#আলো-আঁধার🖤পর্ব ৩২

0
505

#আলো-আঁধার🖤পর্ব ৩২
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

৩২.
রাণী তূর্যয়ের সাথে মহা অভিমান করলেও,একদিন তূর্যয়ের দেখা না পেয়ে রাণী পাগল প্রায়।তূর্যয়ের কথা মনে আসতেই রাণীর চোখ অভিমানের জলে ভরে যায়।কিন্তু,রাণীর মনে জিদের শেষ নেই।তূর্যয়ের এতো ফোন,
মেসেজ সবটা দেখেও রাণী যেনো তা দেখলো না।রাণী চায় তূর্যয় সশরীরে এতিম খানায় এসে রাণীকে “সরি” বলে।এক প্রকার জিদ নিয়ে বসে আছে সে।এইদিকে তার এমন অবস্থা দেখেই,রাণীর সাথে তূর্যয়ের সম্পর্কের কথা রাণীর বান্ধবীরা জেনে যায়।যদিও সিমি আগে থেকে সব জানে,তারপরও সে রাণীর সাথে মিথ্যা নাটক করছে।
দুপুরের খাবার খেয়ে রাণী বসে আছে তার দোকানে।এই দোকানের টাকাটা তূর্যয়ের দেওয়া।রাণীর শরীরের জিদের সাথে সাথে তূর্যয়ের সাথে অভিমানের মাত্রাটাও বেড়ে গেলো প্রচুর।তাই সে খামে করে টাকা নিয়ে এসেছে, যা সে তার দোকানের জন্যে জমিয়েছিল।রাণীর এখন একমাত্র উদ্দেশ্য,তূর্যয়ের গাড়ি তার দোকানের সামনে দিয়ে গেলেই সে বেরিয়ে পড়বে তূর্যয়ের ঘরের রাস্তার দিকে।এরপর তূর্যয়ের রুমে খামের টাকাটা রেখে আসবে।কিন্তু, এই সকাল থেকে তূর্যয়ের গাড়ির দেখা পাচ্ছে না সে।রাণী দোকানের রিসিপশনে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।তূর্যয়ের গাড়ি এখনো কেনো তার বাড়ি থেকে বের হয়নি,এই নিয়েই রাণী ভেবে যাচ্ছে।তাছাড়া,
সালেহার সত্যি কথা,তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যুর রহস্য,সবটাই রাণীর তূর্যয়কে বলা বাকি আছে এখনো।এখন রাণীর মনে হচ্ছে,তূর্যয়ের সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে।রাণী তূর্যয়ের অফিস থেকে দেওয়া মোবাইলটা বের করলো তূর্যয়কে ফোন দেওয়ার জন্য।কিন্তু পরক্ষণে সে ভাবলো,
–“দানবটার কিছুই হয়নি।শুধু শুধু আমি চিন্তা করছি। দানবটার কিছু হলে ভিনদেশী ভাই আমাকে ঠিকই জানাতো।আর কিই বা হবে উনার?হিংস্র হলে উনার সাথে কেউ পারে?সারাদিনই তো চোখে,মুখে,শরীরে হিংস্রতা নিয়ে ঘুরে সে।স্বাভাবিক অবস্থায়ই লোকটা হিংস্র থাকে।”
কথাগুলো ভেবে রাণী নিজের মাথায় হাত রাখলো।নিজের মনে সহস্র কথা ভাবলেও,রাণীর বেশ চিন্তা হচ্ছে তূর্যয়ের জন্যে।রাণী নিজের বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“আল্লাহ্,আমার সন্ত্রাসীকে সবসময় ভালো রাখবেন।”
রাণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের চোখ বন্ধ করলো।চোখ খুলতেই সে দেখলো হ্যারি আসছে তার দোকানে।রাণীর হালকা হেসে হাত নাড়লো হ্যারিকে।

রাণীর অন্য বান্ধবীরা জিনিস বেচা কেনা করছে।আর রাণী রিসিপশনে বসে সবার থেকে টাকা নেওয়ার পাশাপাশি হ্যারির সাথে কথা বলছে।
