আধারে_তুমি,০২,০৩

0
411

#আধারে_তুমি,০২,০৩
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০২

শান শান্ত ভাবে বলে
” দেখুন বউকে নিয়ে যেতে চাইছেন ভালো কথা। তবে বউ যখন নিচ্ছেনই তখন একটু ভালো করে নিয়ে যান ! আপনার বউকে নাহয় পূর্ণ রূপে সাজিয়ে নিয়ে আসি আমরা ! তারপর নিয়ে যান আপনি ” শানের কথা শুনে পাগলের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে। শান সোহার হাত ধরতে নিলেই পাগলটা সোহাকে সরিয়ে নেয়। আর সোহা একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। শান পাগলের উপর বিরক্ত হলেও মুখে হাসি নিয়ে বলে
” কি হলো ? আপনার বউকে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবেন না ?” পাগল তার উল্টো পাল্টা বিলাপ করতে থাকে। শান পাগলের কথা শুনে বুঝতে পারে পাগলও যেতে চাইছে। শান পাগলকে
উদ্দেশ্য করে বলে
” আপনি গেলে কি করে হবে ? সোহাকে বউ আর আপনাকেও জামাই সাজাতে হবে তো নাকি ! ইমন আপনাকে সাহায্য করবে। আমি সোহাকে নিয়ে যাচ্ছি।” ইমন তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে চোখ বড়বড় করে বলে
” এই তুই এখন আমাকে ফাসাতে চাইছিস নাকি ! পরে এই পাগলটা সোহাকে না পেয়ে আমাকেই যদি বউ মনে করে নিয়ে যায়! তোকে কিন্তু ছাড়বো না আমি !” শান দাঁতে দাঁত চেপে ইমনের কাছে এসে বলে
” শালা কিছু না বুঝেই বকবক করিস। আমি সোহাকে নিয়ে গেলে তোরা পাগলকে বেধে তার আস্তানায় রেখে আসবি। তোকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেইনি পাগলকে। আর হ্যা সেখানেও বেধে রাখিস না। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলে তার বাধন খুলে দিবি। এবার কথা ঢুকেছে মাথায় ?” ইমন দাঁত কেলিয়ে সায় দেয়। শান জোড় করে সোহাকে পাগলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে
” এই যে আপনার বউকে একটু পরই নিয়ে আসছি আমি।” পাগলকে কিছু বলতে না দিয়েই শান সোহাকে নিয়ে দৌঁড়ে থানার ভেতরে ঢুকে যায়। ইমনরা সবাই এবার পাগলকে বেধে রাখার জন্য উঠে পরে লাগে।
কেবিনে এসে শান হাফ ছেড়ে চেয়ারে বসে পরে। আর সোহা বাবাকে দেখে আহ্লাদী হয়ে আরো জোড়ে জোড়ে কাঁদতে থাকে। ইমতিয়াজ রহমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সোহার কান্না দেখে। ইমতিয়াজ রহমান উঠে সোহার কাছে গিয়ে বলে
” কি হয়েছে সোহা ? কাঁদছিস কেনো ?” সোহা কিছু না বলে কাঁদতেই থাকে। শান পানি খেয়ে বলে
” আংকেল আপনার মেয়ে এখনই পাগলের বউ হয়ে যাচ্ছিলো। আমি বাঁচিয়ে নিয়ে এলাম।”
ইমতিয়াজ রহমান কিছু বুঝতে না পেরে বলে
” পাগলের বউ মানে?”
