#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০৪,০৫
#লেখক_আয়াশ
০৪
‘কি বলছেন এসব? পুতুল চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে?’
‘হ্যা সেটা তো অনেক আগে।’
শান যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘পুতুল এতদিন চাকুরির নাম করে বাড়ির বাইরে যাওয়া আসা করে। সেইজন্যই কি টাকার কথায় ওইরকম বিহেভ করে মায়ের সাথে!!!’
তখনই পাশ দিয়ে আরেকজন মেয়ে যাচ্ছিল। শান যার কাছে এসব শুনছিল তাকে জিজ্ঞেস করলো ওই মেয়েটি, ‘কিরে লাবনী ইনি কে? তোর রিলেটিভ? আগে তো দেখিনি!!’
‘আরেহ না, আমার রিলেটিভ হবে কেন? ইনি তো পুতুলকে খুজতে এসেছেন।’
‘কিহ! পুতুল? এতদিন পর হঠাৎ?’
‘ইনি নাকি জানতেন না যে এখন আর পুতুল এখানে জব করে না।’
মেয়েটি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,’জব করবেই বা কেন? বড় মাছ আটকেছে না জালে!! এখন আর এসব ছোট খাট চাকুরি কি পুতুলের করা লাগে?’
মেয়েটির কথায় শান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল, ‘কি বলছেন আপু? বুঝতে পারলাম না।’
মেয়েটি হেসে আবার বলল,’বুঝবেন কিভাবে। যদিও আপনার রিলেটিভ তারপরও বলছি, আমরা তো শুধু দেখতাম। আমাদের ম্যানেজার সাহেবের বন্ধু সাব্বিরের সাথে তার উঠা বসা বেশি হত পুতুলের। তার কিছুদিন পরই তো পুতুল জবটা ছেড়ে দিলো।’
‘সাব্বির!!!’
বেলকনিতে বসে গোধূলির রক্তিম আকাশের পানে চেয়ে আছে শান। ভাবছে কিছুসময় আগে পুতুলের অফিস থেকে শুনে আসা কথা গুলো।
পুতুলের এনজিও তে একটা প্রোগ্রামে তার ম্যানেজারের বন্ধু সাব্বিরের সাথে পরিচয় হয় পুতুলের। সেখানেই সাব্বিরের নজর পুতুলের দিকে পড়ে যায়। তারপর নাকি অফিস শেষে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে আসত সাব্বির, পুতুলের সাথে দেখা করতে। প্রথম প্রথম পুতুল সায় না দিলেও পরে নাকি তাদের প্রায়ই কথা বলতে দেখতো লাবনীরা অর্থাৎ পুতুলের কলিগরা।
এনজিওর ম্যানেজারের ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু লাগলে একদিন নাকি তিনি সাব্বিরকে এই নিয়ে বলেন। তার কিছুদিন পরই পুতুল জব ছেড়ে দেয়।
শান শুনেছে সাব্বির একটা খারাপ ছেলে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এবার হয়ত পালা পুতুলের। কিন্তু পুতুল! এভাবে তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করলো!!
হায়রে ভালোবাসা! আজকালকার ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়! যাকে আপনি যতটা ভালোবাসার অধিকার দিবেন, সে ঠিক ততটা কষ্টই আপনাকে ফেরত দেয়ার ক্ষমতা পাবে। মনের গহীনে যতটা স্থান একজনের জন্য বরাদ্দ করা যায়, তার অনুপস্থিতি অবহেলা সেই স্থানটাই কষ্টে পরিপূর্ণ করতে পারে।
‘তোমাকে এতটা বিশ্বাস এতটা ভালবাসার প্রতিদান এভাবে দিলে পুতুল!!’
