#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ২৩

0
467

#আলো-আঁধার🖤 পর্ব ২৩
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

২৩.
অফিসে নিজের কেবিনে বসে কাজ করছে রাণী।অন্যসব স্টাফদের সাথে রাণীর আলাদা কেবিন দিয়েছে হ্যারি।তূর্যয়ের পাঠানো অনেকগুলো ফাইল বেশ মন দিয়ে চেক করছে সে।কিন্তু ফাইলে কোনো ভুল পাচ্ছেই না রাণী।রাণী এক ফাইল বারবার উল্টিয়ে দেখছে।কিন্তু নাহ,একটা ফাইলেও কোনো কিছু ভুল নেই।রাণী নিজের মাথায় হাত রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।এতো ফাইল বারবার চেক করার কারণে রাণীর চোখ ব্যথা করছে।নিজের চোখ কয়েকবার কঁচলিয়ে নিয়ে রাণী চেয়ার থেকে উঠে পড়লো। কেবিনে থাকা কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে রাণী উঁকি দিলো অফিসের মধ্যখানের অবস্থা কেমন দেখার জন্য! সবাই যে যার যার কাজে ব্যস্ত।অবশ্য সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হবে নাই বা কেনো?তূর্যয় কারো ভুল মাফ করে না,এটা এই অফিসের সবারই জানা আছে।তাই তূর্যয়ের হিংস্রতা থেকে বাঁচতে সবাই যে যার যার কাজে লেগে আছে।রাণী পর্দা ঠিক করে আবারও নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।রাণীর মন এই অফিস থেকে বের হওয়ার জন্যে আনচান করছে।তাছাড়া রাণীর এই মুহূর্তে ব্যাপক ক্ষিদে পেয়েছে।যদিও সকালের নাস্তায় সে ভালই খাবার খেয়েছে, তাও রাণীর পেটে ক্ষিদা ডাক ঢোল বাজাচ্ছে।রাণী পেটে হাত দিয়ে মিন মিন করে বলতে লাগলো,
–“কবে সেই সন্ত্রাসী আর ভিনদেশী ভাইয়ের সাথে নাস্তা করেছি,আর কিছুই পেটে পড়েনি আমার।ক্ষিদায় আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে।দুপুরের খাবার খেতে আরো এক ঘন্টা বাকি আছে।এই এক ঘণ্টায় ক্ষিদায় না মরে যায় আমি?”
রাণী নিজের মাথা চুলকালো কথাগুলো ভেবে।পরক্ষণে সে খুশি হয়ে বলতে লাগলো,
–“আরে,হ্যারি ভাই তো বলেছেই;যখনই ক্ষিদা লাগে তখনই ক্যান্টিনে চলে যেতে।চল চল রাণী,ক্যান্টিনে চল।কখনোই তো এমন মরার মতো ক্ষিধা লাগেনি আমার।আর আজ এই ক্ষিধা আমার সহ্যই হচ্ছে না।এই অফিসে আমি কি খিচুড়ি পাকাবো আজ,আল্লাহ্ ভালো জানে। হে আল্লাহ্,আমার দানব সন্ত্রাসীর ধমক থেকে আমাকে রক্ষা করবেন প্লিজ!”
রাণী নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে নিজের কেবিন থেকে বের হলো।তূর্যয়,হ্যারি দুইজনই মিটিং রুমে।রাণীর মনে তাই তূর্যয়ের ভয়টা কমেছে এখন।আগে অফিসের সবাই রাণীকে দেখলেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো।কিন্তু, একদিন রাণী তূর্যয়কে এই ব্যাপারে নালিশ করলে, তূর্যয়ের ধমকে অফিসের সবাই সতর্ক হয়ে গেলো রাণী থেকে।রাণীর দিকে এখন কেউ চোখ তুলেও তাকায় না। এতে রাণী বেশ খুশি।সবার সামনে রাণী বেশ ভাব নিয়ে হাঁটাচলা করে।এতো বড় বড় পালোয়ান কর্মচারীদের ভেতর হাঁটতে রাণীর বেশ অস্বস্থি হচ্ছে।কিন্তু তাও,