সোহা কান্না থামিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” আমি বউ হতে যাচ্ছিলাম ? আপনিই তো ওই পাগলকে আরো উস্কানি দিয়েছেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।” কথা শেষ করে সোহা আবারও কেঁদে উঠলো। শান এক ভ্রু উঁচু করে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
” আগে বলো পাগলের কাছে গিয়ে ঘুরছিলে কেনো তুমি ? রাতে তো এউ পাগলকে তার আস্তানা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আগে যতোবার এমন করেছে সবসময় দিনের বেলায় করেছে। এই পাগল দিনেই শুধুমাত্র থানার সামনে থাকে। তুমি এখন যেচে সেখানে না গেলে পাগল অবশ্যই নিজে নিজে আসবে না।”
সোহা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কান্নাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। ইমতিয়াজ রহমান বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। সোহা চোখ মুখ মুছে মুখ ফুলিয়ে রাখে ।
শান ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে বলে
” চলুন আংকেল আপনাদের ড্রপ করে দিচ্ছি। আপনারা তো মনে হচ্ছে গাড়ি আনেননি।”
ইমতিয়াজ রহমান বাধা দিয়ে বলে
” না না তোমাকে আমাদের জন্য ডিউটি ছেড়ে যেতে হবে না। তুমি কাজ করো আমরা চলে যাবো।” শান হেসে বলে
” আমার ডিউটির টাইম কিছুক্ষণ আগেই শেষ আমি আপনার জন্যই বসে ছিলাম। যদি কোনো প্রবলেম হয় ! তাই যাইনি এখনও। আপনারা বাইরে গিয়ে দাঁড়ান আমি আমার গাড়ি নিয়ে আসছি।”
ইমতিয়াজ রহমান আলতো হেসে সোহাকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। শানও তার অর্ধপূর্ণ কাজ রেখেই সব গুছিয়ে বেরিয়ে গেলো।
সোহা ইমতিয়াজ রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু পাগলের ভয়ে বারবার চারপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে আশেপাশে পাগল আছে কিনা। এর মাঝেই শান তার গাড়ি নিয়ে চলে আসে। ইমতিয়াজ রহমান শানের পাশে বসে পড়লেও সোহার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে পাগলকে খুঁজে যাচ্ছে। শান সোহার কাজ দেখে মনে মনে হাসতে থাকে। সোহার ধ্যান ভাঙার জন্য গাড়ির হর্ণ বাজালো শান। সোহা ভয়ে চমকে উঠে। শান এবার মুখ টিপে হাসলো। ইমতিয়াজ রহমান নিশ্বাস ফেলে বলে
” সোহা ! সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি ? খেয়াল আছে রাত কয়টা বাজে ? ওদিকে তোর মা কি থেকে কি করে বসে আছে সেটাও জানি না। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ।”সোহা তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই সোহা চলে গেলো। শানের কথার অর্থমতে বাদরের মতো গান গাইতে গাইতে আর নাচতে নাচতে চলে গিয়েছে। শান প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সোহা বাঁদরামি দেখে। ইমতিয়াজ রহমান শানকে কয়েকবার জোড় করলো বাড়িতে আসার জন্য কিন্তু শান উত্তরে বলে
” আংকেল ছুটির দিন সাথে ভাইয়া আর ভাবিকেও নিয়ে আসবো তবে আজ না। আজকে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।” ইমতিয়াজ রহমান আর জোড় করতে পারেননি। শান গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই ইমতিয়াজ রহমান বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকতেই তার গুনোধর স্ত্রী আর কাজের মেয়ে শষীর মুখোমুখি হলো। রিয়ানা রহমান চিন্তিত হয়ে বলে
” কি গো ! তোমার মেয়ে দেখি নাচতে নাচতে উপরে চলে গেলো। আমার কথার কোনো পাত্তাই দিলো না এই মেয়ে ! আমি যে এতোক্ষণ ধরে চিন্তায় চিন্তায় মরছিলাম সেদিকে কারোর খেয়াল নেই।” ইমতিয়াজ রহমান শান্তভাবে আগে সোফায় গিয়ে বসলো। শষীকে পানি দিতে বলে, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে
” পাত্তা দেবে কি করে ! তোমার আর তোমার প্রাণপ্রিয় সঙ্গীর কাজকর্ম যে আমাদের বিরক্ত করে তোলে সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ সবই জানো তুমি। তারপরও বারবার কেনো উল্টো পাল্টা কাজ করো ?”
