#বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️,৯(শেষ পর্ব)
#লেখনীতে:সারা মেহেক
আজ সাগরিকার বিয়ে। পুরো বাড়িতে মানুষের সমাগম। চেনা অচেনা মানুষ দিয়ে পুরো বাড়িতে হইহট্টগোলপূর্ণ অবস্থা। সকাল হতে বিয়ে বাড়ি তুলনামূলক শান্ত হলেও বরযাত্রী আসার কিছুক্ষণ পূর্ব হতেই শুরু হয় গ্রামের মানুষদের কানাকানি ফিসফিস। বাড়িতে আগত মহিলা সম্প্রদায় এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি পুরুষেরাও আছে। প্রত্যেকের মুখে রটিয়ে গিয়েছে সুহানা ও নাজের একসাথে চলাফেরার বিষয়টি। সেদিন বৃষ্টির মাঝে ভ্যানে চড়া, ঘাটের কাছে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা, এই দুটো বিষয়কে সকলে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলেছে৷ ঘটনা ধীরেধীরে বড় অগ্নিকুণ্ডের ন্যায় পরিণত হচ্ছে। আর এতে ঘি ঢালার কাজ করছেন সিরাজ মাস্টার। ছোট বিষয়কে তেল মসলা মাখিয়ে সবার সামনে খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করছেন তিনি। এদিকে এসব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে চলছেন ওমর মোল্লা। প্রথম পর্যায়ে ‘না’ ‘না’ করলেও যখন দেখলেন এতে কোনো লাভ হচ্ছে না তখন তিনি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। ওদিকে রশিদা বেগম সুহানার পক্ষে না থাকলেও গলা চওড়া করে সবার আরোপ মিথ্যে প্রমাণিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এতে ধীরেধীরে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে ওমর মোল্লার বাড়ি। শান্তশিষ্ট বিয়ে বাড়ি পরিণত হলো মাছের বাজারে।
সুহানা ঘরে বসে কাঁদছে। নির্বাক চাহনিতে কাঁদছে। সে কখনো ভাবেনি এমন কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। সে এতোদিন যাবত দূর গ্রামের ঝগড়া ফ্যাসাদ শুনেছে, ছোটখাটো ঘটনায় ঘি ঢেলে আগুন বাড়াতে শুনেছে। কখনো স্বচক্ষে দেখেনি। আজ নিজের সাথেই এ মানহানিমূলক ঘটনা ঘটতে দেখে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, এসব মানুষ কখনো আপন হয় না।
কোনো সম্পর্ক না থাকাতেও সুহানা যাকে চাচি বলে ডাকতো সে মানুষটাও আজ সবার তালে তাল মিলিয়ে সুহানাকে যাচ্ছেতাই বলে চলছে৷ আজ যেনো কারোর মুখেই কোনো লাগাম নেই। এদিকে সাগরিকা না পারছে কিছু সইতে না পারছে কিছু বলতে৷ কারণ তার বলার মতো কিছুই নেই আজ। বোনের পক্ষ নিয়ে কিছু বলার মতো সাহস আজ সঞ্চার করতে পারছে না সে৷ সাগরিকা জানে, সুহানা এমন মেয়ে মোটেও না যেমনটা গ্রামের লোকজন তাকে বলছে।
রশিদা বেগমের মেজাজ তুমুল পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তিনি উঠোন হতে তেড়েমেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েন। অকথ্য ভাষায় সুহানাকে গালাগাল করতে করতে সুহানার গালে কষে একটা চড় মেরে দিলেন। গলার স্বর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে বললেন,
” বাপের মুখে কালি মাখায় শান্তি পাইছোস তুই? মুখপোড়া মহিলা৷ মরে যাইতে পারতেছিস না? যে ঘাটের কাছে গিয়া রঙ্গলীলা করছোস, সে ঘাটের কাছে গিয়া গলায় দড়ি দিয়া মর। ”
সুহানা পূর্বের ন্যায় কাঁদলো। তবে মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের করলো না। রশিদা বেগম থামলেন না। বরং মুখে যা এলো বলে গেলেন তিনি। সাগরিকা তাকে থামানোর চেষ্টা করলো না। সে স্তব্ধ। এ মুহূর্তে যেনো সে বোধ বিবেক শূন্য হয়ে পড়েছে। একদিকে বোনের উপর মিথ্যে লাঞ্ছনা, অন্যদিকে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সাগরিকা জানে, তাদেরকে ঘিরে এতো বড় একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যাওয়ার পর কখনো সরদার পরিবার তাকে নিজেদের বাড়ির বউ বানাবে না।
কিছুক্ষণের মাঝে গেটের বাইরে বরযাত্রীর আগমন ঘটলো। তারা বাইরে হতে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আয়োজন করে ভেতরে আসলেন না। বরং বরযাত্রীর প্রতিটি লোক এক প্রকার হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢুকলেন। বাড়িতে ঢুকেই তাদের কানে এলো সুহানার কথা। নাজ সুহানার সম্পর্কে এরূপ কথা শুনে বেশ অবাক হলো। তার বুঝতে বাকি রইলো না সুহানার সাথে তারই নাম জুড়ে তাদের বদনাম করা হচ্ছে। তন্ময়, মিরাজ, হাবিব, রাকিব ও রায়হান নাজের সম্পর্কে এরূপ কথা শুনে বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণ হা হয়ে রইলো। তন্ময় কিছু মহিলাদের কথা শুনে নাজের নিকট গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” কি রে নাজ! এসব কি বলছে এরা? ভাবীর বোনের সাথে তোর নাম!”
