#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ২১
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
২১.
রাতের সেই নির্যাতনের কথা স্বপ্নরূপে রাণীর ঘুমের মাঝে বিচরণ করছে।রাণী সেই স্বপ্ন দেখে ঘেমে একাকার হয়ে আছে।রাহেলা রাণীর বুকে পা উঠানোর দৃশ্যটা স্বপ্নে ভেসে আসতেই রাণী নিজের চোখ খুলে ফেললো।বুকের উপর হাত রেখে শোয়া অবস্থায় রাণী জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।তার বুকে,আর ঠোঁটে হালকা ব্যাথা অনুভব করছে সে।চারিদিকে নজর দিয়ে রাণী বুঝতে পারলো, সে তূর্যয়ের রুমেই আছে।রুমের লাইট জ্বলার কারণে রাণী সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।রুমে লাগানো বড় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাণী দেখলো,এখন মাত্রই ভোর চারটা বাজে।রাণীর নিজের মাথা হালকা উঠিয়ে রুমের সোফার দিকে তাকালো। সোফায় উবুত হয়ে ঘুমিয়ে আছে তূর্যয়।তার কোমর পর্যন্ত চাদরে ঢাকা।তূর্যয়ের মুখ রাণীর দিকেই ফেরানো অবস্থায় আছে।তূর্যয়ের ঘুমন্ত মুখ দেখে রাণী উঠে বসলো বিছানায়। নিজের মুখে হাত রেখে রাণী অপলক দৃষ্টিতে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
–“এই যে দানব সন্ত্রাসী,আপনি কি জানেন এখন ঠিক কি পরিমান আদুরে লাগছে আপনাকে?ইস,কখনোই ভাবিনি আপনার ঘুমন্ত মুখ দেখতে পাবো আমি। আহ,
পরান জুড়িয়ে গেলো আমার।”
রাণী হাসলো নিজের কথায়।রাতে তূর্যয়ের শরীর খারাপ ছিলো,এই কথা রাণীর মাথায় আসতেই রাণী বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয়ের কাছাকাছি যেতেই, তূর্যয়ের উদোম পিঠে রাণী সেই আগের দাগগুলো দেখতে পেলো।রাণী ভেবে পায় না,তূর্যয়ের শরীরে এইসব কিসের দাগ।সেদিক থেকে নজর সরিয়ে রাণী তূর্যয়ের কপালের উপর থেকে খুবই সাবধানে চুল সরিয়ে তূর্যয়ের কপালে হাত রাখলো।
–“নাহ,জ্বর নেই।এই লোকের বৃষ্টিতে এতো সমস্যা কিসের, আল্লাহ্ ভালো জানে।নিজের সমস্যার কথা নিজেই তো জানেন উনি,তাও কেনো বৃষ্টিতে ভিজেছেন?এই লোককে কেউ কাবু না করতে পারলেও, বৃষ্টি ঠিকই উনাকে কাবু করে নেয়।কে যে বলেছিল উনাকে বৃষ্টিতে ভিজতে?”
