পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ ছত্রিশ

0
355

পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ ছত্রিশ

মাথার উপর ফ্যানের নিরলস ভনভন শব্দ, বাহিরে ডাকা কাকের কণ্ঠ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে বাসনপত্র নাড়াচাড়া করার শব্দ। দর্শিনী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ক্রন্দনরত নিপার সামনে বসে আসছে। তার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের রাশি। ছোট বৌদিকে সে এখনও অব্দি রুক্ষ স্বরে কিছু বলে নি, তার আগেই মানুষটা কাঁদছে। এটা কী কেবল দর্শিনীর মন ভোলানোর জন্য!

“বৌদি,কান্নাটা বন্ধ করে আমাকে একটু খুলে বলবে প্লিজ,তুমি কার কথায় আমার সাথে এতটা ভালো অভিনয় করলে? আর আমার সাথে অভিনয় করার প্রয়োজনই বা কী ছিলো? আমি তো সর্বস্বহারা, তোমাকে তো অভিনয়ের পরিবর্তে কিছু দিতে পারবো না। তাহলে কিসের জন্য করলে এটা?”

দর্শিনীর কথার পরিবর্তে নিপা আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। কান্না টা ঠিক আসল না নকল বোঝা মুশকিল। কান্নার জন্য কেঁপে কেঁপে উঠেছে তার শরীর। কথা বলতে পারছে না সে। কণ্ঠ তার কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠেছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে এতক্ষণ কথা বলা ব্যাক্তিটার নাম্বারটা বের করে ফোনের স্ক্রিনটা দর্শিনীর সামনে ধরলো। দর্শিনী বার কয়েক পাপড়ি ঝাপ্টালো, সে ভুল দেখছে না তো! ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে “দৃষ্টান্ত” নাম টা।

দর্শিনী অবাকের সপ্তম আকাশে চলে গেলো। দৃষ্টান্ত ছোট বৌদিকে বলেছে তার সাথে ভালো আচরণ করতে! কিন্তু কেনো? দর্শিনীকে সুখী করার জন্য! নাকি অন্য কিছু? বৌদিও বা শুনলো কেনো ওর কথা! কিসের বাধ্যবাধকতা দৃষ্টান্তের সাথে বৌদির!

হাজের খানেক প্রশ্ন উত্তর বিহীন দর্শিনীকে বিচলিত করে তুললো। সে দৃষ্টান্তকে ভুল বুঝতে পারছে না অথচ দোষীর কাঠগড়ায় আজ দৃষ্টান্ত। ছোট বেলা থেকেই ভাইদের পর যে ছেলেটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো আজ সে মানুষটাকেই অবিশ্বাস করতে হবে! ভাগ্য তাকেই কেনো বার বার এমন পরীক্ষার মুখে ফেলে? তার সাথে এত নির্দয়তা কিসের!

দর্শিনী ক্লান্ত হলো ভাবতে ভাবতে। হাতড়ে পেলো না উত্তর। তবে আর নয়,যে যেমন ভাবে পারছে তাকে নাচিয়ে যাচ্ছে। আর কত?

দর্শিনী ক্রোধে ফেটে পড়লো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো তার। নিপার দিকে আঙ্গুল তাক করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“হয় আমাকে সবটা সত্যি বলো,নাহয় তুমি এ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য। কী চাচ্ছো তুমি?”

নিপা দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরলো। এ মুহূর্তে নিপার যেন কাউকে জড়িয়ে ধরার খুব প্রয়োজন ছিলো। আর সে জানে, জড়িয়ে ধরার জন্য দর্শিনীর চেয়ে উত্তম কেউ হবে না। কারণ এই মেয়েটা পিঠ পিছে ছুড়ি মারতে জানেনা।

নিপাকে অনবরত অসহায়ের মতন কাঁদতে দেখে নরম হলো দর্শিনী। শীতল কণ্ঠে বললো,
“বৌদি,আমার দোষ কী ছিলো গো? তোমাদের ঘাড়ে এসে বসাটাই আমার দোষ? তাই বুঝি একেকজন এমন রঙ বদলাচ্ছো? এসব করো না গো,ভীষণ কষ্ট হয় আমার। তোমাদের তো আমি বড্ড ভালোবাসি, তোমাদের আচরণ আমাকে যে শেষ করে দিচ্ছে। আমি চলে যাবো এ বাড়ি থেকে, তবুও রঙ বদলের খেলায় মেতো না তোমরা।”

নিপা শব্দ করে কাঁদলো। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দর্শিনীকে। অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমি রঙ বদল করি না গো প্রিয়। আমি তোমার সাথে একটু ভালো আচরণ করার চেষ্টা করেছি কেবল। ভালো হয়ে দেখি জীবন কতটা সুন্দর। আর দৃষ্টান্ত আমাকে অভিনয় করতে বলে নি। বলেছে তোমার সাথে ভালো আচরণ করতে। এখানে কোনো অভিনয় ছিলো না গো।”

“তাহলে তুমি নিজের ইচ্ছায় ভালো আচরণ করো নি? সবটা দৃষ্টান্ত দা এর কথায় করেছো! কিন্তু কেনো? তুমি তার কথাও বা কেনো শুনেছো!”

