শর্বের_জোনাকি ❤️,পর্ব:০৪

0
406

#শর্বের_জোনাকি ❤️,পর্ব:০৪
#ইফা_আমহৃদ

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে পিউ-কে। তার সন্নিকটে বসে আছে তারই প্রিয় খেলোয়াড় স্নিগ্ধ। আশেপাশে বসে আছে বাকিরা। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর চেতনা ফিরল পিউয়ের। সর্বপ্রথম তার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হল স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ-কে দেখে হতবুদ্ধি হল সে। তার মুখশ্রী জুড়ে ক্ষোভ আর ভীতের ছড়াছড়ি। মূহুর্তের মাঝে তার স্থির দেহ তীব্রভাবে কম্পনের জানান দিল। রীতিমত পিছিয়ে গেল পিউ। টেবিলের উপর রাখা সিজার ছুঁড়ল স্নিগ্ধের পানে। স্নিগ্ধের টনক নড়ল। সে দ্রুত সরে গেল। কিন্তু তার পূর্বেই কপালে লাগল। মুহূর্তেই মস্তক ঘুরে উঠলো। চটজলদি তার হাত ঠেকল কপালে। কাউকে সাহায্য করার বিনিময়ে এমন প্রতিদান বোধগম্য হলে কখনোই কাউকে সাহায্যের কথা ঘুনাক্ষরেও ভাবত না। স্বল্প একটা কালচে দাগ হয়েছে।

পিউ স্যালাইনের ক্যানেল খুলে ফেলে। স্নিগ্ধ-কে চিনতে তার সময় লাগল না, তবে কোন স্নিগ্ধ তা মস্তিষ্কে হানা দিল না। ঝাপিয়ে পড়ে স্নিগ্ধের ওপর। পিউ ক্ষান্ত নেই। অতীতে ফেলে আসা দিনগুলো তার নেত্রযুগল জুড়ে রয়েছে। নখের আঁচড়ের দাগ পড়ল গলায়। বুকের দেওয়া আঁচড়গুলো শার্ট ভেদ করে বুক স্পর্শ করল। জ্বলে উঠল জায়গাটা। রক্তের দাগ ভেসে উঠল। পিউ অনুশোচনা অনুভব করেনা। যে হিংস্র পশুর ন্যায় স্নিগ্ধ-কে খুবলে খেতে পারলেই শান্ত হবে।

পিউ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “তুই আবার এসেছিস? কেন এসেছিস? তোকে আমি শান্তিতে থাকতে দিবো না।”

অকস্মাৎ আক্রমণে ভরকে গেল স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ দ্রুত দৃঢ় করে আবদ্ধ করে নিল পিউয়ের হাত। দেয়ালে ঠেকিয়ে আয়ত্তে আনার চেষ্টায় মগ্ন হল। মিহুল ভীত হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল।‌ পিউ-কে বরাবরই ভয়ংকর লাগে তার কাছে। বাকিরা একপাশে দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকলেও মেঘলা স্থির রইল না। দ্রুত নার্সের খোঁজ করতে গেল।‌
ততক্ষণে আংশিক আয়ত্তে চলে এসেছে পিউ। নার্স নিয়ে প্রবেশ করল মেঘলা। স্নিগ্ধের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে পিউকে সরিয়ে নেওয়া চেষ্টা চালালো। দু’জনের প্রচেষ্টার মাঝে নার্স তার সূচ ফোঁটালো পিউয়ের বাহুতে। মিনিট দশ অতিবাহিত হওয়ার পর কাজ শুরু হল। দুর্বল হয়ে এলো পিউয়ের উষ্ণ দেহ। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল স্নিগ্ধের বুক। পরম আবেশে নিজের হৃৎপিণ্ডের সাথে মিশিয়ে নিল স্নিগ্ধ।
সোজা করে বিছানায় রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ওষুধের কারণে শিথিল হয়ে এসেছে সর্বাঙ্গ। বিষাদময় শ্বাস নিল। হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করল। রাত বাড়ছে, তাকে অতিদ্রুত বাড়িতে ফিরতে হবে। পকেট থেকে মাক্স আর কেপ বের করে আড়াল করল নিজেকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমাকে এখন যেতে হবে। চিন্তা করো না, আমি বিল পে করে দিবো।”

মুন আগ বাড়িয়ে বলে, “স্যরি, আমাদের জন্য আপনাকে সমস্যায় পড়তে হল। পিউ ইচ্ছে করে এমন করে..