রাণী নিজের মনে কথাগুলো ভেবে তূর্যয়ের উদোম শরীর ঢেকে দিতে চাইলো তার কোমরের নিচে চাপা পড়া চাদর তুলে দিয়ে।কিন্তু তূর্যয়ের কোমরের নিচ থেকে চাদর তোলার কাজে ব্যর্থ হলো রাণী।রাগে গজগজ করতে করতে রাণী নিজ মনে ভাবতে লাগলো,
–“উনার পালোয়ানের মতো শরীরের নিচ থেকে চাদর তোলা আমার পক্ষে সম্ভব না। যা একটু উপকার করতে চেয়েছি উনাকে,কিন্তু এই লোক থাকুক এইভাবে।এই দানবের জন্যেও আমি এতো চিন্তা করবো একদিন, এটা আমি আমার দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।আসলে কিই বা করার আছে,যেই সেই তো এই দানব সন্ত্রাসীর প্রেমেই আমি মত্ত হয়ে আছি।”
রুমে আরেকটু হাঁটাচলা করে রাণী আবারও চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
রুমের ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠলে তূর্যয়ের ঘুম ভেঙে যায়।মিটমিট করে চোখ খুলতেই সে বিছানায় শোয়া অবস্থায় রাণীকে দেখতে পেলো।প্রথমে তার কাছে সব মরীচিকা মনে হলেও ধীরে ধীরে তূর্যয়ের কাছে রাতের এক এক কথা মনে আসতে লাগলো।রাতে অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা থাকার কারণে,সকালে ঘুম থেকে উঠে তূর্যয়ের মাথা বড্ড ফাঁকা লাগছে। কোমর থেকে চাদর সরিয়ে তূর্যয় সোফা থেকে উঠে পড়লো।নিজের মাথা দুই দিকে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিলো সে।দুই হাত কয়েকবার উপর নিচ, ডানে বামে, ঘুরিয়ে নিজের শরীরকে একটু চাঙ্গা করে নিলো তূর্যয়।ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই তূর্যয়ের নজর বিছানায় শুয়ে থাকা রাণীর দিকে ছিল।তূর্যয় ঘুমন্ত রাণীর দিকে এগিয়ে গেলো।এতক্ষণ রাণী এক পাশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলো।খুবই সাবধানে তূর্যয় রাণীর পাশে বসতেই, রাণী এক ঝটকায় ঘুমের মধ্যে সোজা হয়ে গেলো।সাথে রাণী নিজের গায়ের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো ঘুমের ঘোরে।রাণী নিজের এতিম খানায় যেমন ঘুমায়,সে তার রঙিন স্বপ্ন দেখে তূর্যয়ের ঘরেও একই অবস্থায় ঘুমাচ্ছে।আর রাণীর এমন অবস্থা দেখে তূর্যয়ের বুকে ঝড় শুরু হলো।রাণীর বুকের উপর খুবই ধীরে চাদর টেনে দিল সে।রাণীর মুখের উপর চলে আসা চুল সরাতেই রাণীর ডান পাশের গালে হালকা তিনটা আঙ্গুলের ছাপ দেখতে পেলো তূর্যয়।মুহূর্তেই তূর্যয় নিজের ভ্রু কুঁচকে নিলো।রাণীর গালে নিজের দুই আঙ্গুলের উল্টো পিঠ হালকা স্পর্শ করলো তূর্যয়।রাণীর মাথার পাশে নিজের এক হাত রেখে রাণীর দিকে অনেকটা ঝুঁকে রাণীর গালের সেই হালকা দাগে তূর্যয় নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সাবধানে।রাণী ঘুমের মাঝেই যেনো হালকা কেঁপে উঠলো।এমনটা দেখে তূর্যয় ধীর গতিতে রাণীর পাশ থেকে উঠে সোফায় বসে নিজের ফোন চালু করলো। মোবাইলে নাম্বার বের করে তূর্যয় ফোন দিলো এই স্থানের ওসির কাছে। অপর পাশে ফোন ধরতেই তূর্যয় কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“মমতা এতিম খানায় আসতে হবে,দশটার আগে করে।রাহেলা নামের একজন মহিলাকে এরেস্ট করা লাগবে।”
–“ঠিক আছে, স্যার।কয়দিন রাখতে হবে তাকে জেলে?”
ওসি জবাব দিলো।
–“এরেস্ট করবে ঠিকই,তবে তাকে থানায় নিবে না।থানার সামনে থেকে আমার লোক সেই মহিলাকে উঠিয়ে নিবে।তোমার কাজ শুধু থানা পর্যন্ত ঐ মহিলাকে নিয়ে আসা।আর কেউ মহিলার ব্যাপারে কিছু বললে,সবাইকে বলবে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে।এরপর কই গিয়েছে সে,এই ব্যাপারে কিছুই জানো না তুমি।কাজে যেনো কোনো ভুল না হয়।এক্সট্রা টাকা দেওয়া হবে তোমাকে।আর কাজে ভুল হলে,তুমি জানো আমি কি করার যোগ্য!”