হ্যারি তূর্যয়ের সাথে ডার্ক হাউজেই ছিলো।গতকালের গভীররাতে তাদের একটা ভয়ংকর মিশন ছিলো।অতিরিক্ত হিংস্র মিশনগুলো তূর্যয় রাতের বেলায় করতে বেশ সানন্দবোধ করে।গতকালের হিংস্র লড়াইয়ে হ্যারি আর তূর্যয় সাথে তাদের দলের অনেকেই বেশ আঘাত পেয়েছে।তবে,তূর্যয় বিপক্ষ দলের কাউকে ছাড়েনি।তূর্যয়ের বড় ছুরির আঘাতে একেক জনকে সে দুই তিন টুকরো করেছে তো,অনেকের গলা থেকে মাথা আলাদা করেছে।তূর্যয়ের পেটের উপর বাম দিকে বিপক্ষ দলের প্রধানের ছুরির আঘাতে বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে।অগত্য মিশন শেষে হ্যারিকে নিয়ে সে তার নিজের ঘরে চলে এসেছিল।বিশেষ করে হ্যারির আঘাতে ওষুধ লাগানোর জন্যেই তূর্যয় জোর করে হ্যারিকে নিয়ে আসলো তার বাড়িতে।মাঝে মাঝে তূর্যয় রাত এই বাড়িতেই কাটায় যখন সে আঘাত পায়।যখন তার এই বাড়ি ছিলো না,তখন না পারতে সে শান্তি মহলে যেতো।কিন্তু,তার বাড়ি হওয়ার পর তূর্যয় মাঝে মাঝে এইখানেই রাত কাটায়।তার মায়ের ওয়াদাটা তার মাথায় আসলে সে বুকে হাত রেখে বলে,
–“তোমার ওয়াদা আমার মনে আছে,মা।কিন্তু আমার একটু শান্তি দরকার।তাই শান্তি মহলে আজ গেলাম না।”
এই কথা তূর্যয় সবসময় বলে যখন সে রাতে দিনে একবারও শান্তি মহলে যায় না তখন।এই কথাটা বললে তূর্যয়ের হৃদয়ে শান্তি বয়ে যায়।মনে হয়,তার মাও তার এই কথায় তাকে সমর্থন করে।
রাতে তূর্যয় এবং হ্যারি দুইজনই আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো।আর সকাল হতে হতেই তাদের মধ্যে যেনো সেই দানবীয় শক্তি আবার চলে এসেছে।সকালের নাস্তা সেরে দুইজন তূর্যয়ের ঘরের পাশের আস্তানায় আবারও তাদের কাজে লেগে পড়েছিল।অতিরিক্ত নড়ার কারণে তূর্যয়ের পেট থেকে আবারও রক্ত পড়া শুরু হলে তূর্যয় অতিদ্রুত তার কাজ শেষ করে রুমে চলে এলো।রুমে যাওয়ার আগে হ্যারিকে সব কাজ শেষ করে রাণীর সাথে দেখা করতে নির্দেশ দিলো সে।সাথে তূর্যয় হ্যারিকে কঠোর ভাবে বলে উঠলো,
–“দরদ দেখিয়ে নিজের বোনকে আমাকে ব্যাথা পাওয়ার কথা বলবে না।যেহুতু রাগ নিয়ে আছে সে।তাই থাকুক।ব্যাথা কমলে আমি নিজেই তোমাকে প্ল্যান বলবো।এরপর তোমার বোনের সাথে আমাকে দেখা করানোর দায়িত্ব তোমার। আর তখন আমি তোমার বোনকে সারাজীবন এর জন্যে আমার করে নিবো।”
হ্যারি তূর্যয়ের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো।সব কাজ সেরে দুপুরে হ্যারি রওনা দিলো রাণীর দোকানে।

এইদিকে রাণী বিরক্ত,প্রচন্ড বিরক্ত।হ্যারির নাকে, হাতে,
গলার পাশে ব্যান্ডেজ দেখে রাণীর মনটা নরম হয়ে আছে।কিন্তু;হ্যারি কিভাবে ব্যাথা পেয়েছে, তা অনেকবার জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি তার।হ্যারি রাণীকে নানান কথায় পেঁচিয়ে ফেলছে।শেষ পর্যায়ে রাণী জোর গলায় হ্যারিকে বলে উঠলো,
–“ভিনদেশী ভাই,ব্যাথা কিভাবে পেয়েছেন? ঐ সন্ত্রাসীটা ঠিক আছে তো?এইবার কিন্তু আমার জবাব চাই।”
হ্যারি পড়লো মহা বিপদে।তূর্যয়ের পরিকল্পনা হ্যারির পছন্দ হয়েছে।কিন্তু,রাণীর এমন নাছোড়বান্দা ভাব দেখে হ্যারি বিপাকে পড়লো।হ্যারি চোখ সরু করে রাণীকে বলে উঠলো,
–“আর ইউ স্যাড?আমার ব্রোয়ের সাথে কথা এখনো টক করছো না কেনো?ব্রো ইজ ভেরি স্যাড!”