এসব ভাবতে ভাবতে আঁখিদুটি অশ্রুসিক্ত হল শানের। কিন্তু মায়ের ডাকে তৎক্ষনাৎ সেটা আড়াল করে মুছে ফেললো সে।
‘কিরে খেয়ে নে, আবার তো তোকে কাজে যেতে হবে।’
‘মা আজ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।’
‘বাবা এরকম করলে তো শরীর খারাপ হবে।’
‘অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে আমায়। অফিসেই খেয়ে নিব মা। তোমরা খেয়ে নিও।’
শানের মা মন খারাপ করে চলে গেলো। হাজার হোক মা তো৷ ছেলের মনবোঝে। সেও হয়ত বুঝেছে এই বদলে যাওয়া পুতুলের সাথে তার ছেলেটা ভালো নেই।
সন্ধ্যা হলেই শান বেরিয়ে পড়ল। রিয়াদ ভাই যে বিশ্বাসের সাথে তার চাচার কাছে তার কথা বলে জব দিয়েছে সেই বিশ্বাসের সম্মানটুকু তো দিতে হবে! কাজ সে মন দিয়ে করবে। এটা ভেবেই বের হল ঘর থেকে।
বাড়ির সদর দরজা পেরোনোর পরই একটা মেয়ের কন্ঠ আসলো তার কানে।
‘আপনারা আমাকে ডিসটার্ব করছেন কেন? যান এখান থেকে।’
‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো, চলোনা আমাদের সাথে বসে আড্ডা দাও, আমাদেরও একটি মনোতৃপ্তি হোক।’
শান দেখলো কালকের সেই মেয়েটাকে কয়েকটা পাড়ার লাফাঙ্গা টাইপ ছেলেরা জ্বালাচ্ছে। সেই মেয়েটা ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই একটা ছেলে হঠাৎ মেয়েটার হাত ধরে ফেলল,
‘হা…হাত ছাড়ুন বলছি! বেয়াদবি করলে লোক ডাকবো আমি।’
‘আহা আমরা তো তোমার বন্ধুর মতই। চলো না আমাদের সাথে।’
‘এই কি হচ্ছে এখানে?’ শান জোড়ে বলে উঠল। ছেলেগুলো হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো, সাথে মিথুও তাকালো।
‘এলাকায় অসভ্যতা করিস মেয়েদের সাথে! দাড়া তোদের আমি….’ বলে শান লাঠি উচু করে মারার জন্য আসলো।
ছেলেগুলোর বয়স খুব বেশি না, কলেজ পড়ুয়া। শানের হাতে লাঠি আর মারতে আসা দেখে তারা এক দৌড় দিল।
মিথু শানের দিকে দৌড়ে আসল।
‘আপনি! আপনি কথা বলতে পারেন?’
‘চুপ করো মেয়ে, তুমি এখানে কি করছো? সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে কেনো?’
‘আ, আসলে,,’
‘আসলে কি?’
‘আচ্ছা আপনি লাঠি হাতে উচু করে আসলেন! কিছু না দেখে ওদের সাথে মারামারি করে পারতেন?’
শান মুচকি হেসে বলল, ‘শরীরের শক্তির চেয়ে বুদ্ধির জোড় বেশি। ওরা কি বুঝেছে এটা অন্ধের লাঠি? ওরা তো ঠিকই মনে করেছে আমি লাঠি নিয়ে মারতে আসছি।’
‘হুম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে আজ,,, ‘
‘আমি কিন্তু আমার কথার জবাব পাইনি। তুমি বাড়ির বাইরে কি করছো?’
মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেলল। চোখে ইতিমধ্যে জলের আভা প্রকট হয়েছে।
‘অনাথ এতিমদের জীবনটাই কষ্টের।’
‘মানে?’
‘থাক অন্যদিন বলব।’
‘তাহলে তো আমারও আজ না অন্যদিন তোমাকে সাহায্য করা উচিত ছিল।’
‘আসলে,,’
‘তুমি কি বলবে না কি?’