রিয়ানা রহমান শষীর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে ইমতিয়াজ রহমানের মুখের সামনে ধরে যার ফলে কিছুটা পানি ইমতিয়াজ রহমানের পরনের পাঞ্জাবীতে ছিটে পড়লো। ইমতিয়াজ রহমান কিছু না বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। রিয়ানা রহমান উত্তেজিত হয়ে বলে
” কি বলতে চাইছো তুমি ? আমরা দুজন বিরক্ত করি তোমাদের ? এতোবড় কথা ! বাড়িতে পুলিশ এসে স্বামীকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো আর আমি চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখবো ? আমার মন বলে তো কিছু আছে নাকি ? একটু কাঁদতে পারবো না ?”
ইমতিয়াজ রহমান দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। এই মহিলাকে কিছু বোঝানো অসাধ্য ব্যাপার বলা যায়। ইমতিয়াজ রহমান কঠিন রূপ ধারণ করে। গম্ভীর গলায় বললো
” পুলিশ আমাকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে যায়নি বুঝেছো ? শান তার থানার এক কনস্টবলকে পাঠিয়েছিলো আমারই জরুরী কাজে। আমি দুদিন আগে যেই FIR করে এসেছিলাম সেটার ব্যাপারে। আমি শষীকে বলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলে দিতে। কিন্তু তোমার শীর্ষ তো তোমার মতোই কাজ করবে তাই না ! পুরো কথা না বুঝেই কি না কি বলেছে সেটা তুমিই জানো !” ইমতিয়াজ রহমান তার রুমে চলে যেতেই রিয়ানা রহমান শষীর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। শষী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিয়ানা রহমান এমন ভাবে তাকিয়েছে যে শষী আগে, পিছে কোথাও যেতে পারবে না। রিয়ানা রহমান চেঁচিয়ে বলে উঠে
” দাঁড়িয়ে আছিস কেনো মূর্তির মতো ? তোর জন্য আজও কথা শুনতে হলো আমার। বজ্জাত মেয়ে ! কতোবার বলবো তোকে ? আগে পুরো কথা বুঝবি তারপর বলবি। আজ পুরোটা সময় নষ্ট হয়ে গেলো।” শষী মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে। বারবার একই ভুল হয়ে যায় তার দ্বারা। রিয়ানা রহমান ঘড়ি দেখে বলে
” এই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ? চল জলদি রান্নাঘরে চল। রাত ১০টা বেজে গিয়েছে এতো ঝামেলায় আর বেশিক্ষণ দেড়ি হলে সবাই না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।” রিয়ানা রহমান শষীকে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটলো।

এদিকে শান খাবার টেবিলে বসে সোহার করা সব কাণ্ডর কথা বললো। একেকজন খাবার রেখে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শান তার খাবার খেয়ে যাচ্ছে শান্তিতে। শাহানাজ বেগম হাসতে হাসতে মুসফিক চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে
” আচ্ছা সোহাকে কয়েক দিনের জন্য আমাদের বাড়িতে আনা যায় না ! তুমি একটু বেয়াইন সাহেবের সাথে কথা বলে দেখো তো ! মেয়েটা বাড়িটাকে মাথায় তুলে রাখবে সাথে আমাদের নাইসা তো আছেই।”
মুসফিক চৌধুরী মাথা নেড়ে খেতে খেতে বলে
” ঠিকাছে কথা বলে দেখবো। তো ইশান ! আজকে নিউজে দেখলাম গতকাল রাতে নাকি কোথাও বড়সড় এক্সিডেন্ট হয়েছে ! কি খবর সেখানে ?”
