#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড),পর্ব-৪৯,৫০
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৪৯
অর্ষা ফ্রেশ হয়ে ডার্ক গ্রিন রঙের একটা শাড়ি পরেছে। ও অবশ্য খুব ভালো শাড়ি পরতে পারে না। এই কয়েকদিন অনেক বার শাড়ি পরা হয়েছে তাই হালকা হালকা শিখেছে আর সে অনুযায়ীই আজ নিজে নিজে শাড়ি পরেছে। দর্শন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেছে। অর্ষা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু খুলে বের হতে পারছে না। কেমন লজ্জা লাগছে। এই বাড়িতে নতুন ও। চারদিকে অপরিচিত মানুষ। এত মানুষের ভীড়ে নিজেকে কি করে সামলাবে। আর তাছাড়া এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে। বারোটা বাজে রুম থেকে বের হচ্ছে বিষয়টা খুবই লজ্জার।
এসব ভাবতে ভাবতে অর্ষা দরজা খুলে ফেলল। ড্রয়িংরুমে তেমন মানুষ নেই। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অর্ষা রুম থেকে বের হলো কিন্তু কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রান্নাঘরে অনেক মানুষ। মানুষে গিজগিজ করছে। অর্ষা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
একজন মহিলা ওকে দেখে বলল,
“এই তো বউ উঠেছে।”
অর্ষা বউ উঠেছে কথাটা শুনে আরও লজ্জা পেল।
অর্ষা লজ্জা পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“ওই একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে নতুন জায়গা তো ঘুম আসছিল না। ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে বিধায় দেরি হয়ে গেল….! ”
অর্ষাকে কাচুমাচু করতে দেখে উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসছে। দর্শনের মা সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,
” হাসছো কেন তোমরা? এত বেলা হয়েছে মেয়েটার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। অর্ষা, এসো মা, আমার সাথে এসো। আমি তোমাকে নাস্তা দিচ্ছি।”
“দর্শন আসুক। তারপর নাস্তা করব।”
“আচ্ছা, তাহলে এসে বস।”
দর্শন আসার পর দুজনেই নাস্তা করে নিল। নাস্তা শেষ করে দর্শন দিশাকে কল করে খোঁজ খবর নিচ্ছে।
অর্ষা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দর্শন এসে ওর পাশে ধপ করে শুয়ে পড়ল।
“কী ব্যাপার? এসেই শুয়ে পড়লে কেন?”
“তুমি শুয়ে আছো কেন?”
“আমাকে বলেছে রেস্ট নিতে তাই রেস্ট নিচ্ছি। রাতে রিসিপশন, বিকাল থেকে সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। বিকাল থেকে কত ধকল যাবে তাই রেস্ট নিতে বলেছে।”
“আমাকেও বলেছে রেস্ট নিতে।”
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার রেস্টের কি দরকার? তুমি তো আর ভারী লেহেঙ্গা, ভারী গয়না, মেক আপ পরে বসে থেকে থেকে কোমড় আর পা ব্যথা করবে না। আমি জানি এসব তোমার আমার কাছাকাছি থাকার ধান্দা।”
“হয়তো বড়রা আমাদের রেস্টের বাহানায় রোমান্স করার সুযোগ করে দিয়েছে।”
দর্শন, অর্ষার চুলে হাত দিতেই অর্ষা সরে গিয়ে বলল,
“রেস্ট করতে বলেছে, রেস্ট করো। একদম চুলে হাত দিবে না।”
“তাহলে গায়ে হাত দেই?”
“কোথাও হাত দিবে না। সরো। দূরে।”
ঘুমের মধ্যে অর্ষার মনে হচ্ছে কেউ ওর মুখে ফু দিচ্ছে। অর্ষা ধরফরিয়ে উঠে বসে। দর্শন ওর মুখে ফু দিচ্ছিল।
“তুমি! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি।”
“আমার কী দোষ? তুমি আমাকে নিষেধ করেছো তাই গায়ে হাত দেইনি, মুখে ফু দিচ্ছি। অনেকক্ষণ তো ঘুমালে, চারটা বাজে। ওরা এসে কয়েকবার ডেকে গেছে।”
অর্ষা দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা খোলা। ঘড়িতে চারটা বাজে। বুঝতে পারছে না এত ঘুম কোথায় থেকে আসছে। শুনেছে বিয়ের আগে না-কি অনেক ঘুম পায় কিন্তু বিয়ের পর কেন এত ঘুম পাচ্ছে?
