শর্বরে_জোনাকি,অন্তিম

0
568

#শর্বরে_জোনাকি,অন্তিম
#ইফা_আমহৃদ

সেদিনের পর অতিবাহিত হয়েছে দুই দিন। পিউয়ের জীবন অগোছালো ভাবেই যাচ্ছিল। আজ তার গোল দৌড় প্রতিযোগিতা। সেই মোতাবেক উপস্থিত হয়েছে খেলার মাঠে। চারদিকে দর্শকদের করতালির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অতিথি হিসেবে থাকছে স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ পূর্বে উপস্থিত হয়েছে সে। একপাশে বসে খেলা পর্যবেক্ষণ করছে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই শুরু হল দৌড় প্রতিযোগিতা। এক মিটার বিশিষ্ট মাঠের ভেতরে পাঁচবার দৌড়। পিউ একবার দৌড় দিয়ে হাঁপিয়ে গেল। তার মাথায় ব্যথা অনুভব করল। সে থেমে গেল না। বাবার জন্য দৌড়াতে লাগল। দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ করে পিউ আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। তৃষ্ণায় ভেতরটা বেরিয়ে আসছে। পিউ আরও একটা চক্কর দিল। চতুর্থ চক্কর শেষ করে পঞ্চম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল না, তার পূর্বেই মাঠের মাঝখানে পড়ে গেল সে। উবুত হয়ে মাটির শুয়ে পড়ল। প্রতিযোগিরা থেমে গেল। পিউয়ের অবস্থা ভয়াবহ। মেঘলা মুন ছুটে গেল মাঠে। পিউ-কে ধরে কোলে মাথা রাখল। অবিলম্বে আঁতকে উঠল। পিউয়ের মুখ-নাক থেকে রক্ত ঝরছে। চুল হাত দিতে বুঝতে পারল রক্ত চুলেও। মাঠ রক্তে রঙিন হল। মেঘলা চিৎকার করে উঠল। তার হাত পা কাঁপছে। পাশে বসা মুন কিছু বলার শক্তি পাচ্ছেনা।

স্নিগ্ধসহ কতৃপক্ষের সকলে ছুটে এলো। পিউকে দেখে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে যেন। ছোটো খাটো একজন ডাক্তার ছিল। তিনি এগিয়ে এসে পিউ-কে দেখল। পালস রেট স্থির। গলায় হাত দিয়ে আরেকবার চেক করল। সকলের পানে চেয়ে বিষাদময় শ্বাস নিল। টেনে টেনে বলেন, “নেই।”

অচেনা একটা মেয়ের জন্য স্নিগ্ধের চোখের কোণে অশ্রু ঝরল। তার দেহটাকে এমনি এমনি ছাড়ল না। ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হল। স্নিগ্ধ ল্যাবের বাইরে ছিল। পিউয়ের বন্ধুরা স্নিগ্ধের সাথে থাকল। মেঘলা নিজেকে দায়ী করল।

কয়েকঘণ্টা ঘণ্টা পর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বের হয়ে আসে। তিনি কৌতুহল নিয়ে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন করে তা হলো, “মেয়েটা কি বিবাহিত?”

মুন অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বলে, “জি।”

স্নিগ্ধ ফট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “তাহলে ওর স্বামী কোথায়?”

“জানি না।”

ডাক্তার পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “এবশর্ন করিয়েছেন কেন বলতে পারবেন?”

মেঘলা নত কণ্ঠে জবাব দেয়, “আমিই ওকে অবশনের জন্য একজন ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়েছিলাম। ওর স্বামীর সাথে বোঝাপড়া ভালো ছিলনা। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু ও খুব কেঁদেছিল। এবশর্ন না করলে ও বাঁচবে না এমন বলেছিল। আর কিছু জানি না।”

ডাক্তার সন্দেহ নিয়ে বলেন, “কিছু মনে করবেননা। বাই এনি চান্স, তিনি কোনো পতি’তা নয়ত? তার দেহ টেস্ট করে আমরা সেটাই বুঝতে পেরেছি।”

স্নিগ্ধ দ্রুতি কণ্ঠে বলে, “কী বলছেন ডাক্তার?”

