#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ১৮

0
434

#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ১৮
#লেখিকা: সালসাবিল সারা

১৮.
রাণীর হাত,পা বাঁধা। সাথে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো চেয়ারে বসা অবস্থায়।রাণী তার শরীরে এক প্রকার ব্যাথা অনুভব করছে।কিন্তু, কিসের ব্যাথা; সেটা সে জানে না। তার মাথায়ও রাণী বড্ড ভার অনুভব করছে।অনেক কষ্টে রাণী তার মাথা উঠাতেই তার একটু সামনে দেখতে পেলো,তূর্যয়কেও কেউ বেঁধে রেখেছে চেয়ারের সাথে।তূর্যয়ের উদোম গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে রাণী।সে ভেবে পাচ্ছে না তারা দুইজন এইখানে কিভাবে এলো?যতটুক মনে আছে তার,তূর্যয় ঐ লোককে গুলি করেছিল।তাহলে তাদেরকে আটক করলো কে?রাণী কপাল বেয়ে কিঞ্চিৎ ঘাম পড়তে শুরু করলো।তূর্যয়ের হাতের দিকে তাকালে রাণী দেখতে পেলো তূর্যয়ের দুই হাতের উপরের পিঠে একদম চামড়া উঠে আছে।এই দৃশ্য দেখে রাণীর বুক কেঁপে উঠলো।রাণীর জন্যেই তো আজ তূর্যয়ের এই অবস্থা হয়েছে।না রাণী মিশনে আসতো,না তূর্যয়ের আজ এই অবস্থা হতো!রাণী কান্না করা শুরু করলো।ধীর গলায় সে তূর্যয়কে ডাকতে লাগলো,
–“তূর্যয় বস!তূর্যয়?”
তূর্যয় একটু নড়ে উঠলো।ধীরে ধীরে মাথা উচু করে তূর্যয় তাকালো।তূর্যয়ের মুখ দেখে আতকে উঠলো রাণী।তূর্যয়ের কপাল কেটে রক্ত ঝরছে।সাথে সে তূর্যয়ের নাকে,ডান পাশের গালে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে।রাণীর কান্নার বেগ আরো বাড়তে লাগলো তূর্যয়ের এমন অবস্থা দেখে।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে বললো,
–“আমরা এইখানে কিভাবে এসেছি?আর আপনার গায়ে এতো আঘাতের চিহ্ন কেনো?”
তূর্যয় কিছু বলার জন্যে তার মুখ খুলতেই তার মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করলো।এই দেখে রাণী জোরে চিল্লিয়ে বললো,
–“আপনার মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, তূর্যয়।দুঃখিত আমি!আমার জন্যেই তো আপনার এই অবস্থা হয়েছে।আপনি পালিয়ে যান।আমি এখানে একাই মরবো।”
রাণীর কান্নার বেগ বাড়তে লাগলো।তূর্যয় চুপ করে রইলো।তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।কিন্তু, রাণীর জোরে কান্নার শব্দে সেই বদ্ধ ঘরে কেউ প্রবেশ করলো।রাণী সেদিকে তাকাতেই দেখলো,সেই লোকটা এই ঘরে এসেছে;যে লোকটা রাণীর গলায় ছুরি ধরেছিল।
লোকটাকে দেখে রাণী বলতে লাগলো,
–“তোকে না তূর্যয় গুলি করেছিল?তাহলে তুই বেঁচে আছিস কিভাবে?”
লোকটা হা হা করে হেসে উঠলো।পুরো ঘরে লোকটার সেই হাসি প্রতিফলিত হচ্ছে।রাণীর ভয় আরো বাড়তে লাগলো।তূর্যয়ের কোনো নড়চড় নেই।রাণী ভেবে পাচ্ছে না তূর্যয় আজ এত দুর্বল কিভাবে হলো?
–“আমাকে মারবে এই তূর্যয়?তোর এই তূর্যয়কে তো মারবো এখন আমি?”
কথাটা বলেই লোকটা দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগলো তূর্যয়ের দিকে।রাণী মাথা নাড়িয়ে “না” দেখালো লোকটিকে।কিন্তু লোকটি থেমে নেই।রাণী কান্নারত অবস্থায় লোকটিকে বলতে লাগলো,
–“তাকে মারবেন না।আমাকে মেরে ফেলুন উনার বদলে।প্লিজ!মারবেন না উনাকে।তূর্যয়?কি হয়েছে আপনার আজ?উঠুন না!”
কিন্তু বেশ দেরী হয়ে গেলো রাণীর কথাগুলো বলতে। ছুরি হাতে লোকটা, তার ছুরি চালিয়ে দিলো তূর্যয়ের গলায়। তূর্যয়ের চাপা আর্তনাদে রাণীর যেনো জগৎ ঘুরে উঠলো।সাথে সাথেই রাণী জোরে চিৎকার দিলো,
–“তূর্যয়!”

ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো রাণী।একপ্রকার কাঁপছে রাণীর সম্পূর্ণ শরীর।রাণী নিজের হাত পা ভালো করে দেখতে লাগলো।সাথে তার চোখ খুঁজছে তূর্যয়কে।রাণী আশে পাশে তাকাতেই দেখলো সে তাদের এতিম খানার রুমে আছে।রাণীর বুকটা ধুকধুক করছে। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলো রাণী।দুইহাতে নিজের মাথা চেপে ধরলো সে।জানালা দিয়ে আসা আলোতে সম্পূর্ণ ঘর আলোকিত হয়ে আছে।রাণী বুঝতে পারছে একটু আগে তার দেখা দৃশ্যগুলো স্বপ্ন ছিল।রাণীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।মাথা থেকে হাত সরিয়ে আবারও রুমের চারদিক দেখলে রাণী কাউকে দেখতে পেলো না।রুমে লাগানো ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে এখন সকাল নয়টা বাজে।এতিম খানার সবাই অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে যায়। যার কারণে তার বান্ধুবিরা কেউ নেই রুমে।ঘড়ির সময় দেখে রাণীর মাথায় এলো,
তূর্যয়ের ঘরে যেতে হবে তাকে।বিছানা থেকে পা নামাতেই দূর্বল অনুভব করতে লাগলো সে।বিছানার সাথে আবারও মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে সে ভাবতে লাগলো,
–“এতো ক্লান্ত লাগছে কেনো আমার? কাল আমার সাথে কি হয়েছিল?তাছাড়া এতো খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি,তূর্যয়ের কিছু হলো না তো? গতকালের সেই গুলির শব্দে আমার কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না।এরপর নিজের গায়ে তূর্যয়ের স্পর্শ পেয়েছিলাম।তাকে আঁকড়ে ধরতেই কি হলো আমার,কিছুই তো আর মনে নেই।আমাকে এইখানে কে নিয়ে এসেছিল?তাছাড়া তূর্যয় কি ঠিক আছে?আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তূর্যয় কোনো বিপদে পড়েনি তো?”
রাণী বিছানা থেকে নেমে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের মোবাইল বের করলো।কিছু না ভেবেই তূর্যয়ের মোবাইলে ফোন লাগালো সে।যদিও তার ভেতর একটু অনুশোচনা বোধ হচ্ছে এইভাবে তূর্যয়কে ফোন দেওয়ার কারণে।কিন্তু,কিছুই তো করার নেই।হাজার হলেও,
রাণীর প্রাণ বাঁচিয়েছে তূর্যয়।তাছাড়া,তূর্যয়ের প্রতি এখন রাণীর চিন্তাটা; রাণীকে অন্য এক আবেগপ্রবণ অনুভূতি দিচ্ছে।তাই সবকিছু একপাশে ঠেলে রাণী ফোন লাগালো তূর্যয়কে।


বড় এক মাঠের এক পাশ ধরে জগিং করছে তূর্যয়।রাগে তার শরীর গিজগিজ করছে কাল রাতের এক ঘটনার কারণে।এর মধ্যেই মোবাইল বেজে উঠলে তূর্যয় থেমে গেলো।তার পড়নে ট্রাউজারের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখতে পেলো আননোন নাম্বার।বিরক্তি নিয়ে তূর্যয় ফোন রিসিভ করে মোবাইল কানে লাগাতেই তার কানে ভেসে এলো একটা মেয়েলি কণ্ঠ,
–“হ্যালো তূর্যয়,আপনি ঠিক আছেন?সরি,তূর্যয় বস;
আপনি ঠিক আছেন?দুঃখিত আপনাকে আমি ফোন করেছি।”
রাণীর কণ্ঠ চিনতে পেরে তূর্যয় কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো।তূর্যয়ের বুকে চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে।সে মোবাইল হাতে নিয়ে মাঠের পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লো।একহাতে কপালে চলে আসা লম্বা চুলগুলোকে ঠেলে দিয়ে মাথার উপর উঠিয়ে দিলো সে।চোখ বন্ধ করতেই তূর্যয়ের চোখে ভেসে এলো কাল রাতের মিটিং এর কিছু দৃশ্য।

