#বিষাক্তফুলের_আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-২৭
সমুদ্র সৈকতে সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। শীতল বাতাসে শাড়ীর আঁচল বাধাহীন হয়ে উড়ছে। তাজ মুচকি হেসে পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেলো সেই রমণীর দিকে।
তুমি সবসময় সাদা কেনো পড়ো মুসকান ?
হকচকিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে তাজকে দেখে আবার সামনে তাকলো তিতির, সাদা আমার বাবার প্রিয় রং ছিলো। সাদা রংটা আমার সাথে থাকলে মনে হয় বাবাও আমার সাথেই আছে।
তাজ এবার সামনে তাকালো, বাবাকে খুব ভালোবাসতে বুঝি ?
পানি এলো তিতিরের চোখে, হুম।
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, চলো সামনে হাঁটি।
তাজের কথায় তিতির সম্মতি জানিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।
হাঁটতে হাঁটতে তিতির বললো, আপনার তো শুটিং আছে স্যার।
তাজ বিরক্ত বোধ করলো, এতো কাজ কাজ করে আর ভালো লাগে না। এই মুভির হিরোইন মিস রোমানা খুব গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে। এমন মেয়ের সাথে কাজ করতে হচ্ছে, ভেবেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। কন্ট্রাক্ট করায় কিছু বলতেও পারছি না, লাস্ট মুহূর্তে এসে হিরোইন কেনো চেঞ্জ করলো বুঝতে পারছি না।
তাজের কথায় তিতির আড়ালে মুচকি হাসলো, রোমানা ম্যাম তো খুব ভালো অভিনয় করে।
তাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো তিতিরের দিকে, তুমি রোমানাকে ম্যাম কেনো বলছো ?
উনি আপনার কো-অ্যাক্টর। আপনি যেহেতু আমার স্যার তাহলে উনি তো ম্যামই হবেন।
আমি তোমার স্যার হলেও আমার আশেপাশের কেউ তোমার স্যার বা ম্যাম নয়। কথাটা আজ ভালো করে শুনে নাও আর কখনো যেনো এদের স্যার বা ম্যাম বলতে না শুনি।
তিতির মাথা নাড়িয়ে বললো, ওকে স্যার।
তাজ মুচকি হেসে বললো, গুড।
আবার কিছুটা সময় নিরবতায় পাশাপাশি হাঁটতে লাগলে হঠাৎ তাজ বললো, বুঝলে মুসকান তোমার হাসবেন্ড অনেক লাকি হবে।
তাজের কথায় লজ্জায় লাল হলো তিতিরের মুখ, কেনো স্যার ?
তাজ একটু শব্দ করে হেসে বললো, এই যে তুমি কথা কম বলো তাতে তোমাদের ঝগড়া হবে কম। মেয়েদের ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদার স্বভাব, সেটাও তোমার নেই। তোমার পিছনে তোমার হাজবেন্ডকে মেকআপ খরচ করতে হবে না, গাদা গাদা শপিং করতে হবে না। উফফ আমার এসব ভাবতেই তোমার ফিউচার হাসবেন্ডের উপর হিংসা হচ্ছে।
তাজের কথা শুনে তিতির লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
তাজ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো, একি মুসকান তুমি তো দেখি লজ্জা লাল নীল হয়ে যাচ্ছো।
তাজ কথা শেষ করে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। তিতির মাথা নিচু করে লজ্জায় মুচকি হাসছে, তাজ দেখতে পেলো না সেই হাসি। দেখতে পেলে হয়তো বলতো তোমার মুসকান নাম সার্থক। হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু তীক্ষ্ণ অনুভব করলে তিতির আউচ বলে উঠে।
তাজ ব্যস্ত গলায় বললো, কী হলো মুসকান ?
স্যার, পায়ে কিছু ফুটলো মনে হয়।
তাজ হাঁটু গেড়ে বসলো তিতিরের সামনে, কোথায় দেখি ?
