পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
পর্বঃ সাতাশ
উত্তপ্ত রোদে মানুষ তপ্ত শ্বাস ফেলে কূল পাচ্ছে না। ভাদ্র মাসের আদ্র গরমে প্রকৃতিও বোধহয় দিক ভ্রষ্ট। দর্শিনীদের গাড়ি মাত্র কোর্টের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চারপাশে ভীড়। ব্যস্ত পথচারীদের পদচারণে গরম যেন প্রতি মিনিটে মিনিটে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দর্শিনীর ফর্সা গোলগাল মুখ খানা লাল টকটকে হয়ে আছে। ঘামের জন্য কপালে লেপ্টে আছে চুল। কোমড় অব্দি লম্বা বেনীটা শোভা পাচ্ছে ঘাড়ের ডানদিকে। শরীরে ডুমুরফুল রাঙা শাড়ি। কপালে টিপ। সাথে মোটাসোটা শরীর। খুব আদুরে লাগছে তাকে। মনে হয় যেন একটু আদর করে তার গাল গুলো টেনে দিলে খারাপ হতো না।
মৃত্যুঞ্জয় গাড়ির ভেতর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এগিয়ে দিলো দর্শিনীর দিকে সাথে পকেট থেকে বের করা শুভ্র রাঙা রুমালটাও। দর্শিনী ভ্র কুঁচকে তাকাতেই চোখ দিয়ে ইশারা করে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“রুমালটা দিয়ে মুখটা মুছুন। আর জলটুকু খান তো। ঘেমে-নেয়ে কী বিশ্রী অবস্থা হয়েছে মুখটার। নিন ধরুন।”
দর্শিনী আশপাশ তাকালো। মনের মাঝে তার কেমন এক উত্তেজনা। মাঝে মাঝে শরীরটাও মৃদু কেঁপে উঠছে সেই উত্তেজনায়। এতদিন পর মানুষটাকে দেখে তার বুকের তোলপাড় ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে না তো আবার? ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে পারবে তো সে? নাকি বিক্ষিপ্ত অনুভূতি গুলো ছিটকে বেরিয়ে আসবে? পারবে তো সে নিজেকে সামলাতে? বরাবরই ভালোবাসার কাছে মানুষ বেহায়া হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে এসে সেও কী বেহায়ামি করবে?
হঠাৎ দর্শিনী অনুভব করলো তার মুখে আদুরে ছোঁয়া দিয়ে কেউ ঘাম টুকু মুছে দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলো হয়তো বাবা, কিন্তু পরক্ষণেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে দর্শিনী হতভম্ব। ছোট বৌদি এত আদর যত্ন করে তার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে! দর্শিনী যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। এই মানুষটিকে যে তার বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে।
নিপা ঘাম মুছতে মুছতেই জলের বোতলের মুখটা খুলে দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিলো। শীতল কণ্ঠে বললো,
“জলটা খাও,প্রিয়।”
দর্শিনী কাঁপা হাতে জলটা নিলো৷ ধীর গতিতে পান করলো। তন্মধ্যেই বহুল পরিচিত কালো চকচকে গাড়িটা তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। চির পরিচিত গাড়িটা দেখে আকষ্মিক নাকে মুখে জল উঠে গেলো তার। অনবরত সে কাশতে লাগলো। মৃত্যুঞ্জয়, প্রতাপ,দৃষ্টান্ত, নিপা হঠাৎ ই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টায় নিমজ্জিত হলো।
এর মাঝেই ছুটে আসলো বিহু। উৎকণ্ঠা নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে বৌদি? ইশ মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে তোর। রোদের মাঝে এখানে ওরে দাঁড় না করিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়েও তো বসাতে পারেন।”
বিহুর পিছে পিছে গাড়ি থেকে নেমে বিপ্রতীপ,মোহনা,মায়া,নিলয় কুমার হা হয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের নিজেদের চোখকে তারা বিশ্বাস করাতে পারছে না। এ কাকে দেখছে তারা? দর্শিনীর এ কি রূপ! সবার যেন হতভম্ব অবস্থা। পারছে না তারা এটা ভ্রম বলে উড়িয়ে দিতে আর না পারছে সত্য বলে মেনে নিতে। মোহনা হা হয়ে দর্শিনীর মুখ থেকে পা অব্দি চোখ বুলালো। ফুলে উঠা পেটটার দিকে গিয়ে দৃষ্টি আটকালো। চোখের পাতা পড়লো না, মনি নড়লো না।
মোহনার বিষ্ময় আকাশ ছুঁয়েছে। ছেলে আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে তাদেরও এক দশা। মোহনা বিপ্রতীপের কনুইয়ে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিলো। বিপ্রতীপের ধ্যান কাটলো। হতভম্ব ভাব এখনো বিদ্যমান। তার শরীর বেয়ে ঘামের সরু রেখা গড়িয়ে পড়ছে। সে মায়ের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে তার রাজ্যের কৌতূহল। মোহনা ছেলের দৃষ্টির মানে হয়তো বুঝলেন। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন,
“কিছু কী বোধগম্য হলো, বাবু?”
