#বিবি,৪১
#রোকসানা_রাহমান
নিবিড় বাসায় ফিরল প্রায় বারোটা নাগাদ। ক্লান্ত চোখজোড়া এক সেকেন্ডের জন্য নিবদ্ধ হয়েছিল স্ত্রীর অপরিমেয় উদ্বিগ্নে পিষ্ট হওয়া মুখটায়। তারপরেই ক্লান্ত পথিকের মতো হেঁটে গেল অনড়ার রুমটার দিকে। যেতে যেতে শুনল,
” কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আম্মা খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন।
ভেতরে এসে বিছানায় বসল। কোমল পিছু পিছু আসলেও দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুঝতে পেরেও সেদিকে তাকাল না। নীঃশব্দে থম মেরে বসে থাকল। কোমল দুয়ারের কাছ থেকেই বলল,
” হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার বাড়ছি। ”
নিবিড় উঠে ধৌতখানার দিকে এগুলে কোমল রান্নাঘরের দিকে ফিরে গেল। দ্রুতহাতে খাবার বেড়ে স্বামীর অপেক্ষা করছে। প্রায় মিনিট দশ পেরুনোর পরও সে আসছে না দেখে নিজেই আরেকবার ডাকতে গেল। দুয়ারের কাছে পৌঁছে আঁতকে ওঠল। রুম অন্ধকার। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। পাখা বন্ধ। ভ্যাপসা গরমে হালকা দুর্গন্ধ। অনড়া চলে যাওয়ার পর এ কক্ষে কেউ ঢুকেনি। দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় গন্ধটা তৈরি হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের আলো কিঞ্চিৎ প্রবেশ করায় অন্ধকার কিছুটা হালকা হয়েছে। কোমলের সন্ধিৎসু দৃষ্টিতে নিবিড়ের দেহটা কালো ছায়ার মতো ধরা দিল। সে হাত-পা মেলে শুয়ে আছে।
” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? ”
প্রশ্নটা করতে করতে বন্ধ জানালার পাল্লা খুলে দিল। পাখাটা ছেড়ে দিয়ে স্বামীর শিয়রে বসল। পরম স্নেহে কপালে হাত রেখে দরদ ঢেলে দিল কণ্ঠস্বরে,
” আজ খুব চাপে ছিলে, তাই না? চিন্তা করো না। আর তো কিছুদিন। ইন্টার্নি শেষ হলে নিজস্ব চেম্বার নিয়ে বসবে। তখন আর..”
কোমল কথা শেষ করতে পারল না। নিবিড় হাতটা ঝকটায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুমি এখান থেকে যাও। ”
তার আকস্মিক কণ্ঠস্বরে খানিক চমকে ওঠল কোমল। খেঁই হারাল। নরম শরীরটা কাঠের মতো শক্ত হলো। রেগে গিয়ে আদেশ করল নাকি বাধ্য হয়ে অনুরোধ করল বুঝতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত নির্বোধের মতো বসে থেকে বলল,
” সারাদিন খাওনি তো। খাবে না? ”
নিবিড় নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল,
” না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে হয়েছে তাই। তুমি কি যাবে? ”
তার এমন রূঢ়কণ্ঠকে সয়ে নিলেও ব্যবহারে যে বিরক্ত প্রকাশ পাচ্ছে সেটা মানতে পারছে না। নিবিড়ের নিকট সে কখনই বিরক্তের কারণ হয়নি। সামান্যতমও না! কোমল মনের ভাবনাকে, ধারণাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
” আলসেমি লাগছে? ঠিক আছে, তুমি বসো। আমি খাবারটা এখানে নিয়ে আসছি। ”
সে এমনভাবে বেরিয়ে এলো যেন কেউ তাকে তাড়া করছে। ধরা পড়লে বিপদ! প্লেটে ভাত ও তরকারি সাজিয়ে নিয়ে আরেকদফা অবাক হলো। নিবিড় দরজা আটকে দিয়েছে। বন্ধ দরজার পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শামুকের মতো শক্ত খোলস ছেড়ে নরম মনটা বেরিয়ে এলো। দৃষ্টি ঝাপসা হতে বুঝতে পারল, চোখে পানি জমছে। এত সামান্য ব্যাপারে কান্না পেয়ে গেল বলে নিজেই বিস্মিত হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাড়া দিয়ে সংযমী হলো। গলা স্বাভাবিক করে বলল,
” ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? আমি খাবার হাতে দাঁড়িয়ে আছি। দরজাটা খোলো। ”
ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না। অন্যরকম সাড়াও না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল,
” আমি কোনো কথা বলব না। খাবারটা রেখে আসব শুধু। ”
এবারও কোনো উত্তর এলো না। দরজাও খুলল না। কোমল পুনরায় বলল,
” এখন ইচ্ছে না হলে খেও না। ঢাকনা চাপা দিয়ে আসব। পরে খেও। ”
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে মানানোর চেষ্টা করল। ব্যর্থ হয়ে দরজার সামনে বসে পড়ল। চুপচাপ দীর্ঘসময় বসে থাকার পর হালকা স্বরে সুধাল,
” তুমি কি এখানে ঘুমাবে? ”
” হ্যাঁ। ”
উত্তরটা এত দ্রুত ও পরিষ্কার শোনাল যে তার মনে হলো, নিবিড় হয়তো এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। কোমল আর এক মুহূর্তও থাকল না সেখানে। খাবারগুলো সেভাবে রেখেই নিজ কক্ষে ফিরে এলো। ঘুমানোর জন্য বিছানা ঝাড় দিলেও শোয়া এবং বসা কোনোটাই করল না। ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নফল নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। সেজদাহর জন্য মাটিতে মাথা ঠেকাতে বেঁধে রাখা অশ্রুকণা বারিধারায় রূপ নিল। চোখের পলকে ভিজে গেল জায়নামাজের রেশমি সুতো। পবিত্র কাপড়ে আগা-গোড়া মোড়ানো দেহটায় মৃদু কম্পন শুরু হলো। থামার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলল।
নিবিড় বিছানা ছাড়ল ফজরের আযান শুনে। দরজা মেলে দেখল, নিচে ভাতের প্লেট ও পানির গ্লাস রাখা। সেগুলো তুলে নিয়ে রান্নাঘরে রাখল। অতঃপর সচেতনে এগিয়ে গেল নিজেদের রুমটিতে। দরজা মেলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখল, কোমল গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে জায়নামাজে। বন্ধ চোখের নিচের মাংস পিণ্ড ফুলে গেছে। নিষ্প্রভ মুখটায় অশ্রু ধারা শুকিয়ে আকাঁবাঁকা রেখা সৃষ্টি করেছে একাধিক। ধীরপায়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল প্রাণপ্রিয় বিবিকে। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আপনমনে বলল, ‘ আমি আমার কোমলকে ফেরত চাই। যতদিন না পাচ্ছি ততদিন এমনই চলবে। ‘
__________
স্নেহের অনড়া,
আমার রাত জেগে তৈরি করা নোটগুলোর এমন দুর্দশা দেখে একটু কষ্ট পেয়েছি। চিঠির মালিককে যে এত জলদি খোঁজার চেষ্টা করবেন ভাবতেও পারিনি। নোট পাঠিয়ে কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি? আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না। রাগটা হয়তো অন্য কোথাও। ঠিক ধরেছি তো?
আসল কথাই আসি এবার, আপনাকে জ্বালাতন করার ইচ্ছেটা বাতিল করতে গিয়েও স্থগিত রাখতে হলো আপনার জন্য। এভাবে হুট করে হলে উঠেছেন যে, খোঁজ-খবরও নেননি হয়তো। যাদের সাথে আপনি রুম শেয়ার করছেন তারা প্রত্যেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করে। একজন বহুপ্রেমিক নিয়ে ঘুরে, আরেকজন ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিগারেটের প্যাকেট কিনে। অন্য একজন সমকামী। বিশেষ দিনে সকলে একসাথে মদ পান করে। তার খরচ যোগাতে এক নিষিদ্ধ রাস্তায় নিষিদ্ধ কাজের উদ্দেশ্যে রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে।
এবার উপকার নয় উপদেশ দিচ্ছি, সঙ্গ দোষে লোহায় ভাসতে না চাইলে এই সিটটা ত্যাগ করুন। অন্য সিটের আবেদন করে রাখুন। যতদিন না পাচ্ছেন ততদিন মহিলা ম্যাচে গিয়ে থাকুন। কয়েকটা ভালো মহিলা ম্যাচের ঠিকানা দিয়ে দিলাম, ইচ্ছে হলে খোঁজ নিতে পারেন। এগুলোর মধ্যে একটাতে আপনার বন্ধু সুমনাও থাকছে। সম্ভব হলে তার সাথে থাকতে পারেন।
ইতি
চেনা কেউ
