তাসের_ঘরে_তুমি_আমি #পর্ব_১২,১৩

0
317

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_১২,১৩
#লেখক_আয়াশ
১২

‘বেহায়া মেয়ে, বাড়িঘর ছেড়ে এখানে পড়ে আছিস?’ মিথিলার মামীর কর্কশ আওয়াজে ঘর কেপে উঠল, সাথে মিথিলাও। শান দেখলেও কিছু বলতে পারছে না।
‘মা মা মামী!’
‘চুপ কর হতচ্ছাড়ি। তোর বাপ মাকে খে’য়েছিস এবার আমাদের মান সম্মান ডুবাতেও উঠে পড়ে লেগেছিস?’
‘আহা, শান্ত হও, বাসায় যাই তারপর না হয় বলব।’ মিথিলার মামা একটু শান্ত করার জন্য কথাটা বলল তার মামীকে।
‘তুমি চুপ থাক। তোমার আস্কারাতেই আজ এই অবস্থা।’

শানের মা বাবাও ততসময় চলে এসেছে।
‘দেখুন আপনারা ভুল ভাবছেন। আজ কি হল সেটা তো শুনেছেনই। শানের মা রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই মিথিলা বাসায় এসেছে।’

শানের বাবা মিথিলার মামীকে বুঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু মনে হয় না কাজ হল তেমন একটা। মিথিলার মামী মিথিলার হাত ধরে জোড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে’ চল তোর সব পাখনা আজ কেটে দিব আমি।’ মিথিলা চোখের জল ফেলছে, যাওয়ার সময় একবার শানের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো।

শানের মনে একটু খারাপ লাগলো। মেয়েটা তার জন্যই এত কিছু করল আর বিনিময়ে সে তাকে কিছুই দিতে পারলো না, তার হয়ে একটা কথাও বলতে পারলো না।

কিন্তু এখন শানের মাথায় অন্যকিছু চলছে। নিচের দিকে তাকিয়ে পড়ে থাকা ফোনটা দেখতেই সেটা আবার মাথায় আসলো।

পুলিশ স্টেশনে বসে আছে শান। তার পাশে তার বসও আছে আর পুলিশ অফিসাররা। তাদের সামনে একটা লাশ শোয়ানো আছে। সেদিকেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শান।

কিছুক্ষন আগে পু’লিশ তাকে ফোন করে একটা লা’শ পাওয়ার কথা বলেছিল। লাশটা আর কারো নয়, সাব্বিরের!!! তাকে মাথায় অনেক ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে।
খবরটা শুনে শানের মাথায় ৪৪০ ভোল্টের শক লেগেছিল।

‘সাব্বিরকে কে মারবে?’
শানের বসের কথায় শানসহ সব পুলিশ অফিসার তার দিকে তাকালো।
‘না মানে আমি বলছি যে এত সময় তো আমরা সন্দেহ করছিলাম সাব্বিরই পুতুলকে মেরে পালিয়েছে তাহলে?’
শান অন্ধের ভাব করে মাথা নিচু করে আছে। এখন মনে হয় সন্দেহ আবার তার দিকেই গেল। কি থেকে কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতেছে না।

ডিআইজি সাহেব বলল,’শান তুমি টেনশন করো না। আগে লাশের পোস্ট মর্টাম হোক, তারপর না হয় দেখা যাবে।’
‘হুম।’ এই ছোট্ট শব্দটি ছাড়া কিচ্ছু বেড়লো না শানের মুখ দিয়ে।

সেইদিন রাতটা অনেক কষ্টে পার হয়েছে শানের। তার মা বাবা তাকে স্বান্তনা দিয়েছে যে নির্দোষদের উপরওয়ালা কোনো ক্ষতি হতে দিবেন না আর পুতুল নামক কা’লনাগিনী গিয়েছে তো ভালই হয়েছে।

