#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৪১,৪২,৪৩
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪১
“যদি বুঝতাম মানে?”
রুশান ওর পাশে বসে থাকা কলিগের দিকে তাকাল। ওর মুখ থমথমে। কেমন বিব্রতকর পরিবেশ। কলিগের সামনে সিন ক্রিয়েট হোক চায় না। কিন্তু অর্পা তো অবিবেচকের মতো ওর সামনেই প্রশ্ন করছে। কলিগ মেয়েটা বুঝতে পারছে ওদের পার্সোনাল কথা হচ্ছে। এখানে না থাকায় শ্রেয়। তাই উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল,
“স্যার, আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”
মেয়েটা কোন রকমে কেটে পড়ল। মেয়েটা যেতেই রুশান ক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিল অর্পার দিকে। অর্পা ওর রি দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে বলল,
“এভাবে না চেয়ে থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর দেও।”
রুশান বসা থেকে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হয়ে বলল,
“এ নিয়ে আমরা অন্য সময় কথা বলব। এটা আমার অফিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যার চলে আসবে। সো প্লিজ। সিন ক্রিয়েট করো না। এখানে আমার একটা সম্মান আছে।”
অর্পা টেবিলের উপরে ঠাস করে নিজের ব্যাগটা রেখে বলল,
“তোমার সম্মানের তন্দুরি। যদি আমার প্রশ্নের জবাব না দেও এমন সিন ক্রিয়েট করব যে সারা জীবন মনে রাখব।”
রুশান বিরক্ত মুখে আবারও বসল। তারপর দু’হাতে পুরো মুখের ঘাম মুছে চোখ তুলে অর্পার দিকে তাকাল। ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
“কী চাও তুমি?”
অর্পা ওর বিপরীত পাশের চেয়ারে বসে বলল,
“তুমি যে সব সময় ভনিতা করে কথা বলো, ঠিক ভনিতা নয় রহস্য নিয়ে কথা বলো এর কারণ জানতে চাই। তোমার এতসব কথার মানে কী? অনেস্টলি বলবা।”
অর্পা কঠোর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। রুশান নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে। নাহ! আর নয়। এইবার মনের চাপা যত কথা, যত রাগ, যত আক্রোশ সব বলবে।
“তোমার আমার ব্রেক আপ হয়েছে অনেক বছর হয়ে গেছে। এসব থেকে বেরিয়ে দুজনেই জীবনে এগিয়ে গেছি৷ এতদিন পরে এসব নিয়ে কথা না বলাই ব্যাটার ছিল কিন্তু তুমি যখন আজ জবাব চাইছো তাহলে শোন, তুমি আমাকে কখনোই বিশ্বাস করতে না। বিশ্বাসহীন ঠুনকো সম্পর্কে ছিলাম আমরা৷ তুমি সুদূর প্রবাসে থাকার পরেও আমার বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসার কোন কমতি হয়নি৷ তুমি যা বলতে তাই চোখ বুঝে বিশ্বাস করতাম। কখনো তোমাকে যাচাই করতে যাইনি। আর না কারো কথায় তোমাকে জাজ করতে গিয়েছি। সবাই যখন বলত অর্পা উড়াল দিয়েছে ও আর তোর কাছে ফিরবে না তখন কনফিডেন্সের সাথে সবাইকে বলতাম ও আসবে। ও আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। কিন্তু অন্যদিকে তুমি আমার অজান্তে আমার পেছনে স্পাই লাগিয়ে দিলে। কেন? কারণ আমার প্রতি তোমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। তোমার ধারণা তোমার আড়ালে আমি অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াব। আর এইজন্য তুমি আমার পেছনে লোক লাগালে দেন সে যা বলল তাই বিশ্বাস করলে। সে না জানুক তুমি তো জানতে আমি কেমন? কারো সাথে মিশলে, হেসে কথা বললে, ছোটখাটো ফ্লার্ট করলেই সে প্রেমিকা হয়ে যায় না। বন্ধুও হতে পারে। তুমি তো জানতে আমি একটু এমনই ছিলাম। রসিক মানুষ, সবার সাথে মজা করতাম। তখন তো সমস্যা ছিল না। সমস্যা হলো বিদেশে যাবার পর। কেন? কারণ ততদিনে তুমি বদলে গেছো। বিদেশের হাওয়া গায়ে লেগেছে। সেদিন আমাকে কল করে যা নয় তাই বললে। আমার চরিত্র খারাপ, আমি আর কখনো ভালো হব না ব্লা ব্লা। একটা বারের জন্য জিজ্ঞেস করলে না, নিজের সাফাই পেশ করার সুযোগ দিলে না। যখন তোমার এতসব অপবাদের মুখে আমার সামান্য অভিমান হলো, ব্যস! কাচের টুকরোর মতো ভেঙে পড়ল সম্পর্ক। অভিমানে বললাম এত সন্দেহ দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না, এভাবে চলতে পারে না। এর সল্যুশন প্রয়োজন। তুমি বললে তাহলে সেপারেশন ব্যাটার। চলো ব্রেক আপ করি। আমার সাথে তোমার আর থাকতে হবে না। মুক্তি দিলাম তোমায়। কি করব আমিও নিলাম।কাউকে তো জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। তারপর জানো মজা করাই ছেড়ে দিলাম। একটা রসিক মানুষ বেরসিক হয়ে পড়ল। জীর্ণ শীর্ণ জীবন ঢের চলতে লাগল। অগোছালো মানুষটা কেমন গোছালো হয়ে উঠল। থ্যাংকস টু ইউ। এত গোছালো, মুডি পার্সোন বানানোর জন্য। এর বেশি আমার আর কিছু বলার নেই।”