“কারণ বিয়ের এত গুলো বছর পরও আমি তাকে ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি।”

দর্শিনীর যেন মনে হলো সে ভুল শুনেছে। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে সে নিপার দিকে। এটা আদৌও সম্ভব! দৃষ্টান্ত দা কে ছোট বৌদি ভালোবাসে! তবে কি দৃষ্টান্তদা এর প্রথম প্রেমিকা ছোট বৌদি ছিলো? এ জন্যই কী ছোটদা এর বিয়ে হওয়ার পর দৃষ্টান্ত দা এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়ে ছিলো? অথচ দর্শিনী দৃষ্টান্তকে আগা হতে গোড়া অব্দি চিনতো। তবে কী চেনার মাঝে ভুল ছিলো!

দর্শিনী হতভম্ব মুখ খানা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তবে তুমিই কী ছিলে দৃষ্টান্তাদা এর প্রথম ভালোবাসা?”

নিপা মুখ চেপে ধরলো, কান্না ছিটকে যেন না বের হয় সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। দর্শিনী না থামতে বললো, না স্বান্তনা দিলো। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে এক ব্যর্থ প্রেমিকার আর্তনাদ দেখলো। মানুষটা তাহলে এ জন্যই সবসময় এত পাষান হয়ে থাকতো? বিয়ের ছয় সাত বছর পরও এ জন্য ই কী স্বাভাবিক হয় নি শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে!

দর্শিনীর সব প্রশ্নের উত্তর আছে নিপার কাছে সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই নিপাকে আপাতত একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন, নিপা আজ সব বলবে এটা দর্শিনী জানে। অনেকবছর যাবত বলতে না পারার যন্ত্রণা আজ নিপা উজাড় করবে। দর্শিনীও প্রস্তুত হলো সবটা শোনার জন্য।

নিপার কান্নার গতি থেমেছে তবুও কিঞ্চিৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে কণ্ঠধ্বনি। সেই কম্পিত কণ্ঠধ্বনি নিয়ে উচ্চারণ করলো তার যন্ত্রণাদায়ক অতীত,
“আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগের কথা। এই এলাকায় তখন আমার মামার বাড়ি ছিলো,আমার বেশ যাতায়াত ছিলো তাই এ গ্রামে। দৃষ্টান্ত আর আমি তখন কাছাকাছি বয়সেরই ছিলাম। আমার বয়স উনিশ কিংবা কুড়ি আর দৃষ্টান্ত বাইশ তেইশের সুপুরুষ। আমি খুব কমই গ্রাম ঘুরতে বের হতাম, একদিন অপরাহ্নে গ্রামের দক্ষিণ দিকের সূর্যমুখী বাগানের কাছে দৃষ্টান্তের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। দু’জনেরই টগবগিয়ে অনুভূতি হানা দিলো, অতঃপর শুদ্ধ প্রনয়। দু বছর বেশ ভালোই ছিলাম কিন্তু দু বছর পর আমার ভাগ্যে নেমে এলো কাল। দৃষ্টান্ত তখন ক্যারিয়ার নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত, বাবা ব্যস্ত আমার পাত্রের খোঁজে।