নিজের পেটের ক্ষুদার জন্যে রাণীর এই অস্বস্থিকে কাটিয়ে সামনের দিকে যেতে লাগলো।এই অফিসের সবাই নিজের কাজ নিজে করে।শুধু তূর্যয়ের জন্যেই তার কেবিনে খাবার নিয়ে যায় ক্যান্টিনের প্রধান।আর বাকি সবাইকে নিজের খাবার নিজে গিয়ে আনতে হয়।রাণীর দুপুরের খাবার হ্যারি নিয়ে যায়।তাই রাণীর আর কষ্ট করে ক্যান্টিনে আসা লাগে না।হ্যারি যখন যা খায়,তখনই একই খাবার সে রাণীর জন্যে দিয়ে যায়।রাণী তার জীবনে হ্যারির মতো এমন পাতানো ভাই পেয়ে আল্লাহ্ এর কাছে বারবার শোকরিয়া করে।ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে রাণী একটু থামলো।বাম পাশে ফিরতেই রাণী একটা বড় ছবি দেখতে পেলো,যেখানে তূর্যয় একটা সোফায় বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে।তূর্যয়ের হাতে একটা পিস্তল।তূর্যয় না হাসলেও তার এই গম্ভীর ছবিটা দেখে মুহূর্তেই রাণীর মনে ভালোবাসার প্রজাপতি উড়াল দিলো।রাণী হেঁটে সেই ছবির সামনে গিয়ে সেই ছবির উপর হাত রাখলো।রাণী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তূর্যয়ের ছবিটা।রাণীর সাথে তূর্যয়ের দেখা হয়েছে পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিন রাণী তূর্যয়ের ধমক শুনেই এসেছে।কিন্তু, রাণী এখনও তূর্যয়ের ধমকে অভ্যস্ত হয়নি।তূর্যয়ের ধমকে প্রত্যেকদিনই রাণীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।রাণী তূর্যয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে তূর্যয়ের ছবির বুক বরাবর হাত রেখে বলতে শুরু করলো,
–“আপনার এই বুকে অনেক জিদ,হিংস্রতা;তাই না?কিসের জিদ আপনার এতো?আর আমাকে এতো বকেন কেনো?মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার এই ধমকের মাঝে আপনি আমার যত্ন নিন।কিন্তু,কেউ কি ধমক দিয়ে অন্যের যত্ন করে নাকি?যত্ন করতে হয় ভালোবেসে।এইযে দেখুন আমাকে।মন ভরে দেখুন।আমি আপনাকে ভালোবেসে কতো সুন্দর করে আপনার যত্ন নিই!আপনার এতো ধমক সহ্য করে,আপনার সাথে অভিমান করেও আমি আপনার যত্ন করে যায় আপনাকে ভালোবেসে।আর আপনি! আস্ত এক দানব।সারাদিন শুধু আমার দিকে চোখ লাল করে তাকাতে পারেন আর আমাকে চঞ্চল মেয়ে,চুপ,কামড়িয়ে ছিড়ে ফেলবো,খেয়ে ফেলবো এইসব বলেন। হু,সন্ত্রাসী একটা।কিন্তু,যায় করুন আপনি।এই রাণী তো সারাজীবন তার দানব সন্ত্রাসীকে ভালোবেসে যাবে।”

