শর্বরে_জোনাকি ❤️,পর্ব: ০২

0
591

#শর্বরে_জোনাকি ❤️,পর্ব: ০২
#ইফা_আমহৃদ

“এই মেয়ে সংসার ভেঙে বাবার বাড়ি চলে এসেছিল। স্বামী নিতে এসেছিল, কিন্তু সে যাবেনা। স্বামী জোর করাতে নিজেই গলা কে’টে ম’রেছে।”

আমি শুধু একদৃষ্টিতে বুবুর দিকে তাকিয়ে আছি দূর থেকে। পাড়া প্রতিবেশীর কথা অনুযায়ী, সে নিজের ইচ্ছায় জীবন ত্যাগ করেছে। বুবু সত্যি এটা কীভাবে করতে পারল, কেন করল, আমার কথা কি তার একবারের জন্যও মনে পড়েনি? কীভাবে পারলেন? সে আমার কথা ভাবেনি, আমি কেন তাকে নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করব। বাবাকে আশেপাশে দেখছি না, বাবাও বুবুকে হারানোর শোকে কাতর হয়েছে। হয়ত অভিমানে আসেনি তাকে দেখতে।

তৌহিদ ভাই আপুর পাশে বসে কাঁদছেন। তাঁর এই কান্না আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে। সহ্য হচ্ছেনা। পুরুষ মানুষ কাঁদে? তাঁরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে কিন্তু কাঁদে না। মাঝখানে দু’বছর। এই দুবছরে একবারের জন্যও বুবুর খোঁজ নেয়নি। আজ কাঁদছে, আশ্চর্য ব্যাপার!

গ্ৰামের অভিজ্ঞ নারীরা শেষ গোসল করাতে সাহায্য করছে চাচীদের। এখান থেকে অনেকটা দূরে দাফনের ব্যবস্থা হচ্ছে। যথাসম্ভব দাফন সম্পন্ন করবে। আমি বাবার ঘরে গেলাম। ঘর ফাঁকা। বাবা নেই কোথাও। চিন্তা হল ভিশন। কোথায় গেছে তিনি। আমি ছুটে ছোটো চাচির কাছে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “বাবা কোথায় চাচি। বাবাকে দেখছি না।”

পরক্ষণেই চাচি প্রশ্ন করলেন, “কেন তুই জানিস না?”

“না-তো! জানলে কী তোমাকে জিজ্ঞাসা করতাম?”

চাচি ঠোঁটজোড়া মৃদু কাঁপছে। বলার চেষ্টা করেও বলতে ব্যর্থ সে। আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম। চাচি এবার স্থির হয়ে রইতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে বলে দিলো, “তোর বুবুর অবস্থা দেখে ভাইজান কালরাতে ব্রেন স্ট্রোক করেন। হাসপাতালে ভর্তি আছে। তোর চাচারা হাসপাতালে ছিল।”

শরীর থমকে গেল আমার। অদৃশ্য বন্ধন ঘিরে ধরল সবাঙ্গ। বাবা রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আমি কিছু জানতেই পারলাম না। প্রিয় এবং শেষ রক্তের বাঁধন। বাকশক্তি লোপ পেল। গলায় বর্ণগুলো আঁটকে রইল। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন করতে পারলেও শব্দ বের হলনা। ‘বাবা’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই মিনিট সময় লাগল। টেনে টেনে বললাম, “কো-ন হাসপাতালে ভর্তি বাবা?”

“জানি না, তোর এখন যাওয়ার দরকার নেই। বোনের শেষ যাত্রা। তার কাছে থাক। ভাইজান সুস্থ হয়ে যাবে।”

আমি চাচিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। কেন এমন হচ্ছে, আমার সাথেই কেন হচ্ছে?

দোতলা থেকে নিচ তলায় রওনা হলাম। বুবুকে জানাজা দিতে মসজিদের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে। বাড়িতে আর ফিরবে না। আমিও যাবো তাদের সাথে। বাবাতো এখানে নেই। বুবুর কবরে প্রথম মাটি আমি দিবো। বড়ো চাচিকে ডাকতে ঘরে গেলাম। বাইরে থেকেই ছোটো চাচা, বড়ো চাচা, বড়ো চাচি আর তৌহিদ ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম। কিছুটা হতভম্ব হলাম। চাচারা বাবার কাছে থাকলে এখানে কী করছে। ভেতরে গেলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁদের অপেক্ষায় ছিলাম। বড়ো চাচি তাড়া দিয়ে বলছে, “তোমরা এখনো এখানে বসে আছো, তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করো। একবার পুলিশের কানে খবর গেলে ময়না তদন্ত করবে। তাঁরা এমনি এমনি ছেড়ে দিবে না। ধস্তাধস্তির প্রমাণগুলো উঠে আসবে। তখন আমরা সবাই ফেঁসে যাবো। কোমরে দড়ি পড়িয়ে হিরহির করে টেনে নিয়ে যাবে।”

তৌহিদ ভাই বাঁকা হেসে বলে, “চাচিমা চিন্তা করবেন না। একদম করবেন না। গ্ৰামের লোকদের যা বুঝানোর আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। তাঁরা আমাদের পক্ষেই থাকবে।”
আমি থমকে গেলাম। আমার সন্দেহ বেড়ে গেল। তারমানে এরাই আমার বোনকে খু’ন করেছে। তৌহিদ ভাই তখন অভিনয় করছিল, কিন্তু বুবুকে খু’ন করে তার কী ভালো হল। চাচা-চাচি তাঁরা তো আমাদের নিজের লোক। তাঁরা কীভাবে পারলেন।

নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম। যেভাবেই হোক বুবুর মৃত্যুর প্রতিশো’ধ আমি নেবোই। আগে পুলিশকে সবটা জানাতে হবে।
ছুটতে ছুটতে থানায় হাজির হলাম। দারোগা সাহেব সবে এসেছেন। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে সাহায্য চাইলাম। তিনি সর্বপ্রথম আমাকে বসতে বললেন। একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে খেতে বললেন। অতঃপর স্নিগ্ধ গলায় বললেন, “এবার বলো কী হয়েছে তোমার? চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?”