রাণীকে এতিম খানায় নামিয়ে দিলে রাণীর বান্ধবীরা এসে তাকে এতিম খানার ভেতর নিয়ে যায়।হ্যারি আগেই ফোন করে সিমিকে জানিয়ে দিয়েছিল রাণীর অবস্থার কথা।এরপর তারা এতিম খানার সামনে আসতেই সিমিদের দেখতে পেয়েছিল, আর রাণীকে দিয়ে দেয় তাদের কাছে।রাণীকে নামিয়ে দিয়ে তূর্যয় আর হ্যারি চলে যায় তাদের ব্ল্যাক কোম্পানির মিটিং এ।সেখানে বিপরীত পক্ষের সাথে কথা কাটা কাটি হয়।এক পর্যায়ে লেগে যায় তুমুল মারপিট।তূর্যয় তার বুলেটের মাধ্যমে নিয়ে নিয়েছিল অনেকের প্রাণ,যেখানে ছিল আকবর হুসাইন এর ছোট ভাইও।আকবর হুসাইন আর আজমল হুসাইন অন্যতম নাম করা কালো বাজারের ব্যাবসায়ী।আজমলের গুলিবিদ্ধ লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় আকবর হুসাইন রক্তচক্ষু নিয়ে তূর্যয়কে বলেছিল,
–“পরিবার বলতে কিছু তো নেই তোমার।যাদের সাথে থাকো তারাই তো তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু।তাই তাদের মেরেও আমি তোমার মনে কষ্ট দিতে পারবো না।কিন্তু হ্যাঁ,যদি কখনো সন্ধান পায় তোমার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছে,সেদিনই সেই মানুষটার শেষ দিন হবে।আর তুমি বুঝতে পারবে আপন মানুষ হারানোর কষ্ট কি?”

–“হাহাহা, ইঁদুরের মুখে ইঁদুরের ডায়লগ মানায় আকবর হুসাইন।সাহস থাকলে আমাকে মেরে দেখা।একটা বুলেট,একটা বুলেট আমার গায়ে লাগিয়ে দেখা তুই!”
তূর্যয় রাগী ভাব নিয়ে বলেছিল আকবরকে।তখন আকবর হেসে বলেছিল,
–“তোমাকে মারলে তুমি মরে যাবে।কষ্ট পাবে না। তোমাকে জীবিত অবস্থায় যে কষ্ট অনুভব করাতে চাই,তোমাকে একবারে মেরে ফেললে সেই কষ্ট তুমি পাবে না।কারণ,একটা কথা কি জানো?নিজের মৃত্যুর চেয়ে আপনজনের মৃত্যু দেখা বেশি কষ্টকর।দ্রুতই বুঝতে পারবে এই যন্ত্রণা।অপেক্ষায় রইলাম তোমার আপন মানুষের।এখন থেকে তোমার উপর আমার নজর থাকবে চব্বিশ ঘণ্টা।”
আকবর তূর্যয়ের আর কোনো কথা না শুনে নিজের ভাইয়ের লাশ নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