তূর্যয়ের বেশ এমন রাগী উপদেশ শুনে ওসি রুমাল দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে বেশ মলিন কণ্ঠে বললো,
–“স্যার কাজ হয়ে যাবে।কেউ কিছুই জানবে না।আপনি চিন্তা করবেন না।”
ওসির কথায় তূর্যয়ের নিজের হাত মুঠ করে বলে উঠলো,
–“তাশরীফ তূর্যয়,চিন্তা করে না।চিন্তা করায়।”
কথাটা বলে তূর্যয় ফোন রেখে দিলো।
তূর্যয়ের এমন কথায় ওসি নিজের মাথায় রুমাল রেখে বিড়বিড় করতে লাগলো,
–“এই তূর্যয় স্যারের কাজ এলে আমার বিপি কমে যায়।তার কাজে ভুল হলে আমি যে আর দ্বিতীয় সুযোগ পাবো না!উনি কতটা হিংস্র এটা আমি নিজ চোখে কতবার দেখেছি।এই রাহেলা নামের মহিলার আজ হয়তো শেষ দিন, এই দুনিয়ায়?”
তূর্যয় রাণীর দিকে আরেক নজর তাকিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
রাণীর ঘুম ভাঙতেই সে বিছানায় উঠে বসলো।বুকের ব্যথাটা তার এখনো অনুভব হচ্ছে।সে নিজের বুকে হাত রেখে বলে উঠলো,
–“রাহেলা বজ্জাত মহিলা,আমার বুকে তুই পা তুলেছিস?তোর পা কেটে, সেই পা দিয়ে আমি ফুটবল খেলবো।উফ!”
কথাগুলো ভেবে রানী সোফায় তাকিয়ে দেখে তূর্যয় নেই।বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসতেই রাণী বুঝতে পারলো তূর্যয় বাথরুমে আছে।রাণী সোফায় রাখা চাদর,
নিজের গায়ে দেওয়া চাদর সব গুছিয়ে নিলো।সাথে বিছানাও ঠিক করে নিলো সে।তূর্যয় বাথরুমে থেকে বের হতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।তূর্যয়কে উদোম গায়ে হাফ প্যান্ট পড়া অবস্থায় দেখে রাণী নিজের মুখে হাত রেখে বলে উঠলো,
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্,নাউজুবিল্লাহ্!”
তূর্যয় সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে তার ভেজা,শুকনো কাপড় একটা ঝুড়িতে রেখে রুমের বাহিরে রেখে দিলো।এই বাড়ির কাজের লোক তূর্যয়ের সেই কাপড় নিয়ে গেলো।তারাই সব কিছু করে,তূর্যয়ের কাপড় সুন্দর করে ভাঁজ করে দরজার সামনে রাখে।রাতে তূর্যয় রুমে এলে দরজার সামনে রাখা প্যাকেট থেকে সেগুলো নিয়ে নেয়।
রাণীকে এখনো মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তূর্যয় তাকে বললো,
–“ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে গিয়ে দাঁড়া।মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
রাণী তূর্যয়ের কথায় নিজের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তূর্যয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলো,
–“আপনার কি কাপড়ের অভাব?আপনি কিভাবে এই অবস্থায় একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?রাহেলা শয়তান যখন অন্য মেয়েদের এইখানে এনে দেয় আপনাকে,আপনি কি তাদের সামনেও এই অবস্থায় দাড়িয়ে থাকেন?”
রাণীর কথায় তূর্যয় কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলো। সে ইচ্ছে করেই রাণীকে বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্যে,নিজের হাতের তাওয়াল সোফায় ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো রাণীর দিকে।তূর্যয়ের এগিয়ে আসা দেখে রাণী পিছু যেতে লাগলো।এক পর্যায়ে রাণী গিয়ে ঠেকলো বড় একটা আলমারির সাথে।তূর্যয় তার দুই হাত রাণীর দুইদিকে রেখে বলে উঠলো,
–“আমি যায় করি মেয়েদের সামনে,তাতে তোর কি?”
