“চরিত্রহীনের পুত্র, এবং পরিজনেরা”পর্ব১
(স্বাগতা)
(প্রথম অংশ)
মোড়ের দোকান থেকে এক ডজন ডিম আর একটা পাউরুটি কিনে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই সীমার হাত থেকে পটল আর আলু ধরা পলিথিনটা পড়ে গেলো। বাবা গেছেন গ্রামের বাড়িতে কিছু জমিজমা সংক্রান্ত কাজে। দু’দিন পর ফিরবেন। মায়ের জ্বর থাকায় আজকে শুক্রবার, ছুটির দিনে নিজেই নিচে নেমে এসেছে সামান্য কিছু বাজার করতে। বেলা হয়ে গেছে এমনিতেই, বাসায় ফিরে আবার রান্নাটা করতে হবে। ছোট ভাইটাকে তো কিছু বলাই যায় না কোনও কাজের জন্য। সামনে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, রাতদিন বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে।
মুখ দিয়ে বিরক্তির একটা আওয়াজ বের হয়ে এলো ওর। রাস্তায় ৩ টা আলু গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রসাধনহীন স্নিগ্ধ মুখটা অযাচিত ঝামেলায় কুঁচকে গেছে। নিচু হতে যাবে এই সময় হাতখোঁপা করে রাখা লম্বা সিল্কি চুলগুলোও খুলে ছড়িয়ে পড়লো পিঠে। বাইরের লোকের সামনে হাত উঁচু করে খোঁপা করতে গেলো না ও আর। কানের পেছনে চুলগুলো কোনরকমে ঠেলে দিয়ে, ওড়না সামলে উবু হয়ে বসতেই পাশ থেকে কেউ একজন এগিয়ে এলো। হাতে হাতে তুলে দিলো আলু ৩ টা। ধন্যবাদ দেবার জন্য মুখ তুলতেই চমকে গেলো সীমা। ওর সামনে সোহেল।
চারিদিকে না তাকিয়েও সীমা বুঝতে পারছে একা ও চমকায় নি, ওদের আশে পাশের সকলেই যার যার হাতের কাজ থামিয়ে লক্ষ্য করে চলেছে ওদের দু’জনকে। চরম বিব্রতবোধ করলো সীমা। আর সেই বিব্রতভাবটা ফুটে উঠলো ওর চেহারাতে পরিষ্কার। চটপট আলুগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে সোহেলের দিক থেকে আগেই। বাটিকের কাজ করা জাম রঙের কামিজটা টেনে একটু ঠিক করে নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলো নিজেদের বিল্ডিং-এর দিকে। ওর ধন্যবাদের কোনও প্রত্যুত্তর সোহেল করলো কিনা সেই অপেক্ষা না করেই।
ওর বিল্ডিং-এর গেটটা কয়েক পা এগোলেই। গ্যারেজের বড় গেটের মাঝে মানুষ যাতায়াতের জন্য ছোট একটা গেট করে দেয়া। খোলাই ছিলো, দারোয়ান, মমিনুল চাচা আশে পাশেই আছেন সম্ভবত। ছোট গেটটা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে ঢুকতেই কানে এলো দোকানদার মাসুম ভাইয়ের গলা, “দোষ করে কোন জন আর বাঁশ খায় কোন জন… দেখছেন নি মামী? বাপের এমনই সুনাম… যে পোলার দিকে তাকাইতেও এখন ভালো ঘরের মাইয়ারা ডরায়… ইজ্জতের চিন্তা তো সবারই আছে, নাকি? কি কন?”। কথাগুলো সে বলছে আফসানা রহমানের উদ্দেশ্যে। একটু আগে এই আফসানা আন্টির সাথেই দোকানে দাঁড়িয়ে সৌজন্য বিনিময় করেছে সীমা। ওদের বাসার পরের গলিতেই উনাদের বাসা। ভদ্রমহিলা গৃহবধূ। দোকানে এসেছিলেন সীমার মতোই টুকিটাকি দু’চারটা জিনিস নিতে। সাথে ১০-১১ বছর বয়সী সাহায্যকারী মেয়েটা, হাসনা। তার এক হাতে একটু আগে সবজির ভ্যান থেকে নেয়া কলমি শাকের আঁটি আর ঝিঙে দিয়ে ভর্তি একটা ছোট বাজারের ব্যাগ, আরেক হাতে আফসানার কিনে দেয়া চকবার আইসক্রিম। হাসনার পরণে একটা লাল রঙের ফ্রক, কানে দু’টো ছোট স্বর্ণের রিং, দুই হাতে রংবেরঙের বেশ কিছু প্লাস্টিকের চুড়ি, মাথায় একটা লাল রঙের ব্যান্ড, সেটার উপরে হলুদ রঙের প্লাস্টিকের প্রজাপতি বসানো, তেল দেয়া চুলগুলো গুছিয়ে আঁচড়ানো। হাঁ করে গিলছে আশেপাশের সকলের কথাবার্তা, সেই সাথে আইসক্রিম।
মাসুমের কাছে ফরমায়েশ দিতে দিতেই আফসানা রহমান খোঁজ নিয়েছেন সীমার মায়ের শরীর-স্বাস্থ্যের, সীমা আর সীমার ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার। সীমার সদাই গুছিয়ে দেয়ার পরে উনার জিনিসপত্র মাসুম তখনও গোছাচ্ছে বলে উনি তখনও দোকানে দাঁড়ানো। পরণে সাদা সূতার কাজ করা হালকা গোলাপী রঙের ঘরে পড়ার সালোয়ার-কামিজ, ওড়নাটা আলতো করে মাথায় দেয়া। নাকের ফুলটা, হাতের চুড়ি দু’টো আর গলার স্বর্ণের চেনটা ঝিকমিক করছে অল্প অল্প উনার নড়াচড়ার সাথে সাথে। কপালের উপর এসে পড়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো কিছু কোঁকড়ানো চুল। কানের দুলটা আড়াল হয়ে আছে ঘোমটার জন্য। শান্ত মুখটা কিঞ্চিৎ লাল হয়ে আছে বেলা ১২টার রোদের আঁচে।
মাসুমের কথা কানে এলেও সীমা ঘুরে দেখলো না। সেই সাহস করলো না বলা যায়। গেটের ভেতর থেকেই প্রায় লুকিয়ে গেটটা আটকে দিলো। লোহার শব্দ ভেসে এলো। নিতান্তই সাধারণ ৩০ সেকেন্ডের এই ঘটনাটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখলো গলিতে উপস্থিত প্রায় ১০-১২ জন, কেউ কেউ দেখলো উঁচু উঁচু বাড়িগুলির জানালা বা বারান্দা থেকে, কোলে বাচ্চা নিয়ে কান্না থামাতে থামাতে, অথবা কাপড় মেলতে মেলতে। মাসুমের দোকানের পরে জয়নাল মিয়ার হার্ডওয়্যারের দোকান, তার পাশে একটা ছোট্ট সাইবার ক্যাফে, আর গলির মুখে গিয়ে একটা ছোট চায়ের দোকান হাউজিং-এর মূল রাস্তার কোণ ঘেঁষে। মাসুমের দোকানের উল্টোদিকে সাইফুলদের বাসার গেটের সামনে আজকে একটা সবজির ভ্যান দাঁড়ানো, একটু আগে সেখান থেকেই সীমা আর আফসানা দু’জনেই সবজি কিনেছেন। ভর দুপুরে লোকজন কম থাকলেও একেবারে নেই তা না। সাইবার ক্যাফের সামনে উঠতি বয়সী ৩টা ছেলে দাঁড়ানো, কিছু না বললেও মিটমিট করে হাসছে সোহেলের দিকে তাকিয়ে। আর চায়ের দোকানের সামনেও কয়েকজন, তাদের মধ্যে কে যেন শিস দিয়ে উঠলো সীমাকে ওভাবে পালিয়ে যেতে দেখে। এছাড়া অধিকাংশ পুরুষই এখন ঘরে, গোসল করে জুম্মা পড়তে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সোহেল একবার অসহায়ভাবে মাসুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর চোখ ঘুরিয়ে আনলো যে কয়জন আশেপাশে উপস্থিত সকলের উপর দিয়ে। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো ২৮ বছর বয়সী যুবকের। মাথাটা নিচু হয়ে গেলো। পরণের ট্রাউজার আর সুতির গেঞ্জিটা অযথাই একটু টানাটানি করলো। নিজের মনে ভাবলো হয়তো একবার যে মাসুমের কথাটার উত্তর দেবে কি না। ধীর পায়ে তারপর হেঁটে চললো যেদিকে যাচ্ছিলো সেদিকে। বাসা থেকে বের হয়েছিলো কিছু একটা কেনার জন্যই। কিন্তু সেকথা এখন আর খেয়াল নেই ওর।
মোহাম্মদপুরের এই পাড়াটায় এই সোহেল, মাসুম, সীমা, এরা সবাই ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছে। সবাই সবাইকে চেনে ওরা আজ প্রায় এক যুগেরও বেশি সময়। এদের কেউ কেউ এই এলাকারই বাড়িওয়ালা, আফসানার শ্বশুরের মতো, কেউ কেউ দীর্ঘদিনের ভাড়াটিয়া, সীমাদের মতো। একেকজনের এস এস সি বা এইচ এস সি-এর রেজাল্ট যেমন সকলের জানা, কার মা কেমন হালুয়া বানান সেটাও জানা, এখন বড় হয়ে কে কোন চাকরিতে ঢুকেছে তাও জানা। আলাপ পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা কম-বেশি থাকতে পারে এক পরিবারের সাথে আরেক পরিবারের, কিন্তু মুখ চেনা প্রায় সবারই। গলিতে একসাথে ক্রিকেট খেলে বড় হয়েছে ওরা, এখন ওদের ছোট ভাইয়েরা খেলে। সীমাদের মতো মেয়েরা ঈদের আগের রাতে সমবয়সী অনেকে একসাথে মেহেদী দেয় কারও না কারও বাসায় বসে। পাড়ার অবিবাহিত মেয়েদের সাথে যোগ দেয় নতুন বিয়ে হয়ে আসা ভাবীরাও। মুরুব্বীরা সকলে একই মসজিদে নামাজে যান। ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজ আলাদা হলেও রেজাল্টের মিষ্টি টুকটাক সকলের ঘরেই যায়। এই পাড়াতেই শৈশব-কৈশোর পেরুনো মাসুমদের মতো ছেলেছোকরাদের ঘরেও এখন সন্তান চলে এসেছে, তাদের জন্মের বা আকিকার শুভেচ্ছাও পৌঁছায় সবার দোরগোড়াতেই। আফসানা এই পাড়ায় রহমান সাহেবের ছোট ছেলের বউ হয়ে এসেছেন তাও আজ প্রায় দেড় যুগের বেশি সময়। তিনিও এই মাসুম, সোহেল ওদের কৈশোর থেকে দেখছেন। এখন তাঁর নিজেরই দুই ছেলে। বড়টা এস এস সি দেবে, আর ছোটটা ক্লাস সেভেনে।
ছোট একটা শ্বাস ফেললেন শব্দ করে আফসানা। সোহেলকে তিনি দেখছেন আজ এতো বছর ধরে। ছেলেটা খারাপ না তিনি বোঝেন। মাসুমও জানে, সেটাও তিনি জানেন। কিন্তু অন্যায় না করেও ছেলেটা শাস্তি পাচ্ছে। খারাপ লাগলো উনার। উনার স্বভাবসিদ্ধ মৃদুস্বরে বললেন মাসুমকে, “মাসুম, তুমি তো চেনো ওরে… কি দরকার ছিলো তোমার ওরে এমনে বলার? দোষ তো আর ও করে নাই, তাই না! সোহেল ছেলেটা তো খারাপ না!”
