।তুইও আসিস এইখানে।”
সিমি একটু মুড দেখিয়ে বললো।তূর্যয়কে বাথরুম থেকে বের হতে দেখলে রাণী সিমিকে বলে উঠলো,
–“আচ্ছা রাখছি এখন। পরে ফোন দিবো।”
রাণী ফোন কেটে দিলো।তূর্যয়ের মোবাইল রাণী রাখলো ছোট টেবিলের উপর।তূর্যয় আড় চোখে রাণীর দিকে তাকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।রাণী তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“আপনার ওষুধ আছে নাস্তা খাওয়ার আগে।”
তূর্যয় চুপ করে আছে।কিছু বললো না।রাণীর এইবার ভালো লাগছে না।সে আবারও তূর্যয়কে বললো,
–“আপনি কি বাহিরে যাবেন?দেখুন ডাক্তার বলেছে আপনাকে অন্তত দুইদিন রেস্ট করতে।তাই আপনি কোথাও যাবেন না।”
তূর্যয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে।রাণীকে সে আয়নায় দেখতে পাচ্ছে।রাণী কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে তূর্যয়কে।কিন্তু আবারও রাণী কিছু না বলে চুপ করে আছে মাথা নিচু করে।তূর্যয় গায়ে টিশার্ট চড়িয়ে রাণীর সামনে হেঁটে টেবিলের উপর থেকে মোবাইল নেওয়ার সময়,রাণী ছোট্ট করে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“সরি।”
তূর্যয় মনে মনে হাসছে।রাণীকে এমন হেনস্তা করতে তূর্যয়ের বেশ ভালো লাগছে।তূর্যয় উত্তর না দিয়ে চলে আসতে নিলে,রাণী তূর্যয়ের হাত ধরে তাকে বললো,
–“সরি।”
তূর্যয় এইবার মুখ খুললো,
–“কেনো?”
রাণী চোখ তুলে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।রাণীর ছলছল চোখ দেখে তূর্যয়ের মনটা নড়ে উঠলো।রাণী চোখের পলক ফেলতে তার গালে পানি গড়িয়ে পড়লো।তূর্যয় বুঝছে,এখন রাণী কিছু বললে সে রাণীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিবে।কিন্তু,রাণীর শাস্তি এখনো বাকি আছে ভেবে তূর্যয় রাণীকে জোর গলায় বললো,
–“হাত ছাড়।কাজ আছে আমার।”
রাণীর হাত থেকে তূর্যয় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।তূর্যয়ের এমন ব্যবহার দেখে রাণী নিজের ঠোঁট চেপে কান্না করতে লাগলো।যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,সেই মানুষটা রাগ দেখিয়ে তাকে এড়িয়ে চলছে; এটা ভাবতেই রাণীর মনটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।তূর্যয় রাণীর সামনে থেকে সরে রাণীর দিকে চেয়ে রইলো।আর বেশিক্ষণ রুমে থাকলে সে রাণীর প্রতি দুর্বল হয়ে যাবে।তাই তূর্যয় দ্রুত পায়ে নিচে নামলো।তূর্যয় ভেবেছে রাণীর নাস্তা তাকে দিয়ে আসতে হবে।কিন্তু,নিচে একজন কাজের মহিলাকে দেখে অবাক হলো তূর্যয়।তূর্যয়কে দেখে মহিলাটি তূর্যয়কে বললো,
–“আমি সেই সকালেই আইছিলাম কাম করার লাইগা।হ্যারি স্যার কইছে, আপনেরা উঠলে নাস্তা গরম কইরা দিতে।তাই সবাইরে কাম শেষে চইলা যাইতে কইলেও,
আমারে থাকতে কইছে এইয়ানে।আপনি বসেন,আমি খাবার গরম কইরা আনতেছি।”
কাজের মহিলাটি কথাগুলো বলে চলে গেলো।তূর্যয় মোবাইল বের করে হ্যারিকে ফোন দিলো,
–“রৌদ্রের জন্যে কিছু শপিং করা লাগবে।শপিং মলে কিছু শাড়ির অর্ডার প্লেস করে দিও।আর ঠিকানা দিবে আমার বাড়ির।”
–“ওকে ব্রো।তুমি আর সিস দুইজনই ওকে আছো তো?”
