#প্রবাসীর বউ,পর্ব-পাঁচ
মাহাবুবা বিথী
হেলাল মারা যাওয়ার পর থেকেই রহিমাকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী হতে হয়।কারণ আমাদের সমাজ এখনও নারী বান্ধব সমাজ হয়ে গড়ে উঠেনি।সামাজিক ও মানসিক চাপে সেদিন রহিমা ছিলো বিপর্যস্ত।তবুও জীবন থেমে থাকে না।জীবন এগিয়ে চলে জীবনের নিয়মে।
সেদিন ওর স্বামীর সম্পত্তির কোনো অধিকার যেমন পায়নি তেমনি বাবার বাড়িতেও অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।রহিমার থাকা খাওয়া নিয়ে কটুক্তি শুনতে হয়েছে।স্বার্থের কারণে আপন মুখগুলো অপরিচিত হয়ে যায়।রহিমার নিজেকে তখন উদ্বাস্ত মনে হতো।দুঃসময়ে আপন রক্ত ও বেইমানী করে।এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রহিমাকে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
আজ রহিমা অনেক সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী।অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কারনে ওর প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে।
সকাল দশটার মধ্যে রহিমা বাড়ি পৌছে গেলো।বেলালের জন্য ওর তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে হয়েছে।বেলালের এখন দশ বছর চলছে।ওর বাবা বেঁচে না থাকায় মা হিসাবে রহিমাকে বেশী সময় দিতে হয়।রহিমা গতকাল ওর দাদীর বাড়ি গিয়েছে এটা বেলালকে জানায়নি।ওকে বলেছে ব্যবসার কাজে ফেনী গিয়েছে।ও ওর দাদীর খুব ভক্ত।জানতে পারলে ওর অনেক মন খারাপ হবে।
রহিমা নিজে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে।এরপর আর পড়তে পারেনি।তাই বেলালকে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখে রহিমা।মাঝে মাঝে এই স্বপ্ন দেখাটাকে মরিচিকার মতো মনে হয়।তবুও রহিমা স্বপ্ন দেখে।
এই পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে না।যখন কোনো সন্তানের মাথার উপর থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষটা হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে যায় তখন সেই মা আর সন্তানের দুঃখ কষ্টের শেষ থাকে না।বেলালের ডাকে রহিমা সম্বিত ফিরে পায়।
—মা আমার স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা মা,বাবা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তোমাকে এখন কষ্ট করে আমার সাথে যেতে হতো না।বাবাই আমাকে পৌছে দিয়ে আসতো।
রহিমা বলে,
—-বাবার তো অফিস থাকতো।সেই আমাকে যেতে হতো।
খুব সকালে রওয়ানা দেওয়ার জন্য রহিমার নাস্তা খাওয়া হয়নি।রহিমার ভাবী চটজলদি রুটি আর ভাজি নিয়ে আসে।রহিমা দ্রুত নাস্তা সেরে বেলালকে নিয়ে স্কুলে রওয়ানা হয়।
সামনের বছর বেলাল ক্লাস সিক্সে উঠবে।ওকে ভালভাবে পড়াশোনা করাতে গেলে অনেক অর্থের দরকার।রহিমার ব্যবসাটা আগের থেকে অনেক পসার হয়েছে।
এখন কাজই রহিমার চলার পথের সাথী।এই এগিয়ে চলার পথে ওর মতো অসহায় মেয়েদের সঙ্গী করে চলতে চায়।নিজ উদ্যেগে রহিমা “মা”বুটিক শপ গড়ে তোলে।এখন এই বুটিক শপে ৩০ জন নারী পুরুষ কাজ করে।সঙ্গে আরও ১০০ জন অসহায় নারী আছে।এরা বাসায় বসে রহিমার বুটিক শপ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ করে।এদের একজনের নাম রিমা।ওর জীবনের বঞ্চনার কাহিনী শোনার পর রহিমার মনে হয়েছে ও অনেক ভালো আছে।
