#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ এগারো
#মম_সাহা
(২৪)
বিধ্বস্ত এই বাহারকে দেখার পর সবার ভেতর উত্তেজনারা পাখা ঝাপ্টানো শুরু করেছে ক্রমাগত। আজ বছর এক তো হতে চললো মানুষটাকে সবাই দেখছে, অথচ এমন রূপ কখনোই দেখা হয় নি। এ জন্য হয়তো অবাক ভাবটা বেশি।
বাহারকে দেখে সবার প্রথম মুনিয়া বেগমই দৌড়ে এলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
“বাবা,কী হয়েছে তোমার? এত ব্যাথা পেয়েছো কীভাবে? ইশ, আসো, সোফায় এসে বসো।”
বাহার দ্বিমত পোষণ করলো না বরং বেশ বাধ্য ছেলের মতন সোফায় গিয়ে বসলো। সে সোফায় বসতেই সম্বিৎ ফিরে পেলো সবাই, অতঃপর শুরু হলো হম্বিতম্বি। চিত্রা বাহারের বরাবর সোফাতেই বসে ছিলো। সে উঠে গেলো না, উৎকণ্ঠিত হলো না, কেবল নিশ্চুপ হয়ে দেখলো বাহারকে। এমন বাহারকে কখনো দেখে নি সে হয়তো আজ তাই মানতে পারছে না সে দশা।
অহি ঠান্ডা শরবত এনে দিলো, চিত্রার ফুপি দুধের মাঝে হলুদ দিয়ে নিয়ে এলো, মুনিয়া বেগম তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এলো। অথচ বাহার সটান সোজা হয়ে বসে রইলো। কোনো হেলদোল করলো না। ব্যাথার মুখ কুঁচকালো না। কিন্তু তার ক্ষত গুলো দেখলে যেকেউ বুঝবে ব্যাথার গভীরতাটা ঠিক কতটুকু। সবার এত অস্থিরতায় বাহার নিবিড় রইলো। নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো যেন সবটা। সাথে দু একবার পলক ঝাপ্টে দেখে নিলো চিত্রাকেও।
সবার ব্যস্ততার মাঝে গম্ভীর নুরুল সওদাগরের কণ্ঠ ভেসে এলো, রাশভারী কণ্ঠে সে বললো,
“মারামারি করেছো? গুন্ডামী করার গুণটাও যে তোমার মাঝে আছে, জানা ছিলো না।”
এমন তীক্ষ্ণ কথার পরিবর্তে বাহার মলিন হাসলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বখাটের খাতায় যার নাম জ্বলজ্বল করে, তার বখাটে গুণ থাকবে না সেটা ভাবলেন কীভাবে?”
নুরুল সওদাগর হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তাকে চুপ করিয়ে দিলো চিত্রা। খুব ভদ্রতার সাথে সে বললো,
“আব্বু, থামুন। ক্ষত যার এমনেতেই আছে তার ক্ষত বাড়ানোর কী প্রয়োজন? অনেক তো ক্ষত করলেন। মাঝে মাঝে প্রলেপ লাগালেও পারেন।”
চিত্রা নামের মেয়েটির মুখে যে এমন কথা উচ্চারিত হবে তা সবারই ভাবনার বাহিরে ছিলো। যার জন্য উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল। দৃষ্টি চিত্রাতে নিবদ্ধ। আজ যেন একের পর এক চমকে তাজ্জব সওদাগর বাড়ি। হুট করেই বাড়ির মানুষ গুলো যেন বড্ড অপরিচিত হয়ে উঠেছে। এতটা অপরিচিত তারা হয়তো কখনোই ছিলো না। উপস্থিত বিষ্মিত সব চেহারার মাঝে কেবল একজনের মুখে চাপা হাসির রেখা দেখা দিলো। যে মানুষ চিত্রাকে ঘাত-প্রতিঘাতের বাণী শুনিয়েছিলো।
পর পর ছেলে ও মেয়ের এমন উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিমায় নুরুল সওদাগরও যেন কথা বলতে ভুলে গেলেন। মেয়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিরুত্তর। আশপাশ হাতরে যখন ভাঁটা পড়লো শব্দ গুচ্ছের সমুদ্রে, তিনি নতজানু হয়ে প্রস্থান নিলেন। সে যেন দেখলেন, মিছে ক্ষমতার আস্ফালন এখন আর চলবে না। ভ্রমের কার্তুজ ভেঙে পড়ছে অনবরত।
নুরুল সওদাগর চলে যেতেই সকলের ভেতর থাকা টান টান উত্তেজনারাও মিইয়ে এলো। বুক ভরে শ্বাস নিলো সবাই। তারা ভেবেছে এই হয়তো নুরুল সওদাগরের বাজখাঁই গলা ফেঁটে পরবে৷ এই হয়তো ছোট্টো চিত্রা পিষে যাবে নুরুল সওদাগরের কথার তীক্ষ্ণতায়। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। রুদ্ধশ্বাস সময়ের পরিসমাপ্তি হলো। সবাই আবার ধ্যান দিলো বাহারের দিকে। ছেলেটাকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে! মুনিয়া বেগমের ভীষণ মায়া হলো। ছেলেটার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো, ধীর কণ্ঠে শুধালো,
“বাবা, তোমায় যে বড় ক্লান্ত লাগছে! ঠিক কী হয়েছে, বাবা?”
