#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ তেরো,চৌদ্দ
#মম_সাহা
(৩২)
“ওরে পাখি বলিস তারে, কত ব্যাথা রাখি গোপন করে,
কখনো ব্যাথারা মুখ থুবড়ে পড়ে, কখনো বা অশ্রু হয়ে ঝড়ে”
নীল রঙের কালি দিয়ে লিখা ছোটো দু’লাইনের কথা গুলো, কত সুন্দর! কত ব্যাথার! চিত্রা বার কয়েক পড়লো লেখা গুলো, বেশ মনে ধরেছে। সে যখন এসএসসি দেয়, তখন এখানে সেখানে এলোমেলো, অবুঝ মনে কত কথা ই লিখে রাখতো, কত কবিতাই যত্নে গড়তো। টিনেজার সময়টাই তো এমন। বয়ঃসন্ধিতে এসে ছেলে-মেয়ে কিছুটা কাব্যিক হয়ে যায়। তাদের অতি রঙচঙে আবেগ ঝরে পড়ে কাব্যের পাতায়। চিত্রাও তাদের থেকে আলাদা না। অথচ সেদিন যে কথা টা লিখেছিলো একান্তই ফুরফুরে মনের আবেশ অনুভব করার জন্য আজ সে লিখাটাই জীবনের চরম ব্যর্থতা মনে করাচ্ছে। সময় পাল্টাতে ঠিক কতটুকু সময় লাগে? এক সেকেন্ড বা তারও কিছুটা কম। বা’চোখের কাজল ঘেটে মুক্তোর মতন একবিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চিত্রার চোখের কোণে থেকে। আহা, কান্নারা এত অবাধ্য কেন!
সময়টা আগস্টের সতেরো তারিখ, শুক্রবার। বেলা এখন ঠিক অপরাহ্ন। চিত্রার শরীরে নীল রঙের শাড়ি জড়ানো। চোখে গাড়ো কাজলের প্রলেপ। অভিমানীনির প্রগাঢ় অভিমান ঢাকতে যেন সক্ষম সেই কাজল। হয়তো নয়নের গভীরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিদের লুকানোর জন্য এ ব্যবস্থা। শ্যামলা শরীরে গাড়ো নীল রঙটা ঠিক খারাপ লাগছে না। চলনসই থেকেও আরও দু’ধাপ বেশি ভালো লাগছে। পিঠ অব্দি চুল গুলো বাতাসে উড়ছে তার। আজকে বিশেষ দিন তার জীবনে, তাই এত সাজগোজ। জীবন তো কিছুর জন্য থেমে থাকে না, সে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় অনেক দূর। যদি এগিয়ে যাওয়া টা খুব দ্রুত হয় তবুও বোধহয় খারাপ হবে না।
অপেক্ষিত সময়ের অবসান ঘটলো। বাহিরের ঘর থেকে চিত্রার ডাক ভেসে এলো। এইতো চিত্রার ডাক পড়েছে। নতুন কিছুর শুরু হওয়ার আহ্বান এসেছে। চিত্রা বিছানায় বসে রইলো। বুকের মাঝে যন্ত্রণাদের বিক্ষোভ মি*ছিল। তাদের যেন প্রতিবাদ, বুকের মাঝে ঠাঁই দেওয়া মানুষটাকে ছাড়া আর কাউকে সহ্য করবে না চিত্রার জীবনে। কখনোই না।
চিত্রা শ্বাস নিলো, অনুভব করলো এই চারপাশে বাহার ভাইয়েরই কেবল অস্তিত্ব। এই যে আলমারির ভেতর রাখা বাহার ভাইয়ের শুভ্র রঙের টি-শার্ট, বইয়ের টেবিলের উপর বাহার ভাইয়ের নোটস, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের ভেতরে বাহার ভাইযের কতশত ফেলে দেওয়া আধখাওয়া সিগারেট, এই যে হৃদয় মাঝে পুষে রাখা আস্ত একটা বাহার ভাই। সব জায়গাতেই তো মানুষ টা। তবে তাকে ভুলার জন্য এত আয়োজন কেনো! এই আয়োজনের স্বার্থকতা কোথায়?