‘মামী আর মামাতো বোন আমাকে রেগে বাড়ির বাইরে করে দিয়েছে। আজ নতুন না মাঝে মাঝেই দেয়। রাগ হলে অথবা আমার কাজে একটু ভুল হলেই বের করে দেয়। আজ যেমন খাবারে লবন একটু বেশি হয়ে গেছিলো। তার তরকারির প্লেট ফেলে দিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরে বের করে দিয়েছে।’ বলতে বলতে কেদে দিল মেয়েটি।
শান এখন খেয়াল করল মেয়েটির গালে হাতের ছাপ বসে গেছে।
‘কিন্তু তুমি এখন বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছো?’
‘মামা অফিস থেকে আসলে তার সাথে ঢুকবো। তাই অপেক্ষা করছিলাম। এর মাঝেই ওই ছেলেগুলো,,,,’
শানের মেয়েটির জন্য কষ্টই লাগলো। এখন একা দাড়ালে আবার কেউ এসে ডিসটার্ব করতে পারে। তাই সে মেয়েটির সাথেই দাঁড়িয়ে রইল।
দুজনই চুপচাপ। এক দুই মিনিট পরই মেয়েটি বলল,’আমার নাম মিথিলা, আপনি?’
‘পিছনে যে বাড়িটা দেখছো ওটা আমাদের৷ আর আমার নাম,,,,,’
শান বলতে বলতে মেয়েটি আবার বলল,”ওই যে আমার মামা হেটে আসছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘হুম।’ বলে শান আবার লাঠি নিয়ে বিপরীতে এগোতে লাগলো।
‘আপনি রাতে একা যেতে পারবেন?’
‘হাহা অন্ধদের তো রাত আর দিন সবই এক।’
‘আচ্ছা ভাল থাকবেন।’
‘তুমিও সাবধানে থেকো।’
বলে শান অফিসের দিকে রওনা দিল।
অফিস থেকে এসে আজকেও পুতুলকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো শান। তার যেন পুতুলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না। বিশ্বাসঘাতক একটা।
খুব জলদি একটা কিছু করতে হবে আর এই অন্ধের নাটক করতেও ভালো লাগছে না তার।
পরের দিন সকালে আবারো ফলো করলো পুতুলকে শান। আজ আর কোনো ভুল নয়। সে দেখলো গাড়িটা পাশের এক পার্কের কাছে থামল। পুতুল আর সাব্বির নামের ছেলেটা হাত ধরাধরি করে নামলো।
শান পিছনে লুকিয়ে ফলো করছে তাদের। একটা বেঞ্চে বসছে দুজন। পুতুল সাব্বিরের কাধে মাথা রাখলো। শানের চোয়াল মুহুর্তেই রাগে শক্ত হয়ে গেলো।
সে নিজের মোবাইলে পিছন থেকে ভিডিও করতে লাগলো।
পুতুলের আওয়াজ ভেসে আসলো হঠাৎ।
‘তুমি আজকেই চলে যাবে? এই পনেরো দিন আমি কিভাবে থাকবো?’
‘আহা বেবি আমার বিদেশে কয়েকটা গাড়ির পার্টসের জন্য যেতে হবে। বুঝতেই তো পারছো। আর কয়েকটা দিন এমনিতেই চলে যাবে।’
‘আমি আর ওই বাসায় থাকতে পারছি না। এতদিন তো তোমার অফিসে না হয় বাসায় বসিয়ে রাখো। আর একয়দিন কি করবো?’
‘আরে চাকুরীর কথা না বললে কি তোমাকে তোমার শশুর শাশুড়ী বাইরে বেরোতে দিত?? আর আমি তো সারাদিন কাজের ফাকে তোমাকে নিয়েই ব্যস্থ থাকি।’ একয়দিন বলবে ছুটি নিয়েছো অফিস থেকে। আর এই নাও কিছু টাকা। এই দিয়ে চলবা এই কয়দিন।’
‘না থাক আগে যা দিয়েছো সেটাই তো আছে। আর দিচ্ছো কেনো?’