তিতির ছিটকে একটু পিছিয়ে গেলো, কী করছেন স্যার ?
তাজ গম্ভীর গলায় বললো, দেখাও বলছি।
তাজ সবসময় হাসিখুশি থাকে তাই তার গম্ভীর গলায় ভয় পায় তিতির। কথা না বাড়িয়ে শাড়ি একটু উঁচু করে পা দেখালো।
তাজ কিছু না ভেবে তিতিরের পা নিজের হাঁটুর উপর নিলো। তিতির কেঁপে উঠলো তাজের স্পর্শে, নিজের ব্যালেন্স রাখতে তাজের কাঁধে হাত রাখলো।
তাজ কণ্ঠের গম্ভীরতা বজায় রেখে বললো, তুমি খালি পায়ে সমুদ্র সৈকত কেনো এসেছো তিতির ? জানো না সৈকতে অনেক মরা শামুক থাকে। এখন গেলো তো পা কেটে।
তাজ যখন ভালো মুডে থাকে তিতিরকে তখন মুসকান বলে ডাকে আর যখন রেগে থাকে তখন তিতির বলে। তাই তিতির বুঝতে পারলো তাজ রেগে গেছে।
আমতা আমতা করে বললো, আসলে স্যার সমুদ্র সৈকতে বালির উপর খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো।
তাজ নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে তিতিরের পায়ে বেঁধে দিলো, নাও এবার হয়েছে ইচ্ছে পূরণ। এখন চলো ডক্টরের কাছে, শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে আছে কিনা কে জানে।
তিতির কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাথা করছে খুব কিন্তু তাজের ভয়ে মুখে বলতেও পারছে না। নিজের বোকামির উপর নিজের রাগ হলো। তিতির যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত তখনই তাজ তিতিরকে কোলে তুলে নিলো।
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তিতিরের, কী করছেন স্যার ?
অনেকটা কেটেছে হাঁটতে পারবে না আর যদি শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে থাকে তাহলে হাঁটলে আরো ভেতরে চলে যাবে।
তাজ হয়তো দায়িত্ববোধ থেকে এসব করছে তবু তিতির লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার ৷ শেষে কিনা স্যারের কোলে উঠতে হলো তাকে।
তাজ বললো, এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি। একজন অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করছি মানুষ কিছু মনে করবে না।
স্যার এভাবে আমাকে আর আপনাকে একসাথে কেউ দেখলে মুখোরোচক নিউজ বানাবে।
কেনো আমাকে চেনা যাচ্ছে বুঝি ?
এতক্ষণে তিতিরের খেয়াল হল তাজ একটা হুডি পড়েছে আর মুখে মাস্ক লাগানো। সে চিনলেও অন্যকারো চেনার উপায় নেই তাজকে।
তাজ ভ্রু নাচিয়ে বললো, আমি তোমার মতো মাথামোটা নই মিস রোবট।
তাজ তিতিরকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলে ডক্টর দেখে বললো শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে আছে। তাজ পাশে দাঁড়িয়ে রইলো আর ডক্টর শামুক বের করার জন্য তুলো দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছে। ভাঙা অংশ বের করতে গেলে তিতির চোখমুখ কুঁচকে তাজের হাত খামচে ধরে। তিতিরের হাতে লম্বা লম্বা নখ রাখা না থাকলেও যেটুকু আছে তাজের হাতে ডেবে গেলো। তিতিরকে কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করলো তাজ। ড্রেসিং শেষে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর তাজের হাতের দিকে খেয়াল গেলো তিতিরের।
ভয়ে আঁতকে উঠল, আম সরি স্যার। আমি বুঝতে পারিনি।
তাজ মুচকি হেসে বললো, ইট’স ওকে। তোমার এখনও ব্যাথা করছে ?
