#আধারে_তুমি,২৬,২৭
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ২৬
শপিং এ যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সোহা। কিন্তু বেডের উপর তার ড্রেসের মেলা খুলে বসেছে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেকটা ড্রেস দেখে যাচ্ছে আর ছুড়ে বিছানার উপর ফেলছে। আর ইতি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে মেয়েটা কি কি করছে। সোহা বরাবরের মতো আবারও আরেকটা ড্রেস ধরলো সামনে। আয়নায় দেখতে দেখতে ইতিকে উদ্দেশ্য করে বললো
” এটা কেমন রে ?” ইতি বিরক্ত স্বরে বললো
” এটাও তো সুন্দর ! তুই কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছিস ! এতো এতো ড্রেস বের করে রেখেছিস। কতোগুলোই তো সুন্দর কিন্তু তুই বারবার দেখেই যাচ্ছিস।”
সোহা নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো
” অদ্ভুত তো তুই এমন করছিস কেনো ? তোর বেষ্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কোথায় তুই, আমাকে সাজিয়ে ড্রেস চুজ করে দিয়ে গুজিয়ে দিবি। কিন্তু সেখানে আমাকেই সব ঠিক করতে হচ্ছে। তার উপর তুই বিরক্ত হচ্ছিস। কেমন ফ্রেন্ড তুই ?” ইতি কপাল চাপড়াল সোহার কথায়। সোহা ফুঁসছে রাগে। ইতি এগিয়ে এসে সোহার হাত থেকে ড্রেসটা নিয়ে রেখে দিলো। শান্ত ভাবে বললো
” দেখ শান ভাইয়া তোকে তো প্রথম থেকেই দেখে আসছে এখন আর নতুন করে কি দেখবে ? এমনি এমনি তো আর বিয়েতে রাজি হয়নি ! হয়তো তোর মধ্যে কিছু ছিলো যার কারণে তোকে ভালোলেগেছে তার। তুই তো সব সমই সাধারণ ভাবেঅ থাকিস তো এখন এসবের কি মানে ? তুই যেভাবে থাকবি তোকে সেভাবেই আপন করে নিতে পারলেই দেখবি তুই কতোটা অসাধারণ তার কাছে। সো এতো প্যাড়া না নিয়ে একটা ড্রেস পরে চল। বিয়ে হচ্ছে না আজ।”
সোহা মিটমিট করে হেসে বললো
” বিয়েরই তো শপিং করতে যাচ্ছি। যাই হোক তোর কথা ভালো লেগেছে আমার। উম্মাহ বেবি !”
ইতি গালে দিয়ে হাসলো। সোহা নাচতে নাচতে কাপবোর্ড থেকে একটা সাদা ড্রেস খুঁজে বের করলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিলো। ইতি মুখ কালো করে বলে
” নরমাল বলেছি দেখে একদম নরমাল ! এরকম সাদামাটা বিধবা বিধবা ?”
সোহা চোখ রাঙিয়ে বলে
” চুপ কর। নিজে বুদ্ধি দেবে আবার নিজেই আপত্তি করবে। আমি তো এটাই পড়বো।” সোহা ফুস করে নিশ্বাস ফেলে ওয়াসরুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে। ইতি হেসে সোহার বেডে থাকা ড্রেস গুলো কাপবোর্ডের সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো।
ইতি আজ বাড়ি থেকে এসেছে। সোহার সাথে শপিং এ যেতে হবে তার। সোহা ইতিকে ছাড়া কোথায়ই যাবে না সাফ না করে দিয়েছে। বিয়ের আগে ইতির মা, বাবাকেও আসতে হবে সোহার জেদ পুড়ন করতে।
রিয়ানা রহমান আর শষী এলো রুমে। ইতিকে বললো
” তোরা তৈরি হয়েছিস ! শানরা বেরিয়ে গিয়েছে ফোন করে জানিয়েছে মাত্র।” ইতি হেসে বলে
” তোমার মেয়ের তৈরি হওয়ায় শুরু হয়েছে মাত্র। দেখি আর কতোক্ষণ লাগে।”
ইতির কথা শেষ হতেই সোহা ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে গান গাইতে গাইতে। শষী সোহাকে দেখে চোখ বড়বড় চমকানো গলায় বললো
” আয়হায় আপামনি ! তুমি বিয়ের জামাকাপড় কিনতে যাইতাছো সাদা জামা পরছো কেনো ?”