তূর্যয় অন্য সবার লাশকে ঠিকানা লাগাতে বলে নিজে তার অফিস রুমে চলে গিয়েছিল।চেয়ারে বসে নিজের মাথার চুল টানতে থাকলো সে।কাঁচের টেবিলে করে ঘুষি দিয়ে রাগী কণ্ঠে সে চিল্লিয়ে উঠেছিল,
–“কেনো কেনো?আমার সাথেই সব সময় এমন হয় কেনো?আমি কি আল্লাহ্ এর কাছে এতই অপ্রিয়?যে জিনিস আমার কাছে ভালো লাগে,যাদের আমি ভালোবাসি, তারা কেনো থাকে না আমার সাথে?যেভাবে হোক,রাণীকে আমার বাঁচাতে হবে।রাণীর প্রতি আমার এই অনুভূতি এখনই প্রকাশ করা যাবে না।আকবর যদি জেনে যায় কোনোভাবে রানীর কথা,তাহলে রাণীকে সে শেষ করে দিবে।আমার চোখের সামনে আমি এটা কখনোই হতে দিবো না।কিন্তু, আমার চোখের আড়ালে এমন হলে আমি কী করব?আমার জন্যে সেই মাসুম মেয়ের কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না।আমার কাছে নিয়ে এনে তাকে রাখলে বিপদ কমবে না বরং বাড়বে। ঐ শালা আমাকে আপনজনের মৃত্যু বুঝায়?সেই ছোট কালে কষ্ট কি জিনিস আমি বুঝেছি।এখন সেই কষ্ট দ্বিতীয়বার অনুভব করার শক্তি নেই আমার।আকবর হুসাইন আমাকে কিছু করার আগে,আমাকে কষ্ট দেওয়ার আগে আমি তোকেই শেষ করে দিবো।”
তূর্যয় কথাগুলো ভেবে নিজের হাত মুঠ করে নিলো।নিজের শার্টের তিনটা বোতাম খুলে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল সে।এরপর সে শয়তানি হাসি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
–“এতো বছর পর নিজের সুখকে খুঁজে পেয়ে,আমি কখনো আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না তাকে।আমার রোদ্র কন্যার কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না।আমার মনে তার জন্যে জমানো ভালোবাসা, জমানোই থাক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।দূর থেকেই নাহয় আমি তাকে ভালোবাসবো?আমি তাশরীফ তূর্যয়,মাফিয়া লিডার।আমার জন্যে এখন পরিবার হলেই বড় সমস্যা দেখা দিবে।তাই, নিজের যতো ক্লোজ শত্রু আছে,আগে তাদের ধুলোয় মেশাতে হবে।হ্যাঁ তূর্যয়,তোকে তোর রোদ্র কন্যার থেকে দূরে থাকতে হবে; যতক্ষণ পর্যন্ত না এই আকবর হুসাইন আর বাকি শত্রুর কাহিনী শেষ না হয়।কিন্তু, এরপর কি হবে?কালকে তো সে অজ্ঞান থাকায় মুখে ভুলভাল যা এসেছে তাই বলেছি।আদৌ আমি কি এই হিংস্র রূপ থেকে বের হয়ে রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোবাসার কথা বলতে পারবো?তার মতে,আমি দানব,আমি পাথর।তাকে নাহয় আমি আমার দানবীয় কায়দায় ভালোবাসবো!এর আগে আমার সব শত্রুকে এই দুনিয়া থেকে বিদায় করতে হবে।দ্বিতীয়বার কোনো আপন মানুষকে আমি হারাতে পারবো না।”
এটাই ছিল তূর্যয়ের শেষ প্রতিশ্রুতি নিজের প্রতি।এই প্রতিশ্রুতি করার সময় তূর্যয়ের চোখজোড়া ছিল লাল,চোখের কোণায় জমেছিল নিজের ভালোবাসা কাছে থেকেও নিজের করে নিতে না পারার কষ্ট।কারণ,
তূর্যয়ের জীবনে ভালোবাসার,যত্ন নেওয়ার মানুষের খুব অভাব। সে হিংস্র হলেও, তারও তো একটা ছোট্ট হৃদয় আছে!যে হৃদয়ের কথা হার মানায় সকল হিংস্রতাকে।

আবারো মোবাইল বেজে উঠলে তূর্যয় নিজের হুঁশে ফিরে এলো।মোবাইলের দিকে তাকালে আবারও সেই নাম্বার অর্থাৎ রাণীর নাম্বার দেখতে পেলো সে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তূর্যয় সেই নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো।আরো কিছুক্ষণ মাঠে জগিং করে তূর্যয় নিজের “ডার্ক হাউজে” চলে এলো।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সে রাণীকে দেখলো টেবিলে কিছু রাখছে।রাণীকে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।টেবিলে কিছু রাখার পাশাপাশি রাণী বকবক করছে নিজে নিজে।এইসব দেখে তূর্যয় অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো,
–“পাগলী একটা।”
তূর্যয় সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো তৈরি হতে।

একটু পরে হ্যারি এসে পৌঁছালো।রাণীকে একা বিড়বিড় করতে দেখে হ্যারি তাকে প্রশ্ন করলো,
–“সিস,একা একা কি বলা হচ্ছে?”