ভাবনার মাঝে চিত্রার ঘরে প্রবেশ করলো তার মা, মুনিয়া বেগম। চোখে চিকন গ্লাসের চশমা, শরীরে কালো শাড়ি, মুখে চিকচিক করা ঘামের বিন্দুকণা। সে এসেই ব্যাস্ত ভাঙিতে বললো,
“চিতু,তুমি সাজগোজ করেছো কেনো? বাবার সাথে পা*গল হয়েছো? সেখানে তুমি যাবে না। নিজের এত বড় ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে কেনো লেগেছো? আর তোমার বয়সই বা কত? এ বয়সে কিসের বিয়ে! কোনো বিয়ে টিয়ে হবে না।”
মায়ের ব্যস্ততা মেশানো কথার পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দিলো না চিত্রা। কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। মা ‘টা এত সুন্দর কেনো? ভাইয়াও মায়ের মতন সুন্দর। তাদের দেখলেই কেমন চোখে শান্তি শান্তি লাগে। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয় জমিন।
মেয়ের কোনো হেলদোল না দেখে বিরক্ত হলো মুনিয়া বেগম। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,
“তোমায় কি বলেছি শুনেছো? বিয়ের আশা বাদ দাও। তোমার বাবার তালে নাচা বন্ধ করো। এতটুকু একটা জীবন তোমার।”
“বিয়ে তো করতেই হবে, আম্মু। সমাজের চিরপরিচিত প্রথা অনুসারে মেয়েদের তো আজীবন বাবার ঘরে থাকার নিয়ম নেই। যেতেই যেহেতু হবে তবে আগেই যাই। পরে তো মায়া আরও বেড়ে যাবে, আম্মু।”
মুনিয়া মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“চিত্রা! কি বলছো এসব!”
“ভুল বলেছি আম্মু? তোমরা কী আর আমায় চিরদিন রেখে দিবে, বলো? একদিন তো হস্তান্তর করা হবে আমাকে, তবে আজ কেনো নয়! জীবনটা আমার এই একেক জনের হাতে কেবল হস্তান্তরিত হয়েই যাবে। পড়ে পাওয়া কিনা।”
“চিত্রা!”
মুনিয়া বেগমের কণ্ঠে চরম বিষ্ময়। সে বিষ্ময়ের স্রোতে যেন কথারই খেই হারিয়ে ফেললো। সারাদিন দুষ্টুমিতে মত্ত থাকা চিত্রার আজ কথা গুলোর ওজন বেশি। এত ভারী কথা যে আশা করেন নি মুনিয়া বেগম। তাহলে আজ মেয়েটাকে এত অপরিচিত লাগছে কেনো? কেমন অপরিচিত একটা অবয়ব মেয়েটার মাঝে!
মুনিয়া বেগম হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তন্মধ্যেই নুরুল সওদাগরের আগমনে কথার নদীতে ভাঁটা পড়লো।
নুরুল সওদাগরের মুখে বরাবরের চেয়ে আজ হাসির রেখা বেশ গভীর। চোখে মুখে কেমন যেন একটা রাজ্যের শান্তি। শান্তিটা ঠিক কিসের? সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে না, এটাই কী কারণ তবে?
