#অন্তরালে
#শেষ_পর্ব
_আরশিয়া জান্নাত
সাদাত কে দেখে আসিফের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে রেগে বললো,
:কি ব্যাপার তুমি এখানে?
তখন জাহানারা বেগম বললেন,আমি ওকে আসতে বলেছি।এসো সাদাত বসো।বৌমা ওর জন্য চা করতে বলে দাও।
:কিন্তু মা ওকে কেন আসতে বলেছ?(আসিফ)
:ক্ষমা চাইতে ডেকেছি।
:মানে ?
:শোন তাহলে,,,,
আসিফ কল্পনাই করতে পারেনি ফারহান আর রিয়া ওকে এতো বড় মিথ্যে বলেছিল।জেরিনের ডিপার্টমেন্ট এর ফ্রেন্ড বলে ও ওদের বিশ্বাস করেছিল তাছাড়া প্রমাণ ও ছিল।কিন্তু এখন বুঝলো সব নাটক ছিল।মাঝখানে কতকিছু হয়ে গেল!!
:আমাকে ক্ষমা করে দাও সাদাত।আমি আসলেই ভাবিনি।জেরিন আমার খুব আদরের বোন ওকে কেউ ধোঁকা দিচ্ছে জেনেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।আমার তখন তোমার সব কিছু মিথ্যে মনে হয়েছিল তাই তোমাকে বলার সুযোগ ও দেই নি।আমি তোমার কাছে অপরাধী।
:ভাইয়া আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ।আমিও আপনাদের কাছে অপরাধী।বিশেষ করে ঋতু ভাবীর কাছে।
আসিফ অবাক হয়ে বললো ,কিভাবে?
তখন সাদাত বললো,ভাইয়া জেরিনকে হারানোর পর আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।মাথায় জেদ চেপে বসেছিল আপনার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার।সেজন্যই ভাবীকে ব্ল্যাকমেইল করে আপনাদের ডিভোর্স ফাইল করাই।কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি জানতাম না আপনি কেন ঐদিন এরকম করেছিলেন।জেরিন যখন সব বললো অপরাধবোধে আমি কুঁকড়ে গেছি।আমাকে মাফ করে দিন।
আসিফ কি বলবে বুঝতে পারলো না!! তখন ঋতু বললো,শোনো ভাই সেদিন দোষ আসিফ করেছিল তার শাস্তি ও পেয়েছে।আর তুমি জেরিন থেকে এতোদিন দূরে ছিলে ঐটা শাস্তি ছিল।এখন যা হবার হয়ে গেছে।সেইসব নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।তাছাড়া আমাদের ডিভোর্সটা এখন ফলস হয়ে গেছে আমরা রি-রেজিস্ট্রেশন করেছি।
আরাফাত সাহেব বললেন,হ্যাঁ বৌমা ঠিক বলেছে।অকারণে সেদিন তোমাকে অপমান করেছে আসিফ।তোমার মা বাবাও কষ্ট পেয়েছেন।দুই পক্ষই কষ্ট ভোগ করেছে।এখন সেসব ভুলে নতুন করে সব শুরু করাই ভালো।
আসিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,তোমার মায়ের অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে আমি দায়ী।আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইবো।আর তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো।
জেরিন আড়ালে থেকে সব শুনে খুশিতে কান্না করে দিলো।
_____
আজ জেরিনের হলুদ।সারাবাড়িতে মানুষ গমগম করছে।সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত।আসিফ কড়া গলায় ঋতুকে বলেছে কোনো কাজে হাত না দিতে।ঐদিকে সাদাত একটু পরপর জেরিনকে ফোন করছে তা নিয়ে রায়া আর জেরিনের কাজিনরা মজা করছে।
রায়া:কি ব্যাপার বেয়াইন সাহেবা আজ বাদে কাল তো চলেই যাচ্ছেন উনার কাছে।তাও বুঝি তর সইছে না?
জেরিন লজ্জায় লাল হয়ে বললো,এক মাঘে শীত যায়না।তোমার বেলা আমিও দেখবো।
:ওমা তোমার গাল দেখি টমেটো হয়ে গেছে দেখি দেখি এদিকে ফিরো একটা ছবি তুলি।
তারপর গান গেয়ে রায়ারা নাচতে শুরু করলো,
কেউ মনে মনে গড়ছে তাজমহল
কার ঘুমের কোনে হচ্ছে রং বদল
নিচ্ছে কার পিছু
বলছে না কিছু
করছে কারচুপি
মন ভরাডুবি
বলে দে, বলে দে
চুপ কথা খুলে দে আয়
খুশির আনন্দে হাসি চল
জীবনের ছন্দে ভাসি চল
খুশির আনন্দে হাসি চল
জীবনের ছন্দে ভাসি চল…….
ছাদের সব আয়োজন করা হয়েছে।খুব সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে।বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা!