বিপ্রতীপ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“মা,আমাদের সন্তান! দর্শিনীর গর্ভে আমার অংশ তাই না?”
মোহনা হকচকালেন। কী উত্তর দিবে ভেবে না পেয়ে সামান্য চোখ রাঙালেন। বিপ্রতীপ পাত্তা দিলো না সে দৃষ্টি। ছুটে গেলো তার সামনে থাকা অসম্ভব সুন্দর নারীটির কাছে। হাত পা তার কাঁপছে। উত্তেজনায় শরীর মিইয়ে আসছে। কণ্ঠনালীতে মিছিল চালাচ্ছে অগণিত শব্দ কণিকা। কত কথা ভীড় জমিয়েছে ওষ্ঠ মাঝে।
দর্শিনীর তখন কাশি ফুরিয়েছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সব মিলিয়ে যেন তার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। শ্বাস নিতেও তার কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চোখে মুখে লোকটার রাজ্যের অস্থিরতা। চিন্তিত কণ্ঠে শুধালো,
“ঠিক আছেন প্রিয়দর্শিনী? একটু সাবধানে খাবেন তো জল। দেখি হাতটা,পালস টা দেখতে হবে। এত অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছেনও বা কেনো? আপনার কী অসুস্থতা অনুভব হচ্ছে? কথা বলুন প্রিয়দর্শিনী? আপনার কমফোর্ট জোন দরকার এখন। চলেন ভিতরে যাই।”
দর্শিনী মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে ভিতরে যেতে চায়। মৃত্যুঞ্জয়ের এতক্ষণের শাসন করা দৃশ্য দু চোখ ভরে দেখলো বিহঙ্গিনী। গত দু’মাস যাবত মানুষটাকে দেখে নি কিন্তু অনুভব করেছে রোজ। তার এমন অনুভবের কারণ তার জানা নেই। আবার হয়তো আছে। ফর্সা, সুঠাম দেহী মানুষটাকে কী মারাত্মকভাবে ভালো লেগেছে তার। কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া নিত্যান্তই বোকামী ছাড়া কিছুই না। আফসোসের এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে। চাপা কষ্টে মিইয়ে গেলো দর্শিনীর ভাবনা। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে সে তাকিয়ে রইলো।
“আমার বাচ্চা, আমার আমার বাচ্চা তাই না প্রিয়দর্শিনী? আমার ছোট্ট সোনামণি আসছে? তুমি আমাকে জানালে না? ও আমার তাই না প্রিয়দর্শিনী?”
বিপ্রতীপের চোখ মুখ উজ্জ্বল করা কথা শুনে দর্শিনী কাশি চলো গেলো। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া কমে গেলো। এতক্ষণ যে উত্তেজনাটা তার ভেতর কাজ করছিলো সেটা মিইয়ে গেলো। কেবল ঠোঁট জুড়ে বিচরণ করলো কুটিল হাসি। না তার এখন আর বুক আছড়ে এ মানুষটার জন্য কান্না আসছে না তবে মানুষটাকে দেখার যে গোপন তৃষ্ণা, সেটা মিটিয়ে নিয়েছে সে।
বিপ্রতীপ আরেক কদম এগিয়ে আসলো, দর্শিনীর পেটের দিকে আঙ্গুল তাকে করে বললো,
“ও আমার তাই না প্রিয়দর্শিনী?”
“দর্শিনী। কেবল দর্শিনী হবে। আর ও আপনার না, কেবল এবং কেবল মাত্র আমার। চলো বাবা ভিতরে যাই।”
প্রথম কথাটা শক্ত কণ্ঠে বললেও শেষের কথাটা নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো দর্শিনী। মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে বুঝে গেছে এ ছেলেটা কে। হাত তার মুঠ হয়ে এলো। তেড়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিপার গলা ভেসে এলো,
“আরে বিপ্রতীপ বাবু যে,তা কী খবর? নতুন বউ নিয়ে কেমন চলছে দিনকাল? নতুন বউ মনে হচ্ছে তত যত্ন করে না৷ এমন শুকিয়ে মরা কাঠ হয়েছেন যে!”