‘আমার সব তো তোমারই।’
‘শানের কি করা যায় কিছু ভেবেছো?’
‘ওর কাছে তুমি বলতে না পারলে আমি কি করব। আচ্ছা এবার আমি বিদেশ থেকে এসে নেই তারপর দেখা যাবে। ওর তো কিছু একটা করাই লাগবে। তবে যাই বলো চোখ না ভালো হওয়ায় আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে।’
‘হুম।’
‘কিন্তু তুমি কিন্তু শানের কাছেও আর ঘেষবে না।’
‘আরেহ না, আমি ওর সাথে একটা ভাল করে কথাও বলি না। জানো আমি তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝেছি আসলে শানের প্রতি আমার মোহ ছিল। সেটা তোমার ভালোবাসায় কেটে গেছে। কিন্তু মাঝখানে বিয়েটা হয়ে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।’
‘চিন্তা করো না। আমি এসে নেই। তারপর শান সোজা ভাবে রাজি না হলে আমারও পথ জানা আছে।’
এই কথাটা শুনে শান আর এক সেকেন্ড দেরি করলো না। চলে আসলো সেখান থেকে। এই মেয়েকে সে ভালোবেসেছিলো? ছি!
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো৷ আগে সাব্বিরকে শেষ করবে, তার সম্পদ, প্রোপার্টি সব ধ্বংস করে পথে বসাবে তাকে। তারপর পুতুলকে৷ আর সাব্বিরের একয়দিন বিদেশে থাকাও শানের জন্য কাজটা সহজ করে দিল।
পরের কয়দিন পুতুল বাড়িতেই থেকেছে। বলেছে ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে।
পুতুল কিন্তু প্রতিদিন মেসেজ করে শানের সামনেও। আর শান না দেখার ভান করে থাকে।
অফিসে ভালই কাজ চলছে শানের। রেডিও জকি হিসেবে সে আর তার কন্ঠ অনেক পরিচিত এই অল্প কয়দিনেই। সবাই এখন তাকে আর জে শান নামে চেনে। কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি বা পরিচয়ও জানে না। কিন্তু অনেক মেয়েই তার গলার আওয়াজে পাগল। এর মধ্যে একটি নেয়ে প্রতিদিন তার শোয়ের সময় কল করে। শানের মুখের আওয়াজে নাকি তার দিনটা ভালো যায়। শান তার জন্য অনেক পছন্দের গান শোনায়।
এর মধ্যে সাব্বির বিদেশে থেকেই খবর পেয়েছে তার দুইটি গ্যারেজ পুলিশ সিল করেছে সেখানে নানা রকম মাদক দ্রব্য পাওয়ার জন্য। ইয়াবা,, ড্রাগস, ফেনসিডিলের কারবার করে এমন অভিযোগও এসেছে তার উপর৷
টিভিতেও এই খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই অবাক হয়ে দেখছে পুতুল। শান অফিসে যাচ্ছিল। খবর দেখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো মুখে।
‘মা অফিসে যাচ্ছি আমি।’
‘সাবধানে যাস বাবা।’
পুতুল শানের কথায় পেছনে তাকালো, শান লাটজির সাহায্যে চলে যাচ্ছে দরজা দিয়ে। আজকাল শান তার সাথে সেরকম কথা বলেনা। তাহলে কি শান তাকে সন্দেহ করছে? পুতুলের মনে প্রশ্ন জাগে। সব কি জেনে গেছে কোনো ভাবে? কিন্তু সেটার তো উপায় নেই। একজন অন্ধের অপক্ষে কিভাবে সম্ভব জানা? পুতুল মাথা থেকে চিন্তা ঝাড়লো।
রাতে অফিস থেকে এসে ঘরে ঢোকার আগেই বুঝতে পারলো পুতুল ঘরে ভিডিও কলে কথা বলছে।
‘আচ্ছা তোমার কে শত্রু আছে?’