মাসুমের এই ছোট্ট মুদি দোকানের পাশেই জয়নাল মিয়ার ছোট্ট একটা হার্ডওয়্যারের দোকান। জয়নাল মিয়া এখন আর বসেন না। বসে তাঁর ছেলে, আহসান মিয়া। ষাটোর্ধ্ব জয়নাল মিয়ার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, তাঁকে আর তাঁর স্ত্রীকে তাঁর ছেলে গত বছরই হজ্ব করিয়ে এনেছেন, আর তারপর থেকে জয়নাল মিয়ার সময় বেশি কাটে ধর্মকর্মেই। ছেলের হাতে সংসার আর ব্যবসার ভার তুলে দিয়ে ভালোই আছেন তিনি। কখনও কখনও দোকানে আসেন, যেমন আজ। জুম্মা পড়তে যাবেন বাপ-ছেলে মিলে, তার আগেই কিছু কেনাবেচা আর দোকানের হিসেব-নিকেশ সেরে নিতে দোকানে আসা। বাবা-ছেলে দু’জনেই খেয়াল করেছেন সীমার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে যাওয়া, সোহেলের সাহায্য করতে এগিয়ে আসা, আর তারপরে মাসুমের বক্তব্য। আফসানার কথাটা কানে যেতে এবার কথা বলে উঠলেন তিনি, “আল্লাহ মালিক!… মা জননী… কথাটা তো আপনে ভুল বলেন নাই গো মা!… কিন্তু কথা হইলো গিয়া… গোড়ায় গলদ থাকলে কোনও না কোনও দিন সেইডা সামনে আইবোই… সোহেলের বাপ যেই রকম… যা যা করসে… অয় তো ওইগুলান দেইখাই বড় হইসে, তাই না? এহন নাইলে আপনে ভালো কইতাসেন অরে… দেহেন কয় দিন এই ভালো ডা থাকে! এই সমস্ত স্বভাব রক্তে থাইকা যায়, বুজছেন নি? যেমন গাছ, তার ফলও তেমনই তো হইবো!… আল্লাহু!… আল্লাহু!… যাক! সব ভালো হইলেই ভালো!…”
আফসানা আর কথা বাড়ালেন না। বলতে ইচ্ছে করছিলো তাঁর অনেক কিছুই, এই যে মাসুম এখন দোকান দিয়ে বসেছে, বিয়েশাদী করে ছেলের বাপ হয়েছে, কিন্তু সেই ছেলেই বছর ১০ আগেই এই পাড়ারই মোড়ে বসে পাড়ার উঠতি বয়সী মেয়ে-বৌদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো টোন-টিজিং করে করে। দীর্ঘ দিনের পরিচিতরা রেহাই পেলেও সাময়িক ভাড়াটিয়া হয়ে যেসব পরিবার এসেছিলো এই সমস্ত বাড়িগুলোতে, সেই সমস্ত পরিবারে অল্পবয়সী মেয়ে থাকলেই ভুগেছে মাসুম আর ওর বন্ধুবান্ধবের জন্য। মাস্তান বা পলিটিক্যাল গুন্ডা ছিলো না হয়তো ওরা, কিন্তু বখাটেপনা করতে কম করে নি। রাস্তায় টিজ করা, ফোন নাম্বার জোগাড় করে বিরক্ত করা, সবই চলেছে। পড়ালেখার পাট ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্তই। দুইবার ফেল করে বেশ কয়েক বছর বাপের টাকায় স্রেফ চুলের আর পোশাকের স্টাইল করে, আর মেয়েদের পিছে ঘুরে ঘুরেই কাটিয়েছে। ৩০ পার হতে অবশেষে বাবা এই দোকান করে দিলে সংসার আর দোকান নিয়ে থিতু হয়েছে সে। তার মুখেও আজ সোহেলের জন্য খোঁটা!
জয়নাল চাচা বা আহসান মিয়াকে নিয়ে কিছু বলার নেই আফসানার, এরা ভালোয়-মন্দয় মেলানো মানুষ, পাড়ায় হার্ডওয়্যারের দোকান আর অন্যদিকে লোহা-রড-সিমেন্টের আড়তের কারবার, ব্যবসা নিয়ে টুকিটাকি যে এদিক সেদিক করেন না তা নয়, তবে মেয়ে মানুষ সংক্রান্ত চরিত্রের দোষ সম্ভবত নেই। আফসানার শ্বশুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। আফসানার স্বামীও সরকারি চাকরিতে আছেন। জয়নাল মিয়া আফসানার শ্বশুরের স্ট্যাটাসের মানুষ না হলেও মুরুব্বী মানুষ, এতো বছর এক পাড়াতে বসবাস, কি লাভ কথা চালাচালি করে? আর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তাই জয়নাল চাচাকে সালাম দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন আফসানা। হাতে ধরা মাসুমের কাছ থেকে নেয়া ৩টা ম্যাগি নুডলস, একটা টমেটো কেচাপ এর বোতল আর আধা কেজি চিনির প্যাকেট ভরা পলিথিন ব্যাগ। পেছনে পেছনে চললো হাসনা। তার আইসক্রিম তখনও শেষ হয় নি।
***
সোহেলের বাবা সাজ্জাদুল ইসলাম। প্রাইভেট একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ভালো একটি পদে আছেন আজ বহুদিন। সোহেলরা দুই ভাই-বোন। বড় বোন, সিমিনের বিয়ে হয়ে গেছে, সোহেল ওর ৪ বছরের ছোট। ওদের মা, শায়লা আক্তার গৃহিনী।
সাজ্জাদ সাহেব যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, সেখান থেকেই বিবিএ-এমবিএ করে বেরিয়েছে সোহেল। মনে মনে কিছুটা আশা ছিলো যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়তো চাকরির একটা সুযোগ হয়ে যাবে, কিন্তু মাস্টার্স পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সোহেল বুঝে গিয়েছিলো যে সেটা ওর ভাগ্যে নাই। আশে পাশের সবাই যখন বলতো ‘তোর তো জব নিশ্চিত!’, তখন খুব সাবধানে ও দীর্ঘশ্বাস গোপন করতো।
পাশ করে বেরোনোর প্রায় ৩-৪ বছর পর একটা ভালো চাকরিতে ঢুকতে পেরেছে অবশেষে সোহেল। ওর বাবার রেফারেন্সে অনেকেই চাকরিতে ঢোকার জন্য বহুবার বলেছে ওকে। ও রাজী হয় নি। ওর মা তো ঘরে রীতিমতো ঝামেলা করেছেন, চেঁচামেচি, ভাংচুর, ইত্যাদি, যা তিনি বরাবর করেন। ঘাড় গোঁজ করে থেকেছে সোহেল, চুপচাপ শুনে গেছে বাবার খোঁটা, বিদ্রূপ, মায়ের গঞ্জনা, কিন্তু কিছুতেই বাবার পরিচয় নিয়ে, লবিং নিয়ে কোনও ইন্টারভিউ বোর্ডে গিয়ে বসতে রাজী হয় নি। টিউশন করিয়েছে, পার্ট টাইম বিভিন্ন কাজ করে হাত খরচ চালিয়েছে, আর অবশেষে নিজের যোগ্যতায় এবং কিছুটা ওর বড় মামার তদবিরে একটা সম্মানজনক চাকরি অর্জন করতে পেরেছে একটা এ্যাড ফার্মে।
কিন্তু এতো করেও কি শেষ রক্ষা হলো? সাজ্জাদ সাহেবের নামে এখন যা রটেছে, তাতে এতো কষ্টের পাওয়া চাকরিটা সোহেলের থাকে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ওর। বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ক্ষোভে মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো সোহেলের। শরীর খারাপ লাগছে। গলার কাছে কষ্ট ঠেলে উঠছে ওর। প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে। জানে যে এই সমস্ত সস্তা অভিমান-আবেগের কোনও মূল্য বাস্তবতার সামনে নেই। তবুও অভিমান হচ্ছে। কি অপরাধ ওর? কি অন্যায় করেছিলো যে এমন একটা জীবনের দায় বয়ে নিয়ে চলেছে? কি অপরাধ ছিলো বড় আপুর? সেদিনের পর থেকে রোজ নিয়ম করে ফোন দিয়ে কাঁদে ওর বোনটা। নেহায়েত ওর দুলাভাইটা রাগী হলেও ভালো মনের মানুষ, তাই এখনও বোনের সংসারটা টিকে আছে। প্রাচীনপন্থী বা ছোট মনমানসিকতার মানুষ হলে এতোদিনে সিমিনকে বাপের বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিতো হয়তো। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ যন্ত্রণায় ভুগছে, প্রত্যেকটা মানুষ ধুঁকছে রীতিমতো। স্রেফ এবং স্রেফ একটা লোকের জন্য।
না। চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো সোহেলের। একটা লোকের জন্য না। দুই জন মানুষের জন্য। ও, ওর বোন, ওর বোনের স্বামী, ছোট্ট ৫ বছর বয়সী ওর ভাগ্নী, ওরা সবাই ভোগ করছে দুইজন মানুষের কর্মফল। দুই জনই সমানভাবে দায়ী। ওর মা, বাবা, দুইজনই দায়ী আজকের দিনটার জন্য।
নিষ্ফল আক্রোশে শূণ্যে ছুঁড়ে দিলো মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাতটা সোহেল। সরু গলিতে পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া রিকশার হুড ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলো হাতটা। পেছন ফিরে হই হই করে উঠলো খালি গায়ের রিকশাওয়ালা, “ওই মামা! করেন কি! চোক্ষে দ্যাহেন না নাকি? আরেকটু হইলেই তো দিসিলেন লাগাইয়া!… তারপরে মাইরডা লাগাইতেন আমারে…”। বিরক্ত রিকশাওয়ালা গজ গজ করতে করতে খালি রিকশা টান দিয়ে বের হয়ে যায় দুপুরের খা খা করা রোদের মধ্য দিয়ে। তার অর্ধেক কথা কানে ঢোকে সোহেলের, অর্ধেক ঢোকে না। হাতটা ছিলে গেছে মনে হয়। হাতের তীক্ষ্ম ব্যথাটাও ওর মনোকষ্টের ঘের থেকে বের করে আনতে পারে না ওকে। ওদের বাসার গেটের সামনে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ায় ও, ঢুকতে গিয়েও ঢোকে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে আবার অন্যদিকে। এই বাসাটাও সম্ভবত ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে এবার। বহুদিন যাবৎ ভাড়া বাসায় থাকার পরে এই এলাকাতেই কিছুদিন ধরে ফ্ল্যাট কেনার জন্য খুঁজছিলো ওরা, সবই বেকার। এতোদিন সাজ্জাদ সাহেবের নামে টুকটাক গুজব, ফিসফাস থাকলেও এখানে থাকাকালীন কোনও বেচাল তিনি করেন নি, তাই এই এলাকার লোকজনও তাঁর ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামায় নি। কিন্তু এবার এই এলাকাতেও আর থাকা হবে না ওদের।
***
৫৪ বছর বয়সী সাজ্জাদ সাহেবের নামে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন ছাত্রী। এই অভিযোগ ইতিপূর্বেও তাঁর নামে এসেছে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয়ে বার বার ধামাচাপা পড়ে গেছে সেই সমস্ত অভিযোগ। কিন্তু এবার কয়েকজন ছাত্রী কায়দা করে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেছে মেয়ের বয়সী মেয়েদের সাথে তাঁর অশ্লীল সমস্ত কথাবার্তা। ইচ্ছে করেই তাঁর রুমে গিয়ে তাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে তাঁর সাথে কথোপকথন রেকর্ড করেছে। তারপর সেই ভিডিও আর মেয়েদেরকে পাঠানো চ্যাট এর স্ক্রিনশট, সব কিছু মিলিয়ে ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে। দুনিয়ারশুদ্ধু মানুষ এখন সেগুলো দেখছে আর মহানন্দে শেয়ার আর কমেন্ট করে ভাসিয়ে দিচ্ছে। স্ট্যাটাসের, ধিক্কার আর রসালো কৌতুকের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এক দিকে যৌন শোষণের অভিযোগ, আর অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া। চূড়ান্ত চাপে পড়েছেন সাজ্জাদ সাহেব। আর তাঁর পরিবার-পরিজনদের দুরবস্থা নিয়ে তো কিছু বলাই বাহুল্য। তিনি যতোই বলুন যে এগুলো সব এডিট করা, সব মিথ্যা, তাঁর আশেপাশের, ঘরের মানুষগুলো তো জানেই যে তিনি কেমন!