শান স্টুডিওতে কাজটা রাতের বদলে দিনে নিয়েছে। এখন তার লাইভ শো সকালের শুরুতেই টেলিকাস্ট হবে। গতকাল রাতেই তার সাথে এ নিয়ে বসের কথা হয়েছে। সবাই শুধু আর যে শানকে চায়। তাই সকাল বেলাই সে স্টুডিওর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। কাজ থামাবে না শান সে যাই হয়ে যাক না কেনো। কিন্তু যাওয়ার পথে ডিআইজি সাহেবের নির্দেশে পুলিশ স্টেশনে গেল। লাশের পোস্ট মর্টাম নাকি ইতিমধ্যে হয়েছে। আর সাব্বিরকে গতকাল দুপুরের দিকে মারা হয়েছে। একটু আশার আলো দেখলো শান। কারণ তখন তো সে পুলিশ স্টেশনে ছিল। যদিও পুতুলের খুন নিয়ে এখনো মামলা তার উপরই আছে তবুও উটকো একটা ঝামেলা থেকে তো বাচলো।
আরো একটা ইনফরমেশন পেলো শান। আততায়ী বামহাতী ছিল। সেই মোটা ভারী বস্তু দিয়ে বামহাতে সাব্বিরকে প্রহার করা হয়েছে।

শান ভাবতে লাগলো তার চেনাজানা কেউ বামহাতী আছে নাকি। কিন্তু সে নিযে বাদে কাউকেই খুজে পেলো না। যদিও এখন তার ওই অভ্যাস নেই, তবে আগে সে সামান্য কাজেই ঝুলের ভিতর বাম হাত দিয়ে ফেলত। এই নিয়ে পুতুলের সাথে অনেক ঝগড়াও হয়েছে৷ পুতুল তার বামহাত ব্যবহারের স্বভাব বাদ দিয়ে তবে ছেড়েছে।

মাথায় আবারও সেই পুতুলের কথা আসছে! ভাবতেই গা রিরি করে উঠলো শানের৷ না আর সে তার কথা ভাববে না, যে শানকে ঠকিয়ে এসেছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করছে শান। পুতুলের মা বাবাকে আর দেখা যায়নি থানায়। মনে কৌতুহল জাগতেও সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। কিভাবেই করবে! সে তো দুনিয়ার কাছে অন্ধ।

স্টুডিওর কাজ শেষে দুপুরে বাসায় ফিরবে তখনই বাড়ি ঢোকার ঠিক আগ মুহুর্তে মিথিলার মামা ছুটে আসলো।
‘বাবা, আমার ভাগ্নীটাকে বাচাও বাবা। আমার মিথিলাকে বাচাও।’
‘কেন কি হয়েছে মিথিলার আঙ্কেল!! এমন করছেন কেন?’
‘বাবা শান,, মিথিলা,,,,,,,’

চলবে

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_১৩
#লেখক_আয়াশ

‘কি হয়েছে আঙ্কেল? কি হয়েছে মিথিলার?’
‘কাল এখান থেকে যাওয়ার পর ওর মামী ওকে মেরেছে, আমি কি অপারগ মামা! শত চাইতেও ঠেকাতে পারিনি। আজ সকাল থেকে মিথিলার জ্বর, তার মামী মানে আমার স্ত্রী তার দুঃসম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলেকে মিথিলার সাথে বিয়ে দেবে বলে আজ বিকেলেই আসতে বলেছে। আর মিথিলাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। হয়ত কিছু সময় পর চলেও আসবে সেই ছেলে। কিন্তু ছেলেটা ভাল না বাবা, অনেক খারাপ।’

‘আংকেল তো এক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি? এটা কি আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার না?’

‘মিথিলা তার মনের সব কথা আমাকে বলে। দেখো বাবা মেয়েটি বাচ্চা, বুঝে না এখনো অনেক কিছু।
তোমাকে নিজের মনে বসিয়ে ফেলেছে বাবা। আমাকে অনেক আগেই বলেছিল। কিন্তু,,,,’

‘কিন্তু আপনি তো জানেন আংকেল আমার কি অবস্থা। মিথিলার সামনে এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে।’

‘কিন্তু বাবা তুমি কিছু না বললে আজকেই ওর জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে। তুমি কিছু একটা করো। মিথিলা সকাল থেকে তোমার কথাই বলছে জ্বর নিয়ে।’

‘আংকেল মিথিলা বাচ্চা মেয়ে আর আমি বিবাহিত! অন্ধ! তারপরও!”
তখনই মিথিলার মামার ফোনে একটা কল আসলো।
]
ফোন পকেটে রেখেই সে বলল,’বাবা ছেলেটা নাকি চলে এসেছে। তুমি কিছু একটা কর। আমি ততসময় সামলাই ওদিকে।’

শান পড়ল মহাবিপদে৷ যে মেয়েটা তার পরিবারের জন্য তার জন্য এত কিছু করল, তাকে কিভাবে ক্ষতি হতে দেবে‌!!! কিছু একটা ভেবে ফোন ভের করল শান।