সোহা, ইতি, রিয়ানা রহমান তিনজন ভ্রু কুঁচকে শষীর দিকে তাকালো। রিয়ানা রহমান তীক্ষ্ম চাহনি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো
” কেনো সাদা পরলে কি হয়েছে ?” শষী হাহাকার স্বরে বললো
” বিয়ের লাল বেনারসি কিন্তে যাইবো সাদা জামা পইড়া ? কেমন দেখা যায় না খালাম্মা ? যদি কোনো অমঙ্গল ঘটে যায় তখন ?”
রিয়ানা রহমান আতংকিত চাহনিতে সোহার দিকে তাকালো। তার মা আগাম বার্তা শোনার আগেই বুঝতে পারলো কি বলবে। সোহা রেগে লাল হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে বলে
” মা একবার যদি এই শষীর কথায় তুমি আজ আমাকে এই ড্রেস পরে যেতে বাধা দাও তাহলে আর আমি বিয়ের শপিং করতেই যাবো না বলে দিলাম।” ইতি কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। শষী প্রত্যেকবার কোনো কথা বললেই রিয়ানা রহমানের উপর তার প্রভাব পরে যায়। তিনি নিজেও শষীর কথায় ভুলিয়ে যায়। তিনি গ্রামের মানুষের কুসংস্কার বা চলতি কিছু কথায় মান্য করে। শষীও তার গ্রামেরই এক মেয়ে তাই শষীর কথা সঠিক বলে মেনে নেয়। সত্যি কিনা মিথ্যা সেটা ভাববেন না তিনি। রিয়ানা রহান বললেন
” না গেলে নেই কিন্তু সাদা ড্রেস পরে বের হবি না তুই। সত্যি যদি কিছু ঘটে যায় তখন কি হবে ?”
সোহা শান্ত হয়ে বলে
” শোনো মা যখন যা হওয়ার তখন তা হবেই। আল্লাহর ইচ্ছে থাকলে সেই বিপদ কেউ আটকাতে পারবে না। আর তুমি যে শষীর কথায় কান দাও বারবার ! তুমি নিজে কি এই কথা কখনো শুনেছো কারো মুখে ?” রিয়ানা রহমান ভাবনায় পরে গেলো। সত্যিই তো শুনেছে বলে তো মনে হয়না। রিয়ানা রহমানকে ভাবনায় ফেলে সোহা ততোক্ষণে তার ব্যাগ, ফোন নিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে ইতির হাত ধরে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। শষী হতাশ হয়ে বলে
” খালাম্মা আপামনিরা তো চলেই গেছে।” রিয়ানা রহমান চোখ বড়বড় করে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। সাদা জামা নিয়ে তেমন কোনো কথা শুনেছে বলে মনে করতে না পারলেও তিনি হায় হায় করতে লাগলো।
সোহা ইতিকে নিয়ে গাড়িতে বসেই দম ফেললো। ইতি জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে বললো
” দৌঁড় দিবি আগে বললেই তো পারতি ! আর তোর এতো দৌঁড় ঝাপ করা কিন্তু ঠিক না ! পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিস নাকি?”