রুশান চলে গেলেও অর্পা টু শব্দ করল না। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। চোখ দিয়ে মুক্ত দানার মতো অশ্রু ঝরছে। মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে উঠছে।
“রুশান, আমার মনের কথা তুমি সেদিনও বোঝোনি আজও বুঝলে না। আমিও অভিমানে বলেছিলাম ব্রেক আপ করার কথা কিন্তু তুমি যে এত সহজে মেনে নিবে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম তুমি বলবে তুমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ে আমার জীবনে নেই আর থাকবেও না। আমি আর মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করব না। আমরা সব আবার ঠিক করে নেব। কিন্তু তুমি তা করোনি। নীরবে সরে এসেছো জীবন থেকে।”
অর্পা ঠোঁট কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
____________
দিশা আর দর্শন আজ সন্ধ্যে বেলায় আয়ানের বাড়িতে আসবে। অর্ষাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওর ফ্যামিলিকে ম্যানেজ করার জন্য।
“এই অর্ষা, ওরা রাস্তায় আছে। আমার অনেক নার্ভাস লাগছে। তুই দেখ না সব ঠিক আছে কি-না।”
“আয়ান ভাইয়া, আমি তো আপ্যায়নের ব্যাপারটা তেমন বুঝি না। আর ওদের ইম্প্রেশ করে কথাও বলতে পারব না। আমি শুধু তোমার বাসার সবাইকে ম্যানেজ করে ওদের সামনে আনতে পারব। নাস্তার ব্যাপারটা আয়েশা আপু দেখছে আর খালাকে আমি বলেছি যদি আমাকে ভালোবাসে তবে যেন কোন সিন ক্রিয়েট না করে সব স্বাভাবিক ভাবে নেয় আর বিয়েটা যেন হয় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আমাকে কথাও দিয়েছে তাই নো টেনশন।”
“তুই কিন্তু পুরো সময়টা আমার সাথে থাকবি। আমার অনেক নার্ভাস লাগছে। ওর ভাই নাকি বলেছে আমার সাথে কথা বলে, আমার পরিবারের সাথে কথা বলে ভালো লাগলে তবেই ওর বাবা-মার সাথে কথা বলবে। যদি আমাকে পছন্দ না হয়?”
“হবে না কেন? আমার ভাই যেন-তেন ছেলে না-কি? দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ। ভালো এডুকেশন, ভালো জব কি নেই? তুমি একদম ভেবো না। তোমাকে দেখে, তোমার সাথে কথা বলে ওর ভাই টাস্কি খেয়ে থাকবে।”
“এক কাজ কর তুই ভালো করে সেজেগুজে নে। তোকে দেখে ইম্প্রেশ হয়ে রাজি হলে হতেও পারে।”
আয়ান ফিঁক করে হেসে দিল। অর্ষা ভ্রু কুঁচকে মুখ বাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে নতুন একটা ড্রেস পরলেও নিজেকে বিন্দু পরিমাণ সাজায়নি। মেহমান আসছে তাই নিজেকে পরিপাটি করা উচিত।
চলবে
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪২
গেইট দিয়ে গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করার পর পুরনো ধাঁচের বাড়িটা দর্শনের চোখে পড়ল। দর্শন ধারণা করছিল ছোট হোক তবে জাঁকজমক, জৌলুসে পূর্ণ একটা বাড়িতে আয়ান থাকে। কিন্তু এ তো বিপরীত। রংচটা, পুরনো কারুকার্য শোভিত বাড়িটায় আয়ান থাকে। ভবিষ্যতে ওর বোন থাকবে। দর্শন সেদিকে আর মন দিল না। হয়তো দাদার আমলের বাড়ি। যত্নের অভাবে এমন বেহাল অবস্থা। দিশা যদি এই বাড়িতে থাকতে পারে তাহলে ওর সমস্যা কি। তাছাড়া কোন ভূতুড়ে কিংবা ধসে পড়া বাড়ি তো নয়। গাড়ি থেকে নামতেই বাগানের দিকে চোখ পড়ল। বাগানে আর বাড়ির বাইরে কয়েকটা লাইট জ্বলছে। সে আলোয় পুরো বাগানটা চোখে পড়ল। এই বাড়ির মানুষ অনেক শৌখিন। ফুল, বাগান পছন্দ করে তা স্পষ্ট। বাগানটা দর্শনের বেশ পছন্দ হলো। দর্শন দিশার দিকে তাকাল। ওর মুখ বলছে ও বেশ খুশি। ওদের গাড়ির শব্দ পেয়ে আয়ান আর শাড়ি পরা একজন এগিয়ে এল ওদের অভ্যর্থনা জানাতে। আয়ান দর্শনের সালাম দিয়ে, কুশল বিনিময় করে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করতেই দর্শন চমকে উঠল। বাড়ির বাহির দেখে যেমনটা ভেবেছিল ভেতরটা তার উল্টো। ভেতরটা আধুনিক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো-গোছানো। প্রতিটি আসবাবপত্র মনকাড়া। এদের রুচি আছে মানতে হবে। দর্শন আর দিশা, আয়ানের বাবা-মাকে সালাম দিয়ে সোফায় বসল। আয়ান বারবার সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর মনে মনে অর্ষাকে গালাগাল করছে। বিরবির করে বলছে,