বাহার সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং কেমন কণ্ঠে যেন বললো,
“আমায় আগে একটু ভাত দিবেন আন্টি? বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”
কণ্ঠটা কেমন অসহায় শুনালো। কেবল পেটের ক্ষুধা না, মনে হলো এ যেন কত বছরের না পাওয়ার হাহাকার। বাহারের কণ্ঠে আজ অসহায়ত্ব! খেতে চাওয়ার হাহাকার!
মুনিয়া বেগম সাথে সাথে ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। প্লেট ভরে ভাত নিয়ে এলেন। তার জীবনে এমন নিঠুর আবদার যেন সে আর শুনে নি। ‘একটু ভাত দিবেন’ কথাটার মাঝে যেন কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো সকলের অন্তরের অন্তস্তল।
ভাত আনতেই কোনো বাক্যব্যয় না করেই হাত ধুয়ে বাহার খাওয়া শুরু করলো। খুব মন দিয়ে সে খাবার খেলো। এতদিনের মাঝে কখনো বাহারকে এমন ভাবে খেতে দেখে নি কেউ। বরং হয়েছে উল্টোটা। কত সময় দেখা যেতো বাহারের পড়ার টেবিলে উন্মুক্ত রাখা খাবারের থাল যার এক বিন্দু খাবার নড়চড় হয় নি। কত কত সময় বাহার খাবারের প্লেট ফিরিয়ে দিতো। খাবারের প্রতি তার বড্ড অনীহা। অথচ সে বাহার আজ তৃপ্তি করে খাচ্ছে।
মায়া হলো লতা বেগমেরও। কাঠখোট্টা মহিলাটাও আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা, সারাদিন খাও নি তাই না?”
বাহার খেতে খেতেই খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,
“না আন্টি, আসলে পকেটে টাকা ছিলো না। মাস শেষ তো, টিউশনির টাকাও শেষ। বেকার মানুষের বেঁচে থাকাটাই তো যুদ্ধ আন্টি। সে যুদ্ধে আমাদের ভাত না খেয়ে কতগুলো দিন কাটানোর গল্প থাকে, ফুটপাতে রাত কাটানোর গল্প থাকে, প্রিয় মানুষ হারানোর গল্প থাকে, আপন মানুষদের আবদার পূরণ করতে না পারার গল্প থাকে, সাথে গল্প থাকে আমাদের বখাটে হওয়ার। দারিদ্রতা এমন একটা রোগ যা মানুষকে বেহায়া করে দেয়। আর বেকারত্ব এমন একটা অভিশাপ, যা মানুষকে লজ্জাহীন করে দেয়। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের বাঁচতে হয় লজ্জায়, লজ্জায় হীনমন্যতায়। সিগারেটের ধোঁয়া দেখে মানুষ ঠাট্টা করে বলে বেকারের বিলাসিতা, কেবল ঐ নিকোটিন জানে কত হাহাকার উড়িয়ে দেই আমারা সেই ধোঁয়ায়। মানুষ তো শা*লা বেঈমান, নিকোটিন অন্তত সেটা না।”
কথা শেষ, সাথে খাওয়া শেষ। সবাই কেবল নিরব শ্রোতা। বাহার ছেলেটা এত কথা বলতে জানে এটা কেউ জানতোই না। এক বাক্য থেকে দু বাক্যে কোনো কথা তার গিয়েছে কিনা সন্দেহ। আর আজ সে ছেলে কিনা বেকারত্বের হাহাকার পাঠ করলো! অথচ এতদিন সবাই ভাবতো বাহার মানেই ভবঘুরে, ডোন্ট কেয়ার ভাবের ব্যাক্তি। ব্যাথা, আঘাত যাকে ছুঁতে পারে না।
খাবার শেষ হতেই অহি প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এলো। বাহার হেলান দিয়ে বসলো সোফায়। মুনিয়া বেগমও বসলেন বাহারের সাথে। বাহারের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“এবার বলো তো, ঠিক কী হয়েছে? তোমায় তো কখনো মারামারি করতে দেখি নি। তবে আজ!”
বাহার ছোট্টো শ্বাস ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমাদের ভার্সিটির মাঝে অতিরিক্ত রাজনীতির চর্চা। বর্তমানে যেই ছাত্রলীগ নেতা আছেন, তিনি বেশ উশৃংখল। তারই উশৃংখল কাজে প্রতিবাদ করাতেই নেতার চামচারা ক্ষ্যাপে যায়। অতঃপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি।”
সবাই আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বর্তমানে পড়াশোনার জায়গা গুলোও হয়তো ব্যবসায়ের জায়গা নাহয় রাজনীতি হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই তোমার ধ্বংস নিশ্চিত। তবে কী বাহার পা ফেললো সেই ধ্বংসের পথে?