ইশান সহ সবাই একসঙ্গে শানের দিকে তাকালো। শানও মুখে খাবার নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তারপর সরাসরি বাবার দিকে তাকালো। শানের একপাশে সামির আর অন্যপাশে সিমি বসে ছিলো। শানকে চুপচাপ দেখে সিমি কনুই দিয়ে গুঁতো দিতেই শান চমকে উঠে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সবাই ইশারায় বলছে কথা বলার জন্য। নিলা নাইসাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো ইশানের পাশে এসে ফিসফিস করে বলে
” indirectly ভাবে হলেও আজ প্রথম দিন বাবা তোমার কাজ নিয়ে কথা বলছে। সময় নষ্ট করো না কথা বলো !” শান ঢোক গিলে বলে
” জি, তেমন বড়সড় নয়। তবে বাসের ড্রাইভার ড্রিংক্স করে ছিলো তাই রাতে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ মানুষ আহত হয়েছে তাদের পাশের হাসপাতালে হসপিটালাইজড করা হয়েছে আর পাঁচজন নিহত হয়েছিলো। ড্রাইভার আপাতত আমাদের থানার জেলে রয়েছে।”
মুসফিক চৌধুরী আর কিছু না বলে খাবার শেষ করে উঠে গেলো। শান হতাশার নিশ্বাস ফেলে।
শাহানাজ বেগম শানকে বললো
” এভাবে চোখ মুখ শুকিয়ে রাখলে হবে নাকি ? তুই তোর কাজ করে যা। তোর বাবা একদিন না একদিন তো বুঝতে পারবে তুইও তার বাকি দুই ছেলের মতোই এক টুকরো হিরে।” শান স্মিত হাসি দিলো। সামির শানের পিঠে জোরেশোরে থাপ্পড় বসিয়ে বলে
” ভালো করে কাজ কর।” শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” আগে বল তুই শান্তনা দিচ্ছিস আমাকে নাকি মারছিস?” ইশান হেসে বলে
” তুই যা ভাবছিস সেটাই দিয়েছে তোকে ।” শান রেগে তাকালো সামিরের দিকে কিন্তু মহাশয় পাত্তা না দিয়ে খেতে থাকে।

শাহানাজ বেগম আর মুসফিক চৌধুরীর বড় ছেলে ইশান চৌধুরী এবং নিলা তার স্ত্রী। তাদের তিন বছরের মেয়ে সন্তান নাইসা চৌধুরী সুমি। সামির চৌধুরী মেজো ছেলে আর সিমি তার স্ত্রী। মাত্র আট মাসের একটা নতুন দম্পতি তারা।
শান ছোট ছেলে। ইশান একজন ডক্টর তার নিজস্ব হসপিটাল রয়েছে। সামির বাবার সাথে বিজনেস চালাচ্ছে। মুসফিক চৌধুরীর ইচ্ছে ছিলো তার দুই ছোট ছেলেই তার বিজনেস সামলাবে বা আর্মিতে যোগ দেবে কিন্তু শান নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অজান্তেই নিজের বাবার অপছন্দের তালিকায় যোগ হয়েছে। মুসফিক চৌধুরী সব সময় পুলিশ পেশাটাকে অপছন্দ করে কিন্তু তার ছেলেদের কাছে সেটা অজানা ছিলো। শান পুলিশের চাকড়ি পাওয়ার পর থেকে মুসফিক চৌধুরী তার সঙ্গে কখনো তার কাজ নিয়ে কথা বলেনি।

.

.

চলবে…….