“কত করে বললাম পুরো সময় আমার থাকবি আর প্রথম পর্বেই গায়েব। কি এত সাজগোজ করছে? ওকে দেখতে আসছে নাকি আমাকে? আ’ম কনফিউজ।”
অর্ষাকে ছাড়াই আয়ান ওদের সাথে কথা বলছে। বারবার দিশার দিকে চেয়ে ওর ভাইয়ের মনোভাব বোঝার জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করছে। আয়ানের মা আর বোন ওদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। আয়ানের বাবা ওদের সঙ্গে এসে বসল। অর্ষার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
অর্ষাকে সিড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে আসতে দেখল ওর খালু। আয়ান তখনও কথা বলায় ব্যস্ত। ওর আর দর্শনের মধ্যে পড়াশোনা, জব, ফিউচার প্ল্যান, দিশার পড়াশোনা, ওকে নিয়ে ফ্যামিলির ড্রিম এসব ব্যাপারে কথা হচ্ছে। অর্ষা দ্রুত ওদের সামনে এল। আয়ান পায়ের শব্দ পেয়ে ডান পাশে ঘুরে অর্ষাকে দেখে বলল,
“এত লেট?”
অর্ষা জিভ কেটে বলল,
“সরি সরি।”
দর্শন সরি শব্দটা শুনে থমকে গেল। ঠিক সরি শব্দ না অতি পরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সেই মানুষটিকে। অর্ষাকে দেখে পুরো শকড হয়ে গেল। অর্ষা ওদের উদ্দেশ্যে সালাম দিতেই চোখ আঁটকে গেল দর্শনের বিস্মিত চেহারার দিকে। দু’জনেই দু’জনকে দেখে বিস্মিত, হতবাক, হতবিহ্বল। এমন ভাবে দেখা কেউ আশা করেনি। দুজনের বুকের ভেতর ডুগডুগি বাজছে। অর্ষা ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিল। দর্শনের বোনের নাম দিশা ছিল। আর আয়ানের ভাষ্যমতে ফ্যামিলিতে সবাই ডাক্তার।
দর্শন নিজেকে সামলে নিল। মনে মনে ভীষণ খুশি। অর্ষার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। তবে ও আয়ানের কি হয় সেটা জানার জন্যও মনে প্রশ্ন জাগছে।
আয়ান অর্ষাকে বসতে বললে অর্ষা চুপচাপ বসে পড়ল। ওর মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। দিশার সাথে বিয়ে হোক এটা চায় কিন্তু দর্শন ওর আরো কাছাকাছি চলে আসবে সেজন্য ভয় হচ্ছে।
“এ হচ্ছে আমার একমাত্র খালাতো বোন অর্ষা। খুব ভালো মেয়ে।”
দিশা আর দর্শন দু’জনেই হ্যালো বলল। তারপর ও দর্শন আর দিশার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অর্ষা ওদের কথায় শুধু হ্যা, না, হু মিলিয়ে যাচ্ছে আর কোন কথা বলছে না। হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। দর্শন আড়চোখে অর্ষাকে বারবার দেখছে। পুরো সাদা রঙের একটা ড্রেস পরেছে। হালকা সেজেছে। বারবার অর্ষার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে।
অর্ষা পরিস্থিতি অন্য রকম করার জন্য আয়ানকে বলল,
“আয়ান ভাইয়া, এভাবে বসে থাকবে। দিশাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাও। যেখানে থাকবে সেখানটা দেখে নিক। পছন্দ অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে।”
আয়ান দিশার দিকে তাকাল আর দিশা ভাইয়ের দিকে। ভাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। অর্ষা আয়ানের কানে ফিসফিস করে বলল ছাদে চলে যাও কেউ ডিস্টার্ব করবে না। আমি গিয়ে কফি দিয়ে আসব। মন খুলে গল্প করো। ওদের পজিটিভ সাইন দেখতে পাচ্ছি। আয়ান দিশাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেল।
অর্ষা কফি বানানোর বাহানায় উঠে গেল।
অর্ষা ছাদে কফি নিয়ে যেতেই ওদের কথা শুনল।
দিশা বলছে,
“আচ্ছা অর্ষা আপুকে এমন দেখাচ্ছিল কেন? পুরোটা সময় চুপচাপ ছিল। মনটা খারাপ মনে হলো। ও আবার তোমাকে পছন্দ করে না তো?”
