গোধূলির_রাঙা_আলোয় লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ০২

0
348

#গোধূলির_রাঙা_আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০২

ভাবি, মা তোমাকে নিচে যেতে বলেছে।

ননদের আওয়াজ কানে যেতেই তিয়াসা চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। মাগরিবের নামাজ পড়ে বেলকনিতে বসেছিলো মুগ্ধকে কল করতে।

তিয়াসা গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো, আমি আসছি মিশু তুমি যাও।

মিশু আর কিছু না বলে দরজার ওপার থেকে নিচে চলে গেলো। তিয়াসা ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলো।

মিসেস আনোয়ারা হাসি মুখে বললো, বৌমা একটু নাশতা বানাও তো। তামান্নাকে নিয়ে শুদ্ধ হয়তো চলে এলো বলে। এখনো তো ডিনারের অনেক সময় বাকি আছে। হালকা নাশতা করে নিবে বরং ওরা।

মিশু মায়ের কাছে সোফায় বসে বললো, আপু কী একা আসছে ?

না, ওর বান্ধবী আছে না উৎসা, ঐ মেয়েটাও আছে। ভার্সিটির হোস্টেল খোলে দিলেই সেখানে চলে যাবে।

তিয়াসা কিচেনে যেতে যেতে বললো, ওরা তো চাইলে আমাদের বাড়িতেই থাকতে পারতো।

আনোয়ার বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমি বলেছিলাম মনুকে(তামান্নার মা মনোয়ারা)। কিন্তু ও বললো এখানে আসছে পড়াশোনার জন্য। তামান্না এমনিতেই ফাঁকিবাজি করে আমাদের বাসায় থাকলে আরো করবে। হোস্টেলে থাকলে তাও যদি একটু পড়াশোনা করে।

তিয়াসা আর কিছু না বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অনেকক্ষণ ধরে শাশুড়ীকে মুগ্ধর কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

উসখুস করে একসময় বলেই ফেললো, মা উনার সাথে আপনার কথা হয়েছিলো আজ ?

আনোয়ারা বেগম গম্ভীর গলায় বললো, হয়েছে। কেনো তোমার সাথে কথা বলেনি ?

তিয়াসা আমতা আমতা করে বললো, আমার ফোনে একটু সমস্যা হয়েছে।

থাক মা শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না। আমিও বাঙালি নারী তাই জানি স্বামী যা ইচ্ছে করুন আমরা তাদের দোষ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে যাই।

তিয়াসা শাশুড়ীর কথা এড়িয়ে বললো, কবে আসবে জানিয়েছে কিছু ?

বললো তো আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে।

আর কোনো কথা হলো না শাশুড়ী বৌমার। তিয়াসা নাশতা বানাতে লাগলো আর আনোয়ারা বেগম মিশুকে নিয়ে টিভি দেখছে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠলো।

মিশু লাফ দিয়ে উঠে বললো, তামান্না আপুরা মনে হয়ে চলে এসেছে।

মিশু গিয়ে দরজা খোলে দিতেই তামান্নাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো আর পেছনে উৎসা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

মিশু বললো, কেমন আছো আপু ?

তামান্না বললো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস ?

আলহামদুলিল্লাহ।

তামান্না আর উৎসা ভেতরে চলে গেলো। উৎসার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো তামান্না। কুশলাদি বিনিময়ের পর ওদের রুম দেখিয়ে দেওয়া হলো। শুদ্ধ গাড়ি পার্ক করে এসে সোজা নিজের রুমে চলে গেছে। তামান্না আর উৎসা ফ্রেশ হয়ে এসে তিয়াসার বানানো নাশতা খেয়ে নিলো। সবার সাথে অনেকটা সময় গল্প করার পর একেবারে ডিনার করেই রুমে এলো। তামান্না রুমে এসেই ধপাস করে শুয়ে পড়লো।

উৎসা বিরক্ত হয়ে বললো, তুই আবার ঘুমাবি এখনই ?

তামান্না হাই তুলে বললো, রাতের বেলা ঘুমাবো না তো কী করবো ?