বিপ্রতীপ ভ্রু কুঁচকালো। সামান্য হলেও সে নিপাকে চেনে। এ মহিলা তো ননদের পক্ষ ধরে কথা বলার মানুষ না।
নিপা তাচ্ছিল্য হাসলো। মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আমাকে অত কী দেখছেন? নতুন করে আবার বিয়ে টিয়ে করার মতলব আছে নাকি? না ভাই আমার স্বামী আছে। বহু বিবাহ করার স্বাধ আমার নেই।”
নিপার টিটকারি মারা কথা যে সপাটে বিপ্রতীপের গালে চড় লাগিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিলয় কুমারও এবার সাহস করে এগিয়ে এলেন। বিনীত কণ্ঠে দর্শিনীর গোলগাল মুখ খানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কেমন আছো, মা? অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভীষণ মিষ্টি লাগছে। এই চার মাসেই তোমার সৌন্দর্য দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মনে হচ্ছে। এটাকেই হয়তো বাবার বাড়ির যত্ন বলে। তা দাদা, আপনি ভালো আছেন?”
প্রতাপ সাহাও বিনীত স্বরে উত্তর দিলেন,
“এইতো ভালো আছি ভীষণ। আমার মা আমার সাথে থাকে,রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। গত কত গুলো বছর তো চিন্তায় ঘুমাতে পারতাম না। এ বুঝি মেয়েটাকে আর দেখা হবে না ভেবে ভয়ে থাকতাম। এখন আর সে ভয়ও নেই। এর চেয়ে ভালো আর কী আছে?”
নিলয় কুমারের মাথা নত হলো। প্রতাপ সাহা কী বুঝাতে চেয়েছে তার বুঝতে বাকি নেই কারো। ক্ষেপে উঠলো মোহনা, ক্ষিপ্ত বাঘিনীর ন্যায় হিংস্র কণ্ঠে বলল,
“কেনো, কেনো আপনার মেয়ে বুঝি আমাদের কাছে নিরাপদ ছিলো না?”
“তোমার আচরণেই তোমার উত্তর লুকিয়ে, মোহনা। এবার মানুষ হও।”
স্ত্রীর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে বলে উঠলো নিলয় কুমার। মোহনা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে হলো এখানে কিছু বলা মানেই পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেওয়া। ছেলেটাও না আবার বেঁকে বসে।
মোহনা ধীর পায়ে পিছে নেমে গেলো। মায়া তখনো ঠাঁই দাঁড়ানো গাড়ির দরজা ধরে। মোহনা মায়ার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এখানে সঙ সেজে না দাঁড়িয়ে স্বামীকে আগলাও। হাত ছাড়া না হয়ে যায়।”
“হাতের মুঠোয় নিলামই কখন যে হাত ছাড়া হবে? আপনার ছেলে গোঁ ভাগাড়ে গিয়ে মরুক। তাতে আমার কী!”
মায়ার গা ছাড়া এমন উত্তরে মোহনার রাগটা শির শির করে বাড়লো। খুব বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলে উঠলো,
“তো বিয়ে করেছিস কেনো রে? শরীরে জ্বালা মিটানোর জন্য? পতিতা হলেই তো পারতিস।”
মায়ার সারা শরীর যেন ঘিন ঘিন করে উঠলো। মায়ের বয়সী মানুষের এমন কথা তার সহ্য হলো না। মহিলাটা বড় বলে বেঁচে গেলো নাহয় ঠাটিয়ে এক চড় দিতো সে। নিজের ঘৃণাটা নিজের ভিতর চাপা রাখলো না মায়া। বরং এক দলা থু থু মোহনার পায়ের সামনে ফেলে ধিক্কার দিয়ে বলল,
“মনে করুন আপনাকে চড়ের পরিবর্তে এই থু থু টা ফেললাম। আপনার মতন তো আর নিচে নামতে পারি নি নাহয় সেই শুভ কাজটাই করতাম।”
মায়ার কথায় কিছু একটা ছিলো যাতে থম মেরে গেলো মোহনা। হাঁটুর বয়সী মেয়ে তাকে চড় মারার ইচ্ছে পোষণ করেছে এর চেয়ে বড় অপমান যেন আর কিছুই হতে পারে না। হঠাৎ করেই তার মাথা ঘুরে উঠলো। তড়তড় করে ঘাম ছুটলো শরীর থেকে। বুকে কে যেন চেপে ধরলো মনে হয়। লুটিয়ে পড়লো সে মাটিতে। সবাই কেবল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। মায়া নিজেও হা হয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো সে বিশ্রী একটা কাজ করে ফেলেছে।
#চলবে
[উহুম,পাঠকমহল ভেবেছি রাতে আরেক পর্ব দিবো।]