ছবিতে তূর্যয়ের চোখের গভীরতায় তাকিয়ে রাণী অস্ফুট কন্ঠে বললো,”ভালোবাসি”।

রাণীর পেটে গুড়গুড় করে উঠলে রাণী মুচকি হেসে তূর্যয়ের ছবির সামনে থেকে সরে ক্যান্টিনে চলে গেলো।রাণী মনে মনে ভাবছে,
–“আপনার ছবির সামনে কি সুন্দর নিজের মনের সব কথা বলে ফেললাম,তাই না?আমার মনের সেই চুপ কথাগুলো যদি আপনাকে জানাতে পারতাম?”
রাণী আফসোস করতে লাগলো কথাগুলো ভেবে।

ক্যান্টিনে বেশ তাড়াহুড়ো করছে ক্যান্টিনের প্রধান।এতো বড় ক্যান্টিন এই প্রবীণ লোক একা সামলায় ভেবে অবাক হলো রাণী।কফি মেশিন থেকে কফি নিয়ে,রাণী সেই ব্যস্ত প্রবীণ লোক থেকে একটা চকলেট কেক নিয়ে নিলো।রাণী ক্ষিধা মেটাতে দ্রুত কেক খেতে শুরু করলো।কেক খাওয়া শেষ করে রাণী কফির প্লাস্টিকের কাপে চুমুক দিলো।অল্প কফি থাকায় রাণী বেশ জলদি শেষ করে নিলো কফি।ক্যান্টিন থেকে বেরুনোর সময় রাণী দেখলো সেই প্রবীণ লোকটি একসাথে দুই হাতে ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে। রানী দ্রুত লোকটির কাছে গিয়ে এক হাত থেকে ট্রে নিয়ে তাকে বললো,
–“চাচা কই নিবেন এগুলো?আসুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি।”
প্রবীণ লোকটা নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে রাণীকে জবাব দিলো,
–“বড় সাহেবের মিটিং রুমে দিতে হবে। আপনি সেখানে গেলে হয়তো উনি রাগ করতে পারে।”
রাণী হাসলো লোকটার কথায়,
–“আমরা তো মিটিং রুমে উনাদের সাথে মিটিং করতে যাচ্ছি না। শুধুমাত্র ট্রে, মিটিং রুমে রাখবো আর চলে আসবো। ট্রেতে অনেক পরিমান নাস্তা রাখা আছে।আপনি একসাথে নিতে গেলে,দুর্ভাগ্যবশত যদি ফেলে দিন; তাহলে আরো বেশি ক্ষতি হতে পারে।চলুন চলুন।”
লোকটা তার এক হাতে থাকা ট্রে দুই হাতে ভালোভাবে শক্ত করে ধরলো। রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লোকটি রানী কে বলল,
–“স্যারের মিটিংয়ে কেউ বারবার গেলে স্যার খুবই রাগ করে। তাই দুইবার না গিয়ে আমি একবারে দুইবার যাওয়ার কাজটি করতে চেয়েছিলাম।প্রত্যেকদিন আমার সাথে একটা ছোট ছেলে থাকে।আজ সে আসেনি বিধায় কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটেছে।”
রাণী প্রবীণ লোকটির সাথে লিফটে উঠে জবাব দিলো,
–“সবার দিন প্রত্যেক দিনের মতো এক‌ই কাটে না চাচা। মানুষের একেক দিন একেক রকম ভাবে কাটে। তবে দেখুন আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছে আপনার সাহায্য করার জন্য।আর আপনিও বেঁচে গিয়েছেন সেই রাক্ষসের হাত থেকে।”
কথাটা বলে রাণী চোখ বড় করলো।প্রবীণ লোকটি মুচকি হেসে রাণীকে উত্তর দিলো,
–“ভয় পাওয়ার দরকার নেই।আমি কিছুই বলবো না কাউকে।”
রাণী ফিক করে হেসে প্রবীণ লোকটিকে বলে উঠলো,
–“ধন্যবাদ চাচা,এই রাণীর মুখটা না বেশি চলে।”
–“ঠিকই চলে। রাণীরা সবাইকে অর্ডার করে চলে তাই,
মুখটা তো বেশি চলবেই।নামটা সুন্দর তোমার।”
এইভাবে টুকটাক কথা বলে রাণী আর প্রবীণ লোকটি মিটিং রুমের সামনে চলে আসলো।
মিটিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বডিগার্ড তাদের দেখে দরজা খুলে দিলো।রাণী আর প্রবীণ লোকটা নাস্তার বড় ট্রে নিয়ে ঢুকে পড়লো মিটিং রুমে।ভেতরে ঢুকতেই রাণীর নিঃশ্বাস আটকে এলো।এতো এতো লোক,রাণী কখনোই আশা করেনি এইখানে।আর সবার চেহারা একেবারেই রাগান্বিত।সামনে চোখ তুলে তাকাতেই রাণীর গলা শুকিয়ে এসেছে।কারণ,তূর্যয়ের মুখটা দেখে রাণী বুঝতে পারছে,তূর্যয় এখন ভয়ংকর রেগে আছে।তূর্যয়ের অফিসে মেয়ে স্টাফ দেখে সবাই কানাঘুষা করছে।তূর্যয়ের হাত মুঠ হয়ে এলো।সবাই মিটিং ছেড়ে রাণীর নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।এটা লক্ষ করতেই তূর্যয় বেশ জোরে চিল্লিয়ে উঠলো,
–“দরজার সামনে কি আমরা মিটিং করছি?”
তূর্যয়ের রেগে যাওয়া দেখে সবাই আবারও সোজা হয়ে বসলো।