রাণী নিজের বুকের সাথে হাত গুটিয়ে রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ।কিন্তু তূর্যয়ের প্রশ্নে সে মাথা উঠিয়ে তাকে জবাব দিলো,
–“ছি!লজ্জাহীন আপনি।অন্য মেয়ের সামনে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আপনার কোনো কিছুই অনুভব হয় না?চেরি আপু শুধু শুধুই মিথ্যা বলেছে আপনার নামে।আপনি নাকি তাকে রুমের বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন!কিন্তু এইযে দেখুন,আপনি নিজেই বলছেন আপনি অন্য মেয়ের সামনে এইভাবেই উদোম শরীর দেখিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।”
রাণীর জবাবে তূর্যয় নিজের মুখ,রাণীর মুখের আরো বেশি কাছে নিয়ে আবারও রাণীকে জিজ্ঞেস করলো,
–“আমি যায় করি, তোর কি?”
তূর্যয়ের এমন কাছে আসাতে রাণীর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। রাণী নিজের এক হাত তূর্যয়ের বুকের মাঝে রেখে তাকে থামিয়ে দিলো কাছে আসা থেকে।এরপর তাকে উত্তর দিলো,
–“আমার মাথা।আপনি যেখানে যান, যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে থাকুন। এতে আমার কিছু যা..যায় আ..আসে না।”
তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে রাণীর কথায় রাণীর কানে ফিসফিস করে বললো,
–“কথায় সত্যতা থাকলে কেউ কথা বলার সময় আটকায় না।যায় হোক,আমি জানি আমার মতো দানবের জন্যে তোর কোনো রকম অনুভুতিই কাজ করে না।”
কথাটা বলে তূর্যয় সরে গেলো রাণীর সামনে থেকে।তূর্যয়ের কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না রাণীর।সে মনে মনে বললো,
–“খুন খারাবি ছাড়া নিজে কি বুঝেন আপনি?আর আমি জানি,আপনি অন্য মেয়ের সাথে কখনোই থাকেননি।আপনি নিজেই মিথ্যুক।সোজা মুখে কিছু কি উত্তর দিতে পারেন না আপনি?পারবেন কিভাবে?আপনি তো একটা জলহস্তী। দানব সন্ত্রাসী তূর্যয় উরফে মিস্টার জলহস্তী তূর্যয়। ”
আলমারি থেকে কাপড় নেওয়ার সময় রাণীকে তখনো বিড়বিড় করতে দেখে তূর্যয়ের চোখে যেনো রাণীর নেশা লেগে যাচ্ছে।রাণীর চুল এলোমেলো হয়ে আছে,সাথে রাণীর চোখ হালকা ফুলে রয়েছে।গতকাল রাতে কান্না করার ফলে রাণীর সাদা মুখে একটু গোলাপী আভা সৃষ্টি করেছে, যা দেখে তূর্যয় রাণীর মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করে তূর্যয় নিজের ভ্রু কুঁচকে ফেললো,
–“আজ রাতেও কি এইখানে থাকবি?”