‘সেটা তো আমিও বুঝতেছি না। আমাকে কালকেই দেশে আসতে হচ্ছে। দুইটা গ্যারেজ অলরেডি শেষ আরেকটা আছে। এটা শেষ হতে দেয়া যাবে না, তাহলে তো পথে বসে যাব আমি।’
‘আচ্ছা এসো আমিও তোমাকে ছাড়া ভাল নেই, আমরা মিলে কিছু একটা করব।’
‘হুম। কে আমার পিছনে লেগেছে সেটা বের করতেই হবে। তাকে জানে মারব আমি।’
শান তাদের কথা শুনে মুচকি হাসলো। ‘দেশে আয় সাব্বির। এখনো যে অনেক কিছু বাকি আছে তোর সাথে হওয়ার।’
কিন্তু কে জানত, শানের জীবনে সামনে এক ভয়াবহ ঝড় অপেক্ষা করছে!!!
চলবে,
গল্পে এখনো অনেক টুইস্ট বাকি আছে৷ সবাই একটু মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন, বুঝে যাবেন। ধন্যবাদ।
#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০৫
#লেখক_আয়াশ
এতদিন সাব্বিরের প্রতিটা গ্যারেজে গ্যারেজে রাতের আধারে গিয়ে বিভিন্ন রকম নেশা দ্রব্য রেখে আসে যে, সে আর কেউ নয় শান নিজেই। তারপর নিজেই পুলিশের কাছে অচেনা নম্বর অথবা কোনো পি.সি.ও. থেকে ফোন দেয়। বিদেশ থেকে চিকিৎসাকালীন কিছু টাকা বেচে গেছিলো শানের। সেই টাকার প্রায় সবই শেষ এসব নেশা দ্রব্য ম্যানেজ করতে করতে।
আর একটাই কাজ বাকি আছে। সেটা সফল হলে
তারপরই সাব্বির রাস্তায় বসবে। কিন্তু শানের মাথায় অন্য বুদ্ধি।
এক ভয়ংকর পরিকল্পনা তার। সাব্বির দেশে আসলে সে গ্যারেজে থাকাকালীন পুলিশের রেইড হবে। হাতেনাতে ধরা পড়বে সাব্বির। আর শানের মোহরা হবে পুতুল। সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না।
অবশ্য এ পরিকল্পনা হয়েছে গতকাল রাতে। সে ঘরের বাইরে দাড়িয়ে ছিল। পুতুল ফোনে বলছিল আজ এতদিন পর সাব্বির আসবে। তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে পুতুল। সেকথা শুনে শানের কষ্টের চেয়ে মুখে ক্রুর হাসিই বেশি দেখা দিল।
সাব্বির আজ দেশে এসেছে ভোরে। সকাল সকাল উঠে বেলকনিতে বসে বসে প্ল্যানের সব ছক মাথায় কষছিলো শান।
তখনই তার মা এসে কাধে হাত রাখল,’বাবা উঠে পড়েছিস?’
‘হ্যা মা, মাত্র উঠলাম।’
‘আসিস এত রাত করে আরেকটু ঘুমালেও তো পারতি।’
শান কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘কিছু বলবে মা?’
‘হ্যা বাবা, কিভাবে যে বলি, আসলে তোর মামা নাকি অসুস্থ। আজ আমি আর তোর বাবা সেখানেই তাকে দেখতে যেতে চাচ্ছি।’
‘তো সমস্যা কি যাওনা। এক দুইদিন থেকে আসো।’
‘আসলে আমার কাছে তো টাকা যা ছিল সব পরিবারের খরচে শেষ হয়ে গেছে। আবার বৌমার কাছে বললেও কি বলবে তাই,,,,’
শান হেসে বলল, ‘যাবে কখন?’