সাজ্জাদ কোনও রেপিস্ট নন। কিন্তু নারী তাঁর দুর্বলতা। মেয়ে দেখলেই তিনি একটু ফ্লার্ট না করে, কিছুটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা না বলে, একটুখানি নিজের চার্ম প্রকাশ না করে থাকতে পারেন না। যে মেয়ের ব্যাপারে তাঁর সেই অর্থে আগ্রহ নেই, তার সাথেও তিনি এমন সুরে এমন ভাবেই কথা বলেন যে সেও নিজেকে সাজ্জাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে শুরু করে, অবশ্যই ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ না সে সাজ্জাদের চরিত্র আর স্বভাব সম্পর্কে জানে। পিওর উওম্যানাইজার বলতে যা বোঝায়, সাজ্জাদ তাই। চলতি ভাষায় যেটাকে মেয়ে পটানো বলে, সেই শিল্পে তিনি ভালোই দক্ষ। যারা পটার তারা পটে, বাকিরা পারতপক্ষে তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে চায় না। অল্প বয়সে তাঁর এই স্বভাবের দৌরাত্ম্য কি প্রবল ছিলো সেকথা বলাই বাহুল্য, বয়সের সাথে সাথে কিছুটা কমেছে হয়তো, কিন্তু রোগ পুরোপুরি সারে নি। যে কোনও বয়সের একটু সপ্রতিভ, উচ্ছ্বল ধরণের মেয়েদের আশেপাশে গেলে এখনও নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। আবার লাজুক মেয়েদেরও তাঁর ভীষণ ভালো লাগে। আগের মতো বিভিন্ন জনকে অতো সময় হয়তো দিতে পারেন না, যৌবনকালের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঙ্গ উপভোগ করার কায়দা ছেড়ে এখন তিনি প্রৌঢ় বয়সের একাকীত্বের অজুহাতে প্রশ্রয় চান, কিভাবে তাঁর স্ত্রীর সাথে কোনদিন তাঁর মনের যোগাযোগ হয়ই নি সেই হতাশা ব্যক্ত করেন, ছেলে-মেয়ে কেউ যে তাঁকে বোঝে না, জীবনের প্রতি সেই অনুযোগ জানিয়ে ভেজা চোখে অভিমান করেন, বন্ধুত্বের আহবানকে কাজে লাগিয়ে নিজের খেলা চালিয়ে যান। যে যদ্দুর পর্যন্ত যেতে রাজী তার সাথে ততোদূরই যান। জীবনকে ভোগ বা উপভোগ, কোনটাই কম করেন নি তিনি, সুতরাং জোরাজুরির মধ্যে তিনি যান না। তবে কাউকে বিশেষ ভালো লেগে গেলে তার প্রতি মনোযোগ আর পরিশ্রমটা এখনও বেশিই দেন, নিজের মনের-দেহের সন্তুষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত দেন না। সেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, অথবা অন্য যেকোনও রকমের ব্ল্যাকমেইল করতেও তাঁর বাধে না। কোনও মেয়ের কোনও দুর্বল মুহূর্তের করা কোনও মেসেজ, অথবা আরেকটু এ্যাডভান্স হলে মেয়েটার পাঠানো কোনও ছবি, অথবা তাদের দু’জনের একত্রে কাটানো সময়ে তোলা সেলফি, সময় বুঝে খুব সুচারুভাবেই তিনি ব্যবহার করেন যা তিনি চান তা আদায় করে নিতে। ছবি বা মেসেজ যে খুব ঘনিষ্ঠ হতে হয় তা তো আর না! রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসা সাধারণ ছবিও ভুলভাবে উপস্থাপন করলে কোনও মেয়ের বয়ফ্রেন্ড, স্বামী বা হবু স্বামীর ভুল বুঝতে খুব একটা সময় লাগে না। আর স্বামী বা প্রেমিক ভুল বুঝুক আর না বুঝুক, মেয়েগুলো সেই সুযোগটা নিতেই ভয় পায়, আগেই তটস্থ হয়ে যায় পরিণামের ভয়ে। আর সেই ভয়টাকেই কাজে লাগান সাজ্জাদ। বহু চর্চায় তিনি এসমস্ত বিষয়ে সিদ্ধহস্ত হয়েছেন, এক দিনে হয় নি, বহু বছরের অর্জন তাঁর এই দক্ষতা।
দীর্ঘদিন ধরেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা সাজ্জাদ সাহেবের কারণে ভুক্তভোগী হয়ে আসছে। বহুবার তারা একা অথবা কয়েকজন মিলে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও দিয়েছে, কিন্তু কাজ হয় নি কোনও। ১০ বছর আগেও মেয়েরা হয়তো এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে খুব একটা স্বচ্ছন্দবোধ করতো না, কিন্তু যুগ পাল্টাচ্ছে, এখনকার মেয়েরা অনেক স্মার্ট, স্বতস্ফূর্ত, আর সচেতন। ঠিক এই জায়গাটাতেই ধরা খেয়ে গেছেন সাজ্জাদ। ওইটুকু বয়সী মেয়েগুলো যে একজোট বেঁধে এইরকম একটা পরিকল্পনা করবে তাঁর বিরুদ্ধে, সেটা চিন্তাতেও আসে নি তাঁর। ৩-৪ জন কয়েক দফায় এসে তাঁর আচার আচরণের ভিডিও ধারণ করেছে। আর সেই সাথে চালিয়ে গেছে ফোনালাপ আর চ্যাটিং। বয়সের কারণে এখন তো তিনি আবার মেয়েদের সাথে আলাপ শুরু করেন ‘তোমরা তো আমার মেয়ের মতো’, এই স্টেটমেন্ট দিয়ে। তারপরেই শুরু হতো তাঁর বিবাহিত জীবনের প্রচুর হতাশা আর একাকীত্বের দুঃখগাঁথা। সেই সাথে বয়স যতোই হোক, মনের দিক থেকে তিনি কতোটা তরুণ এখনও তা প্রমাণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। এই যুগের তরুণ-তরুণীদের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনি নিজেকে আপডেটেড রেখেছেন ইমো, টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব সব কিছু দিয়ে। লাইভ, শর্টস, রিলস, যা কিছু আছে সব অলিগলি তাঁর জানা, নিজে যে ভিডিও তৈরি করে ছাড়েন সেরকম না বিষয়টা, কিন্তু ট্রেন্ডের ব্যাপারে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। এতোটাই দক্ষ তিনি যে তাঁর ছেলে হয়ে সোহেল নিজেও হয়তো এতো কিছু জানে না। কিন্তু এতো করেও ফায়দা হলো না তাঁর। যাদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে চিরতরুণ করে রাখার তাঁর এই প্রয়াস, তারা এক হাত নিয়ে নিলো তাঁর উপর দিয়ে।
অন্যদিকে এর আগে যেসব মেয়ে তাঁর দ্বারা এভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছে, এবার তাদের অনেকেও এগিয়ে এসেছে সাহস করে। সুতরাং, প্রায় প্রতিদিনই নতুন করে উনার কিছু ইতিহাস বেরোচ্ছে। ফেসবুকে ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপে দিচ্ছে কেউ, তো কেউ সরাসরি নিজের ওয়ালে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিচ্ছে এক হাত, যে অভিযোগ তারাও জানিয়েছিলো, কর্তৃপক্ষ কিছু করে নি। আর উপর মহলের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলা সাজ্জাদের ক্ষমতার দাপটের ভয়ে বেশির ভাগ মেয়েই নিজের অভিজ্ঞতা নিজের মধ্যেই রেখে চুপ হয়ে গেছে। আর সেই সাথে চিরন্তন সমাজ কি বলবে, সেই স্টিগমা তো আছেই। চরিত্রের দিকে আঙুলটা আগে মেয়েদের উপরেই ওঠে কি না! উনার উপর রাগ ধরে রাখা অনেকে তাদের চ্যাট হিস্ট্রি বা ফোনের মেসেজ সংরক্ষণ করেও রেখেছিলো। সেগুলোও সামনে আসছে এখন। অনেক মেয়েরই অনুনয় আছে সেখানে, এভাবে যেন মেসেজে উনি বিরক্ত না করেন, নিজেকে যেন শ্রদ্ধার জায়গাটা থেমে নামিয়ে না নিয়ে আসেন, নিজের বয়সের আর অবস্থানের মর্যাদা যেন রাখেন। কারও বয়ফ্রেন্ড আছে, বা কেউ বিবাহিত, এধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ দেখলে তাদের সম্পর্কের উপর সেটার প্রভাব পড়বে। আর তার বিপরীতে আছে সাজ্জাদের নরম সুরে, অত্যন্ত নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত নিবেদনের ডালি, গান, কবিতা, কিছু অভিমানী কথাবার্তা, বিনয়ীভাবে ভীতিপ্রদর্শন, আর সবকিছুর আড়ালে কুৎসিত ইঙ্গিত।
সাইবার ক্রাইমের আওতায় আনা হয়েছে বিষয়টা। তদন্ত চলছে। এই দফায় তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এবার আর বিষয়টা উপেক্ষা করে কেটে পড়তে পারে নি তারা। যারা ভিডিও করে ছেড়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে, তারা যে নিজেদের ভবিষ্যতের রিস্ক মাথায় রেখেই কাজটা করেছে সেটা সুস্পষ্ট। খুব একটা লুকোছাপার মধ্যে যায় নি তারা। বরং আরও দলবল নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে। তাদের উপর আনা অভিযোগ কতোক্ষণ টিকবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্ট। একজন সাজ্জাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় লক্ষ লক্ষ টাকা ঢেলে পড়তে আসা তার এক গুচ্ছ ছাত্রছাত্রীদের হারাবে না কোনও অবস্থাতেই, সে তিনি যতোই দক্ষ বা কর্তৃপক্ষের পা-চাটা কর্মী হোন। সাধারণ হিসাব সেটাই বলে। এতোদিন তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না বা করতে চায় না বলে মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে উর্ধ্বতনেরা। কিন্তু এইবার আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হলে সাজ্জাদ সাহেবকে নিজের খরচে আর নিজের দমেই চালিয়ে যেতে হবে, এটা ইঙ্গিতে তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সাইবার ক্রাইম ইউনিট সামান্য তদন্ত করলেই তো এটা বের হতে সময় লাগবে না যে, যে সমস্ত মেসেজ চালাচালি হয়েছে, মোবাইল, ল্যাপটপ বা অন্য যে কোনও ডিভাইস থেকে, তার আইপি এ্যাড্ড্রেস, লোকেশন, সব সাজ্জাদ সাহেবের দিকেই নির্দেশ করছে। তারপরেও কারও ব্যক্তিগত আলাপ বা ভিডিও তার অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করাটা অবশ্যই আইনত অপরাধ, কিন্তু সেই অপরাধের সাজা দিতে হলে সাজ্জাদ সাহেবকেও সেক্সুয়্যাল হ্যারাসমেন্টের সাজা মাথা পেতে নিতে হবে। যারা ভিডিও ছেড়েছে, তারা রীতিমতো ডেসপারেট, সাজা ভোগ করার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব তো তা না!