হ্যারির প্রশ্ন।
–“আছি।অফিসের কাজ কেমন চলছে?আমি আসবো সন্ধ্যার দিকে।মাথাটা এখনো ধরে আছে আমার।”
তূর্যয় নিজের চুল টেনে বললো।
–“নো ব্রো।আসতে হবে না তোমার।রেস্ট নাও তুমি।অ্যান্ড,তোমার হাউজের আস্তানায় একবার যাওয়া লাগবে তোমার।ইকরামের কাছে কিছু ফাইল আছে।সিগনেচার করে দিও।”
হ্যারি হাসিমুখে উত্তর দিলো তূর্যয়কে।
–“আচ্ছা।”
তূর্যয় কথাটি বলে ফোন কেটে দিলো।মোবাইলে সে নিজের কালো বাজারির ব্যবসার নানান খবরা খবর দেখছে।কাজের মহিলা খাবার নিয়ে আসলে তূর্যয় তাকে নির্দেশ দিলো,
–“ম্যাডামকে খাবার দিয়ে আয় উপরে।”
–“আইচ্ছা,স্যার।”
তূর্যয় খাবারগুলো দেখে একটু নিঃশ্বাস ফেললো।কারণ,
তূর্যয়ের পছন্দ রাণীর হাতের সাদামাটা নাস্তা।কিন্তু হ্যারি এইখানে সব তার দেশের নাস্তা বানিয়ে রেখেছে।তূর্যয় মাথা নাড়িয়ে চামচ তুলে নিলো নাস্তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে।
রাণী তাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতেই শুনতে পেলো দরজায় খটখট শব্দ।একটু পরেই একটা মহিলা হাতে ট্রে নিয়ে রুমের ভেতরে এসে রাণীকে বললো,
–“স্যার কইছে,নাস্তা খাইয়া নিতে।”
রাণী কিছু বললো না।মহিলাটি ট্রে রেখে চলে গেলো।রাণী একবারও তাকালো না নাস্তার ট্রে এর দিকে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে।একেবারে বিবাহিত লাগছে তাকে দেখে।রাণী নিজের চুলে হালকা হাত বুলিয়ে নিলো।আপনমনে সে ভাবছে,
–“বিয়েটা হয়ে গেলো।ভালোবাসার মানুষটাকেও পেয়ে গেলাম।কিন্তু,এখনো উনি একবারও আমাকে ভালবেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন না।বুঝলাম আমার ভুল ছিল।কিন্তু,ভুল তো উনিও কম করেননি!তাহলে শুধু শাস্তিটা আমি একা কেনো ভোগ করবো?আমার সাথে রাগ দেখিয়ে নিজের ওষুধ পর্যন্ত খেলেন না উনি।এতো জিদ উনার!আসলেই,দানব সন্ত্রাসী নামটা উনার সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে।”
রাণী একনজর খাবারের ট্রে এর দিকে তাকিয়ে বেশ জোরেই বললো,
–“খাবো না আমি।না খেলে মরে যাবো না।আমার সাথে জিদ দেখিয়ে কথা বলছে না,আবার দরদ দেখিয়ে খাবার পাঠিয়েছে। এতোই যদি দরদ থাকতো,তবে আমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতেন উনি!যত্তসব ঢং।”
রাণী মুখ গোমড়া করে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে পড়লো সেখানে থাকা চেয়ারের উপর।সমুদ্রের শান্ত শব্দ আর লোমহর্ষক বাতাস রাণীকে নাড়িয়ে তুলছে।রাণী নানা কথা ভেবে চলার মাঝে স্থির চোখে সমুদ্র দেখছে।