তোর ঘুমাতে আবার রাত লাগে নাকি। পারলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ছাব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাতি।

উৎসা কথা শেষ করে খেয়াল করলো তামান্না ঘুমিয়ে পড়েছে অলরেডি। ওদের দু’জনকে একই রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। উৎসা কিছুটা সময় তামান্নার দিকে তাকিয়ে থাকলো। যদি সেও পারলো এভাবে শান্তিতে একটু ঘুমাতে। শেষ কবে একটু শান্তিতে ঘুমিয়েছিলো মনে পরে না উৎসার। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো রুমটা। মোটামুটি বেশ বড় একটা রুম, আসবাবপত্র বলতে একটা বেড, বেডের সাথে সাইড টেবিল, কাবার্ড, ড্রেসিংটেবিল, একটা বুক সেলফ। বেলকনির দিকে নজর পড়তেই উৎসা সেদিকে এগিয়ে গেলো, বেশি বড় নয় ছোট একটা খোলা বেলকনি। কয়েকটা গাছ লাগানো আর বাকি জায়গা খালি। উৎসা ফ্লোরেই বসে পড়লো আর আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে সেটার সাথে কথা বলতে লাগলো উৎসা। ছোটবেলা থেকেই হোস্টেলে থেকেছে উৎসা। তাই তার সবচেয়ে প্রিয় আর কাছের হচ্ছে চাঁদ মামা। নিজের সব কথা তাকেই বলে। পাশের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো শুদ্ধ সেটা উৎসা খেয়াল করেনি। উৎসাকে একা একা কথা বলতে থেকে খানিকটা অবাক হলো কিন্তু পরে বুঝতে পারলো চাঁদের সাথে কথা বলছে৷ মেয়েটার বাচ্চামিতে মুচকি হাঁসলো শুদ্ধ। কফি শেষ হতেই নিজের রুমে চলে গেলো শুদ্ধ তবে উৎসা বেলকনিতেই বসে রইলো।

২.
পরদিন সকালে মিশু ডাকে তামান্না আর উৎসা ব্রেকফাস্ট টেবিলে গেলো। টেবিলে শুধু বাড়ির মেয়েরা উপস্থিত। শুদ্ধর দেখা মিললো না কোথাও ?

তামান্না বললো, খালামুনি শুদ্ধ ভাইয়া কোথায় ?

আনোয়ারা বেগম বললো, সে তো কোন সকালে হসপিটালে চলে গেছে৷

উত্তরে তামান্না ছোট করে বললো, ওহ্।

তারপর আর কোনো কথা হলো না সবাই খাওয়া শেষ করে করে নিলো। সারাদিন বাড়িতেই কেটে গেলো গল্পগুজবে। সারাদিনেও আর দেখা মিললো না শুদ্ধের। মাগরিবের নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে বসে ছিল সবাই, তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। এবার তামান্না দরজা খুলতে চলে গেলো। দরজা খোলে দেখা মিললো ক্লান্ত মুগ্ধের। তিন দিন পর মুগ্ধের দেখা পেয়ে তিয়াসার মনে মরুর বুকে যেনো এক পশলা বৃষ্টি হলো। টলমলে চোখে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তবে মুগ্ধের যেনো একটু সময় হলো না তিয়াসার দিকে তাকানোর। এদিকে দুজনকেই খেয়াল করলো উৎসা। এই পরিবার সম্পর্কে যতটা জানা দরকার ততটা তামান্না তাকে জানিয়েছে। তিয়াসা আর মুগ্ধর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না সে। মনে একটু সন্দেহের উৎপত্তি হলো তার।

মুগ্ধ তামান্নাকে দেখে বললো, কী রে পুচকি কবে এলি তুই ?

তামান্না গাল ফুলিয়ে বললো, আবার পুচকি ?

মুগ্ধ তামান্নার মাথায় থাপ্পড় মেরে বললো, আমি তোর পাক্কা ১২ বছরের বড়। তারমানে তুই আমার সামনে পুচকি হলি তাই না ?

তামান্না কোমরে দু-হাত রেখে বললো, মিশু তো আমার থেকেও দু’বছরের ছোট তাহলে ও কী ?

মুগ্ধ মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, ও তো পিচ্চি।

মাহির দিকে তাকাতেই উৎসাকে দেখতে পেলো মুগ্ধ আর প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে বললো, পাশের পুচকিটা কে ?

মুগ্ধের কথায় থতমত খেয়ে গেলো উৎসা। তিয়াসা তখনো তাকিয়ে আছে মুগ্ধের দিকে। এতো মানুষের সাথে কথা বলার সময় হচ্ছে তার কিন্তু তার দিকে তাকানোর সময়ও নেই মানুষটার।

আনোয়ারা বেগম বৌমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, এতদূর থেকে এসেছো আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর সবার সাথে কথা বলতে পারবে।

মুগ্ধ তামান্নার মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেঁসে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

আনোয়ারা বেগম তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো, বৌমা যাও দেখো কিছু লাগবে কিনা ওর।

তিয়াসা যেনো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। দ্রুত রুমে চলে গেলো। রুমে এসে দেখলো মুগ্ধ নিজের শার্টের বোতাম খুলছে। তিয়াসা এগিয়ে এসে মুগ্ধের হাত সরিয়ে নিজে বোতাম খুলে দিতে গেলে মুগ্ধ তার হাত ধরে ফেললো।

তিয়াসা করুন চোখে তাকিয়ে বললো, আর কত রাগ করে থাকবেন আমার উপর ?