“ফ্রেশ হয়ে নেও, তারপর কিছু খেয়ে তৈরি হতে শুরু করো। তোমাকে সাজাতে চলে এসেছে।”
অর্ষা হাই তুলতে তুলতে ফ্রেশ হতে গেল। দর্শন অবাক হয়ে শুধু ওকে দেখছে। এ মেয়ে এত ঘুমাচ্ছে কেন? বিয়ের পর ঘুম কুমারী হয়ে গেল নাতো?
অর্ষা রিসিপশনের জন্য তৈরি হয়ে গেল। ভারী লেহেঙ্গা, গয়না আর মেক আপ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দিক থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। মুচকি হেসে নিজেকে দেখছে। পেছনে থেকে এসে দর্শন ওকে জড়িয়ে ধরতেই অর্ষা লাফিয়ে ওঠে।
“আমার সাজ নষ্ট করো না। দূরে থাকো।”
দর্শন দূরে সরে গেল তাৎক্ষনিক। তারপর মুখ মলিন করে বলল,
“বিয়ের পর দেখছি একদম পাত্তাই দিচ্ছো না। এক দিনে এভাবে বদলে গেলে? জানি না বাকি জীবনে কি করবে।”
দর্শন কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ল আর অর্ষাও ওর দুঃখী দুঃখী ফেস দেখে গলে গেল।
“কিছুক্ষণ পরে মেহমান আসবে, ফটোশুট হবে। তাই চাচ্ছিলাম না যে সাজ নষ্ট হোক। আমি তো তোমার পছন্দে, তোমার জন্যই সেজেছি।”
বলেই দর্শনকে জড়িয়ে ধরল।
“তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তোমাকে ভালো না বাসলে কাকে বাসব?”
দর্শন সেই সুযোগ নিয়ে অর্ষার ঘাড়ে, গলায় চুমু একে জড়িয়ে ধরল।
~~~~~
বিয়ের বছর ঘুরতে চলল। এই এক বছরে অর্ষাকে অনেক কিছু ফেস করতে হয়েছে। দর্শন পাশে ছিল তাই সব প্রতিবন্ধকতা হাতে হাত রেখে মোকাবিলা করেছে। কনসিভ করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মতো মেডিসিন, এক্সারসাইজ, খাওয়াদাওয়া সব মেইনটেইন করে চলেছে দুজন মিলে। কিন্তু এই এক বছরে কোন সুখবর আসেনি। দর্শনের মা আকার ইঙ্গিতে অনেকবার বাচ্চা-কাচ্চার কথা বলেছে। ছেলের বয়স যাইহোক অর্ষার বয়স তো কম হলো না। তাছাড়া ছেলের বয়স যেমনই হোক বিয়ের পর মায়েরা নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চায়। অর্ষা তার এই চাওয়া বুঝতে পারলেও পূরণ করতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই আশা ছেড়ে দেয়, হতাশ হয়ে পড়ে, তখন দুচোখে দূর দূর পর্যন্ত হতাশা ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। জীবন তখন অর্থহীন মনে হয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে। ওওয়াশরুমে বসে বসে কাঁদে যেন কেউ দেখতে না পায়। বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। মনের ভেতর শূন্যতা অনুভব হয়। মনে হয় এই জীবনে যতটুকু আছে সেটাও হারিয়ে ফেলবে। কম চেষ্টা তো করছে না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই জুটছে না।
একদিন বিকেল বেলায় দর্শনের মা, দর্শনকে ডাকতে ওর রুমে যায়। অর্ষা তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ঘরে গিয়ে দর্শনকে না পেয়ে ফিরে আসছিলেন। দর্শন হসপিটালে যাবে। তাই ওকে খেতে ডাকতে গিয়েছিলেন কিন্তু ও ওয়াশরুমে। ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন আর ঠিক তখনই কিছু মেডিকেল ফাইল চোখে পড়ে। ফাইলের উপরে বাচ্চাদের ছবি। দর্শন হার্ট সার্জন তাই ওর হাসপাতালের ফাইল হতেই পারে না। হয়তো কোন বাচ্চার ফাইল অথবা কোন গর্ভবতী মেয়ের ফাইল। কৌতূহল নিয়ে ফাইল হাতে তুলে নিলেন। অর্ষার নাম দেখে চমকে গেলেন। মনে মনে আশা জাগল হয়তো ও প্রেগন্যান্ট, কিন্তু না। প্রথম পাতা দেখে ধারণা পালটে গেল। অর্ষা কনসিভ করার চেষ্টা করছে। পরের পাতাগুলো দেখে তার মন ভারী হয়ে গেল। তিনি একজন গাইনী স্পেশালিষ্ট। তাই বুঝতে কিছু বাকি নেই। এক বছর ধরে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে অর্ষা। ওর মধ্যে অনেক কমপ্লিকেশন রয়েছে। তাই কনসিভ করতে পারছে না। আরেকটা ফাইল রয়েছে নিচে। পারমিশন ছাড়া অন্যের জিনিস ধরা উচিত না কিন্তু তিনি কৌতূহল মেটাতে নিচের ফাইলটা হাতে নিলেন। ডেট দেখে বুঝতে পারলেন এই রিপোর্ট আট-নয় বছর আগের। অর্ষা আট-নয় বছর আগে কোন ট্রিটমেন্ট নিয়েছিল। রিপোর্ট পড়ে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অর্ষার অনেক সমস্যা আছে। ওর মা হওয়ার চান্স কম। এই জন্য এক বছর ট্রিটমেন্ট করে ফল পায়নি। নয় বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট চলছে। এত বড় একটা সত্যি লুকানো হয়েছে। উনাদের ঠকানো হয়েছে। যেহেতু এখনো ওর ট্রিটমেন্ট চলছে এর মানে দর্শন সবটা জানত। নিজের ছেলেও সত্যিটা লুকিয়ে আসছে। গোপনে ট্রিটমেন্ট করছে। যেখানে নিজের পেটের ছেলে এত বড় ধোকা দিয়েছে সেখানে পরের মেয়েকে কি বলবেন। চোখে পানি চলে এসেছে। চোখ মুছে দ্রুত তিনি ফাইল রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
রাতে খাবার টেবিলে সুনসান নীরবতা। দর্শনের মা মুখ ভার করে চুপচাপ খাচ্ছেন। দর্শন বাবাকে ইশারা করে কারণ জানতে চাইলে বাবা মাথা নাড়িয়ে জানায় কিছু জানে না। ওর মা ডালের বাটি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে অর্ষা এগিয়ে দেয়। অর্ষা এগিয়ে দেওয়ায় তিনি আর হাত দেননি। ডালও নেননি। মায়ের এহেন ব্যবহারে দর্শন আর অর্ষা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। বুঝতে পারছে না কেন নিল না, এর মানে কি অর্ষা উনার রাগের কারণ।
দর্শন সঠিকভাবে জানতে জিজ্ঞেস করল,
“মা, হাসপাতালে কিছু হয়েছে?”
“হাসপাতালে কি হবে? বাড়িতে সমস্যার অভাব যে অন্য জায়গা থেকে ধার করতে হবে?আফসোস হয় সারাজীবন কী করলাম? নিজের ছেলেমেয়েদের আপন হতে পারিনি। তাদের বিশ্বাস ও ভরসার পাত্র হতে পারিনি। ভালো ডাক্তার হতে পেরেছি, জীবনে অনেক নাম কামিয়েছি কিন্তু ভালো মা হতে পারিনি এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।”
সবাই উনার মুখের দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎ কি এমন হলো যে এমন কথা বলছে।
“কি বলছো মা? তুমি কখনোই ব্যর্থ মা হতে পারো না৷ আজ আমরা সফল তোমার জন্য। তুমি অবশ্যই একজন আদর্শ মা।”
দর্শনের মা তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর দর্শনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“আসলেই? যদি তোদের মনের কাছাকাছি থাকতাম, তোদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারতাম তবে আজ তোর কাছ থেকে ধোকা খেতাম না। এতবড় সত্য তুই আমাদের কাছ থেকে লুকাতি না।”
দর্শন বুঝতে পারছে না কোন সত্যি লুকিয়েছে ও।
“কি লুকিয়েছি মা?”