তিতির মাথা নাড়িয়ে বুঝালো করছে না ব্যাথা। আসলে তাজের হাত দেখে তিতির নিজের ব্যাথার কথা ভুলে গেছে। তাজ ডক্টরের থেকে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিলো নিজের হাতে। বাকি সময় তিতির আর স্বাভাবিক হতে পারলো না। বারবার চোখ চলে যেত তাজের হাতের দিকে আর ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত।
৩১.
মাথায় কোমল হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙলো তাজের। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো তার মাথার কাছে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে।
তাজকে তাকাতে দেখে বললো, তুমি এখানে ঘুমিয়ে আছো কেনো বাবা ?
তাজ খেয়াল করে দেখলো সে তিতিরের কবরের উপর ঘুমিয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তখন এলোমেলো পায়ে এখানে এসে শুয়ে পড়েছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারেনি। ঘুমের মাঝে চোখে ভাসছিল তিতিরের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত। তাজ উঠে এলো সেখান থেকে। ধ্রুবকে কোলে তুলে নিলো।
তুমি এখানে এসেছো কেনো বাবা ? সামনে পুকুর যদি কোনোভাবে পড়ে যেতে।
আমি তো সুইমিং জানি বাবা। আমি আর পাপা কতবার সুইমিং কম্পিটিশন করেছি তুমি জানো ? পাপা সবসময় হেরে যায়।
কথাটা শেষ করে ধ্রুব খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। তাজ মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই হাসি। তিতিরের হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাজের, হয়তো তিতিরের হাসিও এমন নির্মল ছিলো। তাজ ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে মাথায় চুমু খেলো। তাকালো হাতের ডায়েরির দিকে। এখনো অনেকটা পড়া বাকি থেকে গেছে। পুরোটা পড়তে হবে তাকে।
তাজ পুকুরের এপাশে সেই সিঁড়ির কাছে এসে ধ্রুবকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো, বাবা তুমি মাম্মামের সাথে খেলো গিয়ে।
ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, আমি তো মাম্মামের সাথে লুকোচুরি খেলছি। আমি এখানে লুকিয়ে আছি মাম্মামকে বলো না কিন্তু।
ধ্রুবর হাসি দেখে তাজের ঠোঁটে হাসি ফোটে উঠলো। তাজের হাসি কান্না সব এখন এই নিষ্পাপ মুখেই নিবদ্ধ।
এই তো পেয়ে গেছি ধ্রুবকে। এবার আমি লুকাবো তুমি খুঁজবে।
তাজ আর ধ্রুব সামনে তাকিয়ে দেখলো পাখি দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে আর এসব বলছে। ধ্রুব ধরা পরে গিয়ে গাল ফুলালো। তবে কিছু না বলে পাখির সাথে চলে গেলো। তাজ সেদিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে ডায়েরি খুললো আবার।
আমার জীবনের সুখের সময়কাল বরাবরই খুব কম হয়। বেশ তো কাটছিলো আপনার সাথে আমার দিনগুলো। তখন চাকরির প্রায় দেড় বছর পার হয়ে গেছে। আপনার কেবিনে সোফায় বসে কাজ করছিলাম আমি। তখনই কেউ নক করলো দরজায়৷ আপনার মনে আছে সেইদিনের কথা ?
আপনি বললেন, কাম ইন।
ঝড়ের বেগে কেউ প্রবেশ করে জাপ্টে ধরলো আপনাকে। আমার হাত থেকে ফাইল পরে গেলো। সেটা কে ছিলো মনে আছে ? মৌ আপু ছিলো সেটা। গত দেড় বছর ধরে আমার একটু একটু করে সাজানো ভালোবাসা একটা দমকা হাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো। গত দেড় বছরে আপনি মৌ আপুর নামটা পর্যন্ত বলেননি আমাকে। আপনার বুকে মৌ আপু আর আমি সামনে বসে দেখছি আপনাদের। উফফ সে কী নিদারুণ কষ্ট। বুকের ভেতর যেনো কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি জানো তাজ ? আমার ফোনটাও ঠিকমতো রিসিভ করো না তুমি।
আপনি নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন মৌ আপুকে, মৌ ব্যস্ত থাকি আমি। তুই দেশে ফিরলি কবে ?
এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি।
এতক্ষণে মৌ আপুর নজর পরে আমার দিকে, টলমলে চোখে আমি তখন তাকিয়ে আছি আপনাদের দিকে।
এটাই তো তিতির, তাই না তাজ ? এই মেয়েটার কথাই তো বলতে ফোনে। ভারি মিষ্টি তো দেখতে মেয়েটা।
আপনি আমার কথা মৌ আপুকে বলতেন সেটা শুনে অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি। আমি তো যন্ত্রণায় ছটফট করতে ব্যস্ত।
আপু এগিয়ে এলেন আমার দিকে, হাই আমি মৌমিতা রহমান তাজের ফিয়ন্সে।
আপনি কপাল কুঁচকে তাকালেন আপুর দিকে, মৌ আমি কিন্তু এখনো মত দেইনি।
আপু মুচকি হেসে বললো, আজ বা কাল তোমার এই মৌকেই বিয়ে করতে হবে।
এটাই শোনার বাকি ছিলো। কতটা কষ্টে নিজের চোখের পানি আঁটকে রেখেছিলাম সেটা হয়তো আমি জানি আর জানে আমার উপরওয়ালা। আমি আপুর সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলে বের হয়ে আসি আপনার কেবিন থেকে। ওয়াশরুমে গিয়ে কষ্টগুলো মুক্ত করে দেই চোখের পানিতে। তারপরের দিনগুলো বদলে গেলো। আমি আবার হাসতে ভুলে গেলাম। নিজেকে বুঝাতে লাগলাম আপনার পাশে মৌ আপুর মতো কাউকেই মানায়, আমার মতো কোনো এতিমকে নয়। তবু খুব কষ্ট হতো আপনার পাশে আপুকে দেখে। যে আমি আপনার পাশে হিরোইন সহ্য করতে পারতাম না, যেখানে জানতাম সব সাজানো সেখানে আপুকে মানতে হতো সবটা সত্যি জেনেও।
আপনাদের বিয়ের পাঁচদিন আগে জানতে পারি বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। প্রথমে একটু কষ্ট হয়েছিলো, ততদিনে নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেও প্রথম ভালোবাসা তো তবু কষ্ট হয়েছিলো। নিজেকে সামলে নিলাম, ততদিনে এটুকু বুঝেছি মৌ আপুও আপনাকে ভালোবাসে। মানুষ হিসাবেও অনেক ভালো, আপনার জন্য পারফেক্ট। আপনি তো আমার না ছুঁয়া স্বপ্ন তাই হাসিমুখে মেনে নিলাম সবটা। কিন্তু কী নিষ্ঠুর আপনি, আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন বিয়ের শপিং করতে। আমাকে কষ্ট দিয়ে বুঝি আপনার আনন্দ হচ্ছিল। আমিও কষ্ট গিলে স্বাভাবিক থাকার নাটক করে যাচ্ছিলাম। আপনি যে মৌ আপুকেও ভালোবাসতেন না, ততদিনে সেটাও বুঝে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি আপনি যতটা যত্নশীল ছিলেন আপুর প্রতি তো তাও ছিলেন না। আপনি সত্যি ভালোবাসতে জানেন না কিন্তু আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে পারেন। আপনি কী সুন্দর একটা হলুদের শাড়ি কিনে দিলেন আমাকে, আপনার হলুদে পড়ে যাওয়ার জন্য। আচ্ছা হৃদয় পোড়ার গন্ধ আপনি একটুও পাননি।
ডায়েরি বন্ধ করলো তাজ। এসব পড়তে তার কষ্ট হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অনুভব করতে পারছে সেই প্রতিটা মুহূর্ত।
চলবে,,,