মুগ্ধ বিরক্ত গলায় বললো, এমনিতেই ক্লান্ত তোমার অভিনয় দেখার একটুও ইচ্ছে নেই আমার।

তিয়াসা ভেজা গলায় বললো, আমি অভিনয় করি ?

মুগ্ধ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, তোমার থেকে ভালো অভিনয় হয়তো আমাদের দেশের কোনো অভিনেতাও করতে পারবে না। তারা তো ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেও ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু তুমি চব্বিশ ঘণ্টা সবার সামনে অভিনয় করেও ক্লান্ত হও না। তাই আমার সামনে অন্তত তোমাকে অভিনয় করতে হবে না। এটুকু সময় আমি তোমাকে অভিনয়ের থেকে মুক্তি দিলাম।

মুগ্ধ নিজের টাওয়েল আর পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শার্ট পড়েই। তিয়াসার এতক্ষণ আঁটকে রাখা নোনাজল আর বাঁধ মানলো না। সেখানে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। মুগ্ধ ফ্রেশ হয়ে এসে তিয়াসাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কিছু বললো না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে লাগলো।

হঠাৎ তিয়াসা বলে উঠলো, আচ্ছা আপনাকে মুক্তি দিলে খুশি হবেন ?

হঠাৎ তিয়াসার এমন কথায় অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধ। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, এতো অভিনয় করে আমার গলায় ঝুলেছ ছেড়ে দেওয়ার জন্য ? কথাটা ঠিক হজম হলো না।

কথাটা একটু বেশি আঘাত করলো তিয়াসাকে। মুগ্ধ পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো আর তিয়াসা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মনে করতে লাগলো সেই অভিশপ্ত দিনের কথা।

তিয়াসার এলাকার মাদকাসক্ত এক ছেলে জোর করে তাকে বিয়ে করতে চাইলে তিয়াসা বলেছিলো তার অফিসের বসের সাথে তার সম্পর্ক আছে। এতেও ছেলেটা মানতে না চাইলে তিয়াসা বলেছিলো তারা গোপনে বিয়ে করেছে আর সে প্রেগনেন্ট। তখনই সেই ছেলে অফিসে গিয়ে ইচ্ছে মতো অপমান করেছিলো তিয়াসার বসকে। সেই বসই ছিলো মুগ্ধ আর অফিস থেকে এসব কথা বাসায় আসতে সময় নেয়নি। আনোয়ারা বেগম ছেলের কথা বিশ্বাস না করে মানসম্মান রক্ষার জন্য মুগ্ধের সাথে আবার বিয়ে দিয়ে সসম্মানে এবাড়িতে নিয়ে আসে তিয়াসাকে। তিয়াসার বাবা-মাও ভুল বুঝে বিদায়ের সময় বলেছিলো আজ থেকে তাদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। সবকিছু এতো দ্রুত হয়েছিলো মুগ্ধ কিছু বুঝে উঠতেই পারেনি। যখন সবকিছু বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মুগ্ধ আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টাও করেনি। তবে তিয়াসা নিজের ভুলের মাশুল দিচ্ছে রোজ। তিয়াসা প্রথম থেকে ভালোবাসতো মুগ্ধকে তাই তার নামই বলেছিলো বিপদের সময়। তিয়াসা চোখমুখ মুছে নিজের ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করলো। ফোনে কারো সাথে কথা বলে ফোনটা বুকে আঁকড়ে ধরলো।

বিড়বিড় করে বললো, দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। আমি না দূরে থেকেই ভালোবাসবো আপনাকে।

মুগ্ধ সোজা ছাঁদে চলে গেলো। সিগারেটে একটা টান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যস্ততার মাঝে এক টুকরো প্রশান্তি যাকে মনে করেছিলাম সেই সবার সামনে আমাকে নিচু করে দিয়েছে। বাবা-মায়ের সামনে ছোট করে দিয়েছে। ভালো তো আমিও বেসেছিলাম কিন্তু সেটা তুমি প্রকাশ করার সুযোগও দাওনি আমাকে। কীভাবে এতো সহজে মাফ করবো তোমাকে ?

চলবে,,,
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/485400769848367/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here