***
সাজ্জাদের ভোগান্তি এই জায়গাতেই এসে শেষ হয় নি। ভোগান্তির দ্বিতীয় ধাক্কাটা বড় করুণ হয়েছে বলা যায় তাঁর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়েরই অপর একজন মহিলা কর্মকর্তার সাথে তাঁর সম্পর্ক চলে আসছে আজ প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরে। ভদ্রমহিলা নিঃসন্তান এবং বর্তমানে বিধবা, তবে মূলত ওই ভদ্রমহিলার স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থাতেই এরা দু’জন পরকীয়াতে লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে মহিলার স্বামী হুট করে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলে বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে একরকম ওপেন-সিক্রেট হয়ে যায়। তবে, সাজ্জাদ সাহেব সুকৌশলে ব্যাপারটা পরিবারের সামনে ধামাচাপা দিয়ে এসেছিলেন এতোদিন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে সোহেল জানতে পেরেছিলো বিষয়টা, তবে সেটা সাজ্জাদ জানতেন না। জানলেও পাত্তা দেন নি, যেমন তিনি কোনদিনই দেন না। এদিকে স্বামী মারা যাওয়ার পরে মহিলা বেশ অনেক দিন ধরেই সাজ্জাদ সাহেবকে চাপ দিয়ে আসছেন বিয়ের জন্য, কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব এদিক সেদিক করে এড়িয়ে এসেছেন সেটা। মহিলার ব্যাপারে যতোই অনুরক্ত হন তিনি, তার জন্য স্ত্রী-পুত্রসহ সুখী পরিবারের ইমেজ নষ্ট করবেন না তিনি। আর ইমেজের কথা বাদ দিলেও, তাঁর জীবন চলছে মহানন্দে, স্ত্রী আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, বাইরে দু’চারটা ক্ষণস্থায়ী প্রেম আছে, চ্যাটিং করার বা ফোনে সময় দেয়ার পার্টনারেরা আছে, সব মিলিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার মতো তো কিছু ঘটে নি! কি কারণে শায়লাকে ত্যাগ করবেন তিনি? সব চাইতে বড় কথা, এতো ‘বুঝদার’ স্ত্রী তিনি চাইলেই কি পাবেন? একটু হইচই করলেও তাঁর সমস্ত কুকর্ম এমন চমৎকারভাবে আড়াল করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ স্ত্রী কি ঘরে ঘরে পাওয়া যায়? মহিলার সাথে যতোই জমাটি প্রেম থাকুক, বিয়ে করার কথা তিনি কখনোই আসলে ভাবেন নি।
কিন্তু, এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সেই ভদ্রমহিলা সোজা এসে উপস্থিত হয়েছেন সাজ্জাদ সাহেবের বাসায়। সাজ্জাদ সাহেবের সাথে উনার প্রেমের যাবতীয় প্রমাণ তাঁর কাছে ছিলো। সব সহ বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়েছেন তিনি। নিজের দোষ অস্বীকার করেন নি তিনি, যে বিবাহিত জেনেও সাজ্জাদ সাহেবের সাথে তিনি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। কিন্তু সাজ্জাদ সাহেবকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। সাংসারিক জীবনের অপ্রাপ্তি আর অশান্তির কথাগুলো সত্যি বলে ধরে নিয়েই তাঁদের দু’জনের জন্য একত্রে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামীর সাথে মনের বাঁধন কোনকালেই হয় নি তাঁর। আর সাজ্জাদ সম্পর্কে যা কিছু শুনেছেন নানা মানুষের কাছ থেকে, শুরুতে তা তিনি বিশ্বাস করেন নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে জয়েন করার শুরুতেই সাজ্জাদের সাথে পরিচয়। সে মানুষ কেমন, সেটা যাচাই করে ওঠার আগেই ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তীতেও সাজ্জাদ এমন ভাবেই তাঁর সাথে চলেছেন যে তিনি ভেবেই নিয়েছেন আগে যাই হোক, এখন সাজ্জাদ সম্পূর্নভাবে তাঁরই। তাঁর সেই বিশ্বাসের উপর পুরো ছাই ঢেলে দিয়েছে ওই ভিডিও। ওই ভিডিও দেখে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাঁর সাথে সম্পর্ক থাকতে একই সাথে সাজ্জাদ সাহেব কতো মেয়ের সাথে প্রেমালাপ থেকে শুরু করে আরও কি কি করেছেন, সেসব চিন্তা করেই ক্ষেপে গেছেন তিনি। সোজা এসে দাঁড়িয়েছেন ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায়। এটা বলতে, যে কবে বউকে ডিভোর্স দিয়ে উনাকে বিয়ে করবেন সাজ্জাদ সাহেব? উনি এতোগুলো বছর যে ইনভেস্ট করলেন এই লোকের পেছনে, তার কি কোনও দাম নেই? আর যদি শায়লাকে সাজ্জাদ ডিভোর্স নাও দেয়, তাহলেও উনি তাঁকে সুখে সংসার করতে দেবেন না কিছুতেই। সাজ্জাদ তাঁকে এমনিতেও ঠকিয়েছে, ওমনিতেও তিনি ঠকেছেন। তিনি নিজে সুখে থাকতে না পারলে সাজ্জাদকেও সুখে থাকতে তিনি দেবেন না।
ইচ্ছে করেই এই শুক্রবারের মতোই আরেক শুক্রবার বেছে নিয়েছিলেন তিনি সোহেলদের বাসায় হানা দেবার জন্য। তিনি জানতেন সাজ্জাদ বাসায় থাকবে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো ছুটির দিনে বাসায় থাকা আশেপাশের মানুষগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ। সাজ্জাদ তাঁর সাথে প্রতারণা করেছে, তার উপযুক্ত জবাব না দিয়ে তিনিই বা ছাড়বেন কেন? তাঁর চরিত্র নিয়ে যখন মানুষ কথা বলেই, তখন সাজ্জাদের চরিত্র সম্পর্কেও জানুক!
“এটা কি সাজ্জাদের বাসা?”
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে সবে বিকেল হয়ে আসছে, এমন সময় দরজা খুলেছিলেন শায়লা। সামনে দাঁড়ানো, বছর ৪২-৪৩ এর এই মহিলার প্রশ্নে ভ্রূ কুঁচকে উঠলো তাঁর। মহিলার পরণে ছাই রঙের সূতির কামিজ, সালোয়ার আর ওড়না মেরুণ রঙের। চুলগুলো শক্ত করে আটকানো পেছনে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে। চোখ-মুখ দেখে আন্দাজ করা যায় যে মহিলা নিজেকে যত্নে রাখেন। শায়লা বুঝলেন, কারণ রূপচর্চায় আর শরীরের যত্নে তিনি নিজেও যথেষ্ট সময় এবং পরিশ্রম ব্যয় করে থাকেন। মহিলার হাত-পায়ের নখও সুন্দর। তবে এই মুহূর্তে মহিলার গায়ে না আছে কোনও অলঙ্কার, না কোনও সাজ-সজ্জা। শুধু গলায় একটা চেইনের সাথে ঝুলছে একটা ছোট পেনড্যান্ট, গোল, ডিজাইন করা, একটু মলিন, সেটা সম্ভবত উনি সব সময় পরে থাকার কারণে। পায়ে ফ্ল্যাট স্যান্ডাল, কালো রঙের। কাঁধে একটা চামড়ার মাঝারি সাইজের কালো ব্যাগ, অফিসের কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত।
স্বামীকে সারা জীবনেও বিশ্বাস করতে পারেন নি শায়লা। আর এখন এই সমস্ত অভিযোগ, ভিডিও, এই সমস্ত কিছু নিয়ে সাজ্জাদের চাইতেও সম্ভবত আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন তিনি। সামনে দাঁড়ানো মহিলার কথায় এবং সরাসরি অন্য কোনও সম্বোধন ছাড়া সোজা সাজ্জাদ নাম ধরে ডাকায় তাঁর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মন আরও বেশি সন্দিহান হয়ে উঠলো, আর ভ্রূ গেলো কুঁচকে। উত্তর দেয়ার আগে সময় নিলেন তিনি, “হ্যাঁ!… এটা সাজ্জাদ সাহেবের বাসা… কে আপনি? আর আমার স্বামীর কাছে কি চাই আপনার?”
শায়লাকে ক্রুদ্ধ এবং বিস্মিত করে দিয়ে সেই মহিলা বাঁকা হাসি ঠোঁটে টেনে কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন, “ওহ!… স্বামী?” আর বলেই শায়লার পাশ কাটিয়ে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতর। প্রচন্ড বিস্ময়ে আর রাগে শায়লা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে! ভেতরে ঢুকে পড়লেন যে! আমি কি আপনাকে ভেতরে আসতে বলছি নাকি? আশ্চর্য মহিলা তো আপনি!…”
গা জ্বালানো হাসিটা ঠোঁটে ধরে রেখেই মহিলা বললেন, “ওহ সরি… মিসেস সাজ্জাদ!… আপনি আমাকে ইনভাইট করেন নি বুঝি? সোওও সরি!… কিন্তু আমার যে কথাগুলি বলতে আমি এসেছি, সেগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে বলাটা বোধহয় খুব ভালো ব্যাপার হবে না মিসেস সাজ্জাদ!… আফটার অল, আমি আসলেও সেই ‘আশ্চর্য মহিলা’ যার প্রেমে আপনার স্বামী হাবুডুবু খাচ্ছেন আজকে বেশ কিছু বছর… আর আমি ভুল না করলে, আপনি সেটা জানেনও!… রাইট? ইন ফ্যাক্ট আমি আপনাকে এটাই বলতে এসেছি যে আপনি যদি জোর করে সাজ্জাদের ঘাড় ধরে ঝুলে না থাকতেন, তাহলে এতোদিনে আমার হওয়ার কথা ছিলো ‘মিসেস সাজ্জাদ’, কেমন? সো, চিল্লাচিল্লি বাদ দিয়ে আপনার এখন-পর্যন্ত-থাকা স্বামীকে ডাকুন… আপনাদের দু’জনের সাথেই আমার কিছু বোঝাপড়া আছে…”।
প্রচন্ড রাগে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেলেন শায়লা। রীতিমতো ছুটে এসে কোমর বেঁধে ঝগড়ায় নেমে গেলেন। কিন্তু তিনি খুব সুবিধা করে উঠতে পারলেন না, কারণ এই মহিলা, যার নাম মাইশা আবিদ, তিনি ঝগড়ার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। শায়লা চিৎকার শুরু করলে মাঝ পথে তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, “আপনার স্বামীকে ডাকতে বললাম না? উনি এসেই আমাদের এই সিচুয়েশনটার সমাধান করতে পারবেন। কেমন? ডাকুন ওনাকে!”