————

শাড়ি পড়িয়ে সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে মিথিলাকে, শরীরে জ্বর, হালকা কাপছে মেয়েটি। কিন্তু মামীর ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। গালে কালসিটে দাগ হয়ে আছে। কপালেও রক্ত জমাট হয়ে আছে। কালকে মারার সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দেয়ায় কপাল দেয়ালে লেগেছিল।

এই অবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে সামনে বসে থাকা ছেলেটি তাকে লালসার নজরে দেখছে। আগেও এই ছেলেটিকে দেখেছে সে। তার মামীর আত্মীয়। আগেও এসে মিথিলাকে বাজে নজরে দেখেছে। শরীর রিরি করে উঠছে মিথিলার। সে ভেবেই নিয়েছে তার মামা কিছু না করলে বিয়ে হওয়ার আগেই সে কিছু একটা ঘটিয়ে দেবে। হয়ত এ জীবনে আর ভালোবাসা পাওয়া হবে না তার।

কাজীকেও ডেকে আনা হয়েছে। ওই বখাটে ছেলেটি সামনে বসে পাংশুটে হাসি দিচ্ছে।
‘কাজী সাহেব কাজ শুরু করুন।’ মামীর কড়া নির্দেশ।

কাজী বিয়ের কাজ শুরু করার জন্য ছেলেকে মিথিলার পাশে বসতে বলল। ওই বখাটেটা মিথিলার পাশে বসতে যাবে ঠিক তখনই শান তার অফিসের বস ও ডি আই জি স্যারকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। ডি আই জি স্যারের পিছনে আরো দুই তিনজন পুলিশ।

তারা ঢোকা মাত্রই রুমের সবাই উঠে পড়ল।
‘আপনারা!! এখানে?’ মিথিলার মামী বিরক্ত সহকারে বলল।
ডি আই জি সাহেব কড়া গলায় বললেন,’শান জানিয়েছে এখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে!’

এতসময় মাথা নিচু করে থাকলেও শানের আসার কথা শুনে মিথিলা উপরে তাকালো। মনে এক সেকেন্ডেই অনেক সাহস সঞ্চার হয়ে গেল যেন তার। চোখে মুখে আশার আলো ফুটে উঠেছে।

‘কি বলছেন আপনারা?’ শানের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে মিথিলার মামী বলল।
‘সেটা যাচাই করতেই আসা আমাদের। এই ছেলে তোমার নাম কি? কি কর তুমি?’ ডি আই জি সাহেব বখাটে টা কে জিজ্ঞেস করল।
‘জি রাতুল।’
‘কি কর?’
‘জি জি,,,,, ‘ ভাতিজার তোতলানো দেখে মিথিলার মামী বলল,
‘এ আমার ভাইয়ের ছেলে। কেন কি হয়েছে?’
‘কিছুনা। তবে আপনার ভাগ্নীকে যে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, মেয়ের অনুমতি আছে কি?’
‘আছে, থাকবেনা কেন?’
‘আচ্ছা দেখি।’
ডি আই জি সাহেব মিথিলার কাছে গেল,
‘মা বলো তুমি। তুমি এ বিয়ে করতে চাও?’
মিথিলা উপরের দিকে চাইলো তার মামী চোখ লাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে হ্যা বলতে। কিন্তু পাশে শানের দিকে তাকালে দেখলো শান নিচে তাকিয়ে আছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মিথিলার মনে সাহস জাগলো।
‘হ্যা স্যার। এই বখাটেটার সাথে আমাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে। এর জন্য মেরেছেও আমাকে।’

উপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সময় শাড়ি পরিহিতা মিথিলার ঘোমটার আড়ালে মুখে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে ডিআইজি স্যার সহ সবাই চমকে উঠলেন। শান সব দেখেও কিছু বলতে পারছে না। আজ নাটক করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজে রুখে দাড়াতে পারছে না বলে নিজেরই রাগ হল। ভাল থাকলে আজ মিথিলার সাথে বিয়ে হওয়া ছেলেটাকে দিত দুই ঘা।

ডিআইজি সাহেব সাথে সাথে অর্ডার দিলেন,’নারী নির্যাতনের অপরাধে এর মামা মামীকে গ্রেফতার কর। এই ছেলেটিকেও এর মামীর সাথে থানায় নাও।’
ভাগ্যিস মিথিলার মামাতো বোন তার নানার বাড়িতে গেছিলো নাহলে সেও আজ আটক হত।

