#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,অতীত সমাচারঃ পনেরো
#মম_সাহা
(৩৬)
নিরব, নির্জন কালো আকাশে পূর্ণিমার মেলা আজ। কি সুন্দর আকাশ! মেঘেরা ছুটে যাচ্ছে দলবেঁধে। খোলা রাস্তায় ফিনফিনে বাতাস। ঠিক চল্লিশ মিনিটের মাথায় অবনী বেগম তার কাঙ্খিত জায়গায় এসে পৌঁছালেন। বুকের মাঝে কেমন থেকে থেকে কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে! মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছে শ্বাসই বন্ধ হয়ে যাবে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। অবনী বেগমের বাইশ বছরের সাংসারিক জীবনে সে আমজাদকে কখনোই স্বামী হিসেবে মন থেকে মানতে পারে নি। তবে আজ কেনো হারানোর ভয়? হয়তো মায়া। এতবছর একটা মানুষের সাথে থাকলে মায়া পড়ে যায়। যে মায়ার টানেও মনে হয় মানুষটা থেকে যাক। এই মায়া আর অভ্যাসের কারণে কত মানুষ কত মানুষকে ছাড়তে পারে না। অবনী ধীর পায়ে চারপাশের বাড়ি গুলোতে চোখ বুলায়। অবশেষে কাঙ্খিত বাড়িটা পাওয়া গেলো বড় একটা অচেনা গাছের ডানদিকে।
অবনী বেগম ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন বাড়িটার সামনে। বাড়ির গেইটের সামনে একটা লাইট জ্বলছে। লাইটের আলোয় বাড়ির মালিকের নাম জ্বলজ্বল করছে। অবনী বেগমের পা সেখানেই থেমে গেলো। ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লিখা “মিসেস জেছি ফ্রাংকিং”।
অবনীর হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ দ্রুতই চলছে। ঠিক এ মুহূর্তে এসে অবনী বেগমের মনে হলো তার বোধহয় বাড়িটার ভেতর যাওয়া উচিৎ হবে না। ভিনদেশে যা লুকিয়ে আছে তা ভিনদেশেই নাহয় লুকিয়ে থাক। বয়স তো অনেক হলো, আর ক’দিনই বা বাঁচবে! কি দরকার হাহাকার নিয়ে বাঁচার? এরচেয়ে জীবন যেমন চলছে, তেমনই নাহয় চললো। অপ্রত্যাশিত কিছু নাহয় আড়ালেই রইলো। জেনে গেলেই তো দূরত্ব বাড়বে। আমজাদ সওদাগর তো তাকে কম ভালোবাসা দেন নি। সে-ই ভালোবাসা আগলে রাখতে পারলো না বরং প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধ করতে চেয়েছিল বার বার সেই সওদাগর পরিবারকে। কিন্তু কখন যেন আষ্টেপৃষ্টে সে পরিবারের মায়ায় পরে গেলো, টেরই পেলো না। অথচ অসময়ে মায়া বেড়ে কি লাভ! হারানোর পর মায়া কেবল বিলাসিতা হয়ে রয়।
অবনী বেগম আঁধার রাস্তায় আবার পা বাড়ায়। হসপিটালে ফিরে যাওয়ার অত ব্যস্ততা নেই, ধীর পায়েই যাওয়া যাবে। চারপাশে ততক্ষণে ভোরের আলোও ফুটে যাচ্ছে। নীলাভ আকাশ, শীতল প্রকৃতি। অবনী বেগম হাঁটতে হাঁটতে ডুব দিলেন অতীতে। আজকের এই শক্তপোক্ত অবনী বেগম এমন কখনোই ছিলেন না। অজপাড়াগাঁ এর এক সহজ সরল মেয়ে ছিলো সে। বাবা আর সে ছিলো তাদের ছোট্টো কুটিরের সদস্য। অবনী বেগমের বয়স তখন কত হবে? পনেরো কিংবা ষোলো। গ্রাম ঘুরে বেড়ানো উড়নচণ্ডী ছিলো সে। এ পাড়া ও পাড়া, এ গ্রাম ও গ্রাম করেই তো জীবন কাটছিলো বেশ। পড়াশোনাও করতো না। তখন পড়াশোনার ততটা মূল্য ছিলো না, তাও আবার মেয়েদের। তার উপর অজপাড়াগাঁ। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাকালীন সমাপ্তি ঘটিয়ে ছিলো পড়াশোনার। দেখতেও বেশ ছিলো। বাবা ছিলো দিনমজুর, সারাদিন খেটেখুটে যা রোজগার করতো, তা দিয়ে বাবা-মেয়ের সংসার দিব্যি চলতো।