রাণী চোখ ঘুরালো হ্যারিকে,
–“কচু স্যাড।আপনার ব্রো আমাকে ছাড়া ভালো আছে।এখন বলুন না,কি হয়েছে আপনার।আর আপনার ব্রো ঠিক আছে?”
–“ব্রো বলতে নিষেধ করেছে।অ্যান্ড আম সো ফন্ড অফ মাই ব্রো।”
হ্যারি হেসে বললো।হাসার সময় নাকে ব্যাথা অনুভব করলো হ্যারি।নাকে আলতো করে সে হাত রাখলো।
তা দেখে রাণী ভ্রু কুঁচকে হ্যারিকে প্রশ্ন করলো,
–“আপনি আমার দলের নাকি আপনার ব্রো এর দলের?”
–“দুইজনের। আই লাভ ইউ বোথ।”
হ্যারি হেসে বললো।
রাণী মাথা নাড়িয়ে হ্যারিকে জবাব দিল,
–“হবে না। আপনি শুধু আমার দলে থাকবেন।”
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ তাদের দুইজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে লাগলো। একটু পরেই হ্যারির মোবাইল বেজে উঠলে, হ্যারি দেখে তার মা ফোন দিয়েছে। তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হ্যারি। ফোন রিসিভ করে ক্যামেরা অন করলো সে। হ্যারির মাও রাণীকে বেশ পছন্দ করে।হ্যারি আর রাণী অফিসে লাঞ্চ ব্রেকে প্রায় সময়ই হ্যারির মায়ের সাথে কথা বলতো।সেখান থেকেই তাদের মধ্যে আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়েছে।তাই, এখন হ্যারির মায়ের ফোন দেখে রাণী বেশ খুশি হলো। আর রাণীর দেখা পেয়ে হ্যারির মাও বেশ খুশি হয়েছে।অতঃপর হ্যারি সক্ষম হলো রাণীর প্রশ্ন থেকে নিজেকে বাঁচাতে।

রক্ত মুছে শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধেই তূর্যয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।কিন্তু আবারও ব্যথা অনুভব হ‌ওয়ায় তূর্যয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। মুখ কুঁচকে সে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসলো। পেটে বেশ ব্যথা অনুভব করছে সে। ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেলো ব্যান্ডেজ রক্তে লাল হয়ে আছে। তূর্যয় বুঝলো তার এই ক্ষতে সেলাইয়ের প্রয়োজন।তূর্যয় হাত মুঠিবদ্ধ করে “ধেত” বললো।পেট থেকে একটানে ব্যান্ডেজ আর তুলা সরিয়ে নিলো সে।ব্যাথায় তূর্যয় হালকা ভ্রু কুঁচকে নিলো নিজের।সেই ব্যান্ডেজ দিয়ে পেটের রক্ত মুছতে মুছতে বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে,সেলাই করার সরঞ্জাম বের করলো।সোফায় হেলান দিয়ে বসে, দাঁতে দাঁত চেপে তূর্যয় নিজের পেটের সেলাই করা শুরু করলো।এইসব কাজ তার হাতের কাছের ময়লা।যদিও ব্যাথা অনুভব হয় তূর্যয়ের, তাও কেনো জানি কষ্ট লাগে না তার।অতীতের ঘায়ের কাছে এইসব ব্যাথা কিছুই মনে হয় না তূর্যয়ের।বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের সেলাই করা শেষ হতেই তূর্যয় সেখানে ব্যান্ডেজ করে নিলো।আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের সমান্তরাল, খন্ড খন্ড মাংস দ্বারা আবৃত পেটের একপাশে ব্যান্ডেজ দেখতেই তূর্যয়ের বেশ রাগ লাগলো।এইসব কাটাকাটির দাগ তূর্যয়ের মোটেও ভালো লাগে না।সহজে তার আঘাত লাগে না,কিন্তু যখন লাগে তখন একটু গভীর হয়ে যায় ব্যাপারটা।এমন কাটাকাটির, সেলাইয়ের অনেক দাগ ছিলো তার শরীরে।তবে সেই দাগ আবার মিইয়ে যায়।কিন্তু অতীতের তার পিঠের ক্ষতের হালকা দাগ এখনো রয়ে গিয়েছে।এই হালকা দাগগুলোই তূর্যয়ের হিংস্রতার কারণ,আর এই হালকা দাগ যতবারই দেখে ততোবারই তূর্যয়ের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে দাউদাউ করে।আয়নার সামনে থেকে সরে পেইন কিলার আর কিছু দরকারী ওষুধ খেয়ে নিলো সে।গায়ে শার্ট চড়িয়ে সে ফোন করলো হ্যারিকে।

