শর্বরে_জোনাকি ❤️,পর্ব: ০৫

0
377

#শর্বরে_জোনাকি ❤️,পর্ব: ০৫
#ইফা_আমহৃদ

বাস্কেটবল খেলোয়াড় স্নিগ্ধ-কে দেখে মাথা ঘুরে উঠল পিউয়ের। সাতান্নবারের রেকর্ড ভেঙে আটান্নবার চেতনা হারিয়ে ফেলল। অবিলম্বে স্নিগ্ধ আরও একবার হতভম্ব হল। গতকাল তাকে দেখার পূর্বেই বাস্কেটবলের আঘাতে চেতনা হারায়। আজ দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া মাত্র। স্নিগ্ধ দ্রুতি হাতে বেষ্টিত করে নিল পিউ-কে। বসার ছেড়ে চটজলদি দাঁড়িয়ে পিউ-কে বসিয়ে দিল। হৃৎপিণ্ডের সাথে আবদ্ধ করে নিল। মুঠোফোন ব্যবহার করে ডা. মিহানের কন্টাক্ট নাম্বারে কল করে। মিহান কলের ইতি টেনে দ্বি ক্ষণে পাশের কেবিনে চলে এলো।

স্নিগ্ধ বেঞ্চিতে বসে ছিল। পিউ তার পাশে বসছে। স্নিগ্ধের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেনা। তার কাজে মনোযোগী হল। অতিশয় যত্নে হাতের ক্ষতগুলোতে ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছিল। স্নিগ্ধের পায়ের ক্ষত চিহ্নতেও আলতো স্যাভলন মিশ্রিত তুলো স্বযত্নে লাগিয়ে দিচ্ছিল। স্নিগ্ধের সুরসুরি লাগছিল। তুমুল শব্দে কাশি দিল। অকস্মাৎ শব্দে ভীত হল পিউ। অবিলম্বে মানুষটির মুখশ্রীর পানে অবলোকন করল। স্নিগ্ধ-কে তার কল্পনাপ্রবণ ঠেকল। স্নিগ্ধ নামটা-কে চরম অবজ্ঞা, ঘৃণা করলেও এককালে ভালোবাসায় মিশ্রিত ছিল। তাই এই মুখটা-কে সে কখনও বিস্মৃতি করতে পারে না। নিজের স্বামী স্নিগ্ধ থেকে খেলোয়াড় স্নিগ্ধ-কে অতিশয় ঘৃণা করে। সে যথারীতি দৃষ্টি ব্যাঘাত করতে বিস্মৃতি হল। আকস্মিক ঘটনাগুলোতে পিউয়ের মস্তিষ্ক অচেতন হয়। এখনও বিন্দু পরিমাণ ব্যতিক্রম ঘটেনা। তার কপালে নোনতা ঘাম জমল। নেত্রপল্লব ঘনঘন পড়ল। তার সচল মস্তিষ্ক অচল হয়ে ঝুঁকে পড়ল নিচে।

মিহান পিউয়ের অবস্থায় দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। এটা নিত্যদিনের সমস্যা। এর আগে কতবার এমন হয়েছে জানা নেই। পিউয়ের জন্য অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে সে। ‘নার্স নার্স’ বলে চ্যাঁচিয়ে ডাকল মিহান। তৎক্ষণাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো দু’জন নার্স। তাঁরা বেজায় বিরক্ত পিউয়ের ওপরে। তেজ দেখিয়ে বলে, “স্যার ওকে এবার বের করে দিন। দু’দিন পরপর ঝামেলা করে। আগেরবার প্রচুর জিনিসপত্র ভেঙেছিল।”

মিহান রাগান্বিত স্বরে বললেন, “সে আমি বুঝে নিবো, আপনাকে কেউ বুঝতে বলেনি। আপনি পিউয়ের থেকে সিনিয়র হতে পারেন আমার থেকে নয়। অন্যকে বের করে দেওয়ার কথা বললে আমি তাকে বের করে দিবো। বুঝেছেন?
এবার ওনাকে তুলে ওখানে শুইয়ে দিন। তারপরে স্নিগ্ধের কী লাগবে দেখুন।”

নার্সরা নিঃশব্দে সম্মতি দিল। অতঃপর পিউ-কে তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। তাকে নিজ হাতে চ্যাক-আপ করল মিহান। বন্ধু বলে কথা! শরীর দুর্বল। আগামী দু’দিনের ছুটি দিল পিউকে।
_______
বিকেলের সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। তেজ হ্রাস পেয়ে নিস্তেজ রশ্মি।
গভীর ভাবনায় মগ্ন পিউ। তাকে ঘিরে রয়েছে তার বন্ধুমহল। মুখশ্রী জুড়ে দুশ্চিন্তার আভা। অসুস্থ বাবার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। দু’দিনের অবশিষ্ট রয়েছে। অতিদ্রুত মেডিসিন কিনে গ্ৰামে কুরিয়ার করতে হবে। হাতের টাকাও ফুরিয়ে গেছে পিউয়ের। আজ মাসের দুই তারিখ। দশ তারিখের আগে স্যালারি জোটে না তার। একদিন মিস্ গেলে বিশ তারিখের পর। মেঘলা পাঁচজনের জন্য পাঁচ কাপ কফির অর্ডার করল। ওয়েটার কফি রাখল টেবিলে। সবাই কফি খাওয়াতে মনযোগ দিল একমাত্র পিউ ব্যতিত। মেঘলা কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলে, “আমার খবর তো জানিসই। এইচএসসি পাড় করার আগে বাবা টাকা দিবে না। এইচএসসি পরীক্ষা এখনও অনেক দেরি আছে। কী যে করি?
তবে একটা উপায় আছে।”