একদিন সময়টা ঠিক গ্রীষ্মের মাঝামাঝি, উত্তপ্ত দুপুরে গরমের তীব্রতায় জান যায় যায় অবস্থা সকলের। কি গরম! অথচ অবনী বেগম সেই দুপুরেও বেশ আরামে পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরীরে একটা চকচকে হলুদ রঙের থ্রি-পিস। গোসল করায় চুল গুলো খোলা যা বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে। গলায় একটা তাবিজ। শুকনো, সরু দেহখানা নিয়ে সে জারুল গাছের তলায় বসে কামরাঙ্গা খাচ্ছে বেশ আয়েশ করে। সাথে তার বন্ধু বান্ধবের দল। হুট করেই সেখানে পুলিশের জীপ গাড়ি এসে থামলো। এলাকায় তখন ডাকাতের প্রকোপ বেড়েছে বিধায় নতুন অনেক বড় বড় পুলিশ অফিসারের পোস্টিং হয়েছিলো সেথায়।
পুলিশের গাড়ি দেখতেই অবনীর বন্ধুবান্ধব সব ছুটে পালালো। আকষ্মিক ঘটনায় তাজ্জব অবনী বেগম। অবনী বেগমের ছোটোবেলা থেকেই একটা সমস্যা ছিলো, আকষ্মিক কোনো কিছু সে নিতে পারতো না। মাঝে মাঝে সে উদ্ভট কথাও বলে ফেলতো উত্তেজিত হয়ে। সেদিনও ঠিক এমনটা ঘটলো। পুলিশ দেখে সব ছেলেমেয়ে যখন পালিয়ে গেলো অবনী তখনও ঠাঁই বসে আছে। তখন ছেলেমেয়ে পুলিশকে বাঘ ভাল্লুকের মতন ভয় পেতো। যেন কি ভয়ঙ্কর প্রাণী এই পুলিশ।
জীপ গাড়ি থেকে তখন বেশ সুঠাম দেহী, শ্যামলা বর্ণের একজন গম্ভীর মতন পুরুষ নেমে এলো। নেমেই সে অবনীর কাছে চলো এলো। অবনীর হাতে কামরাঙ্গা, চোখে বিষ্ময়।
লোকটি অবনী বেগমের কাছে এসে ভরাট স্বরে প্রশ্ন করলেন,
“এই যে নারী, গাছতলায় কি শুনি? ভরদুপুরে এমন জঙ্গলে কি করছেন?”
অবনী বেগম এর আগে কখনো অপরিচিত পুরুষের সান্নিধ্যে যায় নি। সেদিন হঠাৎ অপরিচিত পুরুষটিকে সামনে দেখে ভয়ে, অস্বস্তিতে তার চোখ টলমল করে উঠলো। ঠোঁট উল্টে ফেললো। কেঁদে দিবে দিবে ভাব।
অবনীর লম্বাটে মুখ খানায় কালো মেঘের আনাগোনা দেখে ভড়কে গেলো পুলিশের পোশাকে থাকা গম্ভীর মানবটা। ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“এই যে জারুলকন্যা, কেঁদো না কেঁদো না। ভয় পাচ্ছো? আমি তোমায় বকি নি তো।”
জারুলকন্যা নাম শুনতেই অবনী বেগমের কান্না থেমে গেলো। সেই প্রথম, সেই প্রথম অবনী বেগমের মনে কোনো পুরুষের আদল ভেসে উঠলো। সেই প্রথম অবনী বেগম কিছু ভিন্ন অনুভূতির সাথে পরিচিত হলেন।
হঠাৎ গাড়ির হর্ণে ধ্যান ভাঙে অবনীর। অতীত ভাবতে ভাবতে আকাশের নীলাভ রঙ সরে গিয়ে সাদা সাদা মেঘে ভরে গেছে। দিনের আলো ও ফুটে গেছে। অবনী বেগম হসপিটালের সামনে চলে এসেছে! টেরই পেলো না? অতীত এমনই মধুময় জিনিস যা ভুলিয়ে দেয় বর্তমান। তাই তো মানুষ সদা আফসোসের গান গেয় অতীত নিয়ে।
(৩৭)
আজ শনিবার। সওদাগর বাড়িতে তুমুল নিরবতা। হৈচৈ নেই কোনোরকমের। তৃষান আর দিশান আজ হোস্টেলে চলে গিয়েছে। অহি ভার্সিটিতে, চিত্রা নিজের কলেজে। ছেলেরা যার যার কাজে। তুহিন গতকাল রাগ করে যে বাহিরে গেলো আর ফিরে আসে নি। তুহিনের রাগ বরারবরই অনেক বেশি। খুব সহজে না রাগলেও, রাগ উঠলে আর হুঁশ থাকে না।