‘বিকেলে আমি আর তোর বাবা রওয়ানা দিতে চাচ্ছি।’
‘অহ, আমি দুপুরে অফিসে গিয়ে বসের কাছে চেয়ে অগ্রিম কিছু এনে দেব মা। চিন্তা করো না।’
‘তোর এমনিতেই এ অবস্থা। তার উপর তোকে আরো কষ্ট দিচ্ছি আমরা। তাইনারে!’ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল শানের মা।
‘আমিই তো কুলাঙ্গার মা। তোমাদের দ্বায়িত্ব নিতে পারলাম না। এখনো তোমাদেরই পরিবার চালাতে হয়।’
‘আমার ছেলে নিজে চোখে না দেখেও তার বয়ষ্ক বাবা মাকে দেখে রাখতে রাত নেই দিন নেই খেটে যাচ্ছে। আর সে কুলাঙ্গার!! এ কথা ভুলেও বলবি না আর।’
শান মাথায় রাখা তার মার হাতের উপর হাত রেখে হাসলো।’কবে আসবে মা?’
‘এইত বাবা দুই একদিন মাত্র। কিন্তু এই এক দুইদিন থাকতে পারবি তো?’
‘হ্যা মা। একা নাকি আমি পুতুল তো আছে, সে কোথায়?’
শানের মা কেমন খাপছাড়া গলায় তাচ্ছিল্য সহকারে বলল
‘সে আজ সকালে উঠে বাজারে গেছে, অফিসের সবার জন্য নিজে রান্না করে নিয়ে যাবে। আর নিজের অসুস্থ স্বামীটার কোনো খোজ নেই। আগে থেকে জানলে তোর জীবনটা আমি এভাবে নষ্ট করতাম না বাবা।’
মুখ মলিন হয়ে উঠল মা ছেলের।
‘আহ মা বাদ দাও তো। আজ যাবে এক জায়গায়। চিন্তা মুক্ত হয়ে যাও।’ কথা কাটাতে শান বলল।
———–
পুতুল সকাল থেকে নানা পদের রান্না করতে ব্যস্ত। অবশেষে দুপুরে রান্না শেষ হল। সব গুছিয়ে রওয়ানা দিবে এমন সময় শান বলল,’পুতুল আজ আমাকেও একটু নিয়ে যাবে সাথে?’
পুতুল চমকে উঠল,’মানে!!!! তুমি এখন কোথায় যাবে? কেনো?’
‘আসলে আমার এখন একটু অফিসে যেতে হবে। নামিয়ে দিও না হয়। প্লিজ।’
শানের মা বাবা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। পুতুল বেড়োবে ঠিক তখনই পিছন থেকে কথাটি বলল শান।
অনিচ্ছা হলেও রাজি হল পুতুল।
বাসায় বাইরে গিয়ে একটা সি এন জি ঠিক করলো পুতুল। হাতে এক গাদা খাবার। শানের কাছেও অফিসের ব্যাগ। গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিল দুজন।
শান হঠাৎ বলল,’পুতুল একটা কাজ করে দেবে আমার?’
‘কি?’ কেমন বিরক্ত হয়ে বলল পুতুল।
‘রেগে যাচ্ছ কেনো? আশে পাশে ওষুধের দোকানের পাশে রেখে একটা মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনে দেবে? আমি যেটা খাই সেটা। চোখও জ্বালা করছে কেমন।’
সামনে ফার্মেসীর পাশে গাড়ি থামাতে বলে পুতুল ওষুধ আনতে নামলো। তখনই মুচকি হাসলো শান। নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা তড়িঘড়ি বের করে পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবারের ব্যাগটির দিকে হাত বাড়ালো।
————-
শানকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে পুতুল চলে গেল। অফিসে গিয়েই শান বসের কাছে কিছু টাকা চাইলো মায়ের কথা বলে। এমনিতেই অফিসের সবাই শানের কাজে আর ডেডিকেশনে মুগ্ধ। এক কথায় তাদের মিডিয়া চ্যানেল শানের গলার আওয়াজেই এখন এত পপুলার। শানের কথা শোনার আগেই বস তার হাতে টাকা গুজে দিল।
‘এখানে দশ হাজার টাকা আছে। তোমার মাকে দিও ঠিক আছে? বাকি টাকা মাস শেষে নিও।’
‘ধন্যবাদ স্যার। কি বলে যে আপনাকে,,,’
‘আরেহ তুমি আমার চ্যানেলের গৌরব। আমারই তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। এখন যাও রাতে এসো কেমন। গাড়িতে উঠিয়ে দিব?’