হ্যান্ডকাফ পড়াতে যাবে তখনই শান তখন বলে উঠল,’স্যার এনার মামার কোনো দোষ নেই, বরং এনার মামাই আমাকে দিয়ে আপনাকে বলিয়েছে।’

মিথিলার মামী রাগী চোখে নিজের স্বামীর দিকে তাকালো। যেন চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দেবে। কিন্তু মিথিলার মামার আজ একটুও দুঃখ নেই। সে নিজে সাহস জোগাতে না পারলেও আজ সে মৃত বোনের মেয়েটির সাথে অন্যায় হতে দেয়নি।

‘পোড়ামুখী এতদিন আমাদের খেয়ে পড়ে আমাদের পিঠেই ছুড়ি ঢুকালি? বিয়ে ভেঙেছে না তোর? দেখ আর কখনো তোর কপালে সুখ আসবে না।’ মিথিলার মামী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে বলছে।

‘ও তোমার খায়নি পড়েনি, আমার ভাগ্নী আমার খেয়েছে, আমার পড়েছে। আর বিয়ের কথা বললে, সেটা এখনি হবে।’

মিথিলার মামার কথায় সবাই অবাকের চরম পর্যায়ে।
”হ্যা আজই ওর বিয়ে হবে সেটাও শানের সাথে।’
মিথিলার গাল লাল হয়ে আসছে। সে আবার মাথা নিচু করে নিয়েছে।

‘কি বলছেন আংকেল, আপনার কথায় আমি এখানে বিয়ে ঠেকাতে এসেছি, কিন্তু বিয়ে এটা করা কিভাবে সম্ভব?’

‘কেন সম্ভব নয় বাবা?’ পিছন থেকে শানের মা বলে উঠল। তার পাশে তার বাবাও রয়েছে।
‘মা, তুমি?’ শান মায়ের আওয়াজ শুনে বুঝেছে এমন ভাব করে বলল৷
‘হ্যা আমি আর তোর বাবাও এসেছে। মিথিলার মামা আমাদের আজকেই জানিয়েছে। বাবা মেয়েটা তোকে খুব ভালবাসে। আমরাও বুঝেছি। তুই জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দে।’
‘কিন্তু মা আমি অন্ধ, বিবাহিত ছেলে। তাছাড়াও আমার নামে এখনো মামলা আছে থানায়। এ অবস্থায়!! স্যার আপনিই বলুন।’

ডি আইজি স্যার বলল,’আমি আর কি বলব, যদিও মামলা চলচজে তোমার নামে, তবে তুমি নির্দোষ প্রমান হওয়ার আগেই যদি সে তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমাদের কি করার। এখন কনে রাজি হলেই হয়। নাকি বলিস বন্ধু?’

‘শান, তুমি চিন্তা করো না। আমরা তোমাদের কিচ্ছু হতে দেব না। আমাদের বিশ্বাস তুমি নির্দোষ। আর আমি কি আমার চ্যানেলের স্টারকে সহজে ছাড়বো নাকি? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এখন শুভ কাজে দেরি করো না তো।’ শানের বস এতসময় চুপ থাকলেও এখন মুখ খুলল।

‘তুমি আমার মেয়ের বয়সী তাই বলছি, মা তুমি রাজি তো শানকে বিয়ে করতে?’ ডি আইজি সাহেব মিথিলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।

মিথিলা লজ্জায় মাথা নিচে নামিয়েছে। তার লজ্জা পাওয়া দেখে সবাই বুঝে গেছে।
শানের মা বাবা শানকে জোড় করে বসালো। মিথিলার পাশে। মিথিলার মামী আর ওই ছেলেকে থানায় যাওয়ার আগে বিয়ের দর্শক হতে হল না চাইতেও। আর কাজী! পড়াতে এসেছিল একজনের সাথে বিয়ে পড়ালো আরেকজনের সাথে। তবে মামার বাড়ি ছাড়ার সময় মিথিলা ডি আইজি সাহেবকে বলল তার মামীকে ছেড়ে দিতে। সে তার নতুন জীবন কারো অভিশাপের সাথে শুরু করতে চায় না।