পুনশ্চঃ আমার দেওয়া গোপন নামটা কি বের করতে পেরেছেন? আমি ঠিক করেছি, যেদিন ‘ আমি রূপে ‘ ধরা পড়ব সেদিন ঐ নামে ডেকে তোমার রাগ দমন করব।
অনড়া এই চিঠিটাও ছিঁড়ে ফেলল কয়েকশো টুকরোয়। সবগুলোকে অঙ্গুলির সাহায্যে দলে-পিষে ছুঁড়ে মারল জানালা দিয়ে। তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠল। কোমল কল করেছে। কলটা ধরতেই শুনল,
” অনু, তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস? ”
সে একটুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর করল,
” না। ”
” মিথ্যা বলছিস? ”
আগের চেয়েও দ্বিগুণ সময় চুপ থেকে উত্তর করল,
” না। ”
এবার বুঝি কোমলের চুপ থাকার পালা। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
” সাবধানে থাকিস। ”
” আচ্ছা। ”
” নিজের যত্ন নিস। ”
” আচ্ছা। ”
” নিয়মিত কল করিস। কিছুর দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে বলবি। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই জানাবি। আমার মতো ভুল করিস না। ”
” আচ্ছা। ”
বুবুর কথা ফুরিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে কলটা কেটে দিতে গিয়েও ডেকে ওঠল,
” বুবু? ”
ওপাশ থাকে দ্রুত উত্তর এলো,
” হ্যাঁ, বল। লাইনে আছি। ”
অনড়া কিছু বলার বদলে চুপ করে থাকল। কোমল অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” বলছিস না কেন? ”
” আমার জন্য দোয়া করো। ”
কথাটা বলেই কল কেটে দিল।
__________
নিবিড় যত কোমলকে উপেক্ষা করতে থাকল ততই যেন তার রাগ-ক্ষোভ, ব্যথা-যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট, অভিমান-অভিযোগের কারণ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল কোমলের চোখে। তার করা অন্যায়টা কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল হৃদয়ে। অনুতাপের বিষ ছড়িয়ে পড়ল শিরা-উপশিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অস্থিমজ্জায়। একসময় বাধ্য হয়ে আপনমনে চিৎকার করে বলল, ‘ আমি ক্লান্ত। সবাইকে নিয়ে চলার শক্তি ক্ষয়ে এসেছে। ধৈর্য্য ফুরিয়ে এসেছে। আমি সাহসী নই, ভীতু। আর ভীতুরা নিজ জীবনে সুখী। আমিও তাদের মতো সুখী হব। নিজেকে নিয়ে ভাবব, যেটায় আমার আনন্দ সেটাই আমার চাই। আর কিছু না। ‘ এই জীবনে প্রথমবারের মতো যখন একটু স্বার্থপর হওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল কুলসুম নাহার। নতুন শাড়ি পরে তার সামনে এসে বলল,
” বড় বউ? নিবিড়ের তো আজ ছুটি। একটু কইয়া দেও তো, আমারে ছোট বউয়ের কাছে দিয়া আইতো। পোয়াতি মাইয়াডা রে আর চোখে চোখে রাখতে পারলাম না। ক্যামনে চলতাছে আল্লাহই জানে! তিনমাস তো শেষ হইল, শরীর বাড়ব এহন। লগে একজন না থাকলে হয়? ”
” ওখানে থাকতে পারবেন না, আম্মা। ”
” ক্যান? ”
” অনু যেখানে থাকে সেখানে বাইরের মানুষদের থাকার অনুমতি নেই। ”
কুলসুম নাহারের উজ্জ্বল মুখটা অনুজ্জ্বল হয়ে এলো। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তাইলে আর কী, দেহা কইরা চইলা আমু। যাও, নিবিড়রে কইয়া আহো। সকাল সকাল গেলে বেশিক্ষণ থাকতে পারমু। ”
শাশুড়ির আদেশ পেয়ে নিবিড়ের কাছে গেলেও কথাটা বলতে একটু সময় নিল। সে এক ঝলক চেয়ে মানিব্যাগ ধরিয়ে দিল কোমলের হাতে। নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল,
” যাও, শাশুড়ির ইচ্ছে পূরণ করো। ”
কুলসুম নাহারকে নিয়ে কোমলই বেরুল। অনড়া যে হলের ঠিকানা দিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখল, সে নেই। তার সাথে থাকে এমন একজন জানাল, অনড়া পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
চলবে