সোহা ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে মাথা আছড়াতে আছড়াতে বললো
” আরে একদিন একটু দৌঁড় ঝাপ করলে কিছু হবে না। আচ্ছা ইমন ভাইয়া আসছে তো আজকে ?” ইতি পরিষ্কার গলায় বললো
” হ্যা।” সোহা ইতির মুখ চেপে ধরে এদিকে ওদিক করে কি দেখতে থাকে। ইতি মুখ ছাড়িয়ে তেতে বলে উঠে
” পাগল নাকি ? কিসব করছিস তুই?” সোহা ভ্রু নাচিয়ে বলে
” তোর মুখে আজ লজ্জা লজ্জা নেই কেনো ? ইমন ভাইয়ার নাম শুনলে তো তুই লজ্জায় লাল হয়ে যাস।” ইতি গম্ভীর গলায় বললো
” জানি না।” সোহা চুপচাপ মাথা ঠিক করে নিলো আগে। চিরুনি রেখে ইতির গা ঘেঁষে বসলো। আদুরে গলায় বললো
” কি হয়েছে আমার ময়না পাখি ? বলবি না আমাকে ?” ইতি বিরক্ত স্বরে বললো
” কি বলবো ? বলার মতো কি রেখেছে ? বারবার বলছি বিয়ের প্রস্তাব দিতে বাবাকে। কিন্তু মহারাজার তো কোনো চিন্তাই নেই। সে আছে তার পুলিশের চাকরি নিয়ে। আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছে না। কাল ঝগড়া করে সব কিছু থেকে ব্লক মেরে দিয়েছি।” সোহা গলা ঝেড়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। যেনো কিছুই হয়নি বা কিছুই জানে না সে। ইতি অবাক হয়ে বললো
” কিছু বলছিস না কেনো তুই ?” সোহা ফোনের ক্যামেরায় নিজেকে দেখতে দেখতে বললো
” কি বলবো ? এটা তো নতুন কিছু নয়। এই পর্যন্ত বিয়ের কথা নিয়ে অনেক বার ঝগড়া করেছিস। ব্লকও অনেকবার দিয়েছিস। আর ১দিনের মাঝেই খুলে ফেলেছিস। তারমধ্যে আজকে আবার দেখা হবে তোদের। ভাইয়া অবশ্যই তোর রাগ ভাঙাবে। তো কিছু বলে কি করবো ?” ইতি মুখ কালো করে বসে থাকে।
শপিং মলে পৌঁছতেই গাড়িতে বসেই শানদের দেখতে পেলো। সবাই গাড়ি থেকে নেমে হাটাহাটি করছে। সবাই বলতে সিমি, সামির, ইশান, নিলা, শান, তামিম। ইতি উঁকিঝুঁকি দিয়েও ইমনকে দেখতে পেলো না। তার মন খারাপ হয়ে গেলো আবারও। আর সোহা তামিমমে দেখে অবাক হয়েছে। কয়েকদিন ধরে ছেলেটার সাথে কথা হয়নি। অবশ্য নিলা বলেছে তামিম তাদের বিয়ের কথা শুনে বেচারা দুঃখ পেয়েছে।
ড্রাইভার সোহাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” সোহা মামুনি নামবে না ? গাড়ি পার্ক করবো।”
সোহা জিভ কামড় দিয়ে চটজলদি নেমে গেলো। গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার কাকা গাড়ি পার্ক করতে নিয়ে যায়। ইতি সোহার হাত ধরে শানদের কাছে এগিয়ে আসলো। শানকে দেখে সোহা বড়সড় ক্রাশ খেলো বলা যায়। শান আজ কালো শার্ট আর কালো জিন্স পড়েছে। চোখে সানগ্লাস আর ঠোঁটের কোণে মিহি হাসির রেখা। সোহার মনে হলো শানের সেই অমূল্য মুচকি হাসিটা দিলে বোধয় তার মুগ্ধ হওয়াটা সার্থক হতো। হঠাৎ ইশান শানকে বলতেই শান তার চোখ জোড়া ফোন থেকে সরিয়ে সোহার দিকে তাকালো। সোহাকে দেখেই তার মুখে আপনা আপনি মুচকি হাসি ফুটে উঠে। সোহা ঢোক গিলে চোখ বড়বড় করে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। তার ইচ্ছে পূরণ হয়ে গিয়েছে। শানকে তার কাছে হঠাৎ মারাত্মক মনে হলো। সোহা বিরবির করে বলে
” কি হয়েছে আমার ? আগে তো এমন করিনি কখনো তাহলে আজ কেনো ? আজ কি উনাকে অন্য চোখে দেখছি তাই এমন হচ্ছে ?”