এই পর্যায়ে ভেতরের ঘর থেকে সাজ্জাদ বের হয়ে এসে মাইশাকে চোখের সামনে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে কড়া ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেলেন। এর আগে বেশ অনেক বারই শায়লার হাতে ধরা পড়েছেন তিনি। কখনও ফোনে কথা বলতে বা চ্যাটিং করতে গিয়ে, কখনও শার্টে মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণে, কখনও সংসারে পর্যাপ্ত খরচ দিতে না পেরে বা বেতনের হিসেব দিতে না পেরে। কিন্তু বাড়িতে কোনও প্রেমিকার সশরীরে এসে উপস্থিত হওয়া এতো বছরে এই প্রথম। ঘাম ছুটে গেলো তাঁর টেনশনে। মাইশা অনেক দিন থেকেই তাঁর পিছে পড়ে আছে বিয়ে নিয়ে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সে যে বাড়িতে চলে আসবে, এটা তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো। ভেতর থেকেই টুকটাক দু’টো একটা কথা কানে আসছিলো তাঁর, এখন মাইশাকে চোখের সামনে দেখে কাঁপুনি উঠে গেলো। তাঁর অবশ্য চিন্তা শায়লাকে নিয়ে না। ওকে যা হোক একটা কিছু বুঝিয়ে দিলেই হবে, প্রতিবারের মতো। চিন্তা তাঁর মাইশাকে নিয়েই। আশাপাশের পাড়া-প্রতিবেশীর সামনে ইজ্জত রাখলে হয় এই মহিলা। এমনিতে মাইশা তাঁর প্রেমে একেবারে মজে আছে, সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ তাঁর নেই। উনার এই বিপর্যস্ত অবস্থায় মাইশাকে কিছুদিন থেকে একটু অবহেলাই করছিলেন তিনি, ওকে চোখের সামনে দেখে মনে হলো তাঁর। ভেবেছিলেন পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে মানিয়ে নেবেন, কিন্তু এ যে একেবারে বাড়ির দরজায় এসে পড়বে, সেটা তাঁর হিসাবের বাইরে ছিলো।
ততোক্ষণে মাইশা তার রোলার কোস্টার চালু করে দিয়েছে, ইচ্ছে করে ঢঙ্গী গলায় বলে চলেছে, “এই যে সাজ্জাদ! বাবুউউউ!… কি অবস্থা তোমার? হ্যাঁ? তোমাকে যে ইদানিং ফোনে, অনলাইনে কোথাও পাওয়াই যায় না! ফোন ধরো না কেন সোনা? বউ বকেছে বুঝি?…”
মাইশার ঢং দেখে আতঙ্কের মধ্যেও গা জ্বলে গেলো সাজ্জাদের। বাড়ি বয়ে এসে ভাবটা করছে যেন কিচ্ছু বোঝে না! কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই শায়লা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন মহিলার উপর, “এ্যাই!… কে তুই? হ্যাঁ? তুই কে? কোথাকার কোন বেটি তোর এতো সাহস!… তুই আমার জামাইরে বাবু ডাকিস!… সোনা ডাকিস!… উন্মাদ নাকি? বলা নাই কওয়া নাই আমার বাড়িতে ঢুকে আহ্লাদ করা শুরু করছিস?… বজ্জাত মহিলা!… ফাইজলামি করার জায়গা পাস না?…”
শায়লা মাইশাকে উন্মাদ বলছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখ আর শরীরের ভাষা দেখে সাজ্জাদের মনে হলো সে নিজেই উন্মাদ হয়ে গেছে। কোনও রকমে শায়লাকে দুই হাতে আটকে তিনি মাইশাকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “মাইশা! হোয়াট আর ইউ ডুইং? আপনি এখানে কেন এসেছেন?!… এটা আমার বাসা ফর গডস সেক!…”
মাইশা কিন্তু এতোকিছুর মধ্যেও নিজের মুখে একটা মুচকি হাসি ধরে রেখেছিলেন। এখন সাজ্জাদের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে কলকল শব্দে হাসিতে ফেটে পড়লেন, “আপনি?… সিরিয়াসলি?… ওহ মাই গড সাজ্জাদ! আদর করার সময় তো তোমার মুখ দিয়ে ডার্লিং, সুইটহার্ট… আমার জান… মাই সুইট লাভ… এসব ছাড়া কোনও শব্দ বের হয় না!… আবদার করার সময়েও তো তুমি ছাড়া কিছু শুনি না… ইন ফ্যাক্ট, আজকে কতো বছর পরে আমাকে আপনি ডাকলে বলো তো!… হাহাহাহা… ওহ সাজ্জাদ… ইউ আর সো ফানি!…”
সাজ্জাদের দুই বাহুর মধ্যে শায়লা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলেন, নড়তে চড়তেও ভুলে গেলেন মাইশার কথা শুনে। অন্যদিকে মাইশার এই রকম সোজাসাপ্টা কথাবার্তা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সাজ্জাদ নিজেও। উনার দূরের কল্পনাতেও ছিলো না কোনদিন যে এরকম কোনও পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে। মাইশা যে আজকে সর্বনাশের খেলায় মেতেছে, সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না উনার। তোতলাতে তোতলাতে কোনরকমে বললেন, “ম…ম… ম্মানে? ক… ক… ক্কি ব্বলছেন আপনি এসব মিসেস আবিদ? … আ…আ… আমি ক্কবে?… ম্মানে…”, এই পর্যন্ত এসে কথা আটকে গেলো উনার। উনার কথা এরপরে শেষ করলেন মাইশা, ওরফে মিসেস আবিদ, “ওহ… এখন তুমি আমাকে চিনতেই পারছো না ঠিক করে, তাই না সুইটহার্ট?… আমরা এখন শুধুই কলিগ… জাস্ট ফ্রেন্ডস, রাইট?… আজকে প্রায় ৭ বছর ধরে তোমার সাথে যে আমার সম্পর্ক চলছে, তা তো তোমার মনেই নেই, তাই না? … বউ তোমার আনস্মার্ট… ছেলে-মেয়ে তোমাকে বোঝে না… ওদের জন্য তুমি শুধুই টাকার মেশিন… বউয়ের সন্দেহের কারণে জীবনে রোমান্স কাকে বলে তা তুমি জানতেই পারলে না… এগুলো তো তুমি আমাকে কোনও দিইইইন… কিচ্ছু বলো নি, তাই না?… আমাকে নিয়ে একটু বাঁচতে চাও… আমার কাছে আসলে তোমার মনে হয় যে তুমি একটু শ্বাস নিতে পারছো… বাকি জীবনটা তুমি আমার সাথেই সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে বাঁচতে চাও… প্রেম কি… ভালোবাসা কাকে বলে… প্রেম কতো সুন্দর হয়… অসাধারণ হয়… স্বর্গীয় হয়… সেকথা তুমি এতো দিন এই বউয়ের সঙ্গে থেকে জানতেই পারো নাই!… এগুলো তো তোমার কথা না মোটেও, তাই না?”
কথাবার্তা যা হচ্ছে সবই যথেষ্ট উঁচু গলায়। তার উপর শায়লা বাসার মূল দরজা রেখে এসেছেন খোলা। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ইতিমধ্যেই বের হয়ে এসেছেন হাবিব সাহেব আর তাঁর স্ত্রী রত্না। শায়লাদের বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন হচ্ছেটা কি ভেতরে। উপর তলা থেকে সিঁড়িতে উকি দিচ্ছেন মিসের কাজরী রায় আর তাঁর মেয়ে অন্তরা। এঁরা সকলেই ফেসবুকের কল্যাণে সাজ্জাদের হাল আমলের বেহাল দশা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং আজকের চেঁচামেচিটা যে মেয়েমানুষ সংক্রান্ত না হয়ে যায়ই না, সে বিশ্বাস তাদের আছে। সামনের উপর এরকম ভদ্র এলাকায় কোনও অভদ্র ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা খেয়াল রাখা উচিৎ, এধরণের একটা মনোভাব দেখালেও, মনে মনে সকলেই কৌতূহলী, সবাই জানতে চায় ভেতরের ঘটনা। লোকজনকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে মাইশার গলার আওয়াজ বেড়ে গেলো। জীবনেও দেখে নি যাকে, সেই রত্নার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললো, “আরে! আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?! ভেতরে আসেন না!… আচ্ছা দেখেন তো! আপনাদের প্রতিবেশী, এই সাজ্জাদ লোকটা কি দুষ্টু!… আমাকে এতো বছর ধরে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ের কথা বলে এখন কেমন ঘোরাচ্ছে দেখেন!… ফোন ধরছে না, মেসেজ সীন করছে না… মেসেজের উত্তরটা পর্যন্ত দিচ্ছে না!… আর এখন দেখেন!… পুরো না চেনার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে কেমন!… বলেন তো কেমন কথা এগুলো! কাছের মানুষটা যদি মেসেজটারও উত্তর না দেয়, টেনশন হয় না? বলেন দেখি!…”। কাঁদো কাঁদো করে তুললেন তিনি চেহারা।
সাজ্জাদের আতঙ্ককে সত্যি করে দিয়ে হাবিব সাহেব আর তাঁর স্ত্রী ভেতরে চলে আসলেন। সিঁড়িতে আরও কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শায়লা মাইশার কান্ড দেখে বোবা হয়ে গেছেন। যে চোটপাট নিয়ে ঝগড়া শুরু করতে গিয়েছিলেন, তার কিছুই তাঁর মধ্যে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। হতভম্ব দৃষ্টিতে শুধু এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন।
সাজ্জাদ মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালালেন, “মাইশা!… প্লিজ! স্টপ ইট!… কেন এরকম করছো তুমি? প্লিজ চলে যাও!… বাইরের লোকের সামনে কোনও সিন ক্রিয়েট করো না প্লিজ!… আমি পরে তোমার সাথে কথা বলি?…”।
কিন্তু সাজ্জাদের কাকুতিতে মন গললো না মাইশার। বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন, “কি আশ্চর্য্য!… একবার তুমি! একবার আপনি!… মেক আপ ইয়োর মাইন্ড ডিয়ার!… আর বাইরের লোকের সামনে মানে? উনারা তো তোমার প্রতিবেশী, তাই না?… আর প্রতিবেশী হলো পরমাত্মীয়… আর তাছাড়া, বিয়ের পরে উনারা তো আমারও প্রতিবেশী হবেন!… তাই আলাপটা আজকেই হয়ে যাক না হয়!…”।
সাজ্জাদ কিছুই বলার খুঁজে পেলেন না। হা করে কয়েকবার খাবি খেলেন শুধু। হাবিব সাহেব এই পর্যায়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন এক রকম, “বিয়ে মানে? কিসের বিয়ে? কার বিয়ে?”
রত্না স্বামীর বাহুতে আলতো করে স্পর্শ করে তাঁকে থামার জন্য ইঙ্গিত দিলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, “এখানে হচ্ছেটা কি আগে বলবেন? শায়লা ভাবী!… এই মহিলা কে?”