“আমার সাহায্য চাই, আমাকে সাহায্য করুন প্লীজ।”

আশ্বাস দিয়ে বললেন, “নাম কী তোমার? আমাকে খুলে বলো।”

আমি ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম, “আমি পিউ। আমাকে সবাই পিউ বলে ডাকে। কালকে বড়ো পর্দায় বাস্কেটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি আমার বুবু গলা কাঁ’টা অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। বাবা হাসপাতালে। সবাই বলছে বুবু না-কি নিজেই গলায় দা চালিয়েছে। কিন্তু একটু আগে আমার চাচারা বলাবলি করছিল ময়না তদন্ত হলে তারা ধরা পড়ে যাবে। সত্যিই কি ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বুবুর আসল মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন হবে?”

“কেন হবেনা, অবশ্যই হবে। চলো.. [হাবিলদার ডেকে বললেন] ড্রাইভার-কে বলো গাড়ি বের করতে। কুইক।”

দারোগা সাহেবের কথা অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হলাম বাড়িতে। পুলিশ দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল, তবে আমাকে তাঁদের সাথে দেখে বেশ হতভম্ব হল। দারোগা সাহেব বাঁধা দিয়ে বললেন, “আমাদের কাছে খবর আছে এটা সাধারণ মৃত্যু নয়, এর পিছনে লুকিয়ে আছে রহস্য। আশা করি, আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন।”

কিন্তু সবাই উল্টো সুর ধরল। গ্ৰামের মানুষজন বলে কথা! নারীর শরীরে হাত দেওয়ার অধিকার তাঁদের নেই। সাক্ষ্য দিল, বুবুই আত্মহ’ত্যা করেছে।

তখন এই প্রভাব আমার উপর না পড়লেও রাতে ভয়ংকর রুপ নিয়ে ফেরে। আমি তখন টেবিলে মাথা গুঁজে বসে ছিলাম। বাবার অবস্থা জানা নেই। আমাকে হাসপাতালে যেতে দেয়নি। ঐঘটনার পর এই ঘরে বন্দি করে রেখেছে।
চুলে স্পর্শ পেতেই ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। সবাই এভাবে দেখে চমকে গেলাম। ভেতরটা হুঁ হুঁ করছে। যখন তখন যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আমি মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ছি। কিন্তু যা হওয়ার তাই হল। সর্বপ্রথম আমার হাঁটুতে আঘাত করল। পড়ে গেলাম নিচে। জীবনে প্রথমবার আঘাত পেয়ে আমার অবস্থা করুন। হাঁটু ধরে বসে রইলাম। অতঃপর কাঁধে আঘাত করল। ফুঁপিয়ে উঠলাম। জড়িয়ে ধরলাম চাচির পা। ধীরে ধীরে অত্যাচার বেড়ে গেল। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল দেহখানা। আমি আধমরা হয়ে পড়ে রইলাম। হাজারো আকুতি মিনতি করেও রক্ষা পেলাম না। মা’রতে মা’রতে একটা কথাই বলছিলেন, “আমাদের জেলে পাঠানোর শখ না তোর, এবার তুই নরকে যা।”

“আর এমন করব না। তোমাদের নামে কাউকে কিচ্ছু বলব না, এবারের মতো ছেড়ে দাও।”

“তোরে ছেড়ে দিলে আরও এমন করবি, তাই ছাড়ছি না।”

ছোটো চাচি নিচ তলা দিয়ে ছুটে এলেন আমার চিৎকার শুনে। আমাকে আগলে নিয়ে বললেন, “ওকে এবারের মতো মাফ করে দাও আর এমন করবে না। ক্ষমা করো।”
আমি জ্ঞান হারালাম। তবু পুরোপুরি নয়। কানে শুনতে পাচ্ছিলাম সবকিছু।
বড়ো চাচির মেয়ে মেলা বলল, “মা। অনেক শিক্ষা হয়েছে, এবার ছেড়ে দাও। দেখো, কালকে ওর বোন ম’রেছে, চাচা হাসপাতালে। আজকে ওর কিছু হলে গ্ৰামবাসীরা আমাদের দোষ দিবে।”

সবাই মেলার কথায় সায় দিল। মাথায় প্রচুর ব্যথা পেয়েছিলাম। এরপর থেকে সামান্য কারণে মাথা ব্যথা হতো। একটু বেশি সমস্যা হলে মাথা ঘুরে যেত। জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। তারপর থেকে ছোটো খাটো ব্যাপারেই অত্যাচার বেড়ে গেল। বাড়িটা আমার জন্য বিষাদের ছায়া লাগছিল।

ছোটো চাচি বিছানায় শুইয়ে দিলেন। মাথায় পানি দিলেন। হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমার চোখ থেকে তখন অবিরাম ধারায় অশ্রু গড়াচ্ছিল। নিঃস্ব লাগছিল নিজেকে। প্রথম বুক ভরা কষ্ট নিয়ে মৃত্যু কামনা করলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here