বাক্যের ইতি টানার পূর্বেই স্নিগ্ধ বলে, “কোনো এক্সপ্লেইন করার দরকার নেই। নতুন অভিজ্ঞতা হল আর-কি। আমাকে দেখে আনন্দে উৎফুল্লিত হয়ে অনেক ভক্তরা ছবি তুলে, অটোগ্ৰাফ চায়, কেউ-বা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কখনো এভাবে আক্রমনের শিকার হতে হয়নি।
বাই দা ওয়ে, আমি যে এখানে এসেছি ওকে বলবেন না। দেখা যাবে আরও উন্মাদ হয়ে যাবে।”

স্নিগ্ধ স্মিত হাসল। যতদ্রুত সম্ভব তার এখন যাওয়া উচিত। যেতে পারলেই তার মুক্তি। মেঘলা ছোটো করে অনুরোধ করল স্নিগ্ধের নিকট, তার বন্ধুদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার। মেঘলার অনুরোধে সন্তুষ্ট হয়ে সবাইকে নিয়ে রওনা হল স্নিগ্ধ। অনিহা থাকার সত্বেও বাধ্য করল মেঘলা। সে একাই হাসপাতালে রইল।
_
রাত আরেকটু গভীর হতেই পিউয়ের চেতনা ফিরে এলো। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ইনজেকশনের রেশ কাটিয়ে নেত্রযুগল উন্মোচন করে অবলোকন করল পিউ। চারপাশের পরিবেশ তাকে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। হতবুদ্ধি হল সে। ধবধবে সাদা চাদর দেখে বোধগম্য হল হাসপাতালে। সাধারণ কোনো নার্সিং হোম নয়, নামিদামি বটে। টাকার কথা চিন্তা হতেই হাঁপিয়ে গেল সে। এত টাকা পরিশোধ করবে কীভাবে? তরতরিয়ে লবণাক্ত ঘাম জমে গেল কপালে। নিঃশ্বাসে ভারী শব্দ হচ্ছে। দ্রুত নেমে গেল। এলোমেলো ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল। সন্তর্পণে পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করল। সবে তন্দ্রা লেগে এসেছে মেঘলার। মৃদু শব্দগুলোতে ধরফরিয়ে উঠে বসল মেঘলা। পিউ-কে হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখতে দ্রুত ধরে ফেলল সে। অবুঝ স্বরে বলে, “কোথায় যাচ্ছিস তুই।”

অতিশয় পরিচিত কণ্ঠ শ্রবণ হতেই থমকে গেল পিউ। মেঘলা-কে দেখে পুনরায় বসল। চিন্তায় মগ্ন হল।

“তুই আমাকে কেন এখানে এসেছিস। তোর ধারণা আছে, কত বিল হয়েছে?”

“আমার ধারণা থাকার দরকার নেই, তোর থাকলেই হবে। যা শুয়ে পড়।”

“না মেঘ, আমাকে এখন বাড়িতে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি যাবো, তত ভালো।”

মেঘলা বিরক্তকর স্বরে বলে, “তোর কি মনে হয়, দাড়োয়ান এখনো তোর জন্য জেগে আছে? ফিরে গেলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সারারাত।”

হাসপাতালে আয়ার কাজ করাতে প্রায়ই দেরি হয় ফিরতে। কলেজে ফিরতে ফিরতে বন্ধ করে দাড়োয়ান তার বাড়িতে ফিরে। সেই রাতগুলো কলেজ ক্যাম্পাসেই অতিবাহিত করতে হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হবেনা। কিন্তু এখানে যতক্ষণ থাকবে, বিল তো বাড়তেই থাকবে। পিউ বিচলিত হয়ে বলে, “আমার চিন্তা তোকে করতে হবেনা। তুই বাড়িতে চলে যা, সবাই চিন্তা করছে।”

“চিন্তা করছে না, আমি সব জানিয়ে দিয়েছি।” একরোখা জবাব মেঘলার।

এখানেই থেমে গেল শব্দ। দু’জনেই কিয়ৎক্ষণ নিরবতা অনুসরণ করল। একসময় ফোড়ন দিয়ে মেঘলা বলে, “আমি বলি-কি, তুই একটা ফ্লাট নিয়ে থাক। রাত বিরাতে ফিরিস, কিছু যদি হয়ে যায়।
তোকে ভেঙে বলতে হবেনা, আশা করি বুঝতে পারবি..

পিউ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে, “আর কিছু হওয়ার বাকি আছে বুঝি?”

