#বিবি,পর্ব (৮)
#রোকসানা_রাহমান
” বাক্সের মধ্যে ভালোবাসা বন্দি করেছ? ”
অনড়ার কণ্ঠে বিস্ময়। চোখদুটো চকচকে। কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে চাহনিতে, নিশ্বাসে। বাক্স হাতে ছুটে এলো বুবুর নিকট। দারুন উৎসাহে বলল,
” আমি একটু ভালোবাসা দেখি? ”
তার আহ্লাদ ঝরে পড়া আবদারে টনক নড়ল কোমলের। খেয়াল এলো বেখেয়ালি মনটায়, মুখটায়। বই সরিয়ে নিল ঝটিতে। বাক্স টেনে নিয়ে বলল,
” না। ”
বুবুর এমন আচরণে অবাক হলো অনড়া। অভিমানে ঠোঁট উল্টাল। সুন্দর মুখটায় মেঘ জমল। দুঃখী গলায় জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” এটা আমার নয়। ”
” তাহলে কার? ”
মুহূর্তেই একটি কিশোর মুখ ভেসে উঠল কোমলের চোখের পাতায়, মনের আয়নায়। মস্তিষ্কজুড়ে ঘুরতে লাগল একটি জেদি পুরুষালি কণ্ঠস্বর। কোমল চোখের পলক ফেলল ঘনঘন। কিশোর মুখটা দূর করতে চাইল মন থেকে। কণ্ঠটা ভুলে যেতে চাইল জোর করে। আপনমনে কিছু একটা বিড়বিড় করে তাকাল অনড়ার দিকে। ধমকের মতো করে বলল,
” পড়া মুখস্থ হয়েছে তোর? ”
” না, আরেকটু বাকি। ”
” থাকবেই তো। মন যদি অন্য কোথাও ঘুরে বেড়ায় তাহলে পড়া মুখস্থ হবে কী করে? ”
অনড়া মাথা নুয়িয়ে নিল। বাক্সের কথা ভুলে অপরাধীর মতো বসে থাকল চুপচাপ। সেই সুযোগে কোমল বাক্সটা ঢেকে দিল ওড়না দিয়ে। একটু সামনের দিকে এগিয়ে বসল যাতে বাক্সটা অনড়া দেখতে না পায়। তারপর বলল,
” বই দে। দেখি কতটুকু মুখস্থ হয়েছে। ”
অনড়া বই দিল ভয়ে ভয়ে। কোমল বলল,
” শুরু কর। ”
অনড়া খাট থেকে নেমে গেল চট করে। দরজার দিকে পালিয়ে যেতে যেতে বলল,
” আমি আবার মিথ্যা বলেছি, বুবু। আমার একটুও পড়া হয়নি। ”
কোমল পেছন থেকে ডাকল। অনড়া শুনেও থামল না। আড়াল হতে হতে চিৎকার করে বলল,
” সন্ধ্যায় আবার পড়ব। এখন আমার ছুটি। ”
কোমল রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল। বই-পত্র গুছিয়ে রাখল নিজের টেবিলে। বিছানার চাদর টেনে ঝাড় দিতে গিয়ে বাক্সটা নজরে পড়ল। হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে ভাবছে, কী আছে এতে। তখনই দৈব কর্ণে বাজল, ‘ আমার ভালোবাসা। ‘
কোমল হাত সরিয়ে নিল। বুকের ভেতর কোথাও একটা ঢেউ উঠল। ঝড় বয়ল। ভাসিয়ে নিতে চাইল অন্য কোথাও। অন্য প্রান্তে। লুপ্তপ্রায় মনটায় বিদ্যুৎপ্রভার মতো জ্বলে উঠতে চাইল কিছু। কোমল বাঁধা দিল। ঠিক করল এটা খুলে দেখবে। নাহলে কৌতূহল বাড়বে ক্ষণে ক্ষণে। কিশোর মুখটা মনে পড়বে বার বার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাক্সটা খুলল ধীরে ধীরে। ভেতরে তাকিয়েই ভ্রূজোড়া কুঁচকে এলো আপনাআপনি। ছোটখাটো বিচিত্র জিনিসে ঠাঁসা। সবার উপরে পড়ে থাকা ব্যান্ডেজ হাতে নিল কোমল। রক্তে মাখা ব্যান্ডেজটি উল্টেপাল্টে দেখল ভালো করে। একটা চিকন সুতোয় মাঝামাঝিতে বেঁধে রেখেছে। কোমল রাখতে গিয়েও থামল। সুতো খুলে ব্যান্ডেজের ভাঁজ খুলতে খুলতে একটি কাগজ বেরিয়ে এলো। এটিও বিভিন্ন ভাঁজে ভাঁজ করা। কোমল আশ্চর্য হলো। কাগজের ভাঁজ খুলে দেখল চিঠির মতো কিছু লেখা। কিন্তু সম্বোধন নেই। কোমল পড়া শুরু করল,
‘ তখন আমার বয়স সাত কি আট। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছি। পড়া শিখতাম নিয়মিত। শিক্ষকরা আদর করতেন খুব। এটা আমার সহপাঠীরা সহ্য করত না। হিংসের চোখে দেখত। সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া লাগত। মারামারি করতে চাইত। তেমনি একটি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল পাশের পাড়ার কাওসারের সাথে। ঝগড়া থেকে মারামারি। আমার সাথে পেরে না উঠায় বলল,
” তুই তো বান্দির পোলা। বান্দির পোলার লগে আমি মারামারি করি না। ”
কাওসার আমার বাঁধন থেকে আলগা হলো সর্বশক্তি দিয়ে। একটু দূরে সরে আবার বলল,
” বান্দি খাইটা জুডা খাওন আনে তোর মা। তুই ওগুলা খাস। ছোডলোকের বাচ্চা। সর আমার গায়ের লগে লাগবি না। গন্ধ করব। ”
আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। রাগে-ক্ষোভে ঘুষি মেরে বসি ওর মুখে। গলা চিপে ধরে আক্রোশ নিয়ে বলি,
” মিছা কথা। শক্তিতে পারছ না তাই এগুলা কইতাছস। ”
” হাচা কথা। বিশ্বাস না হইলে মোল্লাবাড়ি গিয়া দেখ। ”