রাণী নিজের কোমরে হাত রেখে বলতে লাগলো,
–“দুইবার ফোন দিয়েছি আপনার ব্রোকে আমি।প্রথমে এতিম খানায় থাকা অবস্থায় আর দ্বিতীয় বার এইখানে এসে।প্রথমে ফোন ধরেছিল কিন্তু কোনো কথা বলেননি উনি।আমিও আর ফোন না দিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে এইখানে চলে এসেছি।এখানে এসে দেখি উনি তখনও এই বাসায় ছিলেন না।আজ আমার অনেক দেরী হয়েছে এই বাসায় আসতে।তাই উনি কি নাস্তা করবেন নাকি করবেন না, এটা জানার জন্যে উনাকে ফোন দিলে ফোন তুলেননি উনি। পরে ওয়াচম্যান কাকা থেকে জানতে পারলাম উনি এখনো বাসায় আসেননি।আপনাকেও তো ফোন করেছি।আপনি নিজেই কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন।”

–“আচ্ছা ,আচ্ছা রিল্যাক্স।আমি বাইকে ছিলাম।তাই হয়তো খেয়াল করিনি তোমার কল,সিস।আর আজকে হঠাৎ আমার ব্রো এর জন্যে এতো চিন্তা?”
হ্যারি হেসে বললো।
–“এই রাণী তো সবার চিন্তা করে।কিন্তু রাণীর চিন্তা করার জন্যে কেউ নেই।থাকবে কিভাবে?এতিম মানুষদের জন্যে কি চিন্তা করার কেউ থাকে?থাকে না।যাক এই নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই আমার।যদিও ভেবেছিলাম আপনার ব্রো আর আপনি একটু আধটু আমার জন্যে চিন্তা করেন,কিন্তু এটা আমার ভুল ধারণা ছিল।”
কথাগুলো বলতে বলতে রাণীর কণ্ঠস্বর ভার হয়ে গেলো।
তূর্যয় রাণীর পিছনেই দাঁড়িয়ে তার কথাগুলো শুনছিল।তাই তো হ্যারি সুযোগ বুঝে তূর্যয়ের টপিক তুলেছিল রাণীর কাছে।কিন্তু এখন রাণীর কথা শুনে হ্যারি আর তূর্যয় দুইজনের মনেই কষ্ট হানা দিলো।
হ্যারি চেয়ার থেকে উঠে রাণীর কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“আমি আর ব্রো অনেক কেয়ার করি তোমার।আমার কেয়ার তো আমি উপরেই করি।কিন্তু, আমার পাথর ব্রো এর কেয়ার একদিন ঠিক বুঝতে পারবে তুমি।”

তূর্যয়কে চেয়ারে বসতে দেখে রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে হ্যারিকে বলতে লাগলো,
–“দরকার নেই আমার আপনার ব্রো এর কেয়ার।সামান্য একটা ফোন তুলতেই উনার যতো অহংকার।আমার মতো এতিমের ফোন ধরলে উনার তো কান খসে পড়ে যেতো। খুব বড় লোক আপনার ব্রো।”
রাণীর কথায় তূর্যয় রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“চুপ!এইখানে কি শুধু তুই একা এতিম?নিজেকে এতিম এতিম বলা বন্ধ কর।”
–“হ্যাঁ।শুধু আমি একাই এইখানে এতিম।আপনি তো অনেক বড় বংশের ছেলে।আর আমার ভিনদেশী ভাই তো অনেক ভালো পরিবারের ছেলে।তো,এইখানে এতিম আমিই আছি।এখন চুপচাপ নাস্তা করে নিন,দানব একটা।ফোন পর্যন্ত ধরতে পারে না।স্বাভাবিক মানুষের চিন্তা আপনি কিছু বুঝেন?জানেন, আপনার জন্যে কতটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আমার?জানবেন কিভাবে আপনার কি মন আছে?আমাকে আর না বকে নিজের নাস্তা করুন।আল্লাহ্ জানেন রাতে কিছু খেয়েছেন, নাকি শুধু মদ গিলেছেন?”
রাণী এক দমে কথাগুলো বলে রান্না ঘরে চলে গেলো।এরপর সে কানে আঙ্গুল দিয়ে দিলো।কারণ সে জানে এখন তূর্যয় বোম্ব ফাটাবে।ঠিকই হলো তাই,তূর্যয় চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
–“এই চঞ্চল মেয়েটার মুখটা এতো চলে কিভাবে?অন্যকে দানব ডেকে,উল্টো পাল্টা কথা বলে একটা ফোন দিলেই কি কেয়ার করা হয়ে যায়?তূর্যয়ের কারো কেয়ারের দরকার নেই।শুনেছে কি মেয়েটা?”