শান মুগ্ধ চাহনি দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সোহার দিকে। সাদায় সজ্জিত সোহাকে আজ বড্ড স্নিগ্ধ লাগছে। সত্যিই সাদা রংটা শুভ্রতার ছোঁয়া সেটা সোহাকে দেখেই বুঝতে পারছে। সোহার মাঝে শুভ্রতার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। সোহার অস্থির সেই চাহনি, চিন্তিত চেহারা সৌন্দর্যটা যেনো দ্বিগুন ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শানের ভাবনার মাঝে সামির হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলে
” পরেও দেখতে পারবি। নিজেকে কন্ট্রোল কর ভাই আমার।” শান গলা ঝেড়ে নিলো। সোহা কাছে এসেই তামিমকে জিজ্ঞেস করলো
” কেমন আছো তামিম ?” তামিম মুখ কালো করে গম্ভীর স্বরে বললো
” ভালো আছি।” শান হেসে পেছন থেকে তামিমের দুই কাধে হাত রেখে বলে
” ভাই আমার দুঃখ পেয়েছে তোমার বিয়ের কথা শুনে।” সোহা মিটমিট করে হাসলো। নিলাকে জিজ্ঞেস করলো
” নাইসা কোথায় গো আপু ?” নিলা হেসে বলে
” নাইসা ঘুমাচ্ছে তাই আম্মু আনতে দেয়নি তাকে। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবার চলো তোমরা।” ইতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সবাই ভেতরে যেতে থাকে। সোহা তামিমের সাথে হাটতে হাটতে বলে
” এতো দুঃখ পেয়েছো কেনো তুমি বলোতো ? আমি তো ভেবেছিলাম তামিম অনেক খুশি হবে। প্রতিদিনই তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে যাবে সে।” তামিম হাহাকার গলায় বললো
” সেটাই ভাবলে আর এটা ভাবলে না ? আমার তোমাকে ভাবি ডাকতে হবে ? ক্রাশ ছিলে তুমি, আমার। তারপর বয়সে বড় তাই বুকে পাথর রেখে নিজেকে সামলে নিয়ে আপু ডেকেছি আর এখন ভাবি ডাকতে হবে ?” সোহা ফিকফিক করে হেসে দিলো। তামিম আরো বেজার হয়ে গেলো। সোহা হেসে বলে
” আরে বোকা ছেলে ভাবি ডাকতে হবে না। তুমি আমাকে আপুই ডাকবে। তোমার মন ভালো করার জন্য আরেক সুযোগ দিচ্ছি আমি। নাইসুর মতো তুমিও আমাকে মিষ্টিপাখি বলে ডাকতে পারো। এবার বলো খুশি তো ?” তামিমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। উত্তর না দিয়ে মুখে ইয়া বড় হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে এগিয়ে গেলো। সোহা হেসে দিলো। হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলো
” অসাধারণ, অমায়িক, অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে আজ।” বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। শিরশির করে সোহার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। সোহা কাঁপাকাঁপা চোখে পাশে তাকিয়ে শানকে দেখতে পেলো। শান সামনে তাকিয়ে হেটে যাচ্ছে। সোহা নিশ্বাসবন্ধ করে ঢোক গিললো।
চলবে……….
#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ২৭
শান সামনে তাকিয়ে হেটে যাচ্ছে। সোহা নিশ্বাসবন্ধ করে ঢোক গিললো। আজকের অনুভূতি গুলো এমন অগোছালো কেনো ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে উঠতে পারলো না সোহা। সোহা পায়ের গতি বাড়িয়ে নিলার সাথে পা চালিয়ে হাটতে থাকে। শান বাকা হাসলো সোহার কাজ দেখে।
বিয়ের লেহেঙ্গা আর শেরওয়ানি বের করে একে একে দেখাচ্ছে সবাইকে। এখন থেকে নয় প্রায় দেড় ঘন্টা হয়ে গিয়েছে। সোহা লেহেঙ্গা পছন্দ হলে দুপাট্টা পছন্দ হচ্ছে না এভাবেই প্রায় অনেক গুলো দেখা হয়ে গেলো পছন্দ মতো খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। সোহা মুখ ফুলিয়ে বলে
” বিয়েই করবো না আমি। একটাও লেহেঙ্গা সুন্দর না।” সবাই হেসে উঠে সোহার কথায়। শানের মাথা গরম হয়ে গেলো। এতোবড় শপিং অথচ একটা পছন্দ মতো বিয়ের লেহেঙ্গা পাওয়া যাচ্ছে না !