‘না স্যার আমি পারব। আসি স্যার।’
———
অফিস থেকে বেরিয়ে শান এক মুহুর্ত দেরি না করে পাশের কোনো পাবলিক ওয়াশরুমে গেলো। নিজের ব্যাগে আনা ফলস চুল দাড়ি পড়ে জামা পাল্টালো যেটা সে যা প্রতি রাতে করে। এবার লক্ষ্য সাব্বিরের গ্যারেজ। মুচকি হাসলো শান। যাওয়ার আগে পাশের একটা পি.সি.ও. থেকে পুলিশকে খবরটা জানাতে ভুললো না।
———-
গ্যারেজে মাত্র প্রবেশ করলো পুতুল। সাব্বির কথা বলছিল বাকিদের সাথে এসব নিয়েই। পুতুলকে আসা দেখে তাকে নিয়ে গ্যারেজের দুইতালায় গেলো।
শান একটু পরই পৌছাল। বৃদ্ধ লোকের বেশে এসেছে সে। নিচে গ্যারেজে অনেক লোক। গাড়ি রিপেয়ার করছে, তো কেউ পুরাতন গাড়ি কিনতে এসেছে। সবার চোখ ফাকি দিয়ে দুইতলায় গেল।
উপরের রুমের দরজা বন্ধ। কিন্তু পাশের জানালার ছিদ্র দিয়ে সবই প্রায় দেখা যাচ্ছে। শান সেখান দিয়েই খেয়াল করলো, পুতুলকে সাব্বির জড়িয়ে রেখেছে। পুতুলের গায়ে বোরকা নেই এখন আর। নিচে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সেজে এসেছে আজ। পাশে টেবিলের উপর পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবার। জড়িয়ে থাকা দৃশ্য দেখে শানের চোখ লাল হয়ে গেলো। এই বিশ্বাসঘাতককে সে কিনা ভালোবেসেছিলো!
‘কি করছো ছাড়ো।’ পুতুল ন্যাকামো করে বলল।
‘এতদিন পর কাছে পেয়েছি। ছাড়তে ইচ্ছেই করছে না।’ সাব্বিরের কেমন ঘোরের মধ্যে জবাব।
‘আহা, আগে খাবার এনেছি তোমার জন্য সেটা তো খেয়ে নাও।’
‘আমার খাবার তো আমি জড়িয়েই রেখেছি। সেটা আগে খেয়ে নেই। তারপর না হয় দেখা যাবে।’ কথাটা বলেই পুতুলকে আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে আরো গভীর হতে চাইলো।’
শান সেটা দেখেই জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখের সামনে তার একসময়ের ভালোবাসা অন্যের সাথে ভালোবাসার আদান প্রদানে ব্যস্ত।
ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো। না চাইতেও জানালা দিয়ে আবার চাইলো শান। পুতুলের ঘাড়ে মুখ গুজে আচলে টান দিতেই সাব্বিরের কানে আসল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ। সাথে সাথে ছিটকে গেলো দুজনই।
‘পুলিশ হঠাৎ এসময়!!’ সাব্বিরের ভয়ার্ত কন্ঠ।
‘আমাকে তোমার সাথে এখানে দেখে ফেললে কি হবে? কি বলবে সবাই?’ পুতুলও ভয়ে প্রায় কেদে দিয়েছে।
‘আরে পিছনে একটা সিড়ি আছে। তুমি সেখান দিয়ে নেমে যাও।’
‘তুমিও চলো।’
‘আরে না, আমাকে তো এসব ফেস করতেই হবে। আর তাছাড়া আমি এসেছি এখন। এই গ্যারেজে তো কিছু পাবে না।’
‘আচ্ছা আমি যাই।’ পুতুল সাব্বিরকে হালকা জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ালো ওইভাবেই।