চঞ্চল বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো। খাবার টেবিলের হৈচৈ আর হয় না, টিভির চ্যানেল নিয়ে ভাই-বোনদের আর মিছে মিছে তুমুল ঝগড়া হয় না, মাছের বড় টুকরোটা কে খাবে তা নিয়ে আরেক দফা বাকবিতন্ডাও আর হয় নি। কেমন বাড়িটার প্রতিটি কোণায় হাহাকার লেপ্টানো।
আফজাল সওদাগর তার নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। কপালে হাত রেখে, চোখ দু’টি বন্ধ। রোজা সওদাগর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখ যায় স্বামীর নিস্তব্ধ দেহটার দিকে। রোজা বেগমের বড্ড মায়া হয় স্বামীর জন্য। স্বামীর জন্য এই রোজা সওদাগর কত কিছুই না করেছে? কত অন্যায় না মেনে নিয়েছে, কেবল স্বামীর মুখের হাসি দেখার জন্য। অথচ আজ সেই স্বামীই কিনা নিশ্চুপ! এ পরিবারটাকে সবসময় এক আঁচলের ছায়াতলে সে রাখতে চেয়েছিলেন, তবুও আজ কোথাও যেন ভাঙার সূত্রপাত দেখা দিয়েছে। একটা নারীর সংসারের চেয়ে বড় আর যে কিছু নেই।
স্বামীকে এক ধ্যানে মগ্ন হতে দেখে রোজা সওদাগর স্বামীর পায়ের কাছটায় এসে বসলেন। ধীর কণ্ঠে শুধালেন,
“আপনি কী জেগে আছেন?”
আফজাল সওদাগরের ধ্যান ভাঙলো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন করলেন না। যেমন আছে তেমন থেকেই বললেন,
“হ্যাঁ, জেগে আছি। কিছু বলবে?”
“আপনার কি মন খারাপ?”
“মন খারাপ হওয়া টা স্বাভাবিক না, রোজা? যে ভাইদের জন্য এতকিছু করলাম আজ তারাই দাম দিচ্ছে না। এরচেয়ে কষ্ট আর আছে বলো? মা-বাবা যখন মারা গেলেন, দুটো ভাই, একটা বোনের বটগাছ হয়ে দাঁড়ালাম আমি। অথচ আজ আমিই মূল্যহীন।”
রোজা সওদাগরের খারাপ লাগলো। তার স্বামী প্রীতি বেশি। স্বামীর কষ্ট সে মানতে পারে না কখনোই।
রোজা সওদাগর আশ্বাসের স্বরে বললেন,
“আপনি চিন্তা করবেন না। নুরুল আজকাল কেমন হয়ে গেছে। বয়স বাড়ছে তো। আর আপনি তো চিত্রার বিয়ের কথা আটকাতে চেয়েছিলেন, তা আটকেছে। আপাতত দেখে গেছে। পরে কথা আগানো হবে বলা হয়েছে। আর মন খারাপ করবেন না।”
আফজাল সওদাগর ধপ করে উঠে বসলেন। চোখ তার কেমন হলদেটে ভাব। সে তার স্ত্রীর হাত দুটো মুঠ করে ধরলো। কেমন অসহায় কণ্ঠে বললো,
“পাপের ভার নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের, বিবি। তুমি আমারে অভিশাপ দিছিলা তাই না? তাইতো আজ এ অবস্থা আমার।”
স্বামীর কথায় আৎকে উঠলো রোজা। তওবা করে বললেন,
“কি বলেন আপনি! আপনারে অভিশাপ দেওয়ার আগে আমার জিহ্বা খঁসে পড়ুক। আর আপনি যা পাপ বলছেন তা আদৌও পাপ না। আপনি তো জানেন আর আমার আল্লাহও জানে সেটা। আপনি এসব ভাববেন না।”
আফজাল সওদাগর অনবরত মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন,
“এটা পাপই বিবি। আমি তোমাদের ঠকিয়েছি। নিজের স্বার্থে আরেকজনকে ঠকিয়েছি। ওদের মৃত্যুও তো আমায় অভিশাপ দিয়েছে।”
স্বামীর কথায় ভড়কে গেলে রোজা সওদাগর। উৎকণ্ঠিত কন্ঠে বললেন,
“কাদের মৃত্যু?”