ভেবেই শান ক্ষিপ্ত স্বরে দোকানকে বলে উঠলো
” এরকম শপ খুলেছেন কেনো ? যেখানে পছন্দ মতো কোনো বিয়ের লেহেঙ্গাই খুঁজে পাওয়া গেলো না এখন পর্যন্ত !” দোকানদারের মুখটা দেখার মতো একদম ছোট্টটি হয়ে গেলো। শানের বাড়ির সবাই রেগুলার কাস্টমার দেখে মুখ ফুটে কোনো খারাপ কথা বলতে পারলো। শানকে তার হাড়ে হাড়ে চেনা। শান কাওকে পরোয়া না করেই রেগে সোহার হাত ধরে হুরহুর করে টেনে বেড়িয়ে গেলো দোকান থেকে। সবাই চোখ বড়বড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে শানের রেগে যাওয়ার কারণ কারো মাথায় ঢুকলো না। সামির শিস বাজাতে বাজাতে শানের পিছনে চলে গিয়েছে। সিমি সামিরের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। বেপরোয়া লোকটা পরিবারের কাউকে তো থাক নিজের বউকেও সাধলো না যাওয়ার জন্য। ইশান নিশ্বাস ফেলে বলে
” চলো! আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবো ?” সবাই ইশানের কথায় বেড়িয়ে গেলো দোকান থেকে। শানকে খুঁজে বের করে তার কাছে গেলো। সবাই গিয়ে শানের কান্ড দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আর সামির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হেসে চলেছে। সামির ইশারায় তামিমকে নিজের কাছে ডাকলো। তামিম বাধ্য ছেলের মতো সামিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
শান এবার সোহাকে বসিয়ে রেখে দোকানদারকে দিয়ে সেই উপর থেকে সব কিছু নামিয়ে নামিয়ে দেখাতে বলছে সোহাকে। অনেকগুলো লেহেঙ্গার মাঝে প্রথমে কালো ধরলো পরে মুখ লটকিয়ে রেখে দিলো শান। সাদা একটা লেহেঙ্গা সোহাকে দেখিয়ে বললো
” দেখো তো এটা পছন্দ হয়েছে কি না !” সোহা বলবে কি শানের কাজে লজ্জা পেয়েছে বেচারী তাই মুখে তালা মেরে বসে আছে। নিলা, সিমি, ইতি মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে আর ইশান বসে বসে ভাইয়ের কাণ্ড দেখছে।
সোহার উত্তর না পেয়ে শান নিজেই বললো
” বিয়েতে তো আর সাদা পড়লে চলবে না ! বিয়ের দিন তো লাল পড়তে হয়। লাল রঙ্গের লেহেঙ্গা দেখান। কি সব দেখাচ্ছেন ?” শান কিছুটা ধমকিয়েই বললো দোকানদারকে। দোকানদারও বোকার মতো তাকিয়ে লাল, গোলাপি সব দেখাতে লাগলো। নিজেই সব দেখছে অথচ তাদের বকছে, এই ভেবে দোকানদার বড্ড নারাজ হলো মনে মনে। সোহা এবার লজ্জা সরিয়ে মিটমিট করে হাসছে শানের কাজ দেখে। শান সব ধরনের লেহেঙ্গা দেখাচ্ছে সোহাকে। সোহাও তার মতামত জানাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সব কাপড়ের নিচ থেকে গাড় গোলাপি রঙ্গের অসাধারণ একটা লেহেঙ্গা বেরিয়ে আসলো। সোহা আর শানের চোখ চকচক করে উঠে। দুজন একসাথে হাতে উঠিয়ে নেয়। সোহার চোখে মুখে উজ্জ্বলতার ছোঁয়া দেখা গেলো। সোহা পুরো লেহেঙ্গাটা দেখে ছটফটানি মন নিয়ে ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি তুলে বললো
” এটাই নেবো আমি।” শান মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ইতিরা সবাই এগিয়ে আসে তা দেখার জন্য। সবার খুব পছন্দ হয়েছে। কাপল ওয়েডিং সেট তাই শেরওয়ানিও ছিলো। শেরওয়ানি আর লেহেঙ্গা দুটোই সোহার মনে ধরলো। বিয়ের সেট কেনা শেষ। শান সাদা লেহেঙ্গাটা হাতে তুলে মাথা চুলকালো। সোহাকে আজ শুভ্রতার সাদার ছোঁয়ায় দেখে তার ইচ্ছে হলো সাদা লেহেঙ্গাটা কিনে নেওয়ার। সবার কাছ থেকে সরে শানের কাছে এগিয়ে এসে হেসে বললো
” এটা রিসিপশনের জন্য নিন। এটাও খুব সুন্দর।”
শান মিহি হেসে দোকানদারের কাছে গেলো।
কিছুক্ষণ পর ইমনের আগমন ঘটলো। সবাই কিছুটা রাগারাগি করলো। বন্ধুর জন্য প্রাণ দিয়ে দেয় আর সে কিনা শপিং এর শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছলো ! শান কিছু বললো না কারণ শানই বলেছিলো আস্তে ধীরে আসতে।সোহা ইতিকে দেখলো ইতি চোখ ফিরিয়েও তাকাচ্ছে না ইমনের দিকে। সোহা ইমনকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চিন্তিত হয়ে বললো
” ভাইয়াকে কেমন যেনো দেখাচ্ছে ! ইতু ! ভাইয়া অসুস্থ মনে হচ্ছে। কি হয়েছে রে ?”