বোরকা পড়তে ভুলে গেছে তাড়াহুড়োয়। বোরকাটা নিচেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল। দৌড়ের সময় পুতুলের পায়ের সাথে বেধে রুমের বাইরে পর্যন্ত চলে এসেছে। পুতুলের সেদিকে নজর নেই। সে দ্রুত এখান থেকে যেতে পারলেই বাচে।
শান সাথে সাথে আড়ালে এসেছে। যেন পুতুল দেখতে না পায়। পুতুল পিছনের গেট দিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই পুলিশ উপরের তলায় চলে আসল।সাথে গ্যারেজের অনেকেই এসেছে, কর্মচারী, ক্রেতাসহ সবাই। শোরগোলে সবার দেখার ইচ্ছা কি হচ্ছে এখানে। শান বৃদ্ধ বেশে তাদের মাঝে মিশে গেছে।
পুলিশ সবাইকে বাইরে রেখে সাব্বিরের রুমে গেলো। শান আবার জানালায় চোখ রাখল।
‘কি ব্যাপার আপনারা আমার গ্যারেজে?’ সাব্বির প্রশ্ন করলো।
‘আপনার গ্যারেজে নেশাদ্রব্য আছে আমরা খবর পেয়েছি।’
‘হাসালেন। এতদিন আমি দেশে ছিলাম না। আমার গ্যারেজে কে না কে রেখে গেছিলো ওইসব। তার ভিত্তিতে আমার উপর মামলা করেছেন, সিল করেছেন সব। আর এখন তো আমি দেশে। এখানে কে রাখবে? আপনারা খুজে দেখতে পারেন।’ সাব্বির বলে পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসল।
পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোজা শুরু করলো। কিছুই না পেয়ে চলে যাবে তখনই হঠাৎ একজন অফিসার বলল,’এই টিফিন বাটিগুলোতে কি?’
‘আমার লাঞ্চ।’ সাব্বিরের আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব।
পুলিশ কি মনে করে বাটিগুলো খুলতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাথে সাব্বিরের তো জান যায় যায় দশা।
সব গুলো বাটিতে মুখরোচক খাবার। কিন্তু তার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য-ইয়াবা ট্যাবলেট, ড্রাগস এর প্যাকেট!!!!!!।
‘পুতুল!!! তাহলে তুমি??? তুমি আমার সব গ্যারেজে এরকমটা করেছো? আমি তোমাকে ছাড়ব না পুতুল। ছাড়বো না।’ সাব্বির বসে পড়ে রাগে ক্ষোভে এসব বলছিল। তখনই হাতে হাতকড়া পড়ালো একজন। হাতে নাতে মাদকদ্রব্য ধরা পড়েছে। আজ আর রেহাই কোথায়!
বাইরে সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে এখনো দেখছে এসব শান। মুখে আজ তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না আরেকজন তো বাকি আছে। এবার তার পালা। সবাইকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পেতে হবে। সবাইকে!!!!
কিন্তু এক প্রলয়ংকারী ঝড় যে তার জীবনে আসন্ন সেটা কি শান জানে??
চলবে,,
সামনের প্রতিটা পর্বে থাকবে রহস্য আর রহস্য। আপনারা সবাই সাথে থাকবেন। সবার গঠনমূলক মন্তব্যের আশায়!!!!! অগ্রিম ধন্যবাদ।