দর্শনের মা অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা খাওয়া থামিয়ে স্থির হয়ে আছে। ওর মা কঠিন গলায় বলল,
“এই যে অর্ষার মা হওয়ার চান্স খুবই কম। এই সত্যিটা তুই সবার থেকে লুকিয়েছিস। ঠকিয়েছিস তোরা।”
দর্শনের মা খাবার রেখে উঠে দাঁড়াল।কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ওর বাবা অবাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি এই সত্যিটা শুনে এই মুহুর্তে শকড। রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছেন। অর্ষা নিজের মুখ চেপে ধরল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দর্শন কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না।
অর্ষা ঘরে নেই। হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। দর্শনের কিছুই ভালো লাগছে না। কি করে অর্ষাকে স্বাভাবিক করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা খাবার টেবিলে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে গেল দর্শন। অর্ষাকে রেলিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। অর্ষা স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দর্শনের বুক কেঁপে উঠল। হাত-পা কাঁপছে ওর। কি করছে ও? কোন অঘটন ঘটাবে না তো?
চলবে……
#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৫০
“অর্ষা!”
আতংকিত, ভয়ার্ত কন্ঠস্বর শুনে অর্ষা চমকে গেল। চমকে গিয়ে ভয়ার্ত চোখেমুখে পেছনে তাকিয়ে আরেকটা ভয়ার্ত মুখ দেখতে পেল। দর্শন অজানা আশংকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে যাচ্ছে না। সামনে গেলে যদি লাফিয়ে পড়ে।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এই অন্ধকারে ওখানে কী করছো তুমি? তাড়াতাড়ি নেমে এসো। আমি হাত বাড়াচ্ছি। হাত ধরে আস্তে আস্তে নামো।”
দর্শন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে হাত বাড়াল। অর্ষা আরেকবার সামনের দিকে তাকাল। দর্শন বুঝতে পারছে না অর্ষা আদোও ওর হাতটা ধরবে কি না। মনে মনে প্রার্থনা করছে ওর হাতটা যেন ধরে। ওর প্রার্থনাই কবুল হলো। তবে অর্ষা ওর হাত ধরল না। প্রথমে এক পা নিচে নামিয়ে নিজেই লাফ দিয়ে নেমে গেল। দর্শন তাতে কিছু মনে করল না। অর্ষা নেমে এসেছে এই বেশি। যে ভয় পেয়েছিল। ভয়ের চোটে হার্ট এটাক করার অবস্থা।
“তুমি ওখানে কেন উঠেছিলে?”
অর্ষা মৃদু হাসল। সে হাসিতে সুখ নেই। আছে বিষন্নতা, আছে আকাশ সমান ব্যথা।
“কি ভেবেছিলে আত্মহত্যা করব? উহু, আমি এতটা দূর্বল নই। আত্মহত্যা করার হলে অনেক বছর আগেই করতাম। তখন সামলানোর মতো কেউ ছিল না এখন তো তুমি আছো। তখন একাই নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি, এখন পারবো না?”
“অর্ষা, আ’ম সো সরি। আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পাচ্ছো। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।”
দর্শনের কন্ঠে আকুতি।
অর্ষা ছলছল চোখে বলল,
“বলেছিলাম তোমাকে। বারবার বলেছি বিয়ের আগে ম্যাটারটা সলভ করো। করোনি। যদি করতে তবে আজ সিচুয়েশন এমন হতো না। একই বাড়িতে এভাবে কি করে থাকব?”