রিমা গৃহ শ্রমিকের কাজ নিয়ে জর্ডানে গিয়েছিলো।কিন্তু ওখানে ওর ঠাঁই হয় মিনি পতিতালয়ে।সেখান থেকে অন্তঃসত্বা হয়ে দেশে ফিরে আসে।ওর অন্তঃসত্বার খবর পেয়ে সমাজ থেকে ওদের পরিবারকে বিচ্যুত করা হয়েছে।সবাই ওদেরকে একঘরে করেছে।সমাজের কেউ এখন ওদের পাশে নেই।অথচ যে দালালের জন্য রিমার এই অবস্থা সে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়।অবশেষে একটি এনজিও সংস্থার আশ্রয় কেন্দ্রে রিমার ঠাঁই হয়।ওখানেই রিমা একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান প্রসব করে।ঐ সংস্থাই বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
রহিমা এ ধরণের অসহায় নারীদের দিয়ে ওর বুটিকশপের কাজ করায়।ওরা বাসায় বসে রহিমার বুটিক শপ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ করে দেয়। রিমাও বাসা থেকেই রহিমার বুটিক শপে কাজ করে।মহিলা অধিদফতরের সাথে যোগাযোগ থাকায় রহিমা এইরকম অসহায় নারীদেরকে দিয়ে কাজ করাতে পারে।মহিলা অধিদফতর এভাবেই অনেক নারীকে পুনর্বাসিত করে।
জীবনের স্রোতে রহিমার আরও পাঁচ বছর পার হয়ে যায়।এর মাঝে রহিমার ভাসুর মারা যায়।রহিমা ওর মায়ের বাড়ির পাশে জমি কিনে একতলা বাড়ি তৈরী করে।রহিমার মা রহিমার সাথেই থাকে।রহিমার ভাই ভাবীও ওর বুটিক শপে কাজ করে।রহিমার শাশুড়ী ওনার নামে থাকা সব সম্পত্তি বেলালের নামে লিখে দেয়।ফলে ফেনীতে ওর শ্বশুর বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দেয়।আর ওর শাশুড়ী জা রহিমার কাছে চলে আসে।রহিমার ভাসুরের মেয়ে রিতা ও রহিমার কাজে সাহায্য করে।রহিমার দুঃসময়ে যারা কেউ ওকে আশ্রয় দিতে চায়নি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখন সবাই রহিমার কাছে আশ্রয় প্রার্থী।
বেলালের সামনে এসএসসি পরীক্ষা।যদিও বেলাল পড়াশোনায় খুব মনোযোগী তারপরও রহিমার দুশ্চিন্তা হয়।রহিমা অনলাইনে ওর বুটিকশপের পেইজ খুলে।ওই পেইজের মাধ্যমে ঢাকায় একটা ব্রান্ডের দোকানের সাথে রহিমার বুটিক শপের চুক্তি হয়।সেখানেই রহিমার সাথে রুবেলের পরিচয় হয়।রুবেল ওই ব্রান্ডের শোরুমে সেলস ম্যান হিসাবে কাজ করে।
ওই এসে রহিমার কাছ থেকে অর্ডারের মালপত্র নিয়ে যায়।রুবেল রহিমাকে খুব সম্মান করে।
রুবেল বিএসসি পাশ করে চাকরি না পেয়ে মধ্যপ্রাচ্য শ্রমিক হিসাবে পাড়ি জমায়।ওর বাবা মা ছোটো বেলায় মারা যায়।মামার সংসারে বড় হয়েছে।মামাতো বোন সালমার সাথে রুবেলের বিয়ে হয়। কিন্তু সালমার এই বিয়েতে মত ছিলো না। ও একজনকে ভালবাসতো।সালমার বাবা জোর করে রুবেলের সাথে বিয়ে দেয়। বিদেশে যাওয়ার সময় রুবেল সালমার নামে ব্যংকের একাউন্ট খুলে দেয়।ওর ইনকামের সব টাকা বিশ্বাস করে সালমার একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়।সালমা ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে রুবেলকে ডিভোর্স দিয়ে ওর প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়।দুবছর পর দেশে এসে রুবেল নিঃস্ব রিক্ত হয়ে যায়।মামাকেও ও আর কিছু বলেনি কারণ বাবা মা মারা যাওয়ার পর এই মামাই ওকে বড় করে।