পিউ আশার আলোর সন্ধান পেল। অবরুদ্ধ গলায় বলে, “কী? কী উপায়। তাড়াতাড়ি বল।”

মেঘলা একটু থমকে গেলেও পরক্ষণে শান্ত হয়ে বলে, “আমার মনে হয়না তুই পারবি।”

এবার যে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল পিউয়ের। অশান্ত হয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে, তুই বলবি কি-না সেটা বল? আমি বুঝে নিবো।”

উচ্চ শব্দে সবাই বিরক্তিকর দৃষ্টিতে পিউয়ের দিকে দেখল। এতে পিউয়ের অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেল। বিষয়টা বোধগম্য হতেই মেঘলাসহ সবার কাছে স্যরি বলে। অতঃপর করুন গলায় বলে, “প্লীজ বলনা।”

সংক্ষিপ্ত জবাব দিল মেঘলা, “প্রতিযোগিতা।”

সন্দিহান গলায় বলে পিউ, “কীসের প্রতিযোগিতা?”

আমতা-আমতা করে প্রতুক্তি করল মেঘলা, “দৌড় প্রতিযোগিতা। সেদিন ক্লাসে স্যারে দৌড় প্রতিযোগিতার কথা বলেছিলেন। আমাদের কলেজের সাথে অক্সফোর্ড মডেল কলেজের।”
এতবয়সে দৌড় প্রতিযোগিতা? কীভাবে সম্ভব। দৌড় প্রতিযোগিতা চলাকালীন দেখা যাবে, বড় বড় কতগুলো ষাঁড় মাঠের মাঝখানে ঘাস খাওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করল। বিষয়টা সত্যিই দৃষ্টিকটু। পুনরায় প্রশ্ন করল পিউ, “কত মিটারের? বড়দের। নিশ্চয়ই পাঁচ’শ হবে? এতবড় মাঠ কোথায় পাবে? রাস্তায়? ব্যাপারটা কেমন দেখাবে ভেবে দেখ। সবাই কীভাবে দেখবে?”

মুন বলে, “গোল দৌড়। কত মিটারের সেটা বলে নি। মাঠের ভেতরেই হয়ে যাবে।”

মুনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মিহুল ধমকের সুরে বলে, “তোর মাথা খা’রাপ মেঘ। কীসব বলছিস। পিউয়ের মাথায় সমস্যা। গোল দৌড় সে পারবে না। একটুতেই মাথা ঘুরে। পারবে না।”

“তাহলে উপায়?” তূর্ণ।

মেঘলা কৌতুহল নিয়ে বলে,‌ “আমরা তো ভালো দৌড় জানি-না, পিউ জানে। ও ছোটো বেলায় অনেক দৌড়াদৌড়ি খেলেছে। গ্ৰামের মেয়েরা সুপারি গাছ থেকে কলা গাছেও উঠতে পারে। আমরা তা পারি না।”

‘পিউ প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করবে’ – এই ভেবে তার প্রতিজ্ঞায় অনড় রইল। এছাড়া কোনো উপায় নেই বললেই চলে। ধার দেওয়ারও কেউ নেই। কফি ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে চুমুক বসালো কাপে। মনটা ফুরফুরে লাগছে। ভোরের আলোয় আলোকিত হওয়ার পরই সে প্র্যাকটিসে নামবে।
চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখতে নিয়ে বাঁধল বিপত্তি। ডানহাতের সাথে ধাক্কা লেগে অচিরেই কফির তরল অংশটুকু গায়ে পড়ল তার। পিউ বেজায় বিরক্ত। গরম ছ্যাকা লাগল। তারচেয়ে বিরক্ত জামাটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটা মাত্র জামা তার। টাকার অভাবে জামা কিনতে ব্যর্থ সে।
পিউ ঝাঁজালো গলার বলে, “দেখে চলতে পারেন-না নাকি? আশ্চর্য!”

স্নিগ্ধ তখন কফিশপে আসে। ফোনে কথা বলার সময় অসাবধানতায় ধাক্কা লেগে যায় পিউয়ের সাথে। ফোনটা রেখে একবার পরখ করে নিল। অতঃপর কঠোর গলায় বলে,
“না পারি না। দেখে শুনে চলতে না পারলে কফিটা আপনার গায়ে পড়তো না।”

না বোঝার স্বরে, “মানে?”