তূর্যয়ের ধমকে রাণী তূর্যয়কে বকতে বকতে বাথরুমে চলে গেলো।বাথরুম থেকে বের হয়ে রাণী তূর্যয়ের রুমের বাহিরে দাঁড়ালো।একটু পরে সাবিনাকে দেখতে পেয়ে রাণী তূর্যয়ের দরজা আকড়ে ধরলো।তূর্যয় রেডি হওয়ার পাশাপাশি রাণীকে দেখছে।রাণীর এমন ভয় পাওয়া দেখে তূর্যয় বুঝেছে, নিশ্চয় রাণী এখন সাবিনা বা আহমেদকে দেখেছে।তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,
–“এই কম বয়সে অনেক কিছুই সহ্য করেছো তুমি,তাই না?যেখানে তোকে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছে রাখার কথা,সেখানে তুই আমার থেকে অনেক দূরে আছিস এখন।সাবিনা তোকে আমার রুমে দেখলে ঠিকই কিছু একটা বুঝে যেতো।কিন্তু,সে তোকে এখন রুমের বাহিরে দেখে বুঝবে; অন্য মেয়ের মতো তোকেও আমি শাস্তি দিচ্ছি।কষ্ট পাস না তূর্যয়,কিছু কাজ বাকি আছে তোর শত্রুদের সাথে।এরপরই রাণীকে তুই তোর নিজের করে নিবি।কেউ তোকে তার থেকে আলাদা করতে পারবে না।সব শত্রু পরে,আগে এই রাহেলা আর সাবিনার ব্যবস্থা করতে হবে।”
তূর্যয় তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।তূর্যয়ের পিছু পিছু রাণী হাঁটতে হাঁটতে তাকে বলতে লাগলো,
–“সোজা অফিস যাবেন আপনি আজ?জগিং করবেন না?নাস্তা কোথায় খাবেন?আমরা এখন কোথায় যাবো?এতিম খানা নাকি আপনার বাসায়?”
সাবিনা খেয়াল করলো রাণী আর তূর্যয়কে।আর তূর্যয় সাবিনাকে দেখে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রাণীকে দিলো এক ধমক,
–“চুপ! মাথায় উঠে বসার চেষ্টা করবি না।এখন যা টেম্পুতে উঠে এতিম খানায় যা।”
রাণীর বেশ কষ্ট লাগলো তূর্যয়ের কথায়।সে তূর্যয়ের পেছনে পেছনে এক প্রকার দৌড় দিয়ে বলতে লাগলো,
–“আমি এমনিও আপনার সাথে যেতাম না।কিভাবে ধমক দিয়েছন আপনি আমায়?যেখানে ইচ্ছে সেখানে যান আপনি।মানুষের বেশি চিন্তা করলে মানুষ নিজেকে অনেক কিছুই ভাবতে শুরু করে।দানব কোথাকার।”
কথাটা বলে রাণী তূর্যয়ের আগেই দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেলো শান্তি মহল থেকে।এরপর একটা সিএনজিতে উঠে পড়লো সে।তূর্যয় বেশ বুঝতে পারলো রাণী বেশ কষ্ট পেয়েছে তূর্যয়ের কথায়।যার কারণে,সাবিনা আর বাকি সবার উপর তূর্যয়ের রাগের পরিমাণ আরো বেশি বেড়ে গেলো।তূর্যয় রেগে নিজে তার গাড়িতে বসে বেশ জোরেই গাড়ি চালানো শুরু করলো।তার অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ফোন দিয়ে, মমতা এতিম খানায় তূর্যয়ের আগমনের কথা জানিয়ে দিতে বললো।
অন্যদিকে সাবিনা বাঁকা হেসে রাহেলাকে ফোন করলো,
–“তূর্যয়ের বাচ্চাটা এই মেয়ের সাথেও কিছু করলো না।তার মানে এই মেয়েটা তার এতটা কাছের না।রাণীকে নষ্ট করতে হলে অন্য কোনো উপায় দেখতে হবে আমাদের।তাছাড়া,তুই এখন কই?”