হ্যারি আর রাণী মাত্রই শেষ করলো হ্যারির মায়ের সাথে কথা বলা। অমনি তূর্যয়ের ফোন দেখে হ্যারি দ্রুত ফোন রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো তূর্যয়ের কণ্ঠ,
–“বেরুতে হবে।লিংকন আসছে।ডায়মন্ডের ডিল হবে।দোকানের অপর পাশে গাড়ি থামবে।আমি আসা পর্যন্ত দোকানেই থাকো।রৌদ্র ঠিক আছে?”
রাণীকে পানি দেওয়ার অনুরোধ করে হ্যারি রাণীকে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে নিলো।এরপর হ্যারি মিনমিন করে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“ইয়াহ,ভালো আছে।বাট ঐযে,তোমার মতো অবস্থা।তুমি আস্ক করো সে কেমন আছে,আর সে আস্ক করে তুমি কেমন আছো। মিডেলে আমার সিচুয়েশন খারাপ হচ্ছে।”
–“আহ,চুপ করো।রৌদ্রের মতো তুমিও বেশ লেকচার দাও।আমি আসছি দশ মিনিটের মাথায়।”
তূর্যয়ের কড়া জবাব।
–“উম,ওকে ব্রো।”
হ্যারির কথা বলা শেষ।রাণীও এসে পানির গ্লাস রাখলো হ্যারির সামনে।হ্যারি ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিলো।রাণী কিছু বলার আগেই,হ্যারি রাণীকে নিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ালো। দোকানের সামনে রাখা মাটির কিছু জিনিস দেখিয়ে হ্যারি নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে রাণীকে।রাণী টুকটাক উত্তর দিয়ে হ্যারিকে বলে উঠলো,
–“হয়েছে আমাকে ভুলানো?এইবার বলুন কি হয়েছে আপনার?আর আপনার ব্রো কেমন আছে?”
হ্যারি মাথা চুলকালো,
–“আমরা গুড আছি সিস।”
রাণী চোখ বড় করে আঙ্গুল দেখালো হ্যারিকে,
–“এই রাণীর সাথে চিটিং?আমি কিন্তু আপনার ব্রো এর রৌদ্র!উনার চেয়ে আমিও কম না।”
হ্যারি হাসলো রাণীকে দেখে।কেউ কিছু বলার আগেই জোরে গাড়ির হর্ণ শুনতে পেলো।রাণী আর হ্যারি সামনে তাকালো।রাণীর মনে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে।তূর্যয়ের গাড়ি দেখে রাণীর ইচ্ছে এক দৌড়ে গিয়ে তার দানব সন্ত্রাসীকে আঁকড়ে ধরতে।কিন্তু,তূর্যয় গাড়ির জানালা পর্যন্ত খুললো না।এই দেখে রাণীর অভিমানের মান আরো বাড়লো।হ্যারি রাণীকে বিদায় জানিয়ে রাস্তার অপর পাশ চলে এলো।রাণী অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তূর্যয়ের গাড়ির দিকে।রাণী তূর্যয়কে না দেখলেও,
তূর্যয় রাণীকে চোখ দিয়েই দূর থেকে ভালোবাসা দিয়ে দিলো।রাণীকে দেখে তূর্যয়ের মনটা ভালোবাসায় পূর্ণ হলো।সে মনে মনে বললো,
–“যে শাস্তি দিবো,সেটা সহ্য করার ক্ষমতা যেনো তোমার থাকে।সেই দিন আমাকে তুমি ভালোবাসো,এই কথাটি বলতে চেয়েছিলে।এটা আমি বেশ জানি।এইবার তূর্যয়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখবে তুমি।”
গাড়ি চলে যাওয়ার পরেও রাণী সেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।তূর্যয়ের সাথে তার অভিমানের মাত্রাটা যেনো বাড়লো আরো দুই ধাপে।
.