মেঘলা দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলে, “বাকি নেই, তাই বলে নিজের যত্ন নিবি না। তুই যদি একটা ফ্লাট না নিস, আমি আর তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখব না।”

পিউ নিরবে হাসল। ছোট চাচির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী যখন শহরে এসেছিল, তখন সেই ঠিকানায় পৌঁছে কাউকে পায়নি। দু’রাত স্টেশনে মশা কামড়ে অতিবাহিত হয়েছে। সেদি‌ন মেঘলার পরিবারের সাথে গ্ৰাম থেকে বেড়িয়ে শহরে ফিরছিল। অসহায় পিউয়ের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ছোটো একটা হাসপাতালে আয়ার কাজে ধরিয়ে দিয়েছিল। এই মেয়েটা না থাকলে কি-যে হতো। পিউ এই হাত ছাড়তে চায়না। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ফ্লাট ভাড়া তো অনেক।”

“অনেক কোথায়? দুইঘরের একটা ফ্লাট নিবি। একটায় তুই থাকবি আরেকটায় অন্য কেউ। আমার পরিচিত একটা বাড়িতে ফ্লাটা ফাঁকা আছে। আমি স্বল্প খরচে ম্যানেজ করে দিবো।
আমরা কিন্তু কালকেই সিফ্ট করব। এবার ঘুমা..

পিউ সম্মতি দিল। বিছানার একপাশে সেঁটে গেল। মেঘলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা করে দিল। মেঘলা বিছানায় লেপ্টে গেল। দু’জনে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হল। রাত বাড়তে লাগল। একসময়ে ভোরের সূচনা হল।

পরদিন নতুন বাড়িতে পদার্পণ করল পিউ। নতুন ফ্লাটে মনমুগ্ধ করল তাকে। বিশাল বিশাল শোবার ঘর, বৈঠকখানা, রান্নাঘর, বারান্দা। শোবার ঘরের সাথে সাথে ফিট করা ওয়াশরুম। তবে একটা জিনিস অপছন্দ হল পিউয়ের। বারান্দা দুই একসাথে। অর্থাৎ এক বারান্দা দিয়ে অন্য বারান্দায় যাওয়া যায়।
মেঘলার বাড়ির পুরোনো আসবাব পত্র দিয়ে সজ্জিত হল পিউয়ের ঘর। একবার নাকোচ করেছিল, কিন্তু মেঘলা তার কথা কর্ণপাত করেনি। লোক আর বন্ধুদের দিয়ে পুরো ঘর সাজিয়ে দিল। ওয়াচম্যান-কে একটা রুম ভাড়া দিতে বলল। হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন। তাই কোনো রুমমেট-কেই সমস্যা নেই পিউয়ের। শুধু পরিচ্ছন্ন হলেই যথেষ্ট।

পিউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরা শ্বাস নিল। মাথা গোঁজার জন্য একটা বাসস্থানের অতি প্রয়োজন তার। ঠাঁই হিসেবে। কাঁধে হাত রাখল মিহুল। পিউয়ের নেত্রযুগল অশ্রুসিক্ত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “ধন্যবাদ বন্ধুরা, তোদের ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
____
মানুষের ছড়াছড়ি। ছোট নার্সিং হোম। একটা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় এর অবস্থান। সাধারণ ইনজুরি হলেই ভিড় জমে যায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। পিউ বিছানা গোছানো শেষ করেছে। তাকে ডাঃ মিহান ডাকছে। পিউ দ্রুত হাত চালালো। তাড়াতাড়ি কেবিনের মেঝে ফিনাইল দ্বারা পরিষ্কার করতে লাগল। বালতি দরজার বাইরে রেখে বালিশের কুশন আর বিছানার চাদর আনতে গেল। একজন সিরিয়াস পেসেন্ট ভর্তি হবে।
ফিরে এলো কুশন নিয়ে। শুভ্র কুশন বিছিয়ে নিল। হাপ ছেড়ে বাঁচল। নিজে পরিস্কার হয়ে দ্রুত ডা. মিহানের চেম্বারে ছুটল।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল, “স্যার আসব।”

ডা. মিহার কিছুটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, “আপনাকে আমি পনেরো মিনিট আগে ডেকেছিলাম, কাজের প্রতি কোনো দায়িত্ব জ্ঞান নেই দেখছি না।”

পিউ অপমান বোধ করল। আমতা আমতা করে প্রতুক্তি করে, “সিরিয়াস প্যাসেন্ট এসেছে, আমি তার কেবিন পরিষ্কার করছিলাম। আমার কোনো উপায় ছিলনা।”

ডা মিহান নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর অপ্রস্তুত গলায় বলে, “ওনাকে একটু ড্রেসিং করিয়ে দিন। নার্সরা ব্যস্ত আছে, দেখছি না। ইনজেকশন লাগবে। কীভাবে ইনজেকশন পুশ করতে হয় আপনাদের শেখানো হয়েছিল, পারবেন না?”

“না স্যার, নতুন তো। ইনজেকশনের কথা শুনলেই আমার হাত কাঁপে।”

“ঠিক আছে, আপনি ড্রেসিং করিয়ে দিন। ইনজেকশনটা আমি পুশ করে দিচ্ছি।
ড্রেসিং করাতে পারবেন তো?”

পিউ অব্যক্ত স্বরে সায় দেয়, “জি।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here