মুনিয়া বেগম নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলেন,
“আমার মেয়ের ধ্বংস না ডেকে আনলেও পারতে।”
নুরুল সওদাগর হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না স্ত্রীর এহেন কথায়। তাই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। বিষ্মিত কণ্ঠে বললেন,
“কি বলছো এসব! চিত্রা আমারও মেয়ে, ভুলে যেও না।”
বাবার একটা কথায় চিত্রার ভিতরের যত না পাওয়ার হাহাকার ছিলো, সব মিইয়ে গেলো। জীবনের আঠেরোটা বছর সে কেবল অপেক্ষা করেছিলো বাবার মুখ থেকে এ কথাটা শোনার জন্য। আজ মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা স্বার্থক। বাবার আদর পাওয়ার জন্য চিত্রা এমন কয়েকটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নাহয় মাথা পেতে নিবে, তবুও তো তার বাবার ভালোবাসা পাবে। এই ঢের।
“আচ্ছা! চিত্রা তোমার মেয়ে? কবে থেকে তাকে মেয়ে মানা শুরু করলে? তোমার জাত যাবে না?”
স্ত্রীর বিদ্রুপের হাসি দেখে গা জ্বলে উঠলো নুরুল সওদাগরের। সে বেশ খানিকটা জোরেই বললো,
“মুনা, সাবধানে কথা বলো। বাড়ি ভর্তি মেহমান, নাটক টা বন্ধ করো। আমি চিত্রার খারাপ চাইবো না নিশ্চয়।”
“ভালো কেনো চাইতো আসছো? আমার মেয়ের ভালোটা তোমার না চাইলেও হবে। যাদের ভালো এত বছর চেয়ে আসছো, তাদেরটাই চাও। নাকি তাদের ভালোর জন্যই আমার মেয়ের এ সর্বনাশ করছো! কোনটা?”
মুনিয়া বেগমের কথা শেষ হতেই তার ডান গালে সশব্দে চ*ড় বসালো নুরুল সওদাগর। এই ঘটনা টা মুনিয়া আর চিত্রা দুজনের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। মুনিয়া বেগম তাই নিম্চুপ হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তন্মধ্যেই অহি এলো, চিত্রাকে ধরে নিয়ে গেলো পাত্রপক্ষের সামনে। চিত্রা কেবল পাথরের ন্যায় হেঁটে গেলো। এ জীবনে হুট করেই তার চাওয়া-পাওয়া গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কেবল মনে হলো, বিফল এই বেঁচে থাকা।
(৩৩)
সময়টা ঠিক মধ্যরাত, ভিনদেশের মাটিতে পা রেখেছে অবনী আজ পাঁচদিন হতে চললো। বাড়ির সবাই তাদের নিয়ম করে খোঁজ নিচ্ছে, কিন্তু তবুও অবনী কোথাও নিজেকে একা ফিল করে। এই একা অনুভব করাটা একাকীত্ব না বোধহয়, আমজাদের মাঝে পুরোনো আমজাদকে খুঁজে না পাওয়াটাই এই একা অনুভব হওয়ার কারণ। মানুষ সচারাচর যাকে যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, তাকে সেভাবেই দেখতে চায়। মানুষেরও যে বদল আসতে পারে, তা যেন আমরা ভাবতে পারি না বা কোথাও একটা মানতে পারি না।
হীম শীতল কেবিনের সাদা রঙের আরামকেদারাটাই বসে বসে ঝিমুচ্ছে অবনী। রাত সাড়ে তিনটা বাজছে অথচ তার ঘুম আসছে না। চেরির শরীরের বেশ উন্নতি দেখা দিচ্ছে, এতদূর আসাটা সার্থক। কিন্তু তবুও মনে কোথাও শান্তি নেই।