“আরে নাহ! ও আমাকে পছন্দ করে না বলেই তো বিয়ের জন্য প্রেসার দিয়েছে। আমরা একে অপরকে ভাই বোনের চোখে দেখি। ও ছোট বেলায় অনেক চঞ্চল ছিল কিন্তু একটা দূর্ঘটনা ওর জীবন থেকে সব খুশি কেটে নিয়েছে। সে ঘটনা অন্যদিন বলব। আর এই কারণেই কেমন চুপচাপ থাকে। সব সময় বিষন্ন মুখে ঘুরে বেড়ায়।”
“আমার ভাইয়ার ক্ষেত্রেও সেম। এখানে যাই একটু কথা বলছে বাড়িতে কারো সাথে তেমন কথা বলে না। ইউএস থেকে ডাক্তারি পাশ করে বেকার বসে আছে। কত ভালো ভালো হসপিটাল থেকে অফার আসছে কিন্তু ও রেসপন্স করছে না। এত ভালো অপশন থাকার পর কেউ এভাবে মুখ করে ঘরে বসে থাকে? ও এমন ছিল না। জানি না কি হয়েছে। শুনেছি কলেজ লাইফে একটা মেয়েকে পছন্দ করত। তারপর ওর জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে ও এমন হয়ে গেছে। এর জন্য অবশ্য বাবা-মা দায়ী ছিল। ভাইয়ার জন্য অনেক চিন্তা হয়। জীবনটা এভাবে নষ্ট করার মানে হয়?”
অর্ষা ওদের কথার মাঝে ঢুকে পড়ল। কফি দিতে দিতে হাসি মুখে বলল,
“মনে হচ্ছে আয়ান ভাইয়াকে তোমার ভাইয়ার পছন্দ হয়েছে।”
দিশা কফি নিতে নিতে বলল,
“আমারও তাই মনে হচ্ছে। নয়তো এখানে এত সময় দিত না। আর আমাকে আয়ানের সাথে আসতে দিত না। এখন বাবা আর মাকে রাজি করাতে পারলেই হয়।”
“সেটা তোমার ভাইয়া করে ফেলবে। চিন্তা করো না।”
“আমার চেয়ে দেখছি আপনি ভালো চিনেন ভাইয়াকে।”
দিশা আর আয়ান মুখ টিপে হাসল।
অর্ষা থমথমে মুখে বলল,
“না, মনে হলো।”
অর্ষা নিচে গিয়ে সবাইকে কফি দিল। দর্শনের জন্য আলাদা করে ব্ল্যাক কফি বানিয়েছে। বিদেশে থাকতে অনেক বার ট্রেনিং নিয়েছে ব্ল্যাক কফি বানানোর। তারপর নিজেও অভস্ত্য হয়ে পড়েছে ব্ল্যাক কফির উপর।
দর্শনকে ব্ল্যাক কফি দিতে দেখে আয়েশা জিজ্ঞেস করল,
“উনার জন্য ব্ল্যাক কফি? কেন?”
অর্ষা কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। কি করে বলবে দর্শনের পছন্দের কথা। দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,
“আমার ব্ল্যাক কফিই পছন্দ। তাই….
” কিন্তু ও কি করে জানল?”
দর্শন এর জবাব অর্ষার জন্য রেখে দিল।
অর্ষা আমতা-আমতা করে বলল,
“মনে হলো তাই বানালাম।”
এ নিয়ে কেউ আর কথা বাড়ালো না। কফি শেষ করে দর্শন অর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ওয়াশরুম কোন দিকে?”