একা থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিমি ফোন করলো সাবিনাকে।সিমি সাবিনাকে সবটা বুঝিয়ে বললো।সাবিনা সব প্ল্যান মাথায় রেখে এগিয়ে গেলো আহমেদের রুমের দিকে।আজ দুপুরেই সাবিনা দেশে ফিরেছে।এক ঘন্টা ঘুম দিতেই তার ঘুম ভাঙলো সিমির ফোনে।আহমেদ এখন বাসায় আছে,তাই সেই সুযোগ নিয়ে সাবিনা আহমেদের রুমে গেলো।তখনই সে দেখলো একটা মেয়েকে দুইজন লোক ধরে বের করছে আহমেদের রুম থেকে।সাবিনা নাক সিটকালো মেয়েটিকে দেখে।রুমে ঢুকতেই সে দেখলো আহমেদ প্যান্ট পড়ছে।সাবিনা বেশ ভাব নিয়ে আহমেদকে বললো,
–“বাবা,তূর্যয়ের প্রেমিকার সন্ধান পেয়েছি।তাকে মারলে, তূর্যয় বেঁচে থেকেও মরে যাবে।এটা ভেবে আমার কাছে বেশ ভালো লাগছে।তোর কি মতামত?”
–“প্রেমিকা! ঐ হিংস্র জানোয়ারের?প্রেমিকা নাকি রক্ষিতা?”
আহমেদ মলিন হাসলো।
–“আরে তুই তো নষ্ট করতে চেয়েছিলি সেই মেয়েকে।তূর্যয় তোকে মেরেছিল সেদিন।মনে আছে?সারাদিন রাত এতো নেশা করিস,মনে থাকবে তোর কিভাবে?আমাকে মনে আছে তোর?আমি তোর মা।”
সাবিনা ঢং করে বললো।
আহমেদ রেগে গেলো এখন,
–“নেশা ছাড়া আমার কিই বা আছে?কখন কি করেছি মনে নেই আমার।হয়তো দেখেছিলাম একবার তূর্যয়ের সাথে একটি মেয়েকে।তবে মনে নেই আমার এখন।”
সাবিনা এসে আহমেদের মাথায় হাত রাখতেই আহমেদ গা ঝাড়া দিলো,
–“এইসব করো না।তবে একটা কথা বলছি,
তূর্যয়ের ক্ষতি করার জন্যে, ঐ মেয়েকে তার বউ হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করো।কারণ,প্রেমিকার মৃত্যুর চেয়ে বউয়ের মৃত্যুটা বেশি কষ্টের হবে।এখন যাও তো।সময় মতো কাজ হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও তূর্যয়ের বউকে।আমি অপেক্ষা করে আছি।”
আহমেদের কথা শুনে সাবিনার মুখ চিকচিক করে উঠলো,
–“সোনা আব্বা আমার।একদম ভালো কথা বলেছিস।”
আহমেদ কিছু না বলে সাবিনাকে নিজের রুম থেকে বের করে দিলো।রুম থেকে বের হয়েই সাবিনা ফোন করলো সিমিকে,
–“প্রেমিকার মৃত্যুর চেয়ে বউয়ের মৃত্যুটা বেশি কষ্টের,
আমার বাবা আহমেদের কথা এটা।সে যা বলে সেটা বেশ ভেবে বলে।তাই ব্যবস্থা কর,রাণী আর তূর্যয়কে এক হতে।এরপরই রাণীকে মেরে তূর্যয়কে ঘায়েল করতে পারবো।আর তোর ঐ হ্যারি না কি,একে বাদ দে তূর্যয়ের ক্ষতি করার জন্যে।আমাদের জন্যে রাণীই যথেষ্ট।”
সিমি বাঁকা হাসলো,
–“ঐ হ্যারির বাচ্চাকে একটা শাস্তি আমি দিবো।বেশি রাণী ভক্ত সে তাই।”