রাণী দরজার সামনে থেকে নড়লো না।সে ভীত হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রবীণ লোকটা দ্রুত নিজের হাতে থাকা ট্রে মিটিং টেবিলে রেখে রাণীর হাত থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রাখলো টেবিলে।তূর্যয় চোখের ইশারায় রাণীকে চলে যেতে বললো।রাণী তূর্যয়ের ইশারা বুঝতে পেয়ে প্রবীণ লোকটি আসার আগেই বেরিয়ে গেলো সেই রুম থেকে।সে আর প্রবীণ লোক আবারও লিফটে উঠে পড়লো।লিফটে উঠে রাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

কিন্তু,তূর্যয়ের মনে শান্তি নেই।রাণী মিটিং রুমে এসেছিল এটা ভাবতেই তূর্যয়ের মাথা রাগে গজগজ করছে।তূর্যয় রাণীর ব্যাপারে অফিসের সবাইকে সাবধান করেছিল।কিন্তু,মিটিং এ যারা উপস্থিত আছে তারা রাণী সম্বন্ধে কিছুই জানে না।তাই এইভাবে রাণীর উপস্থিতি মিটিংয়ে থাকা মানুষের মনে কি প্রশ্ন তৈরি করেছে এটা তূর্যয়ের অজানা।রাণী অফিসে থাকলে তূর্যয়ের এতো সমস্যা হয় না।সমস্যা হয়েছে,রাণী যাদের সামনে এসেছে তারা কেউ ভালো মানুষ না।সবাই একেকটা দানব।আর তূর্যয় চায় না,রাণী সে ছাড়া অন্য কোনো দানবের সামনে আসুক।তূর্যয়ের এখন ঠিক কি পরিমাণ রাগ লাগছে সে নিজেও জানে না।খুবই রাগ নিয়ে তূর্যয় নিজের মিটিং শেষ করলো। হ্যারিও বেরিয়ে গেলো মিটিং রুম থেকে।তূর্যয় চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের চুল টেনে যাচ্ছে।মিটিং এ উপস্থিত জনাব সোহেল তখনো মিটিং রুমে ছিলো।তূর্যয়ের অস্থিরতা দেখে সোহেল শয়তানি হাসি দিয়ে তূর্যয়কে প্রশ্ন করলো,
–“সেই মেয়েটি এইখানে যখন এসেছে তখন থেকেই আপনার মুখটা অন্যরকম দেখাচ্ছে।কি হয়েছে?মেয়েটি কে?”
তূর্যয়ের মেজাজ অনেক খারাপ ছিলো আগে থেকেই।আর সোহেলের কথা শুনে তূর্যয় বেশ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
–“সে যেই হোক।তোমার কি সমস্যা?যাও এইবার। মিটিং শেষ আমাদের।”
–“মেয়েটার উপর আমার এতো ইন্টারেস্ট নেই।তবে,মনে হয় না এখানে উপস্থিত অন্য কেউ মেয়েটিকে ভালো নজরে দেখছে।সাবধানে রাখবেন তাকে।সুন্দরী মেয়েদের চোখে চোখে রাখতে হয়।”
সোহেল কথাটা বলে চলে গেলো।তূর্যয় গভীর চিন্তায় পড়লো।সে মনে মনে ভাবছে,
–“রাণীর সাহস কি করে হয়,আমার কথা অমান্য করে অফিসের যেখানে সেখানে ঘুরা ফেরা করার?বেশি যত্নে রাখায় মাথায় উঠেছে সে।যায় করুক রাণী আমার সমস্যা নেই।কিন্তু,এইসব দানবের সামনে আসা রাণীর জন্যে মোটেও ঠিক না।রাণীর উপর আমার কঠিন নজর রাখতে হবে।আমার রৌদ্রের কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না। আমাদের দুইজনের মাঝে যে আসবে,তাকেই আমি বাঁচিয়ে রাখবো না।তবে রাণী,আমার কথা অমান্য করার শাস্তি তুমি ঠিকই পাবে।”
তূর্যয় মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।প্যান্টের দুই পকেটে হাত দিয়ে বেশ রাগী ভাবে হাঁটতে লাগলো সে।