অবনী বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কতক্ষণ এপাশ-ওপাশ হাতড়ে নিজের ফোনটা হাতে নিলো। কল লাগালো আমজাদ সওদাগরের ফোনে। আমজাদ সওদাগর প্রতিদিনই এসে মেয়েকে দেখে যান অথচ থাকেন না, এমনকি অবনী বেগমকেও যেতে বলে না আমজাদ সওদাগরের বাসায়। বিষয়টা ভীষণ অদ্ভুত হলেও অবনী এতদিন মাথা ঘামায় নি, অথচ আজ মাঝরাতে তার এ কথা খানা মাথায এলো। গত পাঁচদিন যাবত অবনী হসপিটালেই আছেন। আমজাদ তাকে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রামও নিতে বলে নি।
প্রথম বার কলটা বাজতে বাজতেই কেটে গেলো। অবনী মুখ-চোখ কুঁচকালো। তার হঠাৎ করেই সর্বাঙ্গে অস্বস্তি ছেয়ে গেলো। তার মনে হলো তার অজান্তেই হয়তো ভীষণ অদ্ভুত কিছু হচ্ছে এই ভিনদেশে, যা খুব সস্তা আবরণে ঢেকে আছে। অবনী বেগম ঘুমন্ত চেরির দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই মাঝরাতেই সে সিদ্ধান্ত নিলেন আমজাদ সওদাগরের বাসায় যাওয়ার। যতটুকু জানে সে, হসপিটাল থেকে বাসার দুরত্ব মাত্র আধাঘন্টা। বাড়ির ঠিকানাটাও তার জানা আছে। এই মাঝ রাত্রিরে যেকোনো মূল্যেই তার সংশয় অস্বস্তির পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। তার মন যে মিছে ভয়ের আতঙ্কে তোলপাড় হচ্ছে, তা এই মুহূর্তেই মিটাতে হবে।
হসপিটালের নার্সকে চেরির কাছে রেখেই এই ভিনদেশের অপরিচিত রাস্তায় পা চালালো বাঙালি এই নারী। বাঙালি স্ত্রীদের আলাদা একটা শক্তি আছে। তারা সন্তান আর স্বামীর ক্ষেত্রে অদ্ভুত শক্তি,সাহস পেয়ে যায়।
(৩৪)
সোফায় বসে থাকা বেশ সুন্দর দেখতে ছেলেটাই চিত্রাকে দেখতে এসেছে। নুরুল সওদাগরের ডিপার্টমেন্টেরই একজনের ছেলে সে। নাম নওশাদ। ছেলেটাকে নির্দ্বিধায় সুপুরুষ বলা যাবে। ফর্সা শরীর, উচ্চতাও যথেষ্ট, সুস্বাস্থ্য। কি ভীষণ সুন্দর! কালো রঙের পাঞ্জাবি টা বেশ মানিয়েছে শরীরে।
ছেলেটার মা-বাবাও ছেলেটার সাথে এসেছে। বেশ সুশীল পরিবারই মনে হলো। বেশ হেসে হেসে কথা বললো। এক দেখায় তাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেটাও বলেছে। চিত্রা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কেবল ঠাঁই বসে রইলো। ড্রয়িং রুম জুড়ে সবাই যার যার মতন দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে। চাঁদনীর হাসবেন্ড মাহাতাবও আছে। শুক্রবার যেহেতু, তার অফিসও বন্ধ।
ছেলের বাড়ির থেকে প্রস্তাব দিলো তারা আজই আংটি পড়িয়ে যেতে চায়। নুরুল সওদাগরের মুখের হাসিটা বিস্তৃতি লাভ করলো, অথচ সবাই তখনো হতভম্ব, আহম্মক বনে আছে। তারা যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। বাবা-মেয়ের এমন পরিবর্তন যেন সবাইকেই ভাবাচ্ছে। কি এমন হয়ে গেলো, যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতেও তারা দু’বার ভাবছে না!