অর্ষা মনে মনে রাগ করলেও মুখে বলে দিল। দর্শন বুঝতে না পেরে বলল,
“ঠিক বুঝতে পারলাম না কোন দিকে।”
আয়েশা অর্ষাকে বলল,
“একটু দেখিয়ে দিয়ে আয় না।”
অর্ষা বাধ্য হয়ে দর্শনকে নিয়ে গেল। আয়েশার দর্শনকে বেশ পছন্দ হয়েছে তাই ওর সাথে অর্ষার সেট করতে চাইছে মনে মনে।
অর্ষা ওকে ওয়াশরুমের কাছে নিতেই দর্শন ওর দু বাহু চেপে ধরল দেয়ালে। অর্ষা ভয় পেয়ে গেল। দর্শন ওর একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। নিশ্বাস বারি খাচ্ছে ওর মুখে। অর্ষা ঢোক গিলল। এমন অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় ও। এত বছর পরে সেই পরিচিত মানুষের ছোয়া, তার শরীরের গন্ধ সারা শরীরে শিহরণ বয়ে দিচ্ছে। দর্শনের চোখের দিকে তাকাল। কেমন মাদকতা।
“ছাড়ো আমায়, আমি জানতাম তোমার মতিগতি ভালো না তাই আসতে চাইনি তোমার সাথে। ছাড়ো আমায় কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“সর্বনাশ হয়ে যাক। নতুন করে সর্বনাশ হওয়ার মতো কিছু বেঁচে নেই।”
অর্ষা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
“কী চাও তুমি?”
“যেটা পাওনা আছি। যা পাওয়া বাকি ছিল। সেটাই চাই আমার।”
“তোমার কোন পাওনা নেই আমার কাছে।”
“তোমাকে পাওয়া এখনো বাকি আছে।”
“তোমার কী মনে হয় তোমার জন্য আমি বসে আছি? কেউ আসেনি আমার লাইফে?”
“সমস্যা কী? আসলে আসুক। যেভাবে এসেছে সেভাবে চলে যাবে। আমি তোমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড ছিলাম। ছিলাম কি এখনো আছি। কারণ আমাদের ব্রেক আপই হয়নি। তাই বিয়ের জন্য প্রথম প্রায়োরিটি আমার। বাকিরা বাদের খাতায়।”
অর্ষা রাগে ফুসফুস করছে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে দর্শন আরো জোরে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
“কতদিন পর তোমার নিশ্বাস ছুতে পারলাম। তোমার ঘ্রাণ নিতে পারলাম। কেমন একটা মাদকতা শরীর ছুয়ে যাচ্ছে।”
দর্শন আচমকা ওর গালে ঠোঁট ছুইয়ে দিল। অর্ষা চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। দর্শন বাকা হেসে বলল,
“সরি, কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
অর্ষা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিরবির করে গালাগাল করতে করতে চলে গেল। দর্শন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওর পেছনে পেছনে ড্রয়িংরুমে গেল। বারবার ওর দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে। অর্ষার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
মাঝরাতে রুশানের মোবাইল বেজে উঠল। ঘুমঘুম চোখে কল রিসিভ করে অর্পার মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনতে পেল। ওর কন্ঠ শুনে ঘুম উবে গেল। অর্পা সরাসরি ওকে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা তোমার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? মানে আমার সাথে ব্রেক আপ করার পর কেউ তোমার জীবনে এসেছে?”
“এত রাতে এই প্রশ্ন করার জন্য কল করেছো?”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে পালটা প্রশ্ন করল।
“হ্যা, উত্তর দেও।”
” ব্রেক আপের পর কি প্রেম না করে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব?”
অর্পা জোর গলায় বলল,
“হ্যা, থাকবে। আমি যদি তোমার অপেক্ষায় বসে থাকতে পারি তবে তুমি কেন পারবে না?”
রুশানের কাছে ওর প্রশ্নটা সাংঘাতিক প্রশ্ন লাগছে।
চলবে…..
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪৩
দিশা ভার্সিটি থেকে নিজের রুমে ঢুকতেই দরজায় কড়া নড়ল। ব্যাগটা রেখে ঘরের এসির রিমোট খুঁজছিল। না পেয়ে মেজাজ তুঙ্গে। তখনই দর্শন ওর রুমে ঢুকল।
দিশা রিমোট খোজা বাদ দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল।
“আমি মা’কে সব জানিয়েছি। মা’কে রাজি করানোর জন্য নিজের সমস্ত নলেজ কাজে লাগিয়েছি। সে রাজি।”
“আর বাবা?”
“বাবাও রাজি। আয়ান সম্পর্কে এমন পাম মেরেছি যে কিছুতেই এ পাত্র হাতছাড়া করবে না। একদম বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হবে। আমি বলেছি, আমি ছেলের সব খোঁজ খবর নিয়েছি। খুব ভালো ফ্যামিলি।”
“বিয়ে!”
“হ্যা, বিয়ে। অবাক হচ্ছিস কেন?”
“কিন্তু তুমি না বললে যে অন্তত পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করা উচিত। এখন শুধু…..
” মত পালটে ফেলেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ডেট ফাইনাল করব।”
“হঠাৎ?”