নাস্তা সেরে তূর্যয় নিজের আস্তানায় চলে গেলো।সেখানে ইকরামের সাথে টুকটাক কাজ শেষ করে এসে নিজের রুমে আসলো সে।রুমে তূর্যয় রাণীকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো।টেবিলের উপর নাস্তার ট্রে দেখে মেজাজ খারাপ হলো তূর্যয়ের।রাণী কোনো নাস্তা ছুঁয়েও দেখেনি এটা ভেবে তূর্যয়ের শরীর রাগে গজগজ করছে।সে দ্রুত পায়ে ব্যালকনিতে গেলো।সেখানেও রাণীকে না দেখে তূর্যয়ের একটু খটকা লাগলো।তূর্যয় দ্রুত হেঁটে নিচে নামলো।সব জায়গায় খুঁজতে লাগলো সে রাণীকে।কিন্তু,
কোথাও দেখা মিলছে না রাণীর।রাগে জোরে জোরে চিৎকার করছে সে রাণীর নাম ধরে।
রাণী ছাদের উপর। কোথা থেকে কিছু কবুতর উড়ে এসেছে ছাদের এক কোণে।রাণী ছাদে বিদ্যমান দোলনায় বসে সেই কবুতরদের নানান কীর্তি কান্ড দেখছে।এইদিকে ক্ষুধায় তার পেটে চোঁ চোঁ করছে।রাণী পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“সেই গতকাল সন্ধ্যায় নাস্তা খেয়েছি, এখন দুপুরের সময় চলছে।পেটের ক্ষুধায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে আমার।এই সন্ত্রাসীটা বিয়ে করে পালিয়েছে।কোনো খবর নেই।শুধু মুখে বলে ভালোবাসি,আর কাজকর্মে দেখো,
ভালোবাসার নাম নিশানা নেই।এমন দানব মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।হিংস্র একটা।”
–“একটা চড় দিয়ে সব জিদ বের করে দিবো।আমাকে না জানিয়ে এইখানে এসেছিস কেনো?”
তূর্যয় রেগে চিল্লিয়ে বললো।
রাণীকে খুঁজে না পেয়ে,তূর্যয় ঘরে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করে দেখতে পেলো রাণী ছাদে উঠেছে একটু আগে।
তূর্যয়ের কথায় রাণী ভয় পেয়ে নেমে গেলো দোলনা থেকে।তূর্যয় এর নজর আটকে গেলো রাণীকে দেখে।রাণীর গায়ের অলংকার তাকে তূর্যয়ের বউ বলেই আহ্বান জানাচ্ছে।রাণীর ডাগর ডাগর চোখে ভয় বিদ্যমান।তূর্যয়ের মনে মায়া জমেছে রাণীর জন্যে।কিন্তু রাণীর জিদের কথা মনে আসতেই তূর্যয় দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলো রাণীর কাছে।রাণী ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে যেতেই তূর্যয় রাণীর চুলে টান দিয়ে তাকে চিল্লিয়ে বললো,
–“দুপুরের কয়টা বাজে,এখনো নাস্তা না খেয়ে ছাদে কি করছিস?সাহস কি করে হয় আমার কথা অমান্য করতে?বেশি ভালোবাসি তাই মাথায় উঠে নাচবি?”
রাণী চুপ করে আছে।তূর্যয়ের রাগী চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।তূর্যয় রাণীর গাল চেপে তাকে বললো,
–“মুখ বন্ধ কেনো?”