(২৫)
রাত সাড়ে আটটা। সওদাগর বাড়ির প্রায় সব সদস্য দাঁড়িয়ে আছে বিমানবন্দরে। আর কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়ির ছোটো হাসির জাদুকরটা পথ ধরবে ঐ স্বচ্ছ আকাশ পানে। আবার সুস্থ হয়ে সে ফিরবে কিনা তা জানা নেই কারো। কেবল তারা বুকে এক রাশ আশা পুষে সৃষ্টিকর্তার নিকট করুন প্রার্থনা তুলে দিয়েছে। বাচ্চাটা ফিরে আসুক। বাচ্চা টা বাঁচুক, হাসুক।
আরেক দফা কান্নার রোল পরলো বিমানবন্দরে। এম্বুলেন্স থেকে ছোটো চেরির দেহটা যখন নামানো হয, হাউমাউ করে উঠে সবাই। মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দু নয়ন ভরে দেখলো সে বাড়ির সদস্যদের। কত কিছু যেন বলার ছিলো বাচ্চাটার, অথচ ভাগ্যের নির্মমতায় বলা হলো না কত কিছু। কেবল দেখে গেলো সবাইকে। বাচ্চাটার সুস্থ চোখটা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। বাচ্চাটাও যেন বুঝলো তার অনিশ্চিত ভবিতব্যের কথা। বাচ্চার কান্না দেখে শক্ত, সামর্থ্য মানুষ গুলোও শক্ত রইলো না। কেমন পাংশুটে হয়ে এলো সকলের মুখশ্রী। সবচেয়ে বেশি চিৎকার শোনা গেলো চিত্রার। চেরিকে ছোটো বেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করার কাজটা যেন অগোছালো চিত্রার উপরই ছিলো। আর ছোটো চেরির জানও যে এ চিত্রাতে নিবদ্ধ। চিত্রা আপা ছাড়া যেন তার গতি নেই। অথচ এই আপাকে ছেড়েই যেতে হবে দূরদেশ।
চেরির ছোটো শরীর টাকে জড়িয়ে ধরলো চিত্রা। চেরি তখনো স্ট্রেচারে শোয়ানো। চিত্রা হাউমাউ করে কাঁদলো। চেরিকে জড়িয়ে ধরে অনবরত বলে গেলো,
“চেরি সোনা, তাড়াতাড়ি ফিরবে কেমন? আপা তোমার জন্য পথ চেয়ে থাকবে। ফিরবে না পাখি? আপা তোমায় অনেক চকলেট দেবো। ভাত খাইয়ে দিবো। তাড়াতাড়ি চলে এসো কেমন?”
আপার কান্না হয়তো সহ্য হলো না বাচ্চাটার। সে কেবল ডানে-বামে ধীর গতিতে মাথা নাড়ালো। হয়তো কান্না না করার ইশারা করলো। একে একে পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যের সাথে ভাব বিনিময় করলো সে। হয়তো এই শেষ যাওয়া, আবার এমনও হতে পারে হয়তো ফিরে আসবে সে। এক অনিশ্চত উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই বিদায় জানালো চেরিকে। প্লেন যতক্ষণ না আকাশ পথে উড়াল দিলো ততক্ষণ সবাই বিমুখ হয়ে চেয়ে রইলো। কত মজা, আনন্দ আর হবে না। সওদাগর বাড়ির কোণায় কোণায় যেন শূণ্যতার আভাস।
চেরিদের প্লেন গন্তব্য ধরতেই গন্তব্য ধরলো মুনিয়া, চিত্রা, অহি, নুরুল, আফজাল সওদাগর, তুহিন। যেতে যেতে চিত্রা আবার পিছু ফিরে তাকালো, পিছুটান যে বড় টান।
(২৬)
রাত তখন এগারোটা। ঢাকা শহরের তুমুল জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে নিজ বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো চিত্রাদের গাড়ি। ক্লান্ত দেহ, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন তারা বেরিয়ে এলো, বাড়ির দারোয়ান চাচা হুড়মুড় করে ছুটে এলো। যেন এতক্ষণ সে তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো।
নুরুল সওদাগর গাড়ির দরজা লাগিয়েই শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে? আপনাকে এমন লাগছে যে!”
বৃদ্ধ দারোয়ান ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিলো। বাচ্চাদের মতন অভিযোগ করে বললো,
“স্যার, বাহার বাবাকে পুলিশ নিয়ে গেছে একটু আগে।”
#চলবে
[এইতো চমক শুরু হলো বলে। বেশি করে শ্বাস টেনে নিন। কারণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আসতে চলেছে।]