স্টেজে সবাই জেরিনকে নিয়ে ব্যস্ত।সবাই এক এক করে হলুদ দিচ্ছে, কেক খাওয়াচ্ছে ,ভিডিও করছে।ঐদিকে আসিফ ঋতুকে ফোন করে বললো নীচে রুমে আসতে।ঋতু রুমে গিয়ে ঢুকতেই আসিফ ওকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিলো।
:আহা হচ্ছে টা কি?
:রোমান্স হচ্ছে।
:সবসময় রোমান্টিক মুডেই থাকো তুমি!
:কি করবো বলো এতো সুন্দরী বৌ থাকলে অটোমেটিক রোমান্টিক মুড চলে আসে।
:হুহ ন্যাকা।ঘরভর্তি মেহমান আর উনি আসছে রোমান্স করতে।
:ঘরভর্তি মানুষ থাকলেই তো মজা।লুকিয়ে রোম্যান্স করার আনন্দই আলাদা।
তারপর হলুদ এর বাটি থেকে বেশ খানিকটা হলুদ নিয়ে ঋতুর পেটে মাখিয়ে দিলো।ঋতু শিহরণে চোখ বন্ধ করে ফেললো।এমন সময় আসিফ তাঁর কানে ফিসফিস করে বললো,কি করবো বলো,বিয়ে দেখলেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করে।অবশ্য নিজের বিয়েতে বৌকে হলুদ লাগানো যায়না।
ঋতু ওকে ধাক্কা দিয়ে বললো,দিলেতো শাড়িটা নষ্ট করে।পেটে কেউ হলুদ মাখে?
:তো কি গালে মাখবো?পরে সবাই জিজ্ঞাসা করলে তুমিই তো লজ্জা পেতে।কেউ যেন না দেখে তাই তো…..
:হয়েছে থাক আর বলতে হবেনা।আসছে বড় বুঝদার সাহেব।
ঋতুকে ঘুরিয়ে তাঁর চুলে মুখ গুজে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।
তারপর পিঠের চুল আলগোছে সরিয়ে কাঁধে গাঢ় করে চুমু খেয়ে বললো,
উহু! বুঝদার সাহেব না লাজুকলতার বর।
:ছাদে চলো সবাই খুঁজবে তো।
:না কেউ খুঁজবেনা।সবাই এখন ব্যস্ত।
:বলেছে তোমাকে!
আসিফ ঋতুকে কোলে তুলে বললো,
বলেছেই তো।বলেছে ঋতুর বেশি করে খেয়াল রাখবি।আমরা সবাই ব্যস্ত থাকবো।
ঋতু লজ্জায় লাল হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।
বেশ ধুমধাম করেই সাদাত আর জেরিনের বিয়েটা হলো।সব গ্লানি কাটিয়ে দুই পরিবার মিলিত হলো।
কবুল বলার আগে সাধারণত মেয়েরা কান্না করে, কিন্তু তাঁদের বেলা কবুল বলার পর সাদাত খুশিতে কান্না করে দিলো।
আয়নায় মুখ দেখিয়ে সাদাত কে জিজ্ঞাসা করা হলো কি দেখতে পাচ্ছ ?
সাদাত আনমনে বললো, অপ্সরী।
সবাই খুব জোরে অপ্সরী বলে চিৎকার করলো।জেরিন লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললো।
।
।
বিদায়ের সময় সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠলো জেরিন।তখন আসিফ সাদাতের হাত ধরে বললো,ভাই তোমার হাতে আমার কলিজার বোনকে তুলে দিয়েছি।আমার বিশ্বাস তুমি ওর যত্নে ত্রুটি রাখবেনা।
সাদাত সান্ত্বনা দিয়ে বললো,আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমি আপনার বোনকে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করবো,ইনশাআল্লাহ।
জেরিন চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়িটা কেমন নিরব হয়ে গেল।সবকিছু গুছিয়ে ঋতু রুমে ঢুকে দেখলো আসিফ বসে বসে কাঁদছে।
ঋতু গিয়ে ওর কাঁধ হাত রেখে বললো,
এভাবে কেঁদো না।সব মেয়েকেই একদিন পরের ঘরে যেতে হয়।নিজেকে সামলাও।
আসিফ বললো,সেদিন ই তো বাবা মা জেরিনকে হসপিটাল থেকে আনলো।আমি পুরো বাড়ি মাথায় তুলে বলেছিলাম বোন এসেছে আমার বোন এসেছে! আজ বোনটা চলে গেল অথচ আমি চিৎকার করে কেঁদে বলতে পারছিনা বোন চলে গেছে।কেন আদরের বোন আর মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হয়?
ঋতু আসিফকে বুকে জড়িয়ে বললো,
কষ্ট পেয়ো না।ও তাঁর ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছে,এই ভেবে সুখী হও। জেরিনকে সাদাত খুব ভালোবাসে,দেখো খুব যত্নে রাখবে।
।
।
ফুলে ফুলে সাজানো ঘরে অনেকক্ষণ যাবত জেরিন অপেক্ষা করছে।কিন্তু সাদাত আসছেনা।সারাদিনের দখলে ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসছে।”উফ! লোকটা যে কোথায় কে জানে!”