রাণী তার বন্ধ করা কানেও তূর্যয়ের এইসব কথা শুনে ফেললো।রাণীর মুখে হাসি ঝুলে আছে।কেনো যেনো তূর্যয়কে জ্বালাতে রাণীর অনেক ভালো লাগে।আর তূর্যয়ের প্রতি রাণীর মায়াকে রাণী এখন একদমই অস্বীকার করছে না।রাণী রান্নাঘর থেকে উঁকি দিলো তূর্যয় নাস্তা করছে কিনা দেখতে।তূর্যয়ের চেহারায় গভীর দৃষ্টি দিতেই রাণী যেনো তূর্যয়ের মধ্যে ডুবে গেলো।মাথায় তালুর উপর এক ঝাঁক চুল,আবার মাথার দুইপাশে সেখানে একেবারে ছোট চুল আছে তূর্যয়ের।মাঝে মাঝে বেশি নড়াচড়া করলে সেই মাথার তালুর উপরের কিছু ছিল তূর্যয়ের কপালের সামনে নাক পর্যন্ত চলে আসে।এইযে এখনো,গতকাল মারপিটে তূর্যয় হাতে ব্যাথা পেলে সেখানে ব্যান্ডেজ করেছিল।হ্যারি এখন তূর্যয়ের হাতের ব্যান্ডেজ খোলার সময় তূর্যয় হাত ঝাড়া দিতেই তূর্যয়ের নাক বরাবর চলে এলো কিছু চুল।অন্য হাতে তূর্যয় সেই চুলগুলো উঠিয়ে নিল মাথার উপর।রাণী অবশ্য জানেনা তূর্যয়ের হাতে কিসের ব্যান্ডেজ। তবে,এই দৃশ্য দেখে রাণী আপন মনে বলে উঠলো,
–“উফফ!”
এরপর সে আরো ভালো করে তূর্যয়কে দেখতে লাগলো।কালো রঙের শার্টটা তূর্যয়ের হাতের দিকে একদম টাইট হয়ে আছে তার হাতের খন্ড মাংসের জন্যে।তূর্যয়ের গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তূর্যয়ের চেহারার মায়া যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।রাণীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তূর্যয়ের চোখ বরাবর দিতেই রাণীর মনটা মায়ায় ভরে গেলো।তূর্যয়ের চোখজোড়া বড্ড নিষ্পাপ লাগে রাণীর কাছে।সেই চোখের দিকে তাকালেই তার বুকের স্পন্দন বাড়তেই থাকে।তূর্যয়ের চোখে রাণী অনেক কষ্ট আর অসহায়ত্ব দেখতে পায়।রাণী নিজে রান্নাঘরের মধ্যখানে চলে এলো।ধুকধুক করা বুকে হাত রেখে রাণী ভাবতে লাগলো,
–“তূর্যয়ের চোখজোড়া বলে দেয় উনার জীবনের শত কষ্টের কথা।এখন শুধু সুযোগ বুঝে উনাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করতে হবে আমার।আমি বেশ ভালো জানি তূর্যয়ের এমন হিংস্র হওয়ার পেছনে এক বড় রহস্য রয়েছে।আর তূর্যয়কে সেইসব কষ্ট থেকে উদ্ধার করতে আমার যা করার দরকার হয় আমি তাই করবো।দরকার হলে নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিবো আমি তূর্যয়কে।এই হিংস্র দানবের সকল কষ্ট দূর করতে যদি আমাকে উনার কাছাকাছি যেতে হয় তাহলে আমি তাও যাবো।এমনিও আমার উনার জন্যে বড্ড মায়া লাগে।শুনেছি এই মায়া থেকেই জীবনের সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতির সৃষ্টি হয়?”
রাণী নিজের মনটা শান্ত করার চেষ্টায় আছে।রাণীর মনে হচ্ছে সে একটা প্রশ্নের সাগরে ডুব দিয়েছে।তার বুকে তূর্যয়কে ঘিরে এমন একটা জায়গা তৈরি হয়েছে,যেটা আর কারো জন্যেই কখনো তৈরি হয়নি।
;
রাত দশটা।রাহেলাকে ফোন করেছে মমতা এতিম খানার একজন। সে ফোন দিয়ে রাহেলাকে বললো,
–“কবে আসবেন?আমাদের শিকার এখনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি।তাকে অসম্মান করার এই সুযোগ বারবার আসবে না কিন্তু।রাণী খুব খাটছে এখন,টাকার জন্যে।দিনে অফিসের কাজ করে আর রাতে এসে মাটির জিনিস বানায়।অনেক আয় হচ্ছে তার।তার এইসব কিছু বন্ধ করতে হবে।”