নিজের নাম শুনে বোধহয় শায়লার চৈতন্য ফিরলো। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন সাজ্জাদের হাত থেকে। রাগটা ফিরে এসেছে তাঁর। ম্যাক্সির ওপরের ওড়নাটা ঠিক করলেন হাত দিয়ে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন, “এই মহিলা কে তার পরিচয়টা তাকেই দিতে বলেন!… আমার বাড়িতে এসে আমার স্বামী নিয়ে টানাটানি শুরু করসে নির্লজ্জ, বেশ্যা মহিলা!…”
ধাঁই করে মেজাজ চড়ে গেলো মাইশার। শায়লার নাকের সামনে গিয়ে আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে কড়া গলায় বললেন, “মুখ সামলে কথা বলবা শায়লা বেগম!… আমি নির্লজ্জ? আর তোমার স্বামী কি? ধোয়া তুলসীপাতা? দুনিয়ার মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে বেড়ায়… মেয়ের বয়সী মেয়ের সাথে সেক্স চ্যাট করতে বাধে না তার… প্রেম করে একশোটা!… সেই বেলায় বেশ্যা পুরুষ বলতে পারো না?… নাকি অন্য মহিলাদের সাথে হোটেল আর রিসোর্টে যাওয়ার সময় নিজের হাতে সাজায় গুজায় পাঠাও স্বামীরে? হ্যাঁ?… চরিত্রহীন লোকের সাথে সংসার করো আবার আমারে বলো নির্লজ্জ!”
চিৎকার দিয়ে উঠলেন শায়লা, “আমার স্বামী চরিত্রহীন না কি সেটা আমি বুঝবো!… তুই বলার কে?” তাঁর হাতদু’টো তখন চুলগুলো উঁচু করে বাঁধতে ব্যস্ত। যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি।
সমান তেজে জবাব দিলেন মাইশা, “তোমার স্বামী তুমি বুঝলে তো আজকে আমার এখানে আসাই লাগতো না!… তোমার চরিত্রবান স্বামী গত ৭ বছর ধরে প্রেম করে আমার সাথে!… বিয়ে করবে বিয়ে করবে বলতে বলতে এতোগুলো বছর কাটায় দিসে সে!… সেই সমস্যার হাল করতেই এখন আমারও বুঝা লাগতেসে, বুঝছো? আর তোমার স্বামীরে একলা তুমি তো শুধু বুঝো নাই!… বুঝছে আরও হাজার খানেক মেয়ে… আর এখন পুরা দেশ আর জাতি বুঝতেসে… পারো তো খালি ওই গলাবাজি করতেই!… আর তোমার সাধের স্বামী গিয়ে তোমার নামে গাদা গাদা বদনাম করতে করতে অন্য মেয়ে পটায়… ‘গাধা একটা বউ নিয়ে ঘর করি!’… ‘না আছে কোনও বুদ্ধি, না আছে কোনও গুণ!’… ‘জীবনটা আমার শেষ করে দিলো এই মহিলা!’… ‘দেখতে যেমন বিশ্রী, মনটা সেই রকম কুটিল’… এই সমস্ত বলে বেড়ায় তোমার নামে!… উনার পাঠানো মেসেজ আছে… দেখবা? তোমার স্বামীরে নিয়ে টানাটানির কিছু নাই… বুঝলা? তোমার স্বামী নিজে থেকেই সব কিছু বিলায় দিতে সব সময়েই প্রস্তুত থাকে… কোনও মেয়ে খালি আআ… তু…তু… করে ডাকলেই হইলো!”
মাইশা যে মুখরা, ঠিক এই কারণটার জন্যই সাজ্জাদ কখনও ওকে বিয়ে করার কথা মাথায় আনেন নাই। দারুণ স্মার্ট, চমৎকার ফিগার আর জীবনীশক্তিতে ভরপুর মাইশা তাঁকে ভীষণভাবে টেনেছিলো, ওর সাথে গত প্রায় ৭ বছর ধরে চুটিয়ে প্রেম করেছেন তিনি, কিন্তু এই মহিলাকে বিয়ে করলেই যে তিনি ফাঁদে পড়বেন, সেটা বুঝেই তিনি ওই পথে হাঁটেন নি। একে বিয়ে করলে বাইরের ফূর্তি সমস্ত হাতে ধরে তওবা করে বিসর্জন দিতে হবে। আর সাজ্জাদ সেটা কখনোই করতে পারবেন না। ওই ত্যাগস্বীকার, কোনও একজন মেয়েমানুষের জন্য, তাঁর পক্ষে করা সম্ভব না। কিন্তু কথায় বলে, হাতি কাদাতে পড়লে ব্যাঙও লাথি মারে। আর সাজ্জাদ তো হাতিও না, একজন খেলোয়াড় মাত্র। মাইশার মুখের ভাষা শুনে বনবন করে মাথা ঘুরছে এখন তাঁর। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার মতো খুঁজে পেলেন না তিনি।
এই সময় দরজার কাছে একটা গলা খাঁকারির আওয়াজে সকলের দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গেলো। সাজ্জাদরা থাকেন তৃতীয় তলায়। দোতলায় বাড়িওয়ালার বাসা। গোলমাল শুনে বাড়িওয়ালা আজিজুল সাহেব উঠে এসেছেন। গলা খাঁকারি দিয়েছেন তিনিই। তাঁর আশেপাশে অবশ্য এখন ছোট বড় নানান বয়সের বেশ কিছু মুখ দেখা যাচ্ছে, রত্নাকে দেখা গেলো তাঁর ক্লাস সেভেন পড়ুয়া মেয়েকে চোখ দিয়ে কড়া একটা ইশারা করতে, কিন্তু মেয়ের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, এই আকর্ষণের কাছে মায়ের চোখ রাঙানি নেহায়েতই তুচ্ছ। পশ্চাদ্দেশে দুই-চারটা বাড়ি পড়লেও এখান থেকে এখন নড়বে না সে।
গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের মনোযোগ পাওয়ার পরে আজিজুল এবার বললেন, “ম্যাডাম!… আপনি কে সেইটা তো আমরা জানি না!… কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব আর শায়লা ভাবীরে আমরা দেখতিসি আজকে এতো বছর… আপনি এখন একটা কিছু বলে দিলেই তো আর হইলো না!… কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে? আর ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে ভর দুপুরবেলা কি শুরু করলেন আপনি এসব?”
আজিজুল সাহেবের কথার উত্তর যেন মাইশার ঠোঁটের ডগায় তৈরি ছিলো, “আমি আপনাদের সাজ্জাদ সাহেবের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি!… আর এতো যে ভদ্রলোক ভদ্রলোক করছেন উনাকে… ফেসবুকে উনার কাহিনী মনে হয় কেউ কিছু দেখেন নাই আপনারা! এমন ভাব করছেন!… উনি যা করসেন, যা করেন… সেটা কি ভদ্রলোকের মতো কাজ নাকি?…”
বাঁকা গলায় উত্তর দিলেন রত্না, “তা আপনিই বা কোন ভদ্রলোকের মতো কাজ করসেন আপা?… বিবাহিত লোকের সাথে প্রেম করসেন আবার সেটা গলা তুলে বলতেও আসছেন!… একেবারে সেই লোকের বাড়ি পর্যন্তই চলে আসছেন!… আপনার চরিত্রটাই বা কেমন?”
একটুও না দমে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাইশা বললেন, “আমি তো অপরাধ করসিই!… আর সেই অপরাধের মাশুল গুণতেই আসছি… কিন্তু অন্যায় বলেন, পরকীয়া বলেন, তালি তো আর এক হাতে বাজে না, নাকি? খালি আমি একা ভুগবো কেন?… দোষ করলে আমি তো আর একা করি নাই!… এই সাজ্জাদও করসে… তাহলে একলা আমি চরিত্রহীন হবো কেন? আর ন্যায়ই বা পাবো না কেন?… সাজ্জাদের কারণে আমারে আমার বাড়িওয়ালা শাসায় যায়… অফিসে কলিগরা, বস হেনস্থা করে… পরিবারের লোকজন কথা শুনায়… তা সব বাঁশ কি আমি একাই খাবো? আমার ক্রাইম পার্টনার কিছুই খাবে না? তা তো হয় না!…”।
শায়লা খ্যাঁক করে উঠলেন, “তা এ্যাতোই যখন বুঝো তখন অন্যের স্বামীর সাথে ৭ বছর প্রেম কন্টিনিউ করলা কেমনে? অপরাধ করতেসো বুঝতে কি ৭ বছওওর লাগসে তোমার! হ্যাঁ? আজকে যখন দেখসো যে তুমি যা তোমার প্রেমিকের বউয়ের সাথে করসো সেইটা তোমার সাথে অন্য কেউ করতেসে তখন তোমার বিবেক জাগসে? এর আগে তুমি নাদান ছিলা? ফীডার খাইতা? কিচ্ছু বুঝো নাই?”
বাঁকা হাসলেন মাইশা, “আমি কি বুঝছি আর কি বুঝি নাই তার আগে তোমার স্বামী আমারে আর তোমারে কি বুঝাইসে সেইটা দেখে নিও… সমস্ত প্রমাণ নিয়েই আসছি বললাম না! আমি যখন সরে যাইতে চাইসি তখন কে আমার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় থাকসে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে… না খেয়ে অসুস্থ হয়ে অফিসে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেসে আমার বিরহে!… ৫০ বছর বয়সে এসে ২০ বছর বয়সী কচি ছেলের মতো কাজ কারবার কে করসে… সেগুলো সব পাবা, কেমন?… কার মেসেজে কাকুতি মিনতি আমারে পাওয়ার জন্য… কে কার জন্য মরে যায়… সবই আছে… এখন না বুঝি যে সেগুলো সবই নাটক!… আমার আজকে হারানোরও কিছু নাই… লুকানোরও কিচ্ছু নাই… তুমি ভালো করে দেখে নিও, কেমন? নতুন করে প্রেম শিখতে পারবা… তোমার স্বামী তো দুনিয়াশুদ্ধু মেয়েরে প্রেম করা শিখাইসে… খালি এক তুমিই বোধহয় কিছু শিখতে পারো নাই!”।
হাবিব সাহেব স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মাইশা থামলে এবার তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, “তা এখানে এসে আপনার লাভটা কি হবে? কি আশা নিয়ে আসছেন এখানে? প্রতারণার মামলা বা নারী নির্যাতন বা অন্য কোনও কেস দিতে চাইলেও তো আপনার থানায় যাওয়া দরকার ছিলো!… এখানে এনার বাসায় এসে আমাদের এখানকার পরিবেশ নষ্ট করছেন কেন?”
মাইশার হাসি ব্যঙ্গ ছড়ালো যেন, “বাহ!… দারুণ বললেন তো!… একটা চরিত্রহীন লোকের আশেপাশে বা সংস্পর্শে থাকতে আপনাদের পরিবেশ নষ্ট হয় না… আর আমি এসে দু’টো সত্যি কথা বলে আমার অধিকার চাইলেই পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলো?”