দিশা ওর আগ্রহ দেখে অবাক হচ্ছে। ওর চেয়ে ওর ভাইয়ের আগ্রহ বেশি দেখছে। তাহলে কি দর্শন জেনে গেছে খালাতো বোনের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য পুরো পরিবার অস্থির? দিশার মনে এই শঙ্কা বাসা বাঁধল।
দর্শন বোনের চোখে বিস্ময় দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না। ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চাইছি না। ভাই, তো বোনের ভালোই চাই। তুই আর আপত্তি করিস না। আয়ানের সাথে কথা বল। জিজ্ঞেস কর যে ওরা কবে আসবে আমাদের বাড়িতে। সেদিনই না-হয় বিয়ের পাকা কথা হবে।”
দর্শন তাড়া দেখিয়ে চলে গেল। দিশা এসির রিমোট খোজা বাদ দিয়ে আয়ানকে কল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবাই এত সহজে মেনে নিবে ভাবতেই পারেনি। আয়ানের সাথে ওর বিয়ে হবে উফফ!
আয়ান খুশিতে নাচতে নাচতে অর্ষাকে খবরটা দিল। অর্ষা খুব খুশি হলো তবে মনে একটা ভয় বাসা বাঁধল। দর্শন ওর কাছাকাছি চলে আসছে। ও সেদিন যা করেছে এভাবে যদি লিমিট ক্রস করতে থাকে তবে বিষয়টা কোন দিকে মোড় নিবে জানা নেই।
~~~~~
অর্পা, রুশানের উপর ক্ষেপেছে। রুশান ওকে পাত্তা দিচ্ছে না। যে কি-না এক সময় ওর পেছনে ঘুরত সে এখন ওকে ঘোরাচ্ছে। তাই গিয়ে সরাসরি ওর কলার চেপে ধরল। আচমকা কলার চেপে ধরায় রুশান হকচকিয়ে গেল। চারদিকে চেয়ে বলল,
“কী করছো? সবাই দেখছে তো।”
“দেখুক সবাই। এই কয় বছরে তুমি বড় লায়েক হয়ে গেছো। আমাকে দেখছোই না। এদিকে তোমার জন্য আমি বিদেশে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিলাম।”
“আমি তোমাকে একবারও বলেছি সেটা করতে?”
“না-ও তো বলোনি।”
“আমার বলা না বলায় কি আসে যায়?”
অর্পা চিৎকার করে বলল,
“আসে যায় ষ্টুপিড। যদি না আসতো যেত তবে এভাবে তোমার পেছনে ঘুরতাম না। সব ফাইনাল হওয়ার পরেও বিদেশে যাওয়া ক্যান্সেল করতাম না।”
“আরে, কেন করেছো? তোমার ড্রিম তুমি পূরণ করো। আমি চাই তোমার ড্রিম পূরণ হোক। গো।”
অর্পা রুশানের চোখে চোখ রেখে দু’গালে হাত রেখে বলল,
“আমার ড্রিম তুমি।”
রুশান ওর হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“যারা আমাকে দুই পয়সা দাম দেয় না আমি তাদের এক পয়সা দাম দেই না। তোমার যেখানে যাওয়ার যাও, যা খুশি করো আমাকে প্লিজ বিরক্ত করো না।”
রুশান ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে চলে গেল। অর্পা ওকে পেছন থেকে বারবার ডাকল। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগল। কিন্তু রুশান একবারের জন্য ওর দিকে তাকাল না। নিজের মতো চলে গেল।। ওর চোখগুলো লাল। লাল চোখগুলো হঠাৎ ছলছলে রুপ ধারণ করেছে।
আয়ান রেডি হয়ে অর্ষার রুমে গেল। অর্ষা বিরস মুখে সন্ধ্যার আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ওকে দেখে আয়ানের মেজাজ বিগড়ে গেল।
“অর্ষা, তুই এভাবে বসে আছিস কেন? এখনো রেডি হোস নি?”
অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“ভাইয়া, শরীর ভালো নেই। আমি যেতে পারব না। তোমরা যাও।”
আয়ান ওর বিছানায় বসে বলল,
“শরীর খারাপ? শরীরের আবার কী হলো? জ্বর না-কি?”
“তেমন কিছু না। এমনি ভালো লাগছে না।”
“ঠিক আছে আমি ওদের কল করে জানিয়ে দিচ্ছি আমরা আজ আসতে পারছি না। অন্য দিন আসব৷”
অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল।
“আরে না। কি বলছো? আমার জন্য এত সুন্দর একটা দিন কেন নষ্ট হবে? তোমরা চলে যাও।”
“তুই না গেলে আমি যাব না। তুই যেদিন যেতে পারবি সেদিনই যাব। কোন সমস্যা নাই।”
আয়ান ওর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হায় আল্লাহ!
অর্ষাসহ আয়ানের বাবা-মা সবাই সন্ধ্যে বেলায় দিশার বাড়িতে উপস্থিত হলো। অর্ষা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই ইতস্তত করছে। কখনো ভাবেনি দর্শনের বাড়িতে আসবে। আজ শুধু বাধ্য হয়ে আয়ানের জন্য আসতে হলো। কেমন গুটিয়ে আছে ও। অর্ষাকে দিশা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো বাড়ি দেখাল৷ একটা ঘরে ঢুকে অর্ষার চোখ আঁটকে গেল। এই ঘরটা দর্শন ছাড়া আর কারো হতে পারে না। দর্শন ছোট থেকেই গোছালো, পরিপাটি। এই ঘরটা দর্শনের। অর্ষার স্পষ্ট মনে আছে আগের ঘরের ডেকোরেশন এমনই ছিল।
“এটা ভাইয়ার ঘর।”
অর্ষা মুখ ফস্কে বলে ফেললো,
“তোমার ভাইয়া কোথায়?”