বাড়ির সবচেয়ে বড় সদস্য আফজাল সওদাগর সেখানে উপস্থিত নেই। সকালে নুরুল সওদাগর যখন চিত্রাকে দেখতে আসার প্রস্তাবটা জানিয়েছে, তখনই দুই ভাইয়ের এক রকমের কথা কাটাকাটি হয়েছে। এ প্রথম আফজাল সওদাগরের কথাকে গুরুত্ব দিলো না তার ছোটো ভাই। সেই কষ্টে দোর দিলেন সে। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে সবাই। তুহিনও বেশ চিৎকার চেঁচামেচি করেছে কিন্তু শেষ মুহূর্তে চিত্রা থামিয়ে দিয়েছে তার ভাইকে। বাবা নাকি তার ভালোর জন্য ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তুহিনও রাগে, ক্ষোভে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
পাত্রের মা হাত জোর করে বেশ বিনীত স্বরে বললেন,
“ভাই সাহেব, আপনাদের মেয়েকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। মায়া মায়া মুখ। আপানারা দেখুন, আমরা চাচ্ছি আজই একটা পাকা ব্যবস্থা করে যেতে।”
নুরুল সওদাগর তো আনন্দে আত্মহারা। সবাই বেশ ভয়ে আছে এই ভেবে যে নুরুল সওদাগর না আবার হ্যাঁ করে দেয়। ভাবসাবও ঠিক তেমন মনে হচ্ছে।
কথা ঘুরালো মাহাতাব। বেশ বুদ্ধির সাথে হাসি মুখে উত্তর দিলো,
“আন্টি, বিয়েটা তো আর এক কথায় হয় না। আপনারা খাবার খান, আমাদেরও তো পারিবারিক আলোচনা আছে। আমরা তা সেড়ে নেই, তাছাড়া তো মেয়েরও তো একটা মতামত আছে তাই না?”
ভদ্রমহিলাও সম্মতির সুরে বললেন,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আপানারা আলোচনা করুন। আমদের সমস্যা নেই।”
মহিলার কথায় সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেললো। নুরুল সওদাগর যেন ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছেন। যে কোনো মূল্যে তাকে থামাতে হবে।
সবাই যখন নিজ নিজ বাক বিতণ্ডায় ব্যস্ত, চিত্রা তখন পথ ধরলো ছাঁদের দিকে। বাহার ভাইয়ের উপর অভিমান আর বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খায় সে অনলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে, তবুও কী বাহার ভাই তাকে আটকাবে না? বলবে না থেকে যেতে? বাহার ভাই বললে চিত্রা হাসতে হাসতে সব ভুলে যাবে, এমনকি বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খাও।
(৩৫)
সচারাচর আশ্বিন মাসে ঝড়ের আভাস পাওয়া যায় না। পেঁজা তুলোর দলেরা ছুটে যায় আকাশ ঘেষে। কেমন হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন দেখতে লাগে! আদুরে, তুলতুলে। অথচ আজ আকাশে হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন তুলা নেই। আকাশে আজ ধ্বংসাত্মক রূপ। চিত্রার হৃদয়ের ভয়ানক বিধ্বস্ততা বোধহয় ছেয়ে গেছে আকাশেও।
নিচে পারিবারিক বাকবিতন্ডা চলছে। চিত্রা বেশ কায়দা করেই ছাঁদে চলে এলো। বাহার ভাইকে এক নজর দেখার অসুখে ধরেছে তাকে। যেকোনো মূল্যেই হোক এই অসুখ তাড়াতাড়ি সাড়াতে হবে।
নীল শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। ছাঁদে উঠতেই এক অন্যরকম দৃশ্য চোখে পড়লো চিত্রার। বাহার ভাই ছাঁদের কবুতর দুটোকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। কবুতর দুটো ও চিত্রার। কবুতর দুটোকে ঠিক পালে না সে। সবসময় ছেড়ে রাখে। যখন ইচ্ছে হয় তারা ফিরে আসে, খাবার খায়, চিত্রার সামনে উড়ে বেড়ায় আবার নিজেদের মনমতন চলে যায়। বাহার ভাই কখনো এদের এতো আদর যত্ন করে নি, আর আজ কিনা খাবার খাওয়াচ্ছে!