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০৩

শান পুলিশের চাকড়ি পাওয়ার পর থেকে মুসফিক চৌধুরী তার সঙ্গে কখনো তার কাজ নিয়ে কথা বলেনি।
সকালের ডিউটি শেষ হতেই শান লাঞ্চ করে গাড়ি নিয়ে সোহার বাড়িতে চলে যায়। ইমতিয়াজ রহমান আর রিয়ানা রহমান শানকে আপ্যায়ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে।
সেইদিনের পর আজ এক মাস হয়েগিয়েছে। মুসফিক চৌধুরী, সোহাকে তাদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সোহার সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতে পারেনি। তাই ইমতিয়াজ রহমানের সাথে কথা পরীক্ষা শেষ হতেই আজই শানকে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহাকে সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুসফিক চৌধুরী শানের কাজ নিয়ে এখনও পর্যন্ত নারাজ থাকায় শান সব সময় চেষ্টা করে তার বাবা যেনো অন্য কাজ নিয়ে তার উপর রাগ না করে তাই বিনা শব্দে শান গাড়ি নিয়ে এসে পরেছে সোগাকে নেওয়ার জন্য।
প্রায় অনেক সময় ধরেই শান, ইমতিয়াজ রহমানের সাথে গল্প করতে করতে সোহার জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে কিন্তু সোহার এখনও দেখা মেলেনি। শান সোহার জন্য বসে বসে বিরক্ত হয়ে গেলো। রিয়ানা রহমানও এবার সোহার রুমে ছুটলো। সোহার এতো দেড়ি দেখে রিয়ানা রহমান নিজেই রেগে রয়েছেন। সোহার রুমে ঢুকতেই দেখে সোহা ফ্লোরে বসে রয়েছে কোলে টমিকে নিয়ে কিছু একটা করছে। রিয়ানা রহমান সোহার কাজ দেখে রেগে বললো
” সোহা কি শুরু করেছিস তুই ? ছেলেটা প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে এসে বসে আছে তোর জন্য কিন্তু তুই এখনও বসে আছিস ? তোর জন্য কি ছেলেটা সারাদিন এখানেই বসে থাকবে নাকি !”
সোহা তার কাজ করতে করতে মুখ ফুলিয়ে বললো
” আহ আম্মু ! আমি জানি আজকে উনার হাফ ডিউটি তাই তো তাড়াহুড়ো করছি না। আজ সারাদিন আমাদের বাড়িতে বসে থাকলেও কিছু হবে না।” সোহার মা সোহার পড়ার টেবিল থেকে সোহার স্কেল হাতে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো
” তুই উঠবি ? নাকি এখন মার খাবি আমার হাতে ? আর টমিকে নিয়ে গুঁতোগুতি করছিস কেনো তুই ? এই কুকুরকেও নিয়ে যাবি নাকি সাথে ?” টমিকে কুকুর বলার সোহা ক্ষেপে গেলো। বসা থেকে উঠে রেগে বলে
” তুমি আবারও টমিকে কুকুর বলছো ? তোমাকে কতোবার না করবো আর ! কারোর কোনো কথা শোনো না তুমি।”
রিয়ানা বেগম তেড়ে এসে বলে
” তুই এখন আমাকে শেখাবি ? আমি কার কথা শুনবো আর কার কথা শুনবো না ! গেলি এখনই নাকি এবার সত্যিই মারবো ?” সোহা মুখ ফুলিয়ে টমিকে কোলে নিয়ে সাইড ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে লাগেজ নিয়ে নিচে চলে যায়।
শান সোহাকে নামতে দেখেই হাফ ছেড়ে বাচে। ইমতিয়াজ রহমান সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে
” মনে রাখবে ওটা সিমি শশুড় বাড়ি। সেখানে গিয়ে কোনো উল্টোপাল্টা কাজ করবে না যাতে সিমির মান-সম্মানে আঘাত করে, বুঝেছ ?”
সোহা সুন্দর মতো মাথা নাড়ালো। সবার আড়ালেই শান মুচকি হাসলো সোহাকে দেখে। বিদায় নিয়ে শান গাড়িতে উঠে বসতেই সোহার কোলে টমিকে খেয়াল করে চেঁচিয়ে উঠে। সোহা চমকে বলে
” কি হয়েছে আপনার ? মেয়েদের মতো চেঁচাচ্ছেন কেনো আপনি ?” শান রেগে বলে
” তুমি একে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছো নাকি ?” সোহা ঠোঁট উল্টে মাথা নেড়ে সায় দিলো। শান চোখ বড় বড় করে সানগ্লাস খুলে নেয়। অন্য হাতে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। সোহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” সমস্যা কি আপনার ? আমি এতোদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছি ! আমি কি একা যাবো নাকি ? টমি তো যাবেই আমার সাথে ! এটা সবারই জানা কথা। আপনি আবার কোন আকাশ থেকে টপ করে পড়েছেন ?”