এরপর থেকে রুবেল একাই নিজের মতো থাকে। একটা নামকরা ব্রান্ডের দোকানে সেলস ম্যান হিসাবে কাজ করে যা আয় হয় ও একলা মানুষ ওর ভালোই চলে যায়।বিএসসি পাশ হওয়াতে অংকে ও খুব ভালো।রহিমাই বেলালকে পড়ানোর জন্য অফার করে।বেলাল এখন বড় হচ্ছে।যা দিনকাল পড়েছে রহিমা বেলাল কার সাথে মিশবে ওর বন্ধু বান্ধব শিক্ষক থেকে শুরু করে সব জায়গায় তীক্ষ্ণ নজর রাখে।বেলালকে নিয়ে রহিমার অনেক স্বপ্ন।রহিমা রুবেলকে দুবছর ধরে চিনে।রহিমার মতো ও পোড় খাওয়া মানুষ।নিরিবিলি শান্ত প্রকৃতির।যদিও বর্তমান জামানায় কাউকে বিশ্বাস করা যায় না তারপর ও রুবেল একজন পরোপকারী মানুষ।ব্যবসার কাজ বাদেও রহিমা যে কোনো প্রয়োজনে রুবেলকে ডাকলে রুবেল এগিয়ে আসে। বেলাল ও রুবেলকে খুব পছন্দ করে। তাই সময় পেলে রহিমার বাড়ি এসে বেলালকে অংক করে দেয়।
আজ বৃহস্পতিবার।রহিমার ডেলিভারী মালের টাকা
নিয়ে বিকেল চারটায় রুবেলের আসার কথা।এদিকে ওর শাশুড়ী জা আর রিতা ওরা সবাই মিলে ফেনীতে বেড়াতে গেছে।রহিমার মা ওর ভাইয়ের বাসায় গিয়েছে।কে যেন দরজায় নক করছে।দরজা খুলে দেখে বেলাল এসেছে।রহিমা বেলালকে বলে
—-বাবা মডেল টেস্ট কেমন হলো।
বেলাল বলে,
—-ভালো ই হয়েছে।ক্ষিদে লেগেছে।খেতে দাও।
রহিমা বেলালকে ভাত বেড়ে দেয়।এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।দরজা খুলে দেখে রুবেল এসেছে।রহিমা রুবেলকে ঘরে বসতে বলে।
রুবেল রহিমাকে বলে,
—-বেলালের পরীক্ষা কেমন হয়েছে।
রহিমা বলে
—-ভালোই হয়েছেে।
রুবেল রহিমাকে বলে,
—-আপনার ডেলিভারীর টাকা মালিক পুরোটা দেয়নি।কিছু বাকি রেখেছে।মানে আপনাদের মতো উদ্যেক্তাদের হাতে রাখে।আচ্ছা আপনি নিজেই তো একটা শোরুম দিতে পারেন।তাহলে আপনার মালের পরিপূর্ন মুল্যটাও পাবেন।
রহিমা বলে,
—কে সামাল দিবে।আমারতো লোকবল নাই।আর বেলালকে ব্যবসার লাইনে আনবো না।বেলালের ইচ্ছা ও ডাক্তারী পড়বে।
রুবেল বলে
—-আপনি চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি।আপনার হাতে সময় আছে।চলেন নদীর পাড়টা একটু ঘুরে আসি।
রহিমা বেলালকে ওদের সাথে যেতে বলে।বেলাল ওর মাকে বলে,
—-মা তুমি যাও।আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।
রহিমা আর রুবেল নদীর পাড়ে রওয়ানা হলো।
পড়ন্ত বিকেল।যখন ক্লান্ত সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ে।ঘড়ির কাটায় পাঁচটা বাজে।সূর্যের মায়াবী রশ্নি নদীর জলে ডুবে যায়।তারপর গোধুলী লগ্নে সূর্যটা টুপ করে নদীতে ডুবে যায়।সূর্যাস্তের চিক চিক আলো নদীর বুকে খেলা করে।কি এক অপরুপ দৃশ্য!
রুবেল রহিমাকে বলে,
—আপনার জীবন নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।সারাজীবন একাই থাকবেন।জীবনের স্রোতে সবারই সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
রহিমা বলে,
—কিছু অপ্রাপ্তি হৃদয়ে এতটাই ক্ষতের সৃষ্টি করে তখন কোনো কিছু পেতে মনটা আর অস্থির হয় না।আর আমার সেই দগদগে ক্ষতগুলিকে বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেছি।কারণ সেই ক্ষতটা যদি আবার আঘাত প্রাপ্ত হয় আমার সহ্য করার শক্তি থাকবে না।তাই স্বপ্ন দেখতে বড্ডো ভয় পাই।
রুবেল রহিমাকে বলে,
—-তবুও জীবন নিয়ে যদি অন্য কিছু ভাবেন তবে আপনি জেনে রাখুন কেউ একজন আপনার হাত ধরার অপেক্ষায় আছে।সে নিজেও আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ। ছোটো থেকেই যার কপালে ভালবাসা জোটেনি।একটা ভালবাসার আশ্রয়ের তার খুব প্রয়োজন।
অতঃপর রহিমা বলে,
—-সন্ধে হয়ে এলো।চলেন বাড়ি ফেরা যাক।
চলবপ