চিত্রা ধীর পায়ে বাহারের সাথে এসে দাঁড়ালো। খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো লোকটাকে। নিচে তাকে দেখতে আসা নওশাদ নামের ছেলেটা বাহার ভাই থেকেও বেশি সুন্দর। উচ্চতায় একটু কম তবে বেশ সুন্দর, ভদ্র, সুশীল, সরকারি চাকরি করে। অন্যদিকে বাহার ভাই প্রচুর অ*ভদ্র, অসামাজিক, বেকার। বাহার ভাইয়ের এত এত নেগেটিভিটি তবুও যেন বাহার ভাইয়ের তুলনা কারো সাথে হবে না। তবুও বাহার ভাই অনবদ্য।
“আরে চিত্রা যে, তা এই অসময়ে ছাঁদে?”
বাহারের কথায় ধ্যান ভাঙলো চিত্রার। মানুষটা কত স্বাভাবিক ভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করলো! অথচ মানুষটার সাথে তার নিরব একটা মান-অভিমান চলছে। যেই মান-অভিমানের জন্য আজ চিত্রা এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ যেন কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব লোকটার কথায়।
“কথা টথা না বলার ব্রত করলে নাকি? বেশ ভালো তো। কথা না বললে মানুষ তোমাকে সিরিয়াসলি নিবে। একটা পাত্তা পাবে বুঝলে! তোমার বাপ তো এমনেই দাম দেয় না, এখন যদি কথা না বলার কারণে একটু পাত্তা পাও তাহলে খারাপ হবে না।”
বাহারের ঠাট্টা মারা কথায় ক্ষাণিক রেগে গেলো চিত্রা। রাগী কণ্ঠে বললো,
“আমার বাবাকে নিয়ে একদম এসব বলবেন না।”
“আচ্ছা বলবো না।”
বাহার খুব সহজ ভাবে যেন মেনে গেলো চিত্রার কথাটা। চিত্রার রাগ আবার হারিয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেন? এমন না হলে কী খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতো!
মান-অভিমান কিনারে রেখে চিত্রা ধীর কণ্ঠে বললো,
“বাহার ভাই, আমি নীল শাড়ি পড়েছি। কিছু বললেন না তো।”
বাহার কবুতরকে খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে একবার হালকা করে তাকালো চিত্রার দিকে। তারপর আবার নিজের কাজ করতে করতে বললো,
“বেশ ভালো তো। তা তোমার শরীরে নীল শাড়িটা তেমন মানাচ্ছে না। তুমি বরং সাদা শাড়ি পড়তে। মেঘের মতন লাগবে।”
বাহারের কথায় চিত্রার অভিমানেরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। চোখ-মুখ টলমল করে উঠলো। বাহার ভাই এভাবে বলতে পারলো! অথচ অষ্টাদশী বুঝে নি, বাহার ভাই তার গোপন একটা ইচ্ছের কথা কেমন করে জানিয়ে দিলো। বুঝলে অভিমানের জায়গায় ভালো লাগার সৃষ্টি হতো যে!
বাহার আর চিত্রাকে সিক্ত করতে আকাশ চিরে বেরিয়ে এলো বৃষ্টির ফোঁটারা। হুট করেই তার আগমনে তাজ্জব মানব-মানবী। ভিজে একাকার দু’জনে।
তন্মধ্যেই চিত্রা বলে উঠলো,
“বাহার ভাই, আজ আমাকে দেখতে আসছে, ওরা আজই আংটি পড়িয়ে যেতে চায়।”
“ওহ্ তাই নাকি! বাহ্ দারুণ খবর দিলে তো। মিষ্টি খাওয়াবে না?”
চিত্রা অবাক হলো বাহারের উত্তরে। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“আপনি জানতেন না এটা?”
“না তো। তোমাদের পারিবারিক ব্যাপার আমি আর কেমন করে জানবো!”
উত্তর টা বেশ স্বাভাবিক ভাবে দিলেও চিত্রার মন মানতে চাইলো না। সে দিবানিশি যে ছেলেটার জন্য পুড়ে, সে ছেলেটা নাকি তার এত বড় খবরটাই জানতো না! এ কেমন মানুষ!