নাজ কোনো জবাব দিলো না। নাজকে দেখে এগিয়ে এলেন সিরাজ মাস্টার। নাজের উপর আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বললেন,
” এই যে এই শহুরে পোলার সাথে ঐ মাইয়ার কিছু চলতেছে। আমি সেদিন ঘাটের কাছে দেখতেছিলাম এই দুইটারে। ঐদিনই সকাল দিক বলে রহিম মিয়াও ওদের সন্দেহ করছে। ”
সিরাজ মাস্টারের কথা মাটিতে পড়তে না পড়তেই কয়েক বাড়ি পরের লতা চাচি তেড়ে এগিয়ে এলেন। নাজের দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,
” তুমি কি গ্রামডা তোমাগো শহর মনে করছো? এক সাথে বৃষ্টিত ভিজবা, তোমার জামা খুইল্লা ওরে দিবা, পুকুরের কাছে গিয়া সামনাসামনি দাঁড়ায় কথা বলবা, এগুলো কি ভালো কিছুর লক্ষণ? আর সুহানাই বা এমন হইলো কেমনে। জানা নাই, শোনা নাই, এমন পোলার লগে সারা গ্রাম ঘুইরা শেষ করছে। একবারো কি বাপ মার সম্মানের কথা মনে হইলো না!”
এই বলে লতা চাচি কয়েক কদম পিছিয়ে এলেন। এদিকে চারপাশ সবার চাপা গুঞ্জন, ছেলের নামে আরোপ শুনে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন নাজের বাবা ও মা। বিয়ে বাড়িতে এসে এতোটা অপমানিত হতে হবে তা কখন কল্পনাও করেননি তারা। লতা চাচির কথা শেষ হতেই নাজের মা এক প্রকার ধমকে উঠে বললেন,
” আপনারা কি মানুষ না কি অন্য কিছু? আপনাদের মধ্যে ভদ্রতা বলতে কিছু নেই? বস্তিতের মতো আচরণ করছেন কেনো? একটা ছেলে আর মেয়েকে এতোটা বাজেভাবে অপমান করার রাইট কে দিলো আপনাদের? ”
নাজের মায়ের কথা শুনে এগিয়ে এলেন রহিম মিয়া৷ গলা উঁচিয়ে বললেন,
” অপমান করার মতন কাজগুলান করলে তো অপমানই করবো। ঠিক না? আপনেই বলেন, যে পোলা, মাইয়ার বিয়ে হয় নাই সে পোলা মাইয়া একা একা কেমন বৃষ্টিত ভিজে। ছিঃ ছিঃ…..”
রহিম মিয়ার হেন কথার ধরণে পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন ওমর মোল্লা। তীব্র অপমানে মুষড়ে পড়লেন তিনি। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন যেনো। গলার উঁচু স্বর দিয়ে যেখানে প্রতিবাদ করার কথা ছিলো সেখানে আজ তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। মনে মনে বলছেন, ‘আমার মাইয়ারে আমি চিনি। আমার মাইয়া ওমন না। তোমরা কেন আমার মাইয়া দুইডারে শান্তি দেও না? ছোটডার বিয়েত কেন বড়ডার কথা নিয়ে আসলা? এহন কি আমার সাগরিকার বিয়া হবো?’