——–

শানের মা বাবার পাশের ঘরটায়ই তাদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। পাশাপাশি বসে রয়েছে শান আর মিথিলা। দুজনেই চুপ। কেউ বুঝতে পারছেনা কি করবে, কি বলে শুরু করবে। শানই বলল

‘মিথিলা, আমি সত্যিই আমার এ জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চাইনি। আমার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
মিথিলা হঠাৎ শানের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো।
‘আমি জানি আপনি কি পরিস্থিতিতে আছেন। আমি শুধু এই বিপদে আপনার পাশে দাড়াতে চাই। তাছাড়া নিজে থেকে কোনোদিন আপনার সামনে কিছুর আবদার করব না আমি।’

শান চশমার আড়ালেই তার নববশূর দিকে তাকালো। মুখে মারের কালসিটে দাগ, কপালে লাল রক্তজমাট বাধা, তারপরও যেন কি মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে।

‘তুমি এত ভাল কেন? একজন স্ত্রী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীকে এতটা বিশ্বাস করছো এখনো?’

‘আমার আপনার উপর নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস। আপনি কারো খুন করতে পারেন না।’

‘তারপরও আমার মত বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করলে? তুমি আরো অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করতে মিথিলা।’

‘আর যাই হোক আমার চার বছরের ভালোবাসাকে কিভাবে হারাতাম!!’ বিরবির করে বলল মিথিলা।

‘কি বললে?’

‘কই কই কিছু না তো । বলছি মিথিলা মিথিলা কি? মিথু বলবেন। শুধুই মিথু। আজ থেকে আমি আপনার বউ। ভুলবেন না।’

‘কি আর বলব তোমাকে। তোমার আমার মা বাবার জেদের সামনে আজ পরাস্ত হলাম। যাই হোক আমার কিছু সময় দরকার৷ কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি৷ তোমার সাথে কখনো খারাপ কিছু হতে দিব না। তোমার পাশেই থাকব। দোয়া করো যেন তোমার বিশ্বাস রাখতে পারি।’

‘আপনার উপর বিশ্বাস না থাকলেও আমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আছে।’

‘মিথিলা, সরি মানে মিথু আমি একটু বাইরে খোলা বাতাসে যাচ্ছি। একটু পরেই আসব। তুমি ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে যেও কেমন? তুমি অসুস্থ, জ্বর এখনও যায়নি, রাত জাগা ঠিক হবে না।’

‘কেন বাইরে কেন আবার!!’

‘একটু মাথা ধরে আছে। তাই খোলা বাতাসে যাচ্ছি। দূরে নয় বাড়ির বাইরেই, এই যাব আর আসবো।’

‘আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসবেন।’
———

বন্ধ সিল মারা ঘরের মধ্যেই চুপিসারে প্রবেশ করলো শান। রুমটি অন্ধকার। এক দুমট গন্ধ বেড়চ্ছে এখনো রুম দিয়ে।

আস্তে আস্তে অন্ধকার রুমেই প্রবেশ করলো শান।
পুলিশরা এ ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছে। তবুও আজ নতুন কারো সাথে জীবন শুরু করার আগে এ রুমে তো তার আসতেই হল।

রুমের জানালা দিয়ে চাদের আলো পড়েছে রুমটিতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে শান।

কত স্মৃতি পুতুলের সাথে এ রুমে। ভালোবেসে কত সময় পাড় করেছে। কিন্তু কে জানত এক বিশ্বাসঘাতক সে। নিজের বদলা নেয়ার আগেও চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। এক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতা।

আয়নায় নিজেকে দেখে তাচ্ছিল্য হাসছে শান। আজ সে সুস্থ হতেও অন্ধের নাটক করতে হচ্ছে। আজ দুনিয়ার সবার সামনে সে এরকম শুধুমাত্র সেই ছলনাময়ীর জন্য। আজ আবার তার কাধে আরেকটা নিষ্পাপ মেয়ের ভার এসে পড়ল। কি থেকে কি করবে সে!!