সোহার কথা শুনে শান ক্ষেপে সোহার দিকে ঝুকে বলতে থাকে
” এই মেয়ে তুমি জানো না ? আমার এসব পশুপাখির পশমের সংস্পর্শে আসলেই এলার্জি হয় ! তুমি জেনেও একে সাথে নিয়ে যাচ্ছো ! তোমার কোনো কমন সেন্স নেই ? একে তো এতোগুলো দিন তুমি নামক বাদরকে আমার সহ্য করতে হবে তার উপর আবার এই টমি ! কখনোই না। আমি তো টমিকে নেবোই না।” সোহা হা করে তাকিয়ে থেকে নিজের দিকে আঙুল তাক করে অবাক স্বরে বলে
” কিহহ ! আমি বাদর ! আমি বাদর ! ঠিকাছে এবার আমিও দেখছি আপনি টমিকে ছাড়া আমাকে কি করে নিয়ে যান বাড়িতে ! আমিও দেখছি কি করে, কি করেন আপনি !” সোহা গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলেই শান চটজলদি গাড়ি লক করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সোহা দরজায় বারি দিতে দিতে চেঁচিয়ে বলে
” এই দরজার লক খুলুন ! লক খুলুন বলছি !”
শান বাকা হেসে বলে
” এবার গাড়ি থেকে নামুন আপনি। আমাকে হুমকি দিয়েছো না ! এবার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকো। তোমাকে তো নিয়ে যাবোই আর তোমার এই টমিকেও রেখে যাবো আমি। এমনি এমনি পুলিশ হয়নি আমি !” সোহা তাচ্ছিল্য হেসে বলে
” হ্যা আমিও এবার দেখবো কি করেন আপনি ! আর আপনাকে কতোবার বলবো ? আপনার এই তুমি, আপনির কনফিউশন দূড় করুন ! যে কোনো একটা ডাকুন।”
শান উত্তর না দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়ি চালানোতে মনযোগী হয়। সোহা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তার কোলে টমি আড়ামে ঘুমোচ্ছে। শান ড্রাইভ করতে করতেই আড়চোখে সোহাকে দেখে বিড়বিড় করে বলে
” এভাবে ফোন দেখার কি আছে ? ফোনের ভেতর ঢুকে পড়লেই তো পারো।” সোহা ভ্রু কুঁচকে শানের দিকে তাকিয়ে বলে
” কিছু বলেছেন আপনি ?” শান সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” আমি কি বলবো আপনাকে ? ড্রাইভ করছি চোখে দেখছো না !” সোহা আবারও শানের তুমি, আপনির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে বোমের মতো ফুলতে থাকে। সোহা কোনো কথা না বলেই পূর্বের মতো ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো শান তাদের বাড়ির সোজা রাস্তায় না গিয়ে অন্যরাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সোহা কিছু বলতে চেয়েও বললো না। অনেক্ষণ পর হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করতেই সোহার হুশ আসে। সোহা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে লেকের পারে গাড়ি থামিয়েছে। সোহা ভ্রু কুঁচকে বলে
” এখানে গাড়ি থামিয়েছেন কেনো বলুন তো ! এই যে আপনার মাথায় উল্টোপাল্টা কোনো ধান্ধা চলছে না তো !” শান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকায়। সোহা শানের এমন তাকানো থেকে থতমত খেয়ে যায়। শান গম্ভীর গলায় বলে
” ফুচকা খাবো তাই থামিয়েছি এখানে। ফুচকা খাওয়ার জন্য ধান্ধা করতে হয় সেটা জানতামই না আমি।” সোহা চোখ বড় বড় করে চারপাশ ভালো করে লক্ষ করে। ফুচকার দিকে একদমই খেয়াল ছিলো না তার। সোহা খুশি হয়ে শানকে কিছু না বলেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো কিন্তু বেরিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। টমি এখনও ঘুমাচ্ছে তাকে নিয়ে খেতে পারবে না আর শানের ভয়ে রেখেও যেতে পারছে না। শান বুঝতে পেরে বলে