আমি ছুটে বেরিয়ে আসি স্কুল থেকে। মোল্লাবাড়িতে না গিয়ে আমাদের বাড়ি যাই। চিৎকার করে মাকে ডাকি। মা উত্তর দেয় না। খিল দেওয়া দরজার সামনে বসে থাকি। মা সন্ধ্যা শেষ করে ঘোমটা টেনে বাড়ি আসে। আমি দূর থেকে দেখি তার হাতে ঢাকনা চাপা বড় থালা। আমি দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,
” তুমি বান্দি খাটো? ”
মা উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে। রুমের ভেতর টেনে নিয়ে বলল,
” তোর লাইগা মুরগির কইলজা রাইন্ধা আনছি। আয় খাবি। ”
মা ঘরে থাকা পান্তা ভাত মুঠোয় করে থালাতে নিল। লবণ দিয়ে নরম করে মেখে আমার মুখে ধরল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
” তুমি মোল্লাবাড়িতে বান্দি খাটো? ওগো জুডা, বাসি, পঁচা খাওন আমারে খাওয়াও? ”
” এগুলা জুডা না বাপ। ভালা, কড়াই থেইকা তুইলা দিছে। ”
আমি বুঝে গেলাম কাওসার সত্যি কথা বলছে। সকলের সামনে সত্য অপমান করছে। আমি আসলেই বান্দির পোলা। বড়লোকের ঝুটা, উচ্ছিষ্ট খেয়ে বড় হচ্ছি। ছোটলোকের উপাধি পাচ্ছি।
মা আমাকে আদর করে আবারও খাওয়াতে চাইল। আমি ঠেলে ফেলে দিলাম। মাটির থালা ভেঙে গেল কয়েক টুকরায়। মাও ধৈর্য্য হারিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরে বসল। ছলছল চোখে খাবার তুলতে গেলে আমি চিৎকার করে বললাম,
” ছুঁইবা না। ”
মা আমার কথা শুনল না। খাবার স্পর্শ করল। থালার ভাঙা অংশ সরিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে থাকে। আমি ছুটে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বাঁধা দিতে চাইলাম। মা আমাকে সরিয়ে দিচ্ছিল বারবার। আমি আবারও তার হাত ধরে টানতে থাকি। মা-ছেলের ধস্তাধস্তির মধ্যে হাত কেটে গেল মায়ের। রক্ত পড়ল টপটপ করে। আমি ভয় পেয়ে যাই। এক দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসি। বাড়ি যাওয়ার সাহস করতে পারি না৷ পরের দিন সকালে জহির কাকার আমবাগান থেকে খুঁজে বের করে বাবা। কোলে করে বাসায় নিয়ে যায়। মা তখন বাসায় ছিলই। আমাকে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। আমি মায়ের আদর খেতে খেতে দেখলাম তার হাতে সাদা রঙের কাপড় বাঁধা। জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘ কোমল ওষুধ দিয়া ব্যান্ডেজ কইরা দিছে। আর রক্ত পড়ব না। ব্যথা করব না। ওরা খুব ভালা মানুষ। রাগ করিছ না, বাবা। ‘ সেদিন আমি স্কুলে গেলাম না। মাও কাজে গেল না। সারাদিন-রাত মোল্লাবাড়ির গল্প শুনলাম। সেই গল্পের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে আমার হৃদয়ে বসল শুধুমাত্র কোমল। তার মন নাকি তুলোর মতো নরম। পানির মতো সরল। বাতাসের মতো শীতল। সেই ছোট্ট আমি ভীষণভাবে পুলকিত হলাম, মুগ্ধ হলাম তাকে নিয়ে বলা প্রত্যেকটি বর্ণনায়। ‘
_________________
অনড়া একদৌড়ে বারান্দায় এসে থামে। উঠোনে নামতে গিয়ে দেখে কুলসুম নাহার আসছে হাতে কাপড় নিয়ে। তার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপল। দৌড়ে দরজার পেছন লুকাল। কুলসুম নাহার কাপড় হাতে মূল দরজার সামনে আসতেই ভূতের মতো সামনে এসে দাঁড়াল অনড়া। মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
” আজ তোর রক্ষা নেই, কুলসুম। মাথা চিবিয়ে খাবো। ঘাড় মটকে দেব। ”
ভরসন্ধ্যায় এমন কাণ্ডে ভয় পেয়ে গেল কুলসুম। প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়। ‘ আল্লাহ গো ‘ বলে চিৎকার করলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে অনড়া। মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে নাচতে নাচতে বলছে,
” কুলসুম, ভয় পেয়েছে। আহা, কী আনন্দ! কুলসুম, ভয় পেয়েছে। ”
ছোটবেলা থেকেই কুলসুম নাহারকে নাম ধরে ডাকে অনড়া। অনেক ধমকে-ধামকে, বিচার দিয়েও ডাক পাল্টাতে পারেনি কেউ। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে কুলসুম নাহার। তাই এই ব্যাপারটি রাগ না হলেও তাকে ভূত সেজে ভয় দেখানোটা মানতে পারল না। চুলের মুঠি ধরে বলল,
” অনেক আনন্দ না? আয়, আমার লগে। আজ কোমলের হাতে মাইর খাওয়ামুই। আয়, কইতাছি। ”
চলবে