রাণী নিজের মনের সুখে কেক খাচ্ছে।চকলেট কেক রাণীর অতি প্রিয় খাবার।এই কেকটা তাকে ক্যান্টিনের প্রবীণ লোকটা দিয়েছে,উনাকে সাহায্য করার কারণে।কেকের ভেতরে চকলেটে ঠাসানো থাকায় রাণী আরো বেশি মজা করে কেক খাচ্ছে।আরেকটা বড় কামড় দিয়ে কেক মুখে দিবে রাণী, অমনি সে তূর্যয়ের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলো।যার কারণে কেকে থাকা চকলেট রাণীর মুখে লেপ্টে গেলো।রাণী তূর্যয়ের চিৎকার শুনে হাতে থাকা কেক ফেলে দিলো।তূর্যয় দ্রুত পায়ে এসে রাণীকে চেয়ারে বসা অবস্থায় চেপে ধরলো।রাণী ঠিক বুঝতে পারছে মিটিং রুমে যাওয়ার কারণে তাকে আজ শাস্তি ভোগ করতে হবে।রাণী তূর্যয়ের ভয়ে নিজের কামিজ খামচে ধরে রাখলো।তূর্যয় রাণীর চেয়ারের উপর হাত রেখে তাকে চিল্লিয়ে বললো,
–“মিটিং রুমে ঢোকার জন্যে কার থেকে অনুমতি নিয়েছিস?নিজের চেহারা সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে তোর বেশি ভালো লাগে?এই মেয়ে এই?তখন তো ধুম করে মিটিং রুমে ঢুকে পড়েছিলি।এখন আমার সামনে মুখ বন্ধ কেনো?নিষেধ করেছিলাম না, যেখানে সেখানে না যেতে?আমার কথা অমান্য করার সাহস কোথা থেকে পাস?”
রাণী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে তো আর সহজ সরল কোম্পানিতে চাকরি করে না!সে তো চাকরি করে কালো বাজারের ব্যবসায়ীর অফিসে।এইখানে ভালো মানুষের আশা করা মোটেও ঠিক না।রাণী নিজের ভুল মেনে নিয়ে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“সরি।”
তূর্যয় খপ করে রাণীর বাহু চেপে ধরলো।
–“কিসের সরি হ্যাঁ?মিটিং রুমে যাওয়ার কারণ কি?”
তূর্যয়ের জোরে ধমকে হালকা নড়ে উঠলো রাণী।বুকে সাহস জুগিয়ে সে বলতে লাগলো,
–“ক্যান্টিনের চাচাকে সাহায্য করছিলাম।আজকে উনার সহকারী আসেনি তাই।”
এই কথা শুনে তূর্যয়ের মেজাজ আরো খারাপ হলো।সে একটানে রাণীকে দাঁড় করিয়ে দিলো।রাণীর কোমর চেপে ধরে তূর্যয় রাণীকে বলতে লাগলো,
–“ওহ,দরদ?নিজের চিন্তা না করে সবসময় অন্যর চিন্তা করলে নিজের ক্ষতি হয়।এইযে এখন?কে বাঁচাবে তোকে আমার হাত থেকে?তোর ক্যান্টিনের চাচা?”
রাণীর এবার রাগ লাগতে শুরু করলো।ভয়ের পাশাপাশি রাণীর মনে তূর্যয়ের কথা শুনে রাগ লাগলো।রাণী ভারী গলায় তূর্যয়কে বললো,
–“উনি একজন প্রবীণ লোক ছিলেন।তাই উনাকে সাহায্য করেছি। এতে আমার কি দোষ?আমি কি জানতাম ঐখানে সব দানবেরা থাকবে?”
রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট দেখে তূর্যয়ের রাগ গলে গেলো।এতক্ষণ রাণী মুখ নিচে করে রাখার কারণে তূর্যয় রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট দেখেনি। রাণীকে দেখে তূর্যয়ের বেশ হাসি আসছে।কিন্তু, এই তূর্যয় দানব তো হাসতেই জানে না।রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিলো সে।এরপর সেই আঙুল নিজের মুখে দিলো তূর্যয়।এমনটা দেখে রাণীর চোখ রসগোল্লা হয়ে গেলো।রাণী নিজের ওড়না দিয়ে তার মুখে তূর্যয়ের আঙ্গুল লাগানো স্থানে ঘষতে লাগলো।তূর্যয়ের এমন কান্ড কিছুতেই রাণী বিশ্বাস করতে পারছে না। রাণী তূর্যয়কে ধাক্কা দিলো সরে যাওয়ার জন্যে।কিন্তু,
তূর্যয় নড়লো না।তূর্যয় রাণীর গালে নিজের আঙ্গুল দিয়ে হালকা ঘষে বললো,
–“তোর জন্যে শুধু আমিই দানব।অন্য কাউকে যেনো তুই দানব না বলিস।”
রাণী চোখ বড় করে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে।রাণীর চুপ থাকা দেখে তূর্যয় আবারও রাণীকে বলে উঠলো,
–“আমি চায় না,তুই কারো চোখে পড়িস।তুই যার চোখে পড়বি তার চোখ উঠিয়ে নিবো আমি।সাথে আমি তোকে খেয়ে ফেলবো।বুঝতে পেরেছিস?আজকে থেকে যেখানে সেখানে ঘোরা ফেরা করা বন্ধ তোর।”
তূর্যয় কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে রাণী তাকে বলে উঠলো,
–“খেয়ে ফেলবেন মানে কি?আপনি কি রাক্ষস?”
রাণীর কথায় তূর্যয় আবারও ফিরে এসে রাণীর মুখ ধরলো।সে সাবলীল ভাবে রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“দেখবি কিভাবে খেয়ে ফেলবো?”
কথাটা বলে তূর্যয় রাণীর গালের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিলো। ভয়ে আর অদ্ভুত অনুভূতিতে রাণীর মনে ধুকধুক করছে।রাণী তূর্যয়ের বুকের দিকে শার্ট খামচে ধরলো চোখ বন্ধ করে।
এরমধ্যেই হ্যারি রাণীর কেবিনে এসে বলে উঠলো,
–“সিস, লাঞ্চ এনেছি।”
তূর্যয় আর রাণীকে কাছাকাছি দেখে হ্যারির মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো।হ্যারি হাসিমুখে আবারও বললো,
–“ক্যারি অন।”
রাণী ধাক্কা দিলো তূর্যয়কে, হ্যারির উপস্থিতিতে।তবে এইবারও তূর্যয় নড়লো না।রাণীর কোমর জড়িয়ে ধরা অবস্থায় তূর্যয় হ্যারিকে বলে উঠলো,
–“খাওয়া শেষ করে গাড়ি রেডি করতে বলবে।একটা ছোট্ট মিশন আছে আজ।”
হ্যারি হেসে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“অফকোর্স ব্রো।”

তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে চলে গেলো নিজের কেবিনে।হ্যারি রাণীকে লজ্জা দেওয়ার আগেই রাণী হ্যারিকে বললো,
–“আপনার ব্রো কেনো এমন করেছিলেন আমি জানি না।এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না আমাকে।চলুন খেতে বসি।”
রাণীর কথায় হ্যারি রাণীকে কিছু না বলে খেতে বসে পড়লো।তবে হ্যারি মনে মনে ভাবছে,
–“আমার ব্রো তোমার উপর ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছে, এটা আমি অনেক আগে থেকেই জানি।সিস,তুমিই পারবে আমার ব্রো এর জীবনটা ব্রাইট করতে।মে গড ব্লেস ইউ বোথ।”

খাওয়া শেষে তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়লো তূর্যয়ের গাড়ি করে।মায়া এতিম খানার সামনে গাড়ি আসতেই গাড়ি থামিয়ে প্রত্যেক বারের মতো তূর্যয় গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।সাথে নামলো হ্যারি আর রাণী।গেইট দিয়ে ভেতরের ছোট বাচ্চাদের দেখতে পেয়ে রাণীর মন তাদের সাথে খেলা করার জন্যে আনচান করছে।রাণী তূর্যয়ের শার্টের হাতা ধরে তাকে বলে উঠলো,
–“আমি ভেতরে যায়?”
তূর্যয় নিচু হয়ে তাকালো রাণীর দিকে।তার অতীতের কোনো কিছুতেই তূর্যয় রাণীকে শামিল করতে চায় না।তাই সে রাণীকে কড়া ভাষায় বললো,
–“একদমই না।”
রাণী কিছু বলার আগেই মোল্লা সাহেব বেরিয়ে এসেছে।উনি এসেই বলতে আরম্ভ করলেন,
–“ভেতরে আয় তূর্যয়।সাথে তো রাণী মা এসেছে।কেমন আছিস তুই, মা?”
তূর্যয় কিছু বলার আগেই রাণী হাসিমুখে বলল,
–“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালই আছি।আপনি কেমন আছেন?”
–“রেখেছে আল্লাহ্ ভালই।”
মোল্লা সাহেব জবাব দিলেন। তূর্যয় মোল্লা সাহেবের সাথে কথা বলে চলে যেতে নিলেই রাণী আবারও তূর্যয়ের শার্ট ধরে বলতে লাগলো,
–“দেখুন না,বাচ্চাগুলো আমাকে ডাকছে।আমি যায় ভেতরে? প্লিজ?”
তূর্যয় নিজের শার্ট থেকে রাণীর হাত ছাড়িয়ে রাণীর হাত ধরে বললো,
–“গাড়িতে উঠ।”
মোল্লা সাহেব তূর্যয়কে রাণীর হাত ধরতে দেখে মুহূর্তেই বুঝে গেলো রাণী তূর্যয়ের জীবনে বেশ জরুরি একজন মানুষ।নাহলে,তূর্যয় হাত ধরে এমন মানুষ মোল্লা সাহেব আজ পর্যন্ত দেখেননি।কিছু একটা ভেবে মোল্লা সাহেব তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“থাক না মেয়েটা।যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।”
রাণী নিজের হাত তূর্যয়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
–“যায় না।”
রাণীর ঠোঁট উল্টে কথা বলাতে তূর্যয় মুহূর্তেই রাণীর মাঝে হারিয়ে গেলো।এই সুযোগ নিয়ে রাণী মোল্লা সাহেবের কাছে গিয়ে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“দেখলেন মোল্লা সাহেব,এই জলহস্তীকে রাজি করানো কতো কষ্ট?আমি যাচ্ছি।”
রাণী ভেতরে ঢুকে পড়লো।মোল্লা সাহেব আর হ্যারি “হাহা” করে হেসে উঠলো রাণীর কথায়।