” আমি নিজেও ফুচকাই খেতে যাচ্ছি। তোমার টমির জন্য আমি আমার ফুচকা মিস করতে পারবো না। আর টমিকে কিডন্যাপ ফিডন্যাপ করে আমার কোনো লাভ নেই। ওকে ? যা করার করো তাড়াতাড়ি। গাড়ি লক করে যেতে হবে আমাকে।” সোহা টমিকে সুন্দর করে সিটে রেখে চলে গেলো।
সোহা গিয়েই ফুচকা ওয়ালাকে বলে বেশি করে ঝাল দিয়ে তার জন্য ফুচকা দিতে আর শান কিছুক্ষণ পর আসলো। সোহা শানকে দেখে সন্দেহীবাজের মতো প্রশ্ন করে
” গাড়িটা জাস্ট লক করতেই এতোক্ষণ লাগলো আপনার ?” শান দাঁত কিড়মিড় করে সোহার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে
” তোমার সাহস তো কম না ! আমাকে সন্দেহ করার অধিকার কোথায় পেয়েছো তুমি? আমি কি করবো, কতোক্ষণ সময় নিয়ে করবো এসবের উত্তর কি তোমাকে দিতে হবে আমার ? ইম্পরট্যান্ট কল এসেছিলো তো কথা বলছিলাম। নেক্সট টাইম একদম আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না। মাইন্ড ইট !”
সোহা বড়সড় একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো। ফুচকাওয়ালা সোহার প্লেট দিতেই সোহা খাওয়া শুরু করে আর শান ঝাল ছাড়া খাবার দিতে বলে তার জন্য। সোহা মিটমিট করে হেসে বিড়বিড় করে বলে
” এতোবড় ছেলে হয়ে ঝাল খেতে পারেনা আবার আমাকে পুলিশগিরি দেখায় !” শান আধো কথা শুনতে পেয়ে রেগে বলে
” কি বললে তুমি ? আমি ঝাল খেতে পারি না !”
সোহা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে
” না, না আমি কিছু বলিনি।” শান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সোহা দূড়ে দাঁড়িয়ে খেতে থাকে।
অনেক্ষণ পর শান, সোহার ফুচকা খাওয়া শেষ হতেই দুজন গাড়ির কাছে আসে। গাড়ি আনলক করতেই সোহা গাড়ির ভেতর তাকিয়েই চেঁচিয়ে উঠে। শান বিরক্ত কন্ঠে বলে
” চেঁচাচ্ছ কেনো তুমি শুধু শুধু ?” সোহা ইতিমধ্যে কেঁদে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে
” আমার টমি ! আমার টমি নেই গাড়িতে।” শান রাগ দেখিয়ে বলে
” মজা করার জায়গা পাচ্ছো না ? টমিকে কে নিয়ে যাবে ? তাও আবার আমি গাড়ি লক করে গিয়েছিলাম। ভালো করে খুঁজে দেখো।” সোহা, শান দুজনই টমিকে খুঁজতে থাকে কিন্তু খুঁজে পেলো না তাকে। গাড়ির কিছুদূড়ে দাঁড়ানো ঝালমুড়ি ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো
” একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছি একটা বাচ্চা কুকুর কোলে করে নিয়ে যেতে।”
সোহার কান্না একদমই থামছে না। শানও সোহাকে কোনোভাবে থামাতে পারছে না। সোহা টমিকে ছাড়া কোথায় যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। শান জোড় করে সোহাকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে
” কান্না থামাও তোমার টমিকে খুঁজে দেবো আমি। চুপ করো এখন।”
বাড়িতে আসতেই সোহাকে পেয়ে সবাই খুশিতে মেতে উঠে কিন্তু সোহার কান্না দেখে সবই মাটি হয়ে যায়। শান সব বলতেই সবাই মিলে সোহাকে বোঝাতে