“তেমন কিছু না, এবার তাকে নিয়ে যেতে পারেন। দাফনের ব্যবস্থা করুন। রিপোর্ট এলে আমরা আপনাদের জানাবো।”

স্নিগ্ধের মনে সন্দেহ দানা বেঁধে রইল। কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর সে পেল না। মেঘলা শুধু বলে, “পিউ স্নিগ্ধ নামটা-কে ঘৃণা করত।”
স্নিগ্ধ চমকে গেল। এই প্রথম কেউ এই নামটা-কে ঘৃণা করে। গ্ৰামের ঠিকানা জানা ছিল মেঘলার। তারা রাতে রওনা দিল পিউয়ের গ্ৰামে। রাতেই দাফন সম্পন্ন করা হল।
পিউ-কে শেষবার দেখার জন্য যত মানুষ এসেছে তারচেয়ে বেশি স্নিগ্ধ-কে দেখতে এসেছে। স্নিগ্ধ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলনা। পিউয়ের সংসারজীবনের সম্পূর্ণ ঘটনা না জেনে সে যাবেনা। পিউয়ের বাবার জন্য স্নিগ্ধ অদৃশ্য কষ্ট অনুভব করল। বাবা হয়ে মেয়ের কবরের সামনে হুইলচেয়ারে বসে দাফন দেখেছেন। এরচেয়ে ভয়ংকর আর কি-বা হতে পারে।

স্নিগ্ধ উঠানে সবার সামনে চেয়ারে বসল। সাদা পাঞ্জাবির পকেটে টুপি রেখে কড়া গলায় বলে, “আমি পিউয়ের জীবনের সবকিছু জানতে চাই। যখন থেকে তার কষ্টের শুরু।”

পিউয়ের বড়ো চাচা, বড়ো চাচি, ছোটো চাচা বাঁধা দিল স্নিগ্ধ-কে। কিন্তু স্নিগ্ধ সেই বাঁধা উপেক্ষা করল। স্নিগ্ধ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, “আমি জানতে চেয়েছি মানে বলতে হবে। আমার ক্ষমতা দেখাতে চাইছি না।”

পিউয়ের ছোটো চাচি এবার নিজের ভেতরে সবটা রাখলেন না। প্রকাশ করলেন সবটা। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“পিউয়ের তখন বয়স কত হবে? এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সবে। তখন পিউয়ের বুবুকে খু’ন করা হয়। পিউ দারোগা সাহেবের কাছে যায়। দারোগা বাড়িতে আসেন। কেউ এই খু’নের তদন্ত করতে দেয় না। বিনিময়ে পিউয়ের ওপর অত্যাচার বেড়ে যায়। সপ্তাহ পরে পিউয়ের বিয়ে ঠিক হয়। অবাক কথা কি জানেন? ছেলেটির নাম স্নিগ্ধ। বাস্কেটবল খেলোয়াড় স্নিগ্ধ-কে মনে মনে ভালোবাসে পিউ। তাই ওর চাচারা স্নিগ্ধ নাম বলে পিউকে বিয়েতে রাজি করায়। প্রথমে পিউ নাকোচ করলে ওরে সবাই মিলে মে’রেছে..
ছেলে বিয়েতে না এসে ফোনে কবুল বলে। বউ একাই শ্বশুড় বাড়িতে যায়‌। সেটাতো শ্বশুড় বাড়ি ছিলনা, ছিল জেলখানার চেয়েও ভয়াবহ, নরক।
দেহব্যবসা চলত সেখানে। পিউয়ের বুবু ঐ নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সাত বছর পর বাবার বাড়ি চলে আসে। আর সেদিন জোর করাতে পিউয়ের বুবু-কে খু’ন করেছে।
সেখানে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ, প্রতিরাতে অন্য পুরুষের সংস্পর্শে থাকতে হত পিউয়ের। একটা মেয়ের জীবনে এরচেয়ে বেশি কি থাকতে পারে?”

পিউয়ের ছোটো চাচি কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। পাড়া প্রতিবেশী সবার চোখে জল। স্নিগ্ধের ভেতরে অনুশোচনা দেখা দিল, ‘শুধু স্নিগ্ধ নামের জন্য মেয়েটাকে..
স্নিগ্ধ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, “পিউ বিয়ে না করতে চাইলে পালিয়ে যেতে পারত। ওর স্বামী এটা কীভাবে মেনে নিল?”

তিনি তাচ্ছিল্যের হেসে বললেন, “স্বামী। হাসালেন স্যার। স্বামী থাকলে তো মেনে নিবে।”

অস্ফুট স্বরে স্নিগ্ধ, “মানে..