–“সাবধানে কাজ করবি।তূর্যয়ের মতো না হলেও, হ্যারিও কিন্তু কম গভীর জলের মাছ না।আপাতত রাণী আর তূর্যয়কে সামলা তুই।”
সাবিনা বলে উঠলো সিমিকে।সিমি বাঁকা হেসে ফোন রাখলো।
–“তোকে বিনাশ করতে যা যা দরকার আমি তাই করবো রাণী।দরকার হলে,তোকে আর তূর্যয়কে এক হতে সাহায্য করবো।এরপর তোকে মারবো।উফ,শান্তি।”
সিমির কঠিন মনোভাব।
;
রাণী সুযোগ বুঝে টাকার খাম রেখে দিলো তূর্যয়ের রুমে।তূর্যয় রাতে এই বাড়িতে ফিরেনি।তাই সে টাকার খাম দেখতে পেলো না।সকালে তার বাড়িতে আসার আগেও রাণীকে ফোন দিয়েছিল তূর্যয়।কিন্তু রাণী ফোন ধরেনি।তূর্যয় রাণীকে নিয়ে নিজের প্ল্যানিং জানালো হ্যারিকে।নিজের রুমে আসতেই বিছানার পাশের ছোট টেবিলে একটা খাম দেখলো সে।তূর্যয়ের বাড়িতে ঢোকা কারো জন্যেই প্রযোজ্য নয়।শুধুমাত্র রাণী,হ্যারি আর কাজের লোকরা ছাড়া।খামের উপর রাণীর নাম দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো তূর্যয়। খাম খুলে টাকা দেখে তূর্যয়ের মেজাজ সাত আসমানে উঠে গেলো।তূর্যয় স্বপ্নেও ভাবেনি,রাণী এই কাজটা তার সাথে করবে।তূর্যয় বুঝতে পারছে,এইগুলো রাণীর দোকানের জন্যে দেওয়া তূর্যয়ের টাকা।কারণ,
রাণী খামের উপরে লিখে দিয়েছে “দোকানের টাকা দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।”
সাথে সাথে তূর্যয় হ্যারিকে ফোন করতে নিলে,সে দেখলো হ্যারি ফোন দিয়েছে তাকে। হ্যারির ফোন রিসিভ করতেই সে দ্রুত তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“ব্রো ইমারজেন্সি মিশনে যেতে হবে।রেপিস্ট কেইস।”
–“রাণীর ক্ষেত্রেও প্ল্যান পরিবর্তন করতে হবে।তোমার বোন আমার হিংস্র রূপ দেখবে আজ।”
বেশ রেগে কথাগুলো বলে তূর্যয় রেডি হয়ে নিলো মিশনের জন্যে।

মিশনে সবাই তাজ্জব হয়ে আছে তূর্যয়ের মাইর দেখে।এক ঘায়েই তিনজনকে ঘায়েল করছে তূর্যয়।তূর্যয়ের হিংস্রতায় সবাই জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।যেই জন ধর্ষক দলের প্রধান ছিলো,তাকে মাটিতে ফেলে তার মাথায় পা দিয়ে আঘাত করে ঘটনাস্থলেই মেরে ফেলেছে তাকে তূর্যয়।তূর্যয়ের সাদা শার্টের উপর রক্ত ভেসে উঠেছে।সেলাইয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে তূর্যয়ের ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত তার শার্ট পর্যন্ত উঠে এসেছে।হ্যারি তা দেখে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“ব্রো থামো।স্টপ।হি ইজ ডেড।মারা গিয়েছে সে। এতো জিদ,হুয়াই!”