“মা তো তোমাকে কিছু বলেনি। যা বলার আমাকে বলেছে। আর আমার উপর রেগে আছে। তোমার উপর তার কোন রাগ নেই।”
“আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। কিছু না বলার চেয়ে মন খুলে সব বলা ব্যাটার। বাড়ির পরিবেশ দেখেছো? বাবাও কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করল। দু’জনেই আমার উপর অসন্তুষ্ট। এখন আমি কী করব? আল্লাহ কেন আমার উপর মুখ তুলে তাকাচ্ছে না? জানি না সামনে কি হবে। তাদের কী ডিসিশন হবে সেটা ভেবেই চিন্তায় মরে যাচ্ছি। দর্শন তারা কী সিদ্ধান্ত নিবে? তুমি আমাকে ডিভোর্স করবে না তো? তাহলে আমি মরে যাব।”
দর্শনের চোখে পানি চলে এল। অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অর্ষাও ওর টিশার্ট খামচে ধরে কাঁদছে।
“বোকা মেয়ে। তাদের সিদ্ধান্ত যাইহোক আমার সিদ্ধান্ত কখনো পাল্টাবে না। আল্লাহর কালাম সাক্ষী করে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। যত যাইহোক তুমি আমার আর আমি তোমার আছি আর থাকব৷ এতগুলো বছর পরে যখন এক হয়েছি আল্লাহর ইচ্ছে আছে আমাদের সারাজীবন এক সাথে রাখার। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। এত তাড়াতাড়ি কেন হার মেনে নিচ্ছো? একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘরে চলো।”
দর্শন অর্ষার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেল।
অর্ষা এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু দর্শনের ঘুম আসছে না। সকালে ডিউটি আছে ঘুমানো জরুরি কিন্তু ঘুম আসছে না। দর্শন বিছানা ছেড়ে বাগানে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে বাগানের আম গাছগুলো থেকে দু একটা পাখি ডেকে উঠছে। দর্শন বাগানের আলোয় চেয়ারে বসে পড়ল। আকাশের দিকে চেয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
আর বিরবির করে বলছে,
“হে আল্লাহ, মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবে? ওকে আর কষ্ট দিও না। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছি ওকে খুশি রাখতে। কিছু সময়ের জন্য ওকে তুমি অনেক খুশি দিয়েছো। কেন আবার ওর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিচ্ছো? সন্তান তোমার দেওয়া নেয়ামত। সেই নেয়ামত দান করে আমাদের ধন্য করো। আমাদের একটা সন্তান দেও। শুনেছি মাঝ রাত্রিতে তুমি বান্দার কাছাকাছি চলে আসো৷ তার ডাক শুনো। আমার মোনাজাত, আমার চোখের পানি কবুল করো। আমাদের একটা সন্তান দেও। তুমি সব দিয়েছো আমাকে। এখন তোমার কাছে সুসন্তান ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। কবুল করো।”
দর্শন অঝোরে কাঁদতে লাগল।
দর্শনের কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পড়ল। দর্শন চমকে পেছনে তাকাল। ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল,
“বাবা! তুমি এখানে?”
“তুমি এতরাতে এখানে কি করছো?”
দর্শন আশেপাশে তাকাল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“কিছু না। ওই এমনি ঘুম আসছিল না।”
তারপর দৃষ্টি লুকাল।
দর্শনের বাবা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বাবা হই তোমার। তোমাকে জানি আমি। এমন কাজ কেন করো যাতে একা একা কষ্ট পেতে হয়, দৃষ্টি লুকাতে হয়। তোমার মা-ও আজ অনেক কষ্ট পেয়েছে।”
“বাবা, তুমি আর মা দুজনেই চিকিৎসক। আর চিকিৎসক হয়ে রোগীর রোগ নিয়ে রাগান্বিত, রোগীর সাথে এমন ব্যবহার কি আদোও মানানসই?”
“তুমি যা ভাবছো বিষয়টা তা নয়। মানুষের রোগ-ব্যাধি থাকতেই পারে। রোগ আছে বলেই আজ আমরা ডক্তর কিন্তু তুমি পুরো ব্যাপারটা আমার আর তোমার মায়ের কাছ থেকে লুকিয়েছো। এত কষ্ট করে সন্তান মানুষ করে, তাকে বিশ্বাস ভরসা করে যদি জানতে পারি সে আমাদের থেকে দীর্ঘদিন যাবত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় লুকিয়েছে তখন মনে হয় ধোকা খেয়ে গেলাম। প্রকৃত বাবা-মা হতে পারিনি। সন্তানের কাছে বিশ্বাস আর ভরসার স্থান পাইনি। আসলে আমাদের ফিলিংসটা তোমাকে বুঝাতে পারছি না। যেদিন তোমার সন্তান হবে তখন বুঝবে। বাবামায়ের কাছে সন্তান কি জিনিস। যাইহোক, এসব নিয়ে আর ভেবো না। তোমার মায়ের সাথে আমি কথা বলব। সে আসলে হঠাৎ করে সবকিছু জানতে পেরে শকড হয়ে পড়েছে। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হলে তোমার মায়ের সাথে অর্ষার ট্রিটমেন্ট নিয়ে কথা বলে নিও।”
দর্শন বিশ্বাসের সাথে বলল,
“আচ্ছা। আশা করছি শীঘ্রই সব নরমাল হয়ে যাবে।”
ওর বাবা ভরসার দৃষ্টি দিল।
চলবে…….