–“ব্রো,কুইন পারেই তোমাকে এইসব বলতে।”
হ্যারি হেসে উঠে বললো।

তূর্যয় ভ্রু কুঁচকালো হ্যারির কথায়।যাওয়ার আগে তূর্যয় মোল্লা সাহেবকে নির্দেশ দিলো,
–“বেশি চঞ্চল মেয়েটা।একটু দেখে রাখবেন।বাহিরে কেউ তার সাথে দেখা করতে চাইলে অনুমতি দিবেন না।আমি আসবো সন্ধ্যার পরই।হ্যারি,গাড়িতে বসো।”
রাণীর প্রতি তূর্যয়ের টান দেখে হ্যারির বুঝতে দেরি হলো না,তূর্যয় রাণীকে ভালোবাসে।হ্যারি চলে এলো গাড়িতে।তূর্যয় আসার পূর্বে রাণীকে আবারও দেখে নিলো বাহির থেকে।রাণীর বাচ্চাদের সাথে খেলায় মগ্ন হয়ে আছে। রাণীর হাসি দেখে তূর্যয়ের মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো।তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো রাণীকে দেখে।এর মধ্যেই হঠাৎ তার কানে এলো মোল্লা সাহেবের কথা,
–“ভালোবাসিস এই ছোট মেয়েটাকে?”
তূর্যয় বেশ শান্ত হয়ে জবাব দিলো,
–“অনেক।”
–“আগলিয়ে রাখতে পারবি তো?তার কিন্তু কেউ নেই।তোকেই তার পৃথিবী হতে হবে।”
মোল্লা সাহেব হেসে বললো তূর্যয়কে।
–“যেদিন বুঝেছি ভালোবাসি তাকে, সেদিনই হয়ে গিয়েছি তার পৃথিবী।শুধু আমার অতীত যেনো না জানে সে।আসছি আমি।দেখে রাখবেন তাকে।”
তূর্যয় কথাগুলো বলে ধপ ধপ পা ফেলে গাড়িতে উঠে পড়লো।

–“দুঃখিত তূর্যয়,তোর এই কথা রাখতে পারলাম না।তোর অতীত জানা এই মেয়ের জন্যে খুবই জরুরি।এই মেয়েই পারবে সালেহা,তোর,আমার সবার মাঝের ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে।আল্লাহ্, সব যেনো এইবার ঠিক হয়ে যায়।”
মোল্লা সাহেব আপনমনে কথাগুলো ভেবে ভেতরে চলে এলো।

অন্যদিকে সাবিনা বেশ রেগে ফোন করলো মমতা এতিম খানার সেই গোপন মানুষটিকে,
–“আরে এই রাহেলা কই হাওয়া হলো?কিছুই তো বুঝছি না।”
–“কি আর হবে,পুলিশের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে হয়তো?আমাদের এইবার ভালো একটা প্ল্যান করতে হবে রাণীর জন্যে।”
সেই মানুষটি বললো।
–“এতো কিছু জানি না।আহেমদ এর বিছানায় আনার ব্যবস্থা করে দে।সবটা সে সামলিয়ে নিবে।কোনো প্ল্যান তৈরি করলে ফোন দিস।”
সাবিনা ফোন কেটে দিলো।
–“চিন্তা কর ভালো করে,কিভাবে রাণীকে আহমেদের কাছে পাঠানো যায়?এরপরই রাণীর বিনাশ হবে।”
মানুষটি কথাটা ভাবতেই নিজের ফোন হাতে মুঠ করে নিলো।

চলবে….
কপি করা নিষেধ।অনেক ব্যস্ত ছিলাম আজ‌ও,তাও লিখলাম।কেমন হয়েছে গল্প জানাবেন সবাই।আগের মতো গল্প রিয়েক্ট পড়ে না দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়,লেখার আগ্রহ থাকে না।গল্প যারা পড়েন তারা অবশ্যই পোস্টে রিয়েক্ট করবেন।আপনার একটা রিয়েক্ট আমার গল্প লিখতে উৎসাহ দিবে।যাদের নিউজফিড এ গল্প যায় না,তাদের বেশির ভাগ সাইলেন্ট রিডার।আপনারা গল্পে কিছুদিন লাইক কমেন্ট করুন,দেখবেন আগের মতো নিউজফিডে গল্প পাচ্ছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here