নিজের বিষণ্ণ জীবনের কথা চিন্তা করতে করতে আয়নার সামনে হাটুগেরে বসে পড়ল শান। চোখ থেকে দুফোটা লোনাজল বেড়িয়ে পড়ল।

হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সামনে আয়নায় তাকালো শান।

‘এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে?? হাহাহা’

গলার আওয়াজ পেয়ে প্রচন্ড মাত্রায় চমকে উঠল সে।
এ কি দেখছে চোখের সামনে!!! এ তো পুতুল!!!!!
পুতুল এখানে কিভাবে?? সে তো মরে গেছে! তার দিকে তাকিয়েই বিশ্রিভাবে হাসছে পুতুল। শানের চোখ কি ভুল কিছু দেখছে? না এটা তো পুতুলই। কিন্তু কিভাবে?
‘আমার থেকে ছুটকারা পাবে না তুমি, যতই চাও, হাহাহা।’

বিশ্রি হাসি ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের চারিদিকে।
কাধে রাখা পুতুলের হাতটির উপর কাপা কাপা হাতে নিজের হাত রাখলো শান।
হাতের স্পর্শ পেতেই অবাকের আরো চরম মাত্রায় উঠল।
পাশে চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো এটা তো হাত নয়!!! কঙ্কাল!!
মানুষের রক্ত মাংসের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু কঙ্কালের হাত। পুতুল তখনো তার দিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।

প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো শানের। সে কোনোদিনও এসব ভুত প্রেতে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু নিজের সামনে এত কাছে এই দৃশ্য!!

সামনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ হাত দিয়ে চুলকালো ভাল করে শান। এবার আবার পিছনে তাকালো। কিন্তু নাহ, এবার তো কেউ নেই!! আশে পাশে ফাকা। একদম চুপচাপ। কেউ নেই আশে পাশে।
তাহলে কি ভুল দেখলো? কিন্তু মাত্রই তো সামনে ছিল পুতুল? এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল? হেলুসিনেশন হচ্ছে নাকি তার!!!
কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। তার সাথে কি হচ্ছে? আশে পাশে সব জায়গায় দেখলো, চাদের আলোতে সব ভালই দেখা যাচ্ছে। এবার গিয়ে সাহস করে ঘরের লাইটটাও জ্বালালো। না কিচ্ছু নেই। রুমের সব কিছু ঠিক ঠাক। কালকে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। তার মানে কল্পনাতেই দেখেছে এসব। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!! রুমের লাইট জ্বলার কথা মনে পড়তেই সাথে সাথে আবার বন্ধ করলো কারণ কেউ তাকে এ ঘরে দেখলে সন্দেহ করবে, ভাববে সেই খুনী।
নিজের কল্পনা ভেবেই উপরের রুম থেকে নিচে আসলো শান।

নিজের রুমে এসে দেখলো মিথিলা ঘুমিয়ে পড়েছে ওইভাবেই। পরণের শাড়ি এলোমেলো। দেখে শান মুচকি হাসলো। মেয়েটা বোধহয় শাড়ি সামলাতেই পারে না। নিজেই তার শাড়ির আচল দিয়ে তাকে ঢেকে দিল। মুখের উপর ডিম লাইটের আলো পড়েছে। আঘাত গুলোর উপর হালকা হাত ছুয়ে দিল শান। কতটা কষ্টই না পেয়েছে বেচারি তার জন্য।

না আর এই মেয়েটিকে কষ্ট পেতে দেয়া যাবে না। খুব শীঘ্রই তার সব সত্য সামনে তুলে ধরবে, মিথিলাকে সব জানাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই মিথিলার পাশে শুয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ধীরে ধীরে।

সকালের আলো চোখে লাগতেই ঘুম ভাঙলো মিথিলার। দেখলো পাশে শান তার মাথায় হাত দিয়ে তার মুখোমুখি শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।

সে দৃশ্য দেখেই মিথিলার ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

‘আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আপনার চেয়েও আপনাকে আমি বেশি চিনি। আপনি যতটা না নিজের ব্যাপারে জানেন তার থেকেও আমি বেশি জানি। ঠিক এতটাই ভালোবাসি আপনাকে।কখনো ছাড়বো না আপনাকে। কখনো না।

যে তাসের ঘরে আমি আপনি বন্দী হয়েছি সে ঘরটা আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আজীবন আগলে রাখব প্রিয়।’

কথাগুলো মনে মনে বলে শানের খুব কাছে এসে তার কপালে ওষ্ঠ ছুইয়ে দিল মিথিলা, প্রথম চুমু তার ভালোবাসাতে।

চলবে,

আজকের প্রশ্নঃ শানের সাথে উপরের রুমে হওয়া ঘটনা- কল্পনা না বাস্তবেই দেখেছে সে পুতুলকে? বাস্তব হলে কঙ্কালের হাত? কার কি অভিমত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here