–“আরে কইয়েন না।এতিম খানায় আইসা বইসা আছি।সালেহা ডাকায়ছে আমারে।হুনলাম তূর্যয় বড় সাহেবও নাকি আসবো।তূর্যয়ের এক এসিস্ট্যান্ট ফোন কইরা এতিম খানায় এই ঘটনা জানাইছে।আর আমাদের এতিম খানার গুপ্তচর নিজেই এই ব্যাপারে রাগী আছে,
রাণীর কোনো ক্ষতি কেন হয় নাই এর লাইগা।এই রাণীরে আরো ভালো করে অপদস্ত করা লাইগবো।”
–“ঐ এতিম এর জন্যে তূর্যয়ের দরদ বের হয়েছে।দেখিস না,তূর্যয় এমনিও গরীব অসহায়দের জন্যে আগে এগিয়ে যায়।ব্যাপার না,রাণীর কোনো ক্ষতি করলেও এতে তূর্যয় আমাদের আর কিছু করবে বলে মনে হয় না।শুধু যা করা লাগবে আমাদের তূর্যয় থেকে লুকিয়ে করতে হবে।নাহলে তুই তো জানিস,তূর্যয় তার মরা মায়ের মতো মানব দরদী। ঐ শয়তান মহিলা মরেও এইখানে তার অংশ রেখে গেলো।”
রাহেলা আর সাবিনা তাদের নানান হিংসাত্মক কথা বলতে লাগলো।
এতিম খানায় পৌঁছে রাণী দেখতে পেলো তূর্যয়ের গাড়ি আগে থেকেই এতিম খানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রাণী মুখ ভেংচি দিলো তূর্যয়ের গাড়ি দেখে।নাজিমকে দেখতে পেয়ে রাণী নাজিম থেকে টাকা নিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে দিয়ে দিলো।রাণী এতিম খানার ভেতরে যাওয়ার সময় তূর্যয় রাণীকে দেখতে পেয়ে নিজেও গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।রাণী দ্রুত ভেতরে যাচ্ছে।তূর্যয় লম্বা লম্বা কদম ফেলে রাণীর সাথে হাঁটতে লাগলো।এতিম খানার কেউ কেউ তূর্যয়কে দেখতে পেয়ে একজন আরেকজনকে খবর দিতে লাগলো।অতঃপর এতিম খানার হলে একটা জটলা পাকিয়ে ফেললো সবাই।সেখানে সালেহাকে দেখতে পেয়ে তূর্যয়ের অতীতের কথা মনে আসতে লাগলো।তূর্যয়ের নিজেকে দুর্বল লাগছে,কিন্তু রাণীর দিকে তাকাতেই তূর্যয়ের দুর্বলতা কমে,তার বুকে জমেছে অতীতের সাথে লড়াইয়ের শক্তি।তূর্যয় নিজের হাত মুঠ করে রেখেছে সালেহার দেখা পেয়ে।সালেহা তূর্যয়কে দেখতে পেয়েই যেনো নিজের হারানো কিছু ফিরে পেলো। সে তূর্যয়ের সামনে এসে তাকে বলতে লাগলো,
–“তূ..তূর্যয় বাবা!”
তূর্যয়কে সালেহা “তূর্যয় বাবা” ডাকার কারণে রাণী বেশ অবাক হলো।রাণীর মনে তূর্যয়কে ঘিরে থাকা রহস্যটা আরো ভাবিয়ে তুলছে।
তূর্যয় নিজের হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো সালেহাকে। তূর্যয় গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করলো,
–“আমি কারো আদরের পাত্র না।এক কথার মানুষ আমি।আমারটা আমি বলে চলে যাবো।”
এরপর রাণীর দিকে আঙুল দেখিয়ে তূর্যয় বললো,
–“এই মেয়েটাকে সেদিন সাবিনার ছোট ছেলে কিছু করেনি।সর্বনাশ হওয়ার আগেই আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম।আর না তার সাথে গতকাল কিছু হয়েছিল।সে একেবারেই পবিত্র।”
তূর্যয়ের কথায় সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারলো।তবে রাণী খুশি না হয়ে বাঁকা চোখে একবার তূর্যয়ের দিকে তো আরেকবার অন্যসব মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে।যারা বর্তমানে তূর্যয়কে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।এটা দেখে রাণীর মেজাজ চরম খারাপ হলো।রাণী সেই মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে ভাবছে,