উপর থেকে নেমে এসেছেন কাজরী আর তাঁর স্বামী সুভাসও। মেয়ে অন্তরাকে ঠেলে বাসায় পাঠিয়ে নিজেরা এসেছেন। এই সমস্ত কুৎসিত আলাপের মধ্যে অবিবাহিত তরুণী মেয়ের থাকাটা শোভন দেখায় না। পরম অসন্তোষ নিয়ে ঘরে গেছে অন্তরা। ভেতরের ভীড় বাড়লো একটু। আজিজুল সাহেব আবার গলা খাঁকারি দিলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই তাঁর দিকে চোখ ফিরিয়ে মাইশা তেজী গলায় উত্তর দিলেন, “আর প্রমাণের কথা বললেন না? আমি সমস্ত প্রমাণ নিয়েই আসছি…” বলেই তিনি তাঁর কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা বড়সড় খাম বের করলেন টেনে। তারপর সেই খাম খুলে সকলের সামনে ড্রয়িং রুমের সেন্ট্রাল টেবিলের উপর একের পর এক ঠাস ঠাস করে রাখতে লাগলেন তাঁর আর সাজ্জাদের একসাথে ছবি। তারপর বেরোল কিছু প্রিন্ট করা কাগজ। হাত উঁচু করে সেগুলো সকলের চোখের সামনে নেড়ে জোরে জোরে বললেন, “এই যে… আপনাদের মহান সাজ্জাদের পাঠানো সমস্ত মেসেজ… হোয়াটস এ্যাপ, ইমো, ফেসবুক… সব কিছু আছে এখানে… এখন বলতে পারেন বাকি মেয়েরা যারা সব কিছু ফেসবুকে দিচ্ছে আমি তাদের মতো করলাম না কেন? ওরা তো এই লোকের হাতে হ্যারাসড হইসে… আর আমার সাথে তো এর প্রেম ছিলো… প্রেম!… মতিভ্রম হইসিলো আমার!… মাথা নষ্ট হইসিলো যে আমি তার মতো লোকের সাথে জড়াইসি!… তারে বিশ্বাস করসি!… আমার দোষ আমি মাথায় তুলে নিলাম… কিন্তু এইবার আপনারা বিচার করেন… ৭ বছর ধরে যে তার সাথে আমার সম্পর্ক… সে যে আমারে এতো দিন ধরে বলে আসতেসে যে বিয়ে করবে… সংসার করবে আমার সাথে!… সেইগুলার কি হবে? আমি যে তার ভরসায় জীবনের এতোগুলো দিন নষ্ট করলাম, সেই ক্ষতি আমার পুষাবে কে? সে যে আমারে নষ্ট করলো, আর আমারে সমাজের চোখে নিচু করলো… তার কি হবে? আর আমি তো প্রেম করার জন্য প্রেম করি নাই!… আমি তো বিয়ে করবো, ঘর বাঁধবো বলে প্রেম করসি!… কিন্তু সে যে নষ্টামি করসে… তার বিচার করবেন আপনারা? আমার তো ইহকাল পরকাল দুইটাই গেলো!… আমার জীবন শেষ হয়ে গেলো!… এখন বের হচ্ছে হাজার হাজার মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক… কিন্তু আমার তো আর হাজার হাজার পুরুষের সাথে সম্পর্ক না!… তার সাথে না জড়াইলে তো আমি আরও আগে আমার স্বামী মরার পরে অন্য কাউরে বিয়ে করে আবার সংসার পাততে পারতাম!… আমি যে তার জন্য অপেক্ষা করসি… আমার সময়গুলো ফেরত দিতে বলেন আপনারা তারে!…”
কৌতূহলের উপর আর কিছু নাই। এই পরিস্থিতির মধ্যেও রত্না, কাজরী আর সুভাষ গিয়ে মহিলার রাখা ছবিগুলো আর প্রিন্টেড কাগজগুলো নেড়েচেড়ে গভীর মনোযোগের সাথে দেখছে! দেখতে যান নাই হাবিব সাহেব আর আজিজুল সাহেব। হাবিব সাহেব যান নাই কারণ এগুলো উনার রুচিতে কুলায় না, আর আজিজুল সাহেব যান নাই বয়সের কারণে, কৌতূহল পূর্ণমাত্রায় থাকা সত্ত্বেও। উপর তলার সুভাষদের পাশের ফ্ল্যাটের নববিবাহিত তরুণ দম্পতি ফয়সাল আর লাবণীও নেমে এসেছে, ওরা অবশ্য ভেবেছে কোনও বিপদ হয়েছে বুঝি। আর নেমে এসে পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে আড়ষ্ঠ হয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চক্ষুলজ্জার কারণে চলে যেতেও পারছে না, আবার লজ্জায় কথা বলারও সাহস পাচ্ছে না।
মাইশার বিলাপ আর ক্ষোভ ঝাড়া কোনরকম থামলে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন হাবিব সাহেব, “তাহলে আপনি এখন কি চান? … সাজ্জাদ ভাই আপনাকে বিয়ে করুক, এটাই? কিন্তু উনি তো শায়লা ভাবীর অনুমতি ছাড়া আপনাকে এভাবে বিয়ে করতে পারবে না!… আইনী ঝামেলা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যাপার স্যাপার সবই তো আছে এখানে!… উনার দুইটা বড় বড় ছেলেমেয়েও আছে… কি করলে আপনি খুশি হবেন, বলেন?”
নাক কুঁচকে ফেললো মাইশা, “বিয়ে?! কে করবে বিয়ে এটাকে?… আমি যে এটার সাথে জড়াইসিলাম সেই আফসোস আমার এই জন্মে যাবে না ভাই!… একটা নষ্ট লোকের পাল্লায় পড়ে আমি নিজেরে নষ্ট করসি!… নিজের সম্মান নিজের হাতে ডুবায় দিসি!… সারাজীবন প্রায়শ্চিত্ত করলেও পুষাবে না… আবার বিয়ে!… প্রশ্নই আসে না!… জেনেশুনে একটা বারোভাতারী পুরুষকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে? এইটার জন্য ওই মহিলাই ঠিক আছে, বুঝছেন? … স্বামী বাইরে বাইরে মুখ লাগায় বেড়াবে, আর ঘরে ফিরলে উনি আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিবে… আহা! কত্তো পরিশ্রম করে ফিরলো আমার স্বামী!… আমার স্বামী যদি হইতো… একবার যদি বুঝতাম যে সে জিনিসটা এই রকম!… হয় আমি জিন্দা থাকতাম! নাইলে সে… আমি জেনে বুঝে এই জিনিস বিয়ে করবো? যখন জানি নাই তখন এক কথা ছিলো… জানার পরেও? আমি কি তার খাই না তার পরি? নাকি আমি এই মিসেস সাজ্জাদের মতো যে স্বামী যতো বড় বদই হোক, স্বামীর কামাইই খাওয়া লাগবে! নাইলে পেটের ভাত হজম হবে না!”
মাইশার কথায় বেআক্কেল হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো উপস্থিত সবাই। হিসেব অনুযায়ী সাজ্জাদের সাথে বিবাহবহির্ভুত সম্পর্ক গড়ার জন্য মাইশাকে অপদস্থ করার কথা সকলের। চরিত্রহীন, সংসার নষ্ট করা মহিলা বলে উপাধি দেয়ার কথা তাঁকে। পুরুষ সাধারণত এই অভিযোগ, দায়ী করার এই তীর থেকে অনেকটাই বেঁচে যায়। এধরণের ঘটনার পুরো ঝাঁজটাই যায় একটা মেয়ে বা মহিলার উপর দিয়ে। সেখানে এই মহিলা নিজের দোষ অস্বীকার না করেও তার সাথে তার অপরাধের অংশীদার পুরুষটাকে তুলোধুনো করে ছেড়ে দিচ্ছে!
বিস্মিত কণ্ঠে আজিজুল সাহেব বললেন, “তাইলে আপনি এখানে আসছেন কেন? যদি বিয়ে নাই করতে চান উনারে…”
চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলো মাইশা, “উনার মুখোশ খুলতে আসছি… ওই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো তো আসল কাজ যা করার করে দিসেই!… আমি যদি এইটুকু না করতাম তাইলে আমার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইতো না… তার কারণে আমি পরিবারে, অফিসে সব জায়গায় অপদস্থ হইসি… আমার বাড়িওয়ালা তার ঘটনা জানার পরে ফেসবুকের ভিডিওতে তারে চিনতে পেরে আমারে এসে বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিয়ে গেসে… যে এই রকম লোকের সাথে যেই মহিলার সম্পর্ক, তাও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক… তারে তার বাড়িতে রাখবে না! সে তো আর এইটাও জানতো না যে এই লোক বিবাহিত!… আমি তো সব খানে বলে রাখসি আমরা বিয়ে করবো শিগগিরি! সে আমার ফিয়াঁন্সে! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারসি আমি!… তা বিষ যা গেলার আমি একলা গিলবো ক্যান? তার মুখেই বহুবার শুনছি, সোসাইটিতে নাকি তার অনেক সুনাম!… মসজিদ কমিটিতে, ওয়াজ মাহফিলের জন্য বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে চাঁদা টাদা নাকি অনেক দেয় সে!… তাই এইবার উনার আসল চেহারা খুলে দিয়ে গেলাম… আমার তো যা যাওয়ার গেছেই!… কিন্তু একই অপরাধে একলা আমার ইজ্জত যাবে আর উনি বসে বসে নামাজ-রোজা-হজ্ব করে সাধুপুরুষ সেজে বসে থাকবেন, তা তো হইতে পারে না!… এই বার আপনারা সিদ্ধান্ত নেন যে তারে মাথায় নিয়ে নাচবেন নাকি বাড়ি ছাড়া করবেন… আমি আন্ধা হয়ে গেসলাম বলে এটুকু বুঝি নাই যে এতো বছরের বিয়ে করা বউরে যে ধোঁকা দিতে পারে… ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনীর জন্য যার নষ্টামী করতে আটকায় না, সে আমার কাছেও সৎ থাকবে না… কমিটেড থাকবে না… আরও আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো আমার যে ইউনিভার্সিটিতে যা যা বলে লোকে সেগুলো কারণ আছে বলেই বলে… আমি ভাবসি বাড়িতে বউয়ের কাছে শান্তি পায় না… অন্যায় হইলেও সম্পর্কে জড়ায় পড়সে দুর্বল হয়ে!… ওও মা! এখন তো দেখি রাস্তার ঝাড়ুদারনি থেকে শুরু করে রাজরানী পর্যন্ত সব্বাই তার দুর্বলতা!…”।
মাইশা হাঁপাচ্ছেন রীতিমতো। শায়লা জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি দিয়ে মনে হয় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চাইছেন তাঁকে। উপস্থিত সকলে এতোক্ষণে কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন যে মহিলার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। পরিবার-পরিজন-কলিগ-পরিচিত সমস্ত জায়গায় অপদস্থ হয়ে এক রকম উন্মত্ত হয়েই আজকে এখানে আসা তাঁর। নিজের অপকর্মের জন্য গ্লানি, আর সাজ্জাদের প্রতি আক্রোশ, এই দুই মিলিয়ে পরিণতির চিন্তা না করেই বা নিজের সম্মানের বিবেচনা না করেই ছুটে এসেছেন মহিলা।
কাঁধে ব্যাগ তুলে নিলেন মাইশা। উনার বের করা কাগজগুলি আরও খুটিয়ে দেখার ইচ্ছা থাকলেও সুভাষ সেগুলো গুছিয়ে এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে। সেগুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বিদ্রূপ মাখা স্বরে মাইশা বললেন, “রেখে দেন!… আমার কাছে আরও অনেক আছে!… ৭ বছরে কম জমে নাই আবর্জনা!… আপনারা এগুলো রাখেন… পোস্টার বানায়েন!…”, এরপরে সাজ্জাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনী তুলে বললেন, “তোর চাকরি গেসে না? এবার তোর সংসার যাবে… আমার জীবনে আগুন জ্বালায় তুই সুখে থাকবি? সেটা আমি হইতে দিবো না…আফসোস যে তোর ছেলে বা মেয়ে কেউ নাই এখানে আজকে… ওদের সামনে কথাগুলি বলতে পারলে শান্তি পাইতাম আরও… তোর মতো বজ্জাত পুরুষের এইটাই প্রাপ্য… গাছেরও খাবি আবার তলারও কুড়াবি? ঘরে বউয়ের হাতের সেবা নিবি, রান্না খাবি, গুছানো ঘরে বসে হাওয়া খাবি… কিন্তু বউরে আর ভাল্লাগবে না… তখন মনে হয় নিজের বউয়ের থেকে দুনিয়ার বাকি সমস্ত মেয়েমানুষ বেশি সুন্দর… বেশি ভালো তাই না? মনে রাখিস… চোরের দশ দিন… গৃহস্থের একদিন… তোর কপালে এখন সেই একদিন চলতেসে… সেই মিরপুর থেকে একবার পাড়ার লোকের দৌড়ানি খেয়ে পালাইসিলি না? এইবার এইখান থেকে তোর দূর হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম… জ্বী… মিরপুরের ঘটনাও আমি জানতে পারসি… পাপ কখনও চাপা থাকে না, বুঝছিস?”