সোহার কথা শুনতেই ইতির ভেতরটা ছেত করে উঠলো। অস্থির চাহনি দিয়ে ইমনের দিকে তাকালো। ইমনকে দেখে বুঝে নিলো ইমন সত্যিই অসুস্থ। চোখ মুখ ফোলা ফোলা আর লাল হয়ে রয়েছে। ইতি ছটফটা মন নিয়ে ইমনের কাছে দাঁড়াল। চিন্তিত হয়ে বললো
” কি হয়েছে আপনার ? এমন লাগছে কেনো আপনাকে ?” ইমন মুচকি হাসি দিয়ে বললো
” ওই কিছু না একটু জ্বর এসেছে শুধু।” ইতির কান্না পেয়ে গেলো। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” আমাকে জানালেন না !” ইমন মলিন হাসি দিয়ে বললো
” নিজের কথা বলেই তোমার শেষ হয় না আমার কথা কখন বলবো ? মনে হচ্ছে এখনও তো ব্লক লিস্টেই পরে আছি।” ইতি মনে মনে ধিক্কার জানালো। ইরি জড়ানো গলায় বললো
” আর কখনো এমন করবো না। আর বিয়ের কথা বলে ঝগড়া করবো না আপনার সাথে, প্রমিস !” ইমন হেসে বললো
” ঠিকাছে বাবা আমি এখন সুস্থ তাই তো এসেছি। এখন কান্নাকাটি বন্ধ করো। চলো শপিং করি।”
ইতি নাক টেনে ইমনের হাত জড়িয়ে ধরে। ইমন মুচকি হাসি দিলো।
সবাই শপিং শেষ করলো একে একে। সবার বলতে সবাই বিয়ের জন্য তাদের সব শপিং আগেই করে নিয়েছে এখন শুধু টুকাটুকি কিছু জিনিস ছিলো। তামিম নিজের জন্য শপিং করলেও সোহা আবারও তাকে শপিং করে দিলো আর নাইসার জন্য বিয়ের সাথে মেচিং একটা প্রিন্সেস ড্রেস নিয়েছে।
শপিং এর কাজ শেষ হতেই সবাই এবার রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। এসেছে তো কম সময় হয়নি ! দুপুরে বেড়িয়েছিলো এখন রাত হয়ে গিয়েছে। সবাই গল্প করতে করতে শপিং এ সিরি দিয়ে নিচে নামছিলো। সোহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার খিধে পেয়েছে তাই কথা বলছে না। নিচে নেমে এদিক ওদিক তাকাতুকি করতে করতে হাটছিলো। হঠাৎ তার পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে চোখ পড়লো তার।সোহা চমকে বা পাশে থাকা শানের শার্ট খামছে ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটাও সোহার দিকে তাকিয়ে ছিলো সোহাকে এভাবে তাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে যায়। শান সোহাকে জিজ্ঞেস করলো
” কি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো কেনো ?” সোহা আতংকিত চোখে শানকে ইশারা করে লোকটাকে দেখালো। শান ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা ইতিমধ্যে শান আর সোহাকে চিনতে পেরে গিয়েছে তাই ভয় পেয়ে সোহাকে সজোড়ে ধাক্কা দিয়ে দৌঁড় লাগালো। সোহা শানের বুকের উপর পরে নিচে পরে গিয়েছে। সকলের সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লেগে গেলো। সোহা পেটে ব্যাথা পেয়ে চিৎকার করে উঠে। শান কোনো রকমে নিজেকে সামনে উঠে সোহাকে নিয়ে অস্থির হয়ে গেলো। সবাই ছুটে আসে সোহার কাছে। শানের উপর পরলেও সোহা বেশি ব্যাথা না পেলেও ভালোই ব্যাথা পেয়েছে । শান সোহাকে নিয়ে অস্থির হয়ে গেলো। সোহাকে আগলে অস্থির কন্ঠে বলে উঠে