–“এই লোক শুধু আমার দানব সন্ত্রাসী। তোরা শাকচুন্নির দল কেনো তাকাচ্ছিস উনার দিকে? লুচ্চু মেয়ে কতগুলো।”
তূর্যয় চলে যাওয়ার আগেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করলো রাহেলাকে।আর অভিযোগ দেখালো,রাহেলা মেয়েদের জোর করে দেহ ব্যবসা করতে নিয়ে যায়।রাহেলাকে নিয়ে যাওয়াতে সবাই বেশ প্রশংসা করছে পুলিশের।কারণ,সবাই এখন রাণীর জন্যে দয়া অনুভব করছে।তূর্যয় কিছু না বলে এতিম খানা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।আর রাণী, সে দৌড়ে তূর্যয়ের কাছে গিয়ে বললো,
–“আজ আমার কাজে ছুটি চায়। কাল থেকে আবারও আসবো কাজে।আপনি নাস্তা করে নিবেন।সাথে ওষুধ খেয়ে নিবেন।জ্বর নাহলে আজও আবার আসতে পারে।”
রাণীর এমন কান্ড যেকারো মনে সন্দেহ ঢুকাতে পারে ভেবে,তূর্যয় রাণীর বাহু চেপে ধরে তাকে ধমক দিয়ে বললো,
–“একদম বেশি কথা বলবি না।আমার যত্ন নেওয়ার কোনো দরকার নেই।আমি আমার মতো ঠিক আছি।কিছু বলিনা দেখে কি মাথায় উঠে যাবি?”
কথাগুলো নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলে তূর্যয় দ্রুত হেঁটে গাড়িতে উঠে পড়লো।গাড়িতে বসে তূর্যয় নিজের কপালে আঙ্গুল ঘষে বলে উঠলো,
–“দিলাম তো মন খারাপ করে?কেনো বুঝিস না আমার অতীতের সেই বাজে এক মহিলা এই সালেহা।তাকে দেখেই আমার মেজাজ খারাপ ছিল।তোর জন্যে তাকেও সহ্য করে নিলাম।কিন্তু এইভাবে সবার সামনে আমাকে নিয়ে তুই চিন্তা করলে সবাই সন্দেহ করবে,আর তোকেই আমার ক্ষতি করার জন্যে টার্গেট করবে।আমি বেঁচে থাকতে তোর বড় কোনো ক্ষতি হতে আমি দিবো না, রোদ্র।তোর বেশি ক্ষতি হওয়ার চেয়ে আমার এই ছোট ধমক অনেক ভালো তোর জন্যে।অপেক্ষা কর,শীঘ্রই তোর দানব সন্ত্রাসী তোকে সারাজীবনের জন্যে নিজের করে নিবে।আপাতত তোকে কান্না করানোর জন্যে, রাহেলার কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করছে, তোর দানব সন্ত্রাসী।”
অতঃপর তূর্যয় চলে গেলো তার কাজে।
রাণী এখনো পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিজের চোখের কোণে জমে থাকা পানি আঙ্গুল দিয়ে মুছে রাণী বলে উঠলো,
–“দানব তো দানবই হয়।দানবকে যত্ন করলেও সে বুঝে না।আর আমার মতো এতিমের যত্ন হয়তো উনি চান না।থাক রাণী,তুই দূর থেকেই উনাকে ভালোবেসে যাবি; কিন্তু ভুলেও আর ঐ দানব তূর্যয়ের যত্ন করতে যাবি না।”
কথাগুলো ভেবে মন খারাপ করে রাণী এতিম খানার ভেতর চলে গেলো।
চলবে….
কপি করা নিষেধ।কেমন হচ্ছে গল্প, সবাই জানাবেন।আগের মতো গল্প রিয়েক্ট পড়ে না দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়,লেখার আগ্রহ থাকে না।গল্প যারা পড়েন তারা অবশ্যই পোস্টে রিয়েক্ট করবেন।আপনার একটা রিয়েক্ট আমার গল্প লিখতে উৎসাহ দিবে।যাদের নিউজফিড এ গল্প যায় না,তাদের বেশির ভাগ সাইলেন্ট রিডার।আপনারা গল্পে কিছুদিন লাইক কমেন্ট করুন,দেখবেন আগের মতো নিউজফিডে গল্প পাচ্ছেন।