নিজের বোকামির জন্য জিভে কামড় দিয়ে বিরবির করে কি জানি বলল।
দিশা কিছু মনে করল না। ও স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“ভাইয়ার আজ হসপিটালের জয়েনিং ডেট। এভাবে তো অনেক দিন তো গেল। আজ বাবা অনেক রাগারাগি করেছে। তাই….
দর্শন বাড়িতে নেই, ওকে একটু দেখতে পাবে না এই বিষয়টা হঠাৎ ওকে বেশ পোড়াচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। অর্ষা গিয়ে বসার ঘরে খালা – খালুর কাছে বসল। দিশার মা ডিনার তৈরি করতে ব্যস্ত আর ওর বাবা আয়ানের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরে দর্শন বাড়িতে আসল। হঠাৎ দর্শনকে দেখে অর্ষার মনে ভালো লাগা ছুয়ে গেল৷ আয়ান দর্শনকে কি জানি ইশারা করল। অর্ষা কিছুই বুঝতে পারল না। দর্শন মুচকি হেসে অর্ষার দিকে একবার চেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
ফ্ল্যাশব্যাক। দুদিন আগে।
দর্শন আয়ানকে কল করে একটা রেস্টুরেন্টে ডাকে। আয়ান নার্ভাস মনে দর্শনের সাথে দেখা করতে আসে।
দর্শন ওকে খাবার অফার করলে আয়ান অনিচ্ছা জানায়। ও কেমন আমতা আমতা করছে। দর্শন চুপচাপ বসে আছে কিছু বলছেও না।
” আপনি আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছিলেন।”
আয়ানের কথায় ওর ধ্যান ভাঙে।
দর্শন সোজা হয়ে বসে। তারপর গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল,
“হ্যা, তোমাদের বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই। বাবা-মাকে আমি যেকোনো মূল্যে রাজি করাব। এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত থাকো। তবে আমি সে ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি। আমার আসলে তোমার একটা হেল্প লাগবে।”
“হেল্প? কীসের হেল্প? বলুন, আমি আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি।”
“তুমি দিশাকে ভালোবাসো। আই হোপ আমার ব্যাপারও বুঝবে। আমার ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে পেতে সাহায্য করবে।”
আয়ান বিস্ময়ের চূড়ায়। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
“কে সে? আর আমি কী করে হেল্প করব?”
দর্শন মৃদু হাসল। ওর চোখের কোণে খুশির ঝলক। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলতে লাগল,
“তাহলে শোন, আমি তখন কলেজে পড়ি। সিরিয়াস বয়৷ প্রেম ভালোবাসার ধারে কাছেও নেই। একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসত, আমাকে লুকিয়ে দেখত, ডায়েরিতে আমাকে নিয়ে মনের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো নোট করত, কত পাগলামি করত। এক সময় আমি ওর পাগলামির প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যাই৷ দু’জনই খুব সিরিয়াস ছিলাম। দু’জন দু’জনার মধ্যে বিভোর থাকতাম। কেয়ারিং, শেয়ারিং সব ছিল। তবে আমাদের এই ভালোবাসা অনেকের নজরে পড়ে গেল। তারপর একদিন ছোট্ট ভুল বুঝাবুঝি। ওর ভীষণ অভিমান হলো। আমি অভিমান ভাঙায় তৎপর হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে আমি ফ্যামিলির উপর রাগ করে হঠাৎ একদিন একটা দুঃসাধ্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম। আমার অজান্তে তার লাইফেও বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল৷ সব এলোমেলো হয়ে গেল। দু’জন হারিয়ে গেলাম দু’জনের জীবন থেকে। একদম সিনেমার মতো। কিন্তু ভালোবাসাটা হারালো না। এত বছরে অনুভূতিগুলো আরো মিষ্টি আর প্রখর হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা, বুকের ভেতর দুরুদুরু অনুভূতি, চাপা আনন্দ কিন্তু সে আজো অভিমানী। সেই অভিমানী মেয়েটিকে আমি আজো পাগলের মতো চাই, যেকোন মূল্যে চাই। প্লিজ আয়ান হেল্প মি।”
আয়ান এতক্ষণ বিভোর হয়ে শুনছিল। দিশা বলেছিল ওর ভাইয়া কলেজে থাকতে একজনকে ভালোবাসত৷ এর কথাই বলেছিল?
“তাকে কি আমি চিনি?”