চিত্রার অশ্রু রা ততক্ষণে বৃষ্টির পানিতে মিলেমিশে একাকার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বললো,
“আপনি কি কিছু বলবেন না, বাহার ভাই!”
“হ্যাঁ বলবো তো। নতুন জীবনের জন্য তোমাকে শুভেচ্ছা। তুমি তো বাবার ভালোবাসার কাঙালি, তোমার যেন সেই ভালোবাসা মিলে। নিজের বাবার কাছ থেকে না হোক, জীবন সঙ্গীর বাবার থেকেই নাহয় পেলে।”
বাহার ভাইয়ের উত্তরে চিত্রা ব্যাথিত নয়নে চাইলো। মানুষটার কি ব্যাথা হচ্ছে না বুকে! তবে তার কেনো র*ক্তক্ষরণ হচ্ছে! ভালোবাসা এত যন্ত্রণা কেনো! বাহার ভাইরা এত অবুঝ কেনো!
“যাও চিত্রা, নিচে যাও। তোমার সুপুরুষ হবু বর হয়তো অপেক্ষা করছে। সুন্দর মানুষের আশেপাশে থাকলে তোমারই লাভ। সুন্দর মানুষ দেখলে চোখে একটু প্রশান্তি মিলে বুঝলে। আমরা তো শা*লা পুড়ে ছাই।”
“অথচ এই ছাইকেই আমার চাই।”
চিত্রার এত আবেগীয় কথাটাকেও বাহার বরাবরের মতন হেসে উড়িয়ে দিলো। গা ছাড়া ভাবে বললো,
“শুনো মেয়ে, বয়ঃসন্ধির আবেগ কেটে গেলে, বাহারও কেটে যাবে। এ বয়সে ঠোঁট পুড়ে যাওয়া, উন্মাদ, বখাটেদেরই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু যখন বাস্তবতা বুঝবে তখন এই ভালো লাগা বড়জোড় তোমার হাসির কারণ ছাড়া কিছুই না। যাও নিচে তোমার অপেক্ষা করছে সবাই।”
চিত্রার কান্নার স্রোত বাড়লো। দু’কদম বাহারের দিকে এগিয়ে গিয়ে কেবল উচ্চারণ করলো, “বাহার ভাই…”
বাহার থামিয়ে দিলো চিত্রাকে। গম্ভীর স্বরে বললো,
“যাও রঙ্গনা, বখাটে বাহার তোমার না। জীবনে বাঁচতে হলে সুশীল সঙ্গী দরকার। বাহাররা কেবল মনের ফ্যান্টাসি।”
চিত্রার কত কথা বলতে গিয়ে বলা হলো না। আবার কত অনুভূতি না চাইতেও বলে দিলো। বাহার ভাই তবুও নির্বাক! তবে তাই হোক, বাহার ভাইয়ের নাহয় না-ই হলো চিত্রা।
ভিজে শাড়ি, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চিত্রা যখন পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে, বাহার দু’হাত মেলে আকাশ পানে তাকিয়ে বললো,
“শুনছো গো মেঘ, বাহার আর গিটার ছুঁয়ে দেখবে না। অষ্টাদশীর হৃদয়ে বাহার আর এক্কা-দোক্কা খেলবে না। বাহার যে খুব নির্মম ভাবে সেই দু’টো জিনিসই ভেঙে দিয়েছে। বাহারের আর কেউ নেই মেঘ, না গিটার আর না অষ্টাদশী।”
চোখ বন্ধ করে আপনমনে গেয়ে উঠলো রঙ্গনার বাহার ভাই,
“ভালোবাসা হয় যদি পাঠশালা,
প্রেমের আরেক নাম, কাঁটার জ্বালা
কাঁটার জ্বালা।”
#চলবে