–“কেউ আমার সাথে কথা না বললে,আমি কেনো তার সাথে কথা বলবো!আর আর ক্ষুধা লাগেনি।আপনাকে আমার চিন্তা করতে হবে না।”
রাণী নিজের মুখ থেকে তূর্যয়ের হাত সরাতে নিলে তূর্যয় নিজেই রাণীর মুখ ছেড়ে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো।রাণী চমকে উঠলো।পরক্ষণে সে তূর্যয়কে বললো,
–“আরে আপনার পেটের সেলাইয়ে সমস্যা হবে। আপনি ব্যথা পাবেন।”
–“আমার গায়ে ব্যথা লাগেনা।”
তূর্যয় এই কথা বলে আর কিছু বললো না।রাণীকে রুমে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো তূর্যয়।রাণী হাত পা গুটিয়ে বসে আছে।তার কথা হলো,সে নাস্তা খাবে না।অগত্য,
তূর্যয় রাণীকে জোর করে নাস্তা খাইয়ে দিতে লাগলো।তূর্যয়ের দানবীয় শরীরের সাথে না পেরে রাণী চুপ করে অল্প নাস্তা করলো।নাস্তা শেষে তূর্যয় উঠে চলে যেতে নিলে রাণী তূর্যয়ের টিশার্ট ধরতেই তূর্যয় দাঁড়িয়ে পড়লো।রাণী একহাতে নিজের কান ধরে তাকে বলে উঠলো,
–“সরি তো।আর কখনো আমি এমন করবো না।আপনি যা বলবেন সব শুনবো আমি। ওয়াদা তূর্যয়।আমি শুধু আপনার কথামতো চলবো।”
রাণীর এমন নরম কণ্ঠের কথা শুনে তূর্যয়ের মন গলে গেলো।এখন তূর্যয়ের করুণা হচ্ছে রাণীর জন্যে।সে মনে মনে ভাবছে,
–“শুধু শুধু এই মেয়েকে আমি কষ্ট দিয়েছি।কয়েকবার সরি বলেছে আমাকে সে,শুধুমাত্র আমি যেনো তার সাথে কথা বলি।আর আমি!মেয়েকটাকে শুধু শুধু এতো কান্না করিয়েছি।আসলেই আমি একটা দানব।”
তূর্যয় রাণীর হাত ধরে তাকে টেনে দাঁড় করালো।রাণী মাথা নিচু করে আছে।তূর্যয় আলতো হাতে রাণীর মুখ তুলে তাকে জবাব দিলো,
–“একদম না।আমি তোমাকে আমার কাছে বন্ধী করে রাখবো না।তুমি তোমার মতো সব করতে পারবে।নিজের মন মতো।আমার বউকে আমার দাসী নয়,বরং আমার রাণী করে রাখতে চাই।শুধু একটাই অনুরোধ,আমাকে যেনো একা করে চলে না যাও।আর সেদিনের জন্যে আমিও অনেক সরি।”
রাণী তূর্যয়ের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো।রাণী ভাঙ্গা কণ্ঠে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“ভালোবাসি।আপনাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি।আপনাকে ছেড়ে কই যাবো আমি?আপনিই তো আমার সব,আমার পরিবার,আমার একমাত্র দুনিয়া।”
তূর্যয়ের চোখে ঘোর লেগে যাচ্ছে।নিজের বউকে একান্তই নিজের করে নেওয়ার আকাঙ্খা তূর্যয়ের সারা শরীরে বয়ে যাচ্ছে।তূর্যয় রাণীর কোমরে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো।আবেশে রাণী চোখ বন্ধ করলো।তার একমাত্র ভালোবাসার সবটুকু ভালোবাসা পেতে রাণীর মনটাও ব্যাকুল হয়ে আছে।তূর্যয় রাণীর দিকে বেশ ঝুঁকে তার ঠোঁট দিয়ে রাণীর গলায় বেশ কিছু ভালোবাসার পরশ দিলো।রাণী খামচে ধরলো তূর্যয়ের টিশার্ট।রাণীর ঠোঁট ঠকঠক করে কাঁপছে।তূর্যয় তৎক্ষণাৎ রাণীর ঠোঁট নিজের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলো।রাণী শক্ত করে চোখ বুজে আছে।এক পর্যায়ে তূর্যয় রাণীকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বিছানায় রাখলো।লজ্জায় রাণীর প্রাণ বেরিয়ে আসছে।রাণীর লজ্জামাখা মুখ আর দ্রুত শ্বাস নেওয়া দেখে তূর্যয় নিজের টিশার্ট খুলে নিয়ে রাণীর উপর ঝুঁকতেই রাণী নিজের মুখ দুইহাত দিয়ে ঢেকে নিলো।তূর্যয় রাণীর হাত সরিয়ে দিয়ে রাণীর গলায় বেশ জোরে চুমু দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“আমার সর্ব সত্তায় তোকে মিশিয়ে নিতে চাই।তুই যে শুধু তূর্যয়ের রৌদ্র,এটা আমি তোকে জানাতে চাই।তোর ভালোবাসার সবটুকু ভাগীদার একান্তই আমি হতে চাই।পূর্ণতা পাবে আজ আমাদের আলো আঁধারের ভালোবাসা।যে ভালোবাসায় আলোর দরকারে আধাঁর আসবে তো,আঁধারের দরকারে আলো আসবে।”
রাণী তূর্যয়ের পিঠে হাত রাখলো।নিজের ঠোঁট চেপে তূর্যয়ের এমন ভালোবাসাময় কথা শুনছে সে।কিন্তু,তূর্যয় বেশিক্ষণ দেরী করেনি রাণীর ঠোঁট নিজের করে নিতে।অতঃপর রাণী হারিয়ে যেতে লাগলো তূর্যয়ের ভালোবাসাময় স্পর্শে।
;
সাবিনা মুখ গোমড়া করে বসে আছে আহমেদের সামনে।আহমেদকে তূর্যয়ের বিয়ের খবর দিয়েও লাভ হয়নি তার।আহমেদ নিজের মন মতো নেশা করে যাচ্ছে।এই দেখে সাবিনা আহমেদকে বললো,
–“তুই কি আসলেই তূর্যয়ের ক্ষতি চাস?”
আহমেদ চোখ বাঁকা করে তাকালো সাবিনার দিকে। সে সাবিনাকে গালি দিয়ে তাকে জবাব দিলো,
–“মেয়ে মানুষের মাথায় আসলেই সব গোবর।গতকাল বিয়ে করেছে আর আজই কি মেরে ফেলার প্ল্যান করবো?তাহলে কি লাভ হবে?তূর্যয়ের কোনো কষ্ট হবে?হবে না।আরে বিয়ে করেছে কিছু স্মৃতি তো বানাতে দাও। যতো বেশি স্মৃতি হবে,তত বেশি কষ্ট হবে। বুঝোই তো,মানুষ তার সবকিছু ভুলে যেতে পারলেও প্রিয়জনের সাথে থাকা স্মৃতি ভুলতে পারে না।তূর্যয়কে সময় দাও তার বউয়ের সাথে স্মৃতি তৈরি করতে।আর তোমার ঐ পঙ্গু সাথীকে বলো এইসব।যত্তসব মাথা মোটা।”
–“বালের পঙ্গু।হাঁটতে পারে সে মাইয়্যা।আচ্ছা,বুঝলাম বাবা।যায় বলে আসি সেই মেয়েকে এইসব।তোর মাথা আসলেই অনেক বেশি প্রখর।”
সাবিনা কথাগুলো বলে সিমিকে ফোন দিয়ে আহমেদের কথাগুলো জানালো।সিমি আহমেদের কথাবার্তায় বেশ অবাক হয়।সে আপনমনে বলতে লাগলো,
–“এই লোকের খারাপ মেন্টালিটি দেখে আমি বেশ অবাক হচ্ছি।খারাপ লোকের মাথায় আসলেই বুদ্ধির অভাব নেই।এই যেমন আমি!কেউ বলতে পারবে আমি সেই কালনাগিনী,যে রাণীর ক্ষতি করতে চাই?পারবে না।তবে এই আহমেদ বেশ চালাক এক লোক।ঠিক আছে রাণী,কিছুদিন দুনিয়াটা দেখে নে ভালো করে তোর সেই সন্ত্রাসীর সাথে।এরপর তুই যাবি কবরে আর তূর্যয় হবে বেচারা।আহহহ!”
সিমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
চলবে…..
কপি করা নিষেধ।কেমন হয়েছে গল্প জানাবেন সবাই।ভালোবাসা অবিরাম।সবার সাথে কমেন্টে কথা হবে।