রাহেলা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
–“কাল রাতে আইতেছি আমি ঐখানে।সাবিনা মালকিনের লগেও কথা হইসে আমার।রাণী এতদিন প্রমাণ জোগাড় করে নাই কাইলো পারবো না জোগাড় করতে প্রমাণ।তূর্যয়রে আমি ভালা চিনি।হেই এইসবে পড়বো না কখনো।ছোট সাহেব মানে আহমেদ সাহেবের খাওন হইবো কাল এই রাণী।হাহাহা।”
রাহেলার কথায় অপর পাশের মানুষটি ফোন কেটে দিলো।আর দাতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
–“মান সম্মান একবার হারালে কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবি না তুই, এটা আমি বেশ জানি।কালকে তোর জন্যে মরণ আছে রাণী।”

মাটির কাজ শেষ করে রাণী গোসল সেরে চুল মুছতে লাগলো।হঠাৎই রাণীর চোখে ভেসে এলো আজ তূর্যয়ের একটা হাসিমাখা চেহারা।অফিসের সুইপার একজন মহিলা।উনার বাচ্চাটা ছোট হওয়ায় উনি বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিলেন অফিসে।বাচ্চাটা আদৌ আদৌ হাঁটে।রাণী,হ্যারি আর তূর্যয় অফিসে ঢুকতেই সেই বাচ্চাটা দৌড়ে এসে তূর্যয়ের পা জড়িয়ে ধরেছিল।সুইপার মহিলাটি দৌড় দিয়ে আসতে আসতেই তূর্যয় বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছিল।যদিও রাণী জানতো তূর্যয় বাচ্চাটিকে কিছু করবে না। তাও তূর্যয়কে বিরক্ত করার জন্যে রাণী তূর্যয়কে চিল্লিয়ে বলেছিল,
–“ফেলবেন না বাচ্চাটাকে।আমাকে দিন তাকে।”
তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে এক নজর রাণীর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে তার মাকে দিয়ে দিলো।সাথে বাচ্চাটার হাতে গুঁজে দিলো এক হাজার টাকার একটি নোট।বাচ্চাটা তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতেই তূর্যয় বাচ্চাটার গাল ধরে নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো।আর এই হাসি দেখেই রাণীর ছোট খাটো একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।তূর্যয়কে হাসতে দেখে রাণী যেনো মুহূর্তেই তূর্যয়ের সেই মুচকি হাসির প্রেমে পড়ে গেলো।পরক্ষণে তূর্যয় তাকে কড়া ভাষায় বলেছিল,
–“আমি যতো হিংস্র হই না কেনো,অকারণে কাউকে খুন করিনা।মাথা নষ্ট মেয়ে একটা!”
রাণীর মন তখন তূর্যয়ের হাসির পেছনে ছুটলেও এখন রাণী রেগে বললো,
–“আমার না আপনার মাথা নষ্ট।দানব সন্ত্রাসী একটা।হাসতেও পারেন উনি!হিংস্র মানুষের ঠোঁট বাঁকানো হাসি কি সত্যি এতো মনোরম হয়?নাকি শুধু তূর্যয়ের হাসিটাই এমন,এতো মনোরম ছিল?কি সুন্দর ছিল সেই হাসি!!ইসস,সুন্দর হিংস্র সন্ত্রাসী একটা!”
রাণী কথাগুলো বলে নিজের আনমনে হাসতে লাগলো।

রাণীকে খুশি হতে দেখে দরজার আড়াল থেকে কেউ মনে মনে বলতে লাগলো,
–“কাল তোর এই হাসি একেবারেই বিলীন হয়ে যাবে।আহারে বেচারা রাণী।”

চলবে….
কপি করা নিষেধ।গল্পটা কেমন লাগছে সবাই জানাবেন।কমেন্টে কথা হবে সবার সাথে❤️।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here