এরপরে শায়লার দিকে ফিরে কথা বললেন, অপেক্ষাকৃত শান্তভাবে, “আপনার ছবি দেখসি ওর মোবাইলে মিসেস সাজ্জাদ!… সামনাসামনি দেখে বুঝলাম ছবির চাইতেও সুন্দরী আপনি… এই এতো সুন্দর, এতো শিক্ষিত, এতো সুন্দর সংসারী হয়েও যখন আপনার স্বামীর আপনারে দিয়ে পোষায় না… স্বামীরে এতো এতো সেবাযত্ন, কায়দাকানুন করেও যখন আটকায় রাখতে পারেন নাই, তখন আপনার আরও আগেই উচিৎ ছিলো এইটারে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া… আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তো খারাপ না যদ্দুর জানি!… তারপরেও আপনি তারে টাইট দেন নাই… এই আপনাদের মতো মেয়েমানুষের জন্য এই টাইপের পুরুষগুলো আস্কারা পায় বেশি… বুঝছেন? লাত্থি দিক… গালি দিক… এই নষ্ট চরিত্রের নষ্ট মনমানসিকতার মানুষরে আঁকড়ায় ধরে বসে আছেন!… আর সে আপনারে পেয়ে বসছে… ঘর তো ঠিক আছেই!… সুতরাং বাইরে লাড্ডু খাওয়াই যায়!… যত্তোসব!”
উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো মাইশা। সে চলে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কথা বলতে পারলো না। এরপরে আজিজুল গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “চলেন আপনারা… এইখানে বসে থেকে তো আর লাভ নাই কোনও!… যা হওয়ার তা হইসে… সাজ্জাদ মিয়ারে একটু একলা থাকতে দেয়া দরকার…”।
ফয়সাল আর লাবণী প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো আজিজুল সাহেব একথা বলা মাত্র। কান গরম হয়ে গেছে ওদের মাইশার কথা শুনে। একে একে সবাই বের হয়েই যাচ্ছিলো, কথা বললেন রত্না আজিজুলের উদ্দেশ্যে, “ভাইসাহেব, ওই মহিলার সমস্ত কথা বাদ দিলেও একটা কথা কিন্তু আপনার একটু ভাবতে হবে… উনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা নাই আমার… কিন্তু ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে… আমার একলার না… আরও অনেকেরই আছে বিল্ডিং-এ… আবার উঠতি বয়সী ছেলেও আছে… জেনেশুনে এরকম মানুষের সাথে একসাথে বসবাস করাটা তো…”।
কথাটা শেষ করলেন না রত্না। সকলেই বুঝেছে তিনি কি বলতে চাইছেন। হাবিব মৃদুস্বরে ধমক দিলেন স্ত্রীকে, “আহ!… কিসের মধ্যে কি শুরু করলা!… এখন কি এই কথা বলার একটা সময় হলো নাকি?… আজিজ ভাই!… আপনি বাসায় যান… বিশ্রাম নেন… আমরা পরে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হইলে বলবো…”।
স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন শায়লা আর সাজ্জাদ। কারও রুচি হলো না তাঁদের দু’জনের সাথে কোনও কথা বলার, আর তাঁদের দু’জনের বলার মতো কোনও মুখ তো ছিলোই না। সেদিনের কথাবার্তা তাই এখানেই শেষ হলো। যে যার বাসায় ফিরে গেলো। কিন্তু আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো ঘটনা পুরো পাড়াতে।
ভাগ্যক্রমে ওই দিন বাসায় উপস্থিত ছিলো না সোহেল। কিন্তু সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছানোর আগেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ওর জানা হয়ে গেলো। মোড়ের চায়ের দোকানে থেমেছিলো এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে, সেখানে শুনেছে কিছু, বাসা পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে স্বান্তনা পেয়েছে কিছু, আর বিল্ডিং-এ ঢোকার পর দোতলায় উঠেই বাড়িওয়ালা আজিজুল আঙ্কেলের কাছে বাকিটুকু যা শোনার শুনে নিয়েছে। সর্বশেষ বাসা ছাড়ার নোটিশটাও ওকেই বয়ে আনতে হয়েছে তিন তলা পর্যন্ত, “দেখো বাবা সোহেল! তুমি যে কতো ভালো একটা ছেলে সেটা তো আমরা জানিই… তুমি আর তোমার বোন সিমিন… দুইজনেই তোমরা অত্যন্ত ভদ্র ছেলেমেয়ে… চোখের সামনে দিয়েই তো বড় হইলা!… আগে ছিলা মোসলেম ভাইদের বাসায়… আর এখন আমার বাড়িতে… সত্যি বলতে কি তোমার বাপের মধ্যে যে কোনও সমস্যা আছে, সেইটাও তো এতোদিন কিছু বুঝি নাই ওইভাবে… টুকটাক যা কানে আসছে তা আর চোখের সামনে কিছু না দেখে আমলেও নেই নাই ওইভাবে… আজ এতো বছর ধরে আছো তোমরা আমার বাসায়!… কথাটা বলতে খারাপই লাগতেসে… কিন্তু কি করবো বলো… আমরা তো সমাজ নিয়েই চলি… তোমার বাপের যে বদনাম হইসে… তোমার আন্টি একেবারেই পছন্দ করতেসে না আসলে… বুঝোই তো… কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন তো তোমার আন্টি!… অন্যায়-দুর্নীতি একদম সহ্য করতে পারে না… হেহে… আর চরিত্রের বদনাম একবার লাগলে তো সহজে মোছে না বাবা… আবার তোমাদের ওই মিরপুরের ঘটনাটাও শুনলাম… আমার এক বন্ধু থাকে মিরপুরে… তোমরা আগে যেই বাসায় থাকতা, ওই এলাকাতেই বাড়ি করসে… এতো দিন তো কিছু জানতে পারি নাই, জিজ্ঞেসও করি নাই কোনদিন কিছু… আজকে ওই মহিলার কথায় ওরে জিজ্ঞেস করলাম কিছু জানে টানে কিনা… তো দেখলাম সবই জানে, তোমার বাবাই যে আমার ভাড়াটিয়া সেটা জানতো না আর কি…সব বললো আর কি… যাই হোক… পুরান ঘটনা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নাই… কথা হইলো তোমরা আমার পুরানো ভাড়াটিয়া… তোমাদের কোনও সময় বেঁধে দিচ্ছি না… কিন্তু দেইখো আর কি… ভালো একটা বাসা-টাসা দেখে উঠে যাইয়ো… তুমিও তো এখন চাকরি করো… আশা করি আরও বড় বাসাই পাবা…”। মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনে চুপচাপ উঠে এসেছিলো তিন তলায় সোহেল।
সেদিনের ঘটনাগুলো ওর সামনে ঘটলে ও আদৌ সহ্য করতে পারতো কিনা ও জানে না। কিন্তু শায়লা পরবর্তীতে ইনিয়ে-বিনিয়ে নাকের জল চোখের জল এক করে ওর কাছে সমস্ত ঘটনা বিবরণ করে গেছেন যখন, তখন ওর কোনও প্রতিক্রিয়া হয় নি। নির্বিকারভাবে শুনে গেছে, একটা কথাও বলে নি। ও তো জানতোই সাজ্জাদ আর মাইশার এই সম্পর্কের কথা। একদম শুরুর দিকেই মা’কেও জানিয়েছিলো। ওর মা উল্টো ওকেই গালাগালি করেছেন বাপের নামে উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বানিয়ে বা শুনে শুনে বলার জন্য। ‘কোথাকার কোন মহিলার জন্য তুই তোর বাপের নামে এই সমস্ত কথা বলিস! কেমন ছেলে তুই?’, এই ছিলো উনার প্রতিক্রিয়া। সুতরাং, এই দফায় তিনি যখন সোহেলকে তাঁর উপর হওয়া অন্যায়, জুলুম আর এই বাড়ি বয়ে আনা অপমানের বয়ান দিতে এসেছেন, সোহেল বাস্তবিকই বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় নি। শুধু এটুকুই ভেবেছে মনে মনে যে এর পরে এই পাড়ায় মুখ তুলে চলাফেরা করাটা কতোটা কঠিন হতে পারে ওর জন্য, যার প্রতিফলন ঘটলো একটু আগেই, মাসুমের দোকানের সামনে। যদিও আজকেই প্রথম না, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই ক্রমাগত টিটকিরি শুনে আসছে সোহেল। ওর বাবা কতোটা শুনছেন জানে না ও, কারণ উনার সাথে কোথাও একসাথে ও বের হয় না, কিন্তু ও শুনছে। ঘরের বাইরে পা দিলেই।
অতি শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ কেউ ওকে ভালো করে খোঁজখবর নিতে বলেছে যে ওর বাবার আর দুই-একটা বিয়েশাদী আছে কিনা, সেই সাথে আরও কয়েকটা ছেলেপুলে। থাকলে এখন থেকেই যেন সোহেলরা ব্যবস্থা নেয়, পরে সহায়সম্পত্তির ওয়ারিশ নিয়ে ঝামেলা হয়ে যাবে। মুরুব্বীরা ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভালো ভালো উপদেশ দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন কেমন বাপের ছেলে ও, কি ওর করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না। বেশি বেশি ইবাদত করা উচিৎ এখন থেকেই, নামাজ-রোজা নিয়মমতো মেনে চলা উচিৎ, যাতে সংযম থাকে নিজের উপর। বাবার দোষ কিছু যদি ওর মধ্যে থেকেও থাকে, ইবাদতের মাধ্যমে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কেউ কেউ মেডিটেশন, আবার কেউ কাউন্সেলিং-এর পরামর্শও দিয়েছেন। সমবয়সীরা সমবেদনা দেখালেও হালকা রসিকতা করতে ছাড়ছে না এই বলে যে, ‘বাপ এই রকম, আর তুই কিনা ব্যাটা ঠিকমতো একটা প্রেমও করতে পারলি না!’ বয়সে ছোট সাহসী ছেলেপিলেরা পেছন থেকে টোন কাটছে। ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিতরা দৃশ্যত এড়িয়ে চলছে, যাতে ওর সাথে চলাফেরা করতে দেখে তাদের নামটাও খারাপ না হয়। আর মহিলারা অতি সন্তর্পনে এড়িয়ে চলছে ওর সংস্পর্শ, যেন ও মারাত্মক কোনও ছোঁয়াচে রোগের রুগী, ধারে কাছে আসলেই রোগ ধরে যাবে।
***
(পরের পর্ব আগামীকাল)