আফজাল সওদাগর উত্তর দিলেন না। আফসোসের অশ্রু গড়িয়ে গেলো তার গাল বেয়ে।
(৩৮)
গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রা। সাদা কলেজ ইউনিফর্ম টা লেপ্টে গেছে শরীরে। চুলের মাঝে দুই বেণী। পিঠে বইয়ের ভারী ব্যাগ। গতকাল তার দেখাদেখিটা সে অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিলো। মাহাতাব দুলাভাই এর কারণে তা বেশি দূর অব্দি আগায় নি। আবার নওশাদ নামের লোকটাও বলেছে সময় নেওয়া উচিৎ দুই পক্ষের।
চিত্রার মনে কেমন যেন অশান্তি। বিরক্তিতে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ জ্বালা দিয়ে উঠছে। জীবনটা তার এত অসহ্য ছিলো না কখনো। আগে তার বাবা তাকে পছন্দ করতো না। সে জানতো না বাবা কেনো তাকে অপছন্দ করতো কিন্তু যখন সে জানলো বাবার অপছন্দের কারণ তখন থেকে চিত্রা নিজেই আর নিজেকে পছন্দ করছে না। জীবনটা হঠাৎ ই বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো।
“এই চিত্রা, দাঁড়া।”
পথে মধ্যে চির পরিচিত কণ্ঠ শুনে দাঁড়ালো চিত্রা। পিছে ঘুরতেই চোখে পড়লো অহি আপার লাল টুকটুকে মুখটা। গরমে লাল হয়ে গেছে। চিত্রা কিঞ্চিৎ হাসলো অহি আপাকে দেখে। অহি ততক্ষণে চিত্রার কাছে চলে এসেছে।
“আপা, তোমার ক্লাস শেষ?”
“না রে, ভালো লাগছে না। যা গরম। বাসায় গিয়ে ঘুম দিবো। তোর ক্লাস শেষ?”
“হ্যাঁ আপা।”
“তো চল, একসাথে বাসায় যাই। ফুচকা খাবি, চিত্রা?”
অহি আপার প্রস্তাবে অবাক হলো চিত্রা। অহি কখনোই বাহিরের খাবার পছন্দ করে না। আর আজ সে কিনা, ফুচকার কথা বলছে!
চিত্রার অবাক বিষ্মিত মুখ খানা দেখে ফিচলে হাসলো অহি। বাঁকা হেসে বললো,
“কিরে, খাবি না?”
চিত্রা দ্রুত মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে খাবে। অহি মিষ্টি হেসে চিত্রাকে নিয়ে পাশের একটা পার্কে গিয়ে বসলো। পাশের থাকা ফুচকার দোকানটা থেকে দু প্লেট ফুচকা দিতে বললো।
চিত্রা তখনো অবাক। অহি চিত্রার অবাক ভাবটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে হুট করে বলে উঠলো,
“একটা সিক্রেট শুনবি চিত্রা?”
চিত্রা তখন তার ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল টা বের করেছে। অহির কথায় ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি সিক্রেট, আপা?”
অহি বিবশ কণ্ঠে বললো,
“তোর ফুল গাছের টব গুলো আমি ভেঙেছি।”
#চলবে
Porer porbo koi