দর্শন ওর কথার জবাব মুখে দিল না। মোবাইল বের করে গ্যালারি ঘেটে পুরনো কিছু ফটো বের করল। তারপর আয়ানের দিকে মোবাইল ঘুরালো। পরপর অনেকগুলো ফটো দেখাল। আয়ানের চোখে মুখে বিস্ময়।
“অর্ষা!”
দর্শন মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যা, অর্ষা।”
আয়ান অন্য দিকে ঘুরে জোরালো শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি বুঝেছি। সেদিন আপনাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার জন্যই ছুটছিল।”
দর্শন অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। চোখের কোণে পানি জমেছে। ভাঙা গলায় বলল,
“যা হয়েছে তা আমার অজানা ছিল। জানার পরেও আমার কিছু করার ছিল না কারণ কোন কিছু বদলানোর ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। তবে আমি ওকে বাকি জীবন সুখে রাখতে চাই।”
“করুণা?”
দর্শন, আয়ানের চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“করুণা আর ভালোবাসা যেমন আলাদা দুটো শব্দ তেমনি আলাদা জিনিস। আমি ওকে কাল ভালোবাসতাম, আজ বাসি, আগামীকালও বাসব। ওকে আমি এতগুলো বছর পাগলের মতো খুঁজেছি, কষ্ট পেয়েছি, কেঁদেছি, নিজেকে একটা গন্ডির মধ্যে বেঁধে দিয়ে কেমন নিরস, নির্জীব, নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করছি। আর তুমি বলছো করুণা?”
শেষের কথাগুলো দর্শন একটু জোরে বলল। আয়ান ওর চোখের দিকে তাকাল। লাল অশ্রুসিক্ত চোখগুলো শুধু আরেকজন প্রেমিকই পড়তে পারে। আয়ানও পেরেছে। অর্ষাও তো দর্শনকে ভালোবাসে তবে মেনে নিচ্ছে না কেন? কারণ….. ওহ নো! আয়ানের বুঝতে বাকি নেই কেন ও দর্শনকে ভালোবাসার পরেও ইগ্নোর করছে। তবে অর্ষা হ্যাপি থাকা ডিজার্ভ করে। তাই ওকে হ্যাপি করবে। দর্শনকে হেল্প করবে ও।
আজ তাই করেছে। অর্ষাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। দর্শনের কাছাকাছি রাখবে বলে। দর্শন ফ্রেশ হয়ে এসে বসল ওর সাথে। অর্ষা ওকে দেখে ইতস্তত করল। নড়ে-চড়ে বসে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে অন্য দিকে চেয়ে আছে। এমন ভাব করছে যেন বাড়ির প্রতিটি ইট, বালি, সিমেন্ট, রডের হিসাব করছে। দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে আলতো হাসল।
দর্শনের মা সবাইকে ডিনার করতে ডাকল। অর্ষা যেখানটায় বসল তার ঠিক পাশে দর্শন বসল আর তার ব্যবস্থা আয়ান করল। খাওয়ার এক পর্যায়ে দর্শনের মা অর্ষাকে দেখে, ওর সম্পর্কে জেনে অর্ষার খালাকে বলল,
“কেমন ছেলে চান ওর জন্য? আমার কলিগের একটা ছেলে আছে। আমেরিকা থাকে। আমেরিকায় স্যাটেল।”
উনার কথা শুনে সবাই খাওয়া বন্ধ করে দিল। বিশেষ করে দর্শনের। ওর নিজের মা নিজের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর প্রেমিকার বিয়ের জন্য পাত্র দেখাচ্ছে?
অর্ষার খালা আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কী করে ছেলে?”
অর্ষা খালার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর আয়ানের দিকে চেয়ে কি যেন ইশারা করল।
দর্শনের মা খুশি মনে বলল,
“ডাক্তার।”
অর্ষার খালা হতাশ হলো। হতাশার সুরে বলল,
“তাহলে তো হবে না। অর্ষার আবার ডাক্তার পছন্দ না।”
এই কথা শুনে দর্শনের গলায় খাবার আঁটকে গেল। খুকখুক করে কাশতে লাগল। সবাই ওর দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্ষা দ্রুত পানি এগিয়ে দিল। দর্শন ঢকঢক করে পানি খেয়ে জোরে শ্বাস নিল।
দর্শনের মা বলল,
“বাবা,আস্তেধীরে খাও।”
দর্শন আড়চোখে অর্ষার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“আপনার ডাক্তার পছন্দ না কেন?”
অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে বিষম খেল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“এমনি। এমনি পছন্দ না।”
আয়ান ওর কথার সাথে কথা জোড়ে বলল,
“ওর ধারণা ডাক্তারটা হার্টলেস। আর হার্টলেস মানুষের সাথে জীবন কাটানো যায় না। ওর ধারণা আর কি।”
আয়ান মৃদু হাসল। ওর সাথে সবাই তাল মিলিয়ে হাসল। অর্ষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকাল।
চলবে……..