বেশ কিছুক্ষণ পর সাদাত এলো,
স্যরি আসতে দেরী হলো।আসলে বন্ধুরা ছাড়তেই চাইছিল না।তোমার ঘুম পেয়েছে?
:না সমস্যা নেই।
:তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো।
(আজীব ছেলে।বাসর রাতে কেউ ঘুমায়।কোথায় একটু রোমান্টিক কথা বলবে তা না।।ইশ এতো আনরোমান্টিক জানলে বিয়েই করতাম না।হুহ)
জেরিন ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সাদাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
:ঘুমোবেন না?
:হ্যাঁ।তোমার জন্য খাবার আনতে বলবো?ক্ষিদে পেয়েছে?
:না।
তারপর সাদাত জেরিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর হাত মুঠোবন্দী করে বললো,
জানো জেরিন আমার বিশ্বাস ই হচ্ছে না তোমার আমার বিয়ে হয়েছে।তুমি চলে যাওয়ার পর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি তোমাকে।আমার মনে হলো আমি তোমাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছি।এই যে তুমি আমার পাশে আছো আমি পুরো পৃথিবী পেয়ে গেছি।তোমাকে কতটা ভালোবাসি তুমি কল্পনাই করতে পারবেনা।
তারপর জেরিনের হাতটা ওর বুকে চেপে ধরে বললো,
দেখো আমার হার্ট কত জোরে বিট করছে।এখনো
সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
জেরিন দুষ্টুমি করে সাদাতের হাতে চিমটি কেটে দিতেই সাদাত চমকে গেল।
:আহ! কি হলো এটা?
:চিমটি কেটে বুঝালাম স্বপ্ন না বাস্তবেই আছেন।
:তাই বলে এতো জোরে?
:না মানে আমি তো মজা করছিলাম।
সাদাত এক টানে ওকে নিজের কাছে এনে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে বললো,মজা করছিলে?
দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
তারপর জেরিনের ওষ্ঠদ্বয় নিজের করে নিলো।
জেরিনের মনে হলো সে এই পৃথিবীতে নেই।অন্য কোনো জগতে হারিয়ে যাচ্ছে……
বেশ খানিকক্ষণ পর সাদাত তাঁকে কোলে তুলে রুমে যেতে যেতে বললো,দীর্ঘদিনের সাধনায় তোমায় পেয়েছি প্রিয়তমা।আজ তোমায় নিয়ে স্বর্গসুখে পাড়ি জমাবো।এ মন বহুদিন ধরে তোমার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে বসে আছে।
জেরিন সাদাতের গালে হাত রেখে বললো,
আপনাকে আমি সবটা উজাড় করে ভালোবাসবো।আপনার সব দুঃখ আমার হোক।
পরিশিষ্ট:
আরিয়াত তাঁর বাবা মায়ের বিয়ের ফটো অ্যালবাম নিয়ে বসে আছে।আসিফ অফিস থেকে ফিরতেই সে গাল ফুলিয়ে বললো,বাবাই তোমাদের বিয়েতে আমার একটাও ছবি নেই কেন?আমাকে না নিয়ে কেন বিয়ে করলে?
ঋতু মিটমিটিয়ে হাসছে,দাও এবার উত্তর দাও।
:তুমি তখন আল্লাহর কাছে ছিলে তো,তাই বিয়েতে ছবি তুলতে পারেনি।
:ওহ আচ্ছা।কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা তো করতে পারতে।এখন যেমন কোনো বিয়েতে যাওয়ার আগে তোমার জন্য অপেক্ষা করি,তুমিও তো করতে পারতে?
আসিফ বিড়বিড় করে বললো,ইশ মেয়েটা কত প্রশ্ন করে।
ঋতু আরিয়াত কে কোলে তুলে বললো,বাবাই তো জানতো না তো কখন তুমি আসবে।অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারপরেই তো গেল।তুমি তো তখন এঞ্জেলদের সাথে খেলায় ব্যস্ত ছিলে মা।
:আসলেই তো এটাতো ভেবেই দেখিনি।
আসিফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
আরিয়াত চলে যেতে আসিফ ঋতুকে জড়িয়ে ধরে বললো,কি বাঁচাটাই না বাঁচালে,হুহ।
:যেমন বাপ তাঁর তেমন মেয়ে।
:তাই বুঝি?
:কোনো সন্দেহ?
:বাবাই তুমি আবার মাকে আটকে রেখেছ,ছাড়ো বলছি মা মরে যাবে তো।(কোমড়ে দুই হাত দিয়ে রাগী চোখে বললত আরিয়াত)
ইশ রে কি মেয়ে পেয়েছি একটু রোমান্স ও করতে দেয়না।
ঋতু খিলখিলিয়ে হাসে।
♡সমাপ্ত♡