দৃষ্টান্ত বাবার কাছে কোন মুখে আমার হাত চাইবে? তখন সে বেকার। একদিকে ক্যারিয়ার, আরেকদিকে প্রিয়তমা। সে যখন দ্বিধার সাগরে ডুবন্ত প্রায় তখন তার ভিসা এলো। তার ঝলমলে ক্যারিয়ার গঠনের সবচেয়ে উত্তম সুযোগ। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। বেশ কড়া গলায় বললাম তাকে আমায় যেন ছেড়ে দেয়। সে মানলো না আমার কথা, শুরু করলো পাগলামি। আমার বাবার কান অব্দি গেলো সে পাগলামি। প্রচন্ড মার খেলো দৃষ্টান্ত। আমাদের গ্রামে গিয়েছিল আমাকে বুঝানোর জন্য, তখনই ভাড়াটে লোক দিয়ে অনেক মারলো তাকে। র*ক্তা*ক্ত দৃষ্টান্ত পরে রইলো পথের ধারে। শুধু মাত্র আমি তার পাশে এসে দাঁড়াবো সেই আশায়। কিন্তু আমি তখন শক্ত পদার্থ হয়ে গিয়েছিলাম। র*ক্তা*ক্ত দৃষ্টান্তকে দেখে হৃদয় আমার আরও পাষাণ হলো। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যা-ই হোক দৃষ্টান্ত আজ বেকার বলে আমার বাবা যে আচরণ করেছে একদিন তার জন্য লজ্জিত হবে। দৃষ্টান্তের ক্যারিয়ার দেখে সে আফসোসের দহনে পুড়বে। আমার অনীহায় মূর্ছা গেলো দৃষ্টান্ত ৷ প্রায় কত গুলো দিন নিরুদ্দেশ ছিলো। ততদিনে আমিও বসে গেছি বিয়ের পিঁড়িতে। মনের মাঝে রাজ্যের ক্ষোভ নিয়ে পা দিলাম তোমাদের বাড়ি। তুমি খেয়াল করে দেখো,আমি তোমাদের সবার সাথে কেমন আচরণ করতাম। আমি অতটাও অমানুষ ছিলাম না গো। পরিস্থিতি আমাকে এমন বানিয়েছে। আমার এমন স্বার্থপরতা সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টান্ত পাড়ি জমালো ভিনদেশ। আর আমি,আজও আরেকবার ভালোবাসার চেষ্টা করে যাচ্ছি তোমার ভাইকে। আজ আমি বুঝি,তোমাদের তো কোনো দোষ ছিলো না তবে এত অনীহা তোমাদের আমি কেনো দিলাম! তোমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছি নিজের মনগড়া ক্ষোভের কারণে। তখন মনে হতো তুমি হয়তো সবটা জানতে আমাদের প্রনয়ের কথা তবুও তুমি কোনো পদক্ষেপ নেও নি। অথচ এত গুলো বছর পর দৃষ্টান্ত আমার ভুল ভাঙলো সেদিন। তুমি না করা কাজের শাস্তি পেয়েছো এতদিন। আর আমিও কত বোকা, তখনের ষোলো বছরের কিশোরী কতটুকুই বা আমাকে সাহায্য করতে পারতো? ভালোবাসার কাছে মাঝে মাঝে সব যুক্তিতর্ক হেরে যায়। আজ বিয়ের সাতটা বছর যাবত চেষ্টা করছি তোমার ভাইকে ভালোবাসার কিন্তু তা আর পরলাম কই? আজও তো নির্দ্বিধায় বললাম আমি দৃষ্টান্তকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কী আর বার-বার হয় গো? এমন করে কত ভালোবাসার গল্প চাপা পড়ে বাস্তবতার নিচে। কেউ জানেনা, কেউ রাখে না সে খোঁজ। তবে হ্যাঁ, তোমার ভাইকে আমি স্বামীর অধিকার দিয়েছি। এতবছর তার সাথে থেকে বেশ শক্তপোক্ত একটা মায়া জন্মেছে তার প্রতি। যার জন্য চাইলেও আমি তাকে ছাড়তে পারবো না। ভালোবাসা অন্তরে পুষে বাঁচা যায় তবে মায়া কাটানো সম্ভব না। তবে আজীবনের জন্য ভালোবাসাটা থেকে যায় খুব গোপনে।”

দর্শিনী এতক্ষণ কেবল হা হয়ে শুনলো সব ঘটনা। হ্যাঁ, অনেকবছর আগে দৃষ্টান্তদা একবার নিখোঁজ হয়ে ছিলো। এরপর হুট করে বিদেশ চলে গেলো। দর্শিনীদের বাড়ি আসাও কমিয়ে দিলো। অথচ এত গুলো বছর সে কিছুটি টের পেলো না! কী অদ্ভুত!

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে নিপা এগিয়ে এসে দর্শিনীর দু’হাত চেপে ধরলো। ততক্ষণে তার কান্নাও থেমে গেছে। দর্শিনী প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো নিপার দিকে। নিপা তা দেখে মুচকি হাসলো। দু-হাত দিয়ে চোখের পাপড়িতে, গালে লেপ্টে থাকা জলের কণা গুলো মুছে অনুরোধের স্বরে বললো,
“দৃষ্টান্ত আরেক বার যেহেতু অতীত ভুলে ভালোবাসতে পেরেছে, তবে তার ভালোবাসাটা রক্ষা করো প্রিয়। ছেলেটা আবারও একই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না যে! একটা মানুষ আর কতবার প্রেমের দহনে পুড়বে বলো? মিলিয়ে দিও তাদের।”

দর্শিনী উত্তর দেওয়ার আগেই নিপা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দর্শিনী তপ্ত এক শ্বাস ফেললো। ব্যাথিত স্বরে নিজেই নিজেকে বললো,
“প্রেম অনলে পরলে প্রিয়,পুড়ে হবে ছাই,,
তবুও এ প্রেমের মাঝেই স্বর্গ খুঁজে পাই।”

উঠোনে পা রাখতে আরেকদফা চমকালো দর্শিনী। বড়বৌদি পিতলের বাটিখানায় পায়েস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি নেই আবার কাঠিন্যতাও নেই। কিন্তু বড়বৌদির এ আচরণে দর্শিনী রীতিমতো হতবাক।

#চলবে

[যতবারই ভাবি আজকের পর্বে অনেক গুলো ঘটনা উল্লেখ করবো ততবারই দেখা যায় একটা ঘটনা বিশ্লেষণ করতে করতে ১৩০০+ শব্দ হয়ে যায়। এরপর আর লেখার এনার্জি থাকে না। তবে একটা রহস্য শেষ,আমরা আরেকটা রহস্যের কাছে চলে যাবো খুব শীগ্রই। ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here