স্নিগ্ধ বুঝিয়ে বলতে আরম্ভ করল, “আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়েছি। মানে আপনি ধাক্কা পেলে নুড়ে যেতেন। কাপটা নিচে পড়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। হয়েছে উল্টো, কাপটা আপনার গায়ে পড়েছে। আমি তো কাপে ধাক্কা দেইনি। তাই আমার দেখেশুনে চলার প্রশ্নই আসেনা।”

পিউ একবার নিজের পানে আরেকবার কাপের পানে উদাস দৃষ্টি দিচ্ছে। ধাক্কা লাগার স্পর্শটা উধাও হয়ে গেছে। কোথায় ধাক্কা লেগেছে সেটাই বলতে পারছেনা। নিজের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত সে। কেন স্পর্শটা অনুভব না করেই ক্ষেপে গেল। তবুও দমে গেল না। অন্য দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে, “ধরা পড়ার পর সবাই এককথাই বলে। আমার শখের জামাটা যে নষ্ট হল, তার দায় কে নিবে?”

“আমি নিবো..

“ড্রাই ক্লিন করতে আর কত লাগে? অন্যের জামা কাপড় নষ্ট করবেন আর ড্রাই ক্লিনিং করতে টাকা দিয়ে দিবেন। বিরক্তিকর!”

স্নিগ্ধ বুঝতে পারল না পিউয়ের কথার ধরন। তাকে ব্যঙ্গ করে কথা বলা হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। অবিলম্বে পিউয়ের ডানহাত চেপে ধরল স্নিগ্ধ। তার চোখের মণিগুলো জ্বলজ্বল। স্নিগ্ধ মনে প্রাণে চাইছে, যাতে এই মেয়েটার সাথে তার দেখা না-হয়। যতবার দেখা হয়েছে, চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাকে।
ঘরের বাইরে পা রাখলেই নিজের নিরাপত্তার জন্য মাক্স ব্যবহার তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজও মাক্সের কারণে তাকে চেনা দুস্কর।

আকাশে ভারী মেঘরা ধরা দিয়েছে। তবুও গরমের আভা ছড়াচ্ছে। বৃষ্টির আগমনের পূর্বে হিম হাওয়া শরীরের লোম খাড়া করে দিলেও, আজ গরমে দিশেহারা। পিউ ওড়না দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিল। গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে যাচ্ছে। তার ডানহাতটা এখনও অন্য কারো দখলে। জায়গা বন্দি হয়ে থাকলেও বন্দি মনে হচ্ছে না। আলতো করে ধরেছে সে।

শপিং মলের আরেকটু ভেতরে ঢুকতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটল। আলোকিত সবকিছু নিমিষেই আঁধারে নিমজ্জিত হল। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে গেল একপাশে। মিনিট দুই অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই জেনারেটর সিস্টেম চালু হল। পুনরায় আলোকিত হল। তাকে লিফ্টের সাহায্য নিতে হবে, কিন্তু এখন সে লিফ্টে যেতে চায়না। নিচতলার ছোটো একটা কফি হাউজের গিয়ে বসল। দু’কাপ কফির অর্ডার করল। পিউ কিছুটা অস্বস্তি ভুগে। সে জানেনা, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে কিছুটা অনুমান করতে পারে। অসহায় কণ্ঠে বলে, “আমি সত্যি বুঝতে পারিনি।”

“কী বুঝতে পারেননি আপনি? কফি তো আমি ফেলেছি, আপনি কেন বুঝবেন? হম! না-কি ইচ্ছে করে..

পিউ বুঝতে পারল স্নিগ্ধের কথার ধরন। সে নিভৃতে অধর চেপে ধরল। স্নিগ্ধ মাক্স খুলে ফেলে। প্রকাশ হয় তার ঘাম মিশ্রিত মুখশ্রী। পিউ ঘোরে চলে গেল‌। তার সামনে সত্যিই স্নিগ্ধ বসে আছে, ভাবতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা হাসপাতালে কি সত্যি স্নিগ্ধ ছিল? চারদিকে সবাই তখন স্নিগ্ধ-কেই দেখতে ব্যস্ত। ভিড় জমে গেল। ‘সেলফি অটোগ্ৰাফ’ – নিয়ে বেশ নাজেহাল স্নিগ্ধ। তবুও কাউকে ফেরাতে নারাজ সে। গরম কফিকে ঠান্ডার হওয়ার আহ্বান করে ভক্তদের সাথে মেতে উঠল। ভিড়ের কারণে স্নিগ্ধ-কে দেখার তৃষ্ণা, তৃষ্ণাই রয়ে গেল। এতটা মিশুক মানুষ হতে পারে, স্নিগ্ধ-কে না দেখলে তার জানা হতো না।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here