তূর্যয় থেমে গেলো।হ্যারির কলার চেপে সে হ্যারিকে বললো,
–“তোমার বোন।আমার জিদের কারণ তোমার বোন।ওর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি,হ্যারি।এতো সাহস তার?আমাকে দোকানের টাকা ফেরত দেয়?সামান্য কথায় এতো জিদ দেখাচ্ছে তোমার বোন?সব দেওনা পাওনা মিটিয়ে আমাকে ছেড়ে দিবে ভেবেছে সে?আমি বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব না।”
–“ভুল বুঝছো,ব্রো।রাণী তোমাকে লাভ করে।সে তোমার জন্যে বেশ টেন্সড ছিলো।হয়তো,এখন সে অ্যাংরি।”
হ্যারি তূর্যয়কে বলে উঠলো।
–“অ্যাংরি!রাগ?তূর্যয়ের হিংস্র রূপ দেখেনি তো সে কখনো,তাই এতো বার বেড়েছে সে।এতিম খানায় চলো।”
হ্যারির কলার ছেড়ে বলে উঠলো তূর্যয়।
–“তোমার রক্ত…!”
–“গাড়িতে চেঞ্জ করছি।”
হ্যারির কথায় তূর্যয় জবাব দিলো।

জঙ্গলের রাস্তায় তূর্যয় নিজের গাড়ি পরিবর্তন করলো,
যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে তূর্যয় মমতা এতিম খানায় যাচ্ছে।আর এখন সন্ধ্যা হওয়াতে তাদের লক্ষ্য করাটাও অনেক দূরের ব্যাপার।গাড়িতে সে নিজের ব্যান্ডেজও পরিবর্তন করে নিলো।গাড়ি এতিম খানার গেইট দিয়ে গিয়ে একেবারে পার্কিং লঞ্জে গেলো।আজ শুধু তূর্যয় আর হ্যারি এসেছে।তূর্যয় গাড়ি থেকে নামতেই সবাই বেশ অবাক হলো।সবাই চুপ হয়ে আছে তূর্যয়ের ভয়ে।সবাই জানে,তূর্যয়কে দেখে শব্দ করা মানে তাদের মরণ।তূর্যয় আর হ্যারি ধপধপ পা ফেলে ভেতরে গেলো।সালেহা কথা বলতে চাইলে তূর্যয়ের সাথে,তূর্যয় হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়।হ্যারি সালেহাকে জিজ্ঞেস করে,
–” রাণী কই?”
–“এইযে তাদের রুমে।”
সালেহা জবাব দিলো।

রাণী দোকান থেকে ফিরে গোসল সেরে বারান্দায় তাওয়াল আর কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলো।তখনই জোরে দরজা খোলার শব্দে কেঁপে উঠলো সে।রুমে এসে দেখে তূর্যয় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।রুমের দরজা খোলার আগেই তূর্যয় রাণীর বান্ধুবীদের রুমের বাহিরে দেখেছিল।অগত্য রাণী রুমে একা থাকায়, নির্দ্বিধায় সে জোরে দরজা খুললো।রাণী অবাক হলো তূর্যয়কে দেখে।তূর্যয়কে প্রচন্ড হিংস্র মনে হচ্ছে তার।রাণী বুকটা ধুকধুক করছে।পেছন থেকে হ্যারি রাণীকে চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে দরজা বন্ধ করে সে বাহিরে দাঁড়ালো।কিন্তু তূর্যয়ের পেটের দিকে রক্ত দেখে রাণী বিচলিত হয়ে তূর্যয়ের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে তাকে বললো,
–“এই কি হয়েছে আপনার?রক…রক্ত দেখা যাচ্ছে তো।”
তূর্যয় নিজের হাত সরিয়ে নিলো রাণী থেকে।রাণী তূর্যয়ের হাতের ধাক্কায় একটু সরে গেলো।তূর্যয় এইবার রাণীর দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে রাণীর কাছে এগিয়ে গেলো।রাণীর ভয় হচ্ছে তূর্যয়ের এমন রূপ দেখে।রাণী হালকা ঢেঁকুর গিললো।তূর্যয় রাগী কণ্ঠে বললো,
–“তুই ভেবেছিস কিভাবে,আমাকে সকল দায়মুক্ত করে আমার থেকে দূরে যাবি? তূর্যয়কে ছেড়ে যাওয়ার অধিকার কি তোকে তূর্যয় দিয়েছে?”