ওমর মোল্লার বিধস্ত চাহনি লক্ষ্য করলো নাজ। সে নিজেও ভেতর হতে ভেঙেচুরে গিয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে নিজের থেকে বেশি সুহানার চিন্তা তাকে দখল করে বসে আছে৷ ছেলে হয়েও এসব অপবাদ শুনে যেখানে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না সেখানে সুহানা নিজেকে কিভাবে ঠিক রেখেছে তা ভাবতেই শিউরে উঠলো নাজ। এদিকে সরদার পরিবারের প্রতিটি সদস্য, নাজদের পরিবারের সবাই হতবুদ্ধিকর একটি পরিস্থিতিতে পড়ে প্রায় দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা এসেছিলো সাগরিকাকে বাড়ির বউ করে নিতে। কিন্তু এ বাড়িতে এসে যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।
ওমর মোল্লার বাড়িতে ভীড়। লোকে লোকারণ্য হয়ে মাছের বাজারের ন্যায় পরিবেশ তৈরী হয়েছে। সেখানে চলছে চাপা গুঞ্জন, বানোয়াট ও মিথ্যে আরোপের ছুড়াছুড়ি। এসব দেখে আর নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না রায়হানের দাদা মোতালেব সরদার। হাত উঁচিয়ে এক হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি। তার হুঙ্কারে যেনো কেঁপে উঠলো ওমর মোল্লার বাড়ি। সকলে একবারেই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাড়িতে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। মোতালেব সরদারে হুঙ্কারে ঘর হতে ছুটে এলেন রশিদা বেগম ও সাগরিকা, ধ্যান ভাঙলো ওমর মোল্লার। মোতালেব সরদার চোখ পাকিয়ে কণ্ঠে কাঠিন্য মিশিয়ে বললেন,
” আমার অনুমতি ছাড়া এখন কেউ কথা বললে তার বিরুদ্ধে আমি কঠোর একটা ব্যবস্থা নিবো। এখন কথা বলবো শুধু আমি। ”
মোতালেব সরদারের এরূপ কথায় ভয় জেঁকে ধরলো ওমর মোল্লা ও রশিদা বেগমকে। দুজনের মনে আতঙ্ক তৈরী হলো সাগরিকার বিয়ে নিয়ে। তারা নিশ্চিত, সুহানার নামে এসব অপবাদ শুনে মোতালেব সরদার সাগরিকা ও রায়হানের বিয়ে ভেঙে। মনে এ ভয় নিয়ে দাওয়া ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়ালেন ওমর মোল্লা। এক দৌড়ে গিয়ে ধরলেন মোতালেব সরদারের পা। মুহূর্তেই দু চোখ ছাপিয়ে কান্নার ফোয়ারা নেমে এলো। ওমর মোল্লা কাঁদতে কাঁদতে আকুতি মিনতি করে বললেন,
” সাগরিকার বিয়ে ভাইঙ্গেন না সরদার। আপনার পায়ে পড়ি। আমার বড় মাইয়ার শাস্তি ছোট মাইয়ারে দিয়েন না। ওর তো কোনো দোষ নাই এতে। আমার মাইয়ার এতো বড় ক্ষতি কইরেন না সরদার। ”
এই বলে আরো আকুতি মিনতি করলেন ওমর মোল্লা। তার এরূপ করুণ কণ্ঠের আকুতি শুনে মোতালেব সরদার ওমর মোল্লার ঘাড় ধরে উঠে দাঁড় করালো। পূর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নরম কণ্ঠে বললেন,
” তোমার ছোট মেয়ের বিয়ে ভাঙবো না আমি। ওর তো এতে কোনো দোষ নেই। ও আমার নাতির পছন্দ। সাগরিকার বিয়ে রায়হানের সাথেই হবে। ”
মোতালেব সরদারের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন ওমর মোল্লা, রশিদা বেগম, সাগরিকা ও রায়হানসহ তার পুরো পরিবার। তারা সকলে ভেবেই নিয়েছিলো, মোতালেব সরদার এ বিয়ে ভাঙতে দ্বিতীয়বারও ভাববে না।
মোতালেব সরদার আবারো গলার স্বর উঁচু করলেন। বললেন,
” তবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাগরিকা আর রায়হানের বিয়ের পর সুহানা আর নাজেরও বিয়ে হবে৷ ”
মোতালেব সরদারের হেন কথা শুনে থমকে গেলেন নাজের বাবা ও মা। থমকে গেলো নাজ নিজেও। নতুন করে উঠলো চাপা গুঞ্জন। উপস্থিত সকলের চাহনি বিস্ময়াবহ।
মোতালেব সরদার পুনরায় বললেন,
” এখানে আসার পরপরই আমি একজনকে বলতে শুনেছিলাম, সুহানার গায়ে যে কলঙ্ক লেগেছে তাতে ভবিষ্যতে তার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তো যার সাথে সুহানাকে সবাই জুড়ে দিচ্ছে, সেহেতু তার সাথে বিয়েটা হয়ে যাক। এতে করে সুহানার জীবনে আর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন, নাজ ও সুহানার উপর যে আরোপ দেওয়া হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে নাজের নাম যেহেতু একটা মেয়ের সাথে এভাবে জুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেহেতু এ ঘটনায় নাজেরও ভুল আছে। সুতরাং নাজের দায়িত্ব পরে সুহানাকে বিয়ে করা এবং সে সুহানাকে বিয়ে করবেও। এ বিষয়ে আমি দ্বিতীয় কোনো মত শুনতে চাই না। ”
এই বলে মোতালেব সরদার ওমর মোল্লাকে বসার ঘর দেখিয়ে দিতে বললে ওমর মোল্লা তাকে নিয়ে বসার ঘরে যান। তার পিছু পিছু যায় বরযাত্রীর উপস্থিত লোকেরাও। নাজের বাবা মা যায় সবার আগে। কারণ নিজের ছেলের বিয়ে ঠিক করবে অন্য কেউ এটা তারা ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে মোতালেব সরদারের সাথে কথা বলতে হুড়োহুড়ি করে বসার ঘরে চলে যান তারা। আর নাজ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
.
সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো রায়হান ও সাগরিকা এবং নাজ ও সুহানার বিয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুহানার সাথে ছেলের বিয়ে মুখ বুজে মেনে নিলেন নাজের বাবা ও মা। একজন কৃষকের মেয়েকে তারা বাড়ির বউ করতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না৷ কিন্তু পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়ে মোতালেব সরদারের সিদ্ধান্তে রাজি হলেন নাজের বাবা মা। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে হলেও নাজ বেশ খুশি। প্রথম পর্যায়ে সে নাখুশ হলেও পরবর্তীতে সে ঠিকই খুশি হয়। কারণ সুহানাকে সে পছন্দ করে। কিন্তু এদিক দিয়ে সুহানা মোটেও খুশি নয়। তার মন মস্তিষ্কে এখনও লোকেদের দেওয়া অপবাদগুলো গুঞ্জন তুলছে। সে এখনও নিজেকে সামলাতে পারেনি।
সাগরিকা বিদায় নিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে। কিন্তু সুহানা এখনও তাদের বাড়িতে আছে। তার ক্ষেত্রে ঠিক হলো, আগামী এক মাস পর অনুষ্ঠান করে বাড়ির বউ হিসেবে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। আর কালকেই ঢাকায় ফিরে যাবে নাজ ও তার বাবা মা। নাজ জানে, তার বাবা মা এখনও মন থেকে বিয়েতে রাজি না। এজন্য সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকায় গিয়ে প্রথমেই সে তার বাবা মাকে রাজি করাবে যেনো সুহানাকে মন থেকে মেনে নেয় তারা। সে জানে, তার বাবা মাকে এতে রাজি করাতে হলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে। তবুও সুহানার জন্য তা করবে সে।
.