“ফোনে কার গলা রেকর্ড করে এনেছে, কে জানে? পালিয়ে যায়নি, বাবার কথা ভেবে।পরেরকথা শুনেন,
সাত-আট মাস পিউয়ের এভাবেই অতিবাহিত হল। একদিন তৌহিদ পিউ-কে নিয়ে আসে। পিউ তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাকে এবশর্ন করতে এখানে রেখে যায়। আমি আগে জানতাম না, সেদিন পিউ আমাকে জানায় তার কষ্টের কথা। আমি আর সহ্য করতে পারি না। নিজের কাছে থাকা জমানো টাকা দিয়ে জোর করে ওকে শহরে পাঠাই। যেতে চায় না মেয়েটা, তবুও আমি জোর করি তাকে। মাসে মাসে ভাইজানের জন্য ওষুধ কুরিয়ার করত।
এখানে ওরা আমাকে অনেক হু’মকি দিয়েছিল, কিন্তু আমি তো আমিই। কিছু বলিনি।”

স্নিগ্ধ কিছু বলেনা। তার দৃষ্টি কাতর। সে অতি শান্ত রইল। কী শাস্তি দিবে? সে শূন্য আকাশের দিকে অবলোকন করল। মিটমিটে তাঁরা জ্বলছে। দূর থেকে দু’টো তাঁরা যেন স্নিগ্ধ-কেই দেখছে। স্নিগ্ধের কাছে ঐ আকর্ষণীয় তাঁরাটা পিউ আর তার বুবু মনে হল। তাঁরাটা মুক্তির আনন্দে হাসছে। স্নিগ্ধ তাঁরার দিকে চেয়ে মনে মনে বলে, “তোমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের কোনো বিচার নেই। কী বিচার করব আমি? একটা ফুলের মত মেয়ের জীবন নষ্ট করলে আমি শাস্তি দিতাম। কিন্তু ওরা একটা ফুলের বাগান-কে নষ্ট করেছে। তার কোনো শাস্তি আমার জানা নেই।
আমার শাস্তি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু প্রভুর শাস্তি চিরস্থায়ী। ওদের না-হয় প্রভুই শাস্তি দিবেন।”

স্নিগ্ধের ফোনে কল এলো। চটজলদি ফোন রিসিভ করল। কোনো কথা বলেনা। তার সেই ক্ষমতাটুকু এখন নেই। ওপাশ থেকে ডাক্তার নিজেই বলেন, “যেটা সন্দেহ করেছিলাম, সেটাই ঠিক মি. স্নিগ্ধ। অনেক আগে থেকেই মেয়েটা ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছে। দৌড় প্রতিযোগিতার সময় মাথায় অনেকটাই চাপ লেগেছে। তারপরে যখন মাটিতে পড়েছে তখন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। ফেটে গিয়েছিল। তাই সময় করেনি। শরীরের যতটুকু রক্ত ছিল তখন বেরিয়ে গেছে।”

স্নিগ্ধ ফোন রাখল। বাবার চিন্তায় মেয়েটা নিজের দিকে খেয়াল করার সময়ও পায়নি, যার ফলস্বরূপ তার এই দশা। বারবার চেতনা হারানো স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরলেও এটা মোটেও সহজ ব্যাপার ছিলনা।
স্নিগ্ধ উঠে দাঁড়াল। আকাশের তাঁরারা উধাও হয়েছে। মেঘ জমেছে। অবিলম্বে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ভিজে গেল উঠান। স্নিগ্ধ পিউয়ের বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুখের তার বিষাদের রেখা। চোখজোড়া টলটল। তার অবচেতন মস্তিষ্ক একটু হলেও কাজ করছে।
স্নিগ্ধ শেষবারের মত পিউয়ের কবরের কাছে গেল। সাথে পিউয়ের বাবা আর বন্ধুমহল। দূর থেকেই দেখল। পিউ যেন বলছে, “আমার গল্পে আমিই নায়িকা, কোনো নায়ক নেই। নায়কের থাকার অনুমতি নেই।”
কাছে গেলনা। গাড়িতে উঠল সকলে। কেউ তার মেয়ে, কেউ অচেনা, কেউ প্রিয় বন্ধুকে রেখে গেল। স্নিগ্ধ বিষাদের সুরে বলে,

“স্নিগ্ধ নামটা একজনের জীবন নিয়ে গেল। আজকের পর থেকে কেউ আমাকে স্নিগ্ধ নামে ডাকবে না। কথা দিচ্ছি। আমি না-হয় শুধুমাত্র তোমার স্নিগ্ধ হয়েই রইলাম।”

[সমাপ্ত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here