” বেশি ব্যাথা করছে সোহা ? এতো কেয়ারলেস কেনো লোকটা ? এভাবে কাউকে ধাক্কা দেয়?” শানের রাগে রি রি কন্ঠস্বর। সোহা ব্যাথা নিবারণের যথেষ্ট চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে কাতর স্বরে বলে উঠে
” ওই লোকটাই আমাকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করেছিলো। আপনাকে দেখানোর আগেই ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছে।” শানসহ প্রত্যেকে প্রচণ্ড পরিমাণে চমকে গিয়েছে। শান কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে হঠাৎ সোহাকে ছেড়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। নিলা আর সিমি ছুটে এগিয়ে এসে সোহাকে ধরে নেয়। ইমনও শানের পেছনে গেলো। সবাই ব্যস্ত হয়ে সোহাকে নিয়ে। ব্যাথায় সোহায় চোখে পানি চলে এসেছে। সোহাকে ধরে নিচ থেকে উঠিয়ে বসালো। সামির ছুটে গিয়ে গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে আসলো। সোহার পানি খাইয়ে দিয়ে চোখে মুখে দিয়ে দিলো কিন্তু তাও সোহার শান্তি পাচ্ছে না। ব্যাথায় কাতরে যাচ্ছে আর কাঁদছে। ইশান দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেডিসিন নিয়ে এলো। নিলার কাছে দিয়ে বলে
” এটা খাওয়াও। ব্যাথা কমে যাবে কিছুক্ষণ পর।” নিলা সোহাকে খাইয়ে দেয়। সোহাকে কোনো রকমে বাইরে এনে গাড়ির সিটে বসিয়ে গাড়ি খুলে রেখে দেয়। সোহা ছিটে বসেই ব্যাথায় ছটফট করতে থাকে।
ইশান শানকে ফোন করতে যাচ্ছিলো তখন শান আর ইমনকে ছুটে শপিং মলের দিকে যেতে দেখে এগিয়ে গিয়ে ডাকলো। শান দৌঁড়ে এখানে এসে পরে। ইমন হাপানো স্বরে বললো
” পালিয়ে গিয়েছে ধরা অসম্ভব। তবে আমি কালই ফোর্স লাগাবো।” শান অস্থির গলায় শুধল
” সোহা কোথায় ! কেমন আছে এখন ?”
সিমি আর একসঙ্গে দেখালো সোহাকে। শান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। তামিম সোহার কাছে দাঁড়িয়ে বাতাস করছিলো শানকে দেখে সরে দাঁড়ায়। শান সোহাকে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” এখন কেমন লাগছে ?” এখনও চিনচিন ব্যাথা করলেও প্রকাশ করলো না। ধীর গলায় বললো
” ভালো। খিধে পেয়েছে আমার।”
চিন্তার মাঝেও শান ফিচলে হাসি দিলো সোহার কথায়। শান ইশানকে বললো
” ভাইয়া সোহার নাকি খিধে পেয়েছে।” ইশান বললো
” তাহলে আমরা বাড়ি চলে যাচ্ছি তুই সোহাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে ড্রপ করে দিয়ে আসিস।”
” কেনো ভাইয়া ! তোমরাও চলো একা একা যাবো না আমি।” শানের জোরাজোরিতে সবাইকে যেতে হলো।
চলবে……….