কেটে গিয়েছে একটা মাস। প্রকৃতি বদলিয়েছে তার রূপ। আগমন ঘটেছে নতুন এক ঋতু৷ বর্ষা ঋতু। বর্ষণময় বর্ষা ঋতুর আগমনে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়েছে এক নতুন রঙে। চারপাশে সবুজ সবুজ বৃক্ষরাজিরা নিজেদের আসল রঙরূপ দেখাচ্ছে রোজ। নদী ও পুকুরের পানি অঝোর আষাঢ়ে থৈ থৈ করছে। সে পানিতে রোজ সাঁতার কাটছে গ্রামের বাচ্চারা। সাঁতার কাটছে হাঁসরাও।
ঘরে বসে পাঞ্জাবিতে সেলাইয়ের কাজ করছিলো সুহানা। তার ইচ্ছে ঢাকায় যাওয়ার পর নাজকে প্রথমেই সে পাঞ্জাবিটা উপহার দিবে। এখন নাজ ও তার মাঝে বোঝাপড়া হয়েছে। প্রেমানুভূতি জেগেছে। সুহানা নাজকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। নাজের বাবা মাও সুহানাকে মেনে নিয়েছে। সবকিছুই মসৃণভাবে চলছে। নাজদের কোম্পানি নতুন একটা প্রোজেক্ট হাতে পাওয়ায় বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে আরো প্রায় দেড় মাস। এতে অবশ্য নাজ ও সুহানা দুজনেই খুশি হয়েছে। কারণ তারা দুজনেই নিজেদের ভালোমতো বুঝার জন্য কিছুটা সময় চাচ্ছিলো। আর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবো এ সময়টা পেয়ে দুজনেই খুশি হলো।
হঠাৎ নাজের কল আসায় চমকে উঠলো সুহানা। অসাবধানতাবশত হাতে একটুখানি সুঁই বিঁধে গেলো৷ তবে সেদিকে তোয়াক্কা করলো না সুহানা। ফোন নিয়ে এক দৌড়ে ঘাটের কাছে চলে এলো। তখনও নাজের ফোন বেজে চলছে। সুহানা নাজের কল রিসিভ করলো কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে। সে কল রিসিভ করতেই নাজ ওপাশ হতে ধীর লয়ে বললো,
” কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছো ঠিক না?”
সুহানা ঈষৎ হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলো,
” হ্যাঁ।”
নাজ মুচকি হাসলো। নিশ্চুপ রইলো ক্ষণিকের জন্য। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা? আমি প্রতিবার কল করলে তুমি ওখানে গিয়ে কথা বলো কেনো সুহানা?”
সুহানা নাজের প্রশ্নে মৃদু শব্দে হাসলো। কৃষ্ণচূড়া গাছটির সাথে হেলান দিলো। এখন গাছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে অসংখ্য সবুজ পাতার মাঝে কিছু সংখ্যক লাল কৃষ্ণচূড়া মানিয়েছে দারুণ। সুহানা মুচকি হেসে সেই কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোর দিকে চেয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
” কারণ আপনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ এই কৃষ্ণচূড়ার নিচেই। ”
” মনে আছে সে ঘটনা?”
” মনে থাকা কি স্বাভাবিক না?”
” উমমম, বোধহয় না। ”
” কেনো না?”
” কারণ তখনও তুমি আমাকে চিনতে না, ভালোবাসতে না। ”
” কিন্তু এখন যে চিনি। আর আপনাকেও ভীষণ ভালোবাসি। এই অনুভূতির টানেই সেই ঘোলাটে স্মৃতিকে সাফ করে স্পষ্ট করে তুলেছি। ”
মৃদু হাসলো নাজ। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, সুহানা? তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? কেমন ভালোবাসি?”
সুহানা জবাব দিলো,
” উঁহু। জানা নেই। ”
” আচ্ছা, আজ তবে জেনে নাও….. আমি তোমাকে বৃষ্টির সেই প্রথম ছোঁয়ার মতো ভালোবাসি। প্রকৃতির প্রথম বর্ষণের মতো ভালোবাসি। জারুল ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো ভালোবাসি। বাদলা দিনের কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো ভালোবাসি। ”
মুগ্ধতায় চোখ বুজে এলো সুহানার। হৃদয়ে অনুভব করলো অপার শান্তি। হঠাৎ দূর গগনে গর্জে উঠলো মেঘ। সুহানা চোখ মেলে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশটা বড্ড মেঘলা। ঘোর কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। হয়তো এখনই বৃষ্টি নামবে।
আরম্ভ হলো শীতল হাওয়ার আনাগোনা। ক্রমেই বৃদ্ধি পেলো তার গতি। সে হাওয়ার দোলে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো ঝরতে শুরু করলো। এভাবেই একটা কৃষ্ণচূড়া এসে পড়লো সুহানার কাছে। সুহানা তা উঠিয়ে হাতের মুঠোয় নিতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লো তার গালে।
সুহানার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি৷ সে ফোনের স্পিকার মুখের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” প্রকৃতি আপনার ভালোবাসার বার্তা নিয়ে এসেছে নাজ। আজ বাদলা দিনে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো আমার হাতে ধরা দিয়েছে। ভালোবাসি আপনাকে। ভীষণ ভালোবাসি। ”
❤️❤️❤️ সমাপ্ত❤️❤️❤️