রাণী পিছু যেতে যেতে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকলো।রাণী কাঁপছে।রাণীর কাঁপা হাত তূর্যয়ের বুকে রাখতেই তূর্যয় রাণীর হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।রাণীর চোখে পানি টলটল করছে।এইবার তূর্যয় শক্ত করে চেপে ধরলো রাণীর মুখ,
–“এই একদম কান্না করবি না।তূর্যয়কে অবহেলা করার আগে তোর বুঝা উচিত ছিলো তূর্যয় কি জিনিস।তোর বেশি শখ আমাকে টাকা দেওয়ার?কি ভেবেছিস তুই?তূর্যয়ের জীবন থেকে চলে যাবি?আমি তোকে যেমন ভালোবাসতে পারি,তেমন আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাবলে তোকে আমার কাছে আটকিয়েও রাখতে পারি।”
তূর্যয়ের মুখে ভালোবাসার কথাটা রাণী এইভাবে হিংস্রতার সাথে শুনবে, এটা রাণী কোনো কালেই আশা করেনি।রাণীর গালে তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়তেই তূর্যয় রাণী কোমর খামচে ধরলো কামিজ সরিয়ে।রাণীর শরীর গীরগীর করে উঠলো।
–“আপনি ভুল বুঝছেন।আমি..”
রাণীকে কিছু বলতে দিলো না আর তূর্যয়।রাণীর এতক্ষণ কান্না মাখা চেহারা সহ্য করতে পারলেও রাণীর এমন লজ্জা মাখা মুখ আর গালে লেপ্টে থাকা পানি দেখে তূর্যয় নিজের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো।অতঃপর সে রাণীর ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো নিজের ঠোঁট দিয়ে।রাণী অপ্রস্তুত হওয়াতে তূর্যয়ের গায়ে হাত ছুঁড়ছে সে।কিন্তু সেদিকে তূর্যয় ভ্রুক্ষেপ না করে দুই হাতে রাণীর কোমর চেপে তাকে আলগিয়ে বেশ হিংস্রতা আর ভালোবাসা মিশ্রিত চুমু দিচ্ছে রাণীর ঠোঁটে।যার বেশিরভাগ চুমু রাণীর কাছে কামড় বলে মনে হচ্ছে।তূর্যয়ের এমন হিংসাত্মক আচরণে রাণী ভয়ে শেষ।আর এমন আচমকা এতো বড় শাস্তি তূর্যয় রাণীকে দিবে এটা রাণী ভাবেনি।তবে এই শাস্তি রাণীর কাছে শাস্তির পাশাপাশি চরম সুখ বলে মনে হচ্ছে।
তূর্যয় নিজেকে শান্ত করে রাণীকে আঁকড়ে ধরা অবস্থায় তার চুল টেনে তাকে বলে উঠলো,
–“সারাজীবনের জন্যে আমার হওয়ার জন্য,তৈরি হো।”
রাণী বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে।রাণীর মাথায় আসছে না,তূর্যয় ঠিক কি চাচ্ছে।কিন্তু,রাণী এটা বেশ জানে;তূর্যয় রাণীর কোনো ক্ষতি করবে না।তূর্যয়ের চোখের দিকে তাকাতেই,রাণীর বুকটা আবারও ধক করে উঠলো।

চলবে।
কপি করা নিষেধ।কেমন হয়েছে গল্প জানাবেন সবাই।ভালোবাসা অবিরাম।সবার সাথে কমেন্টে কথা হবে।আগের মতো গল্প রিয়েক্ট পড়ে না দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়,লেখার আগ্রহ থাকে না।গল্প যারা পড়েন তারা অবশ্যই পোস্টে রিয়েক্ট করবেন।আপনার একটা রিয়েক্ট আমার গল্প লিখতে উৎসাহ দিবে।যাদের নিউজফিড এ গল্প যায় না,তাদের বেশির ভাগ সাইলেন্ট রিডার।আপনারা গল্পে কিছুদিন লাইক কমেন্ট করুন,দেখবেন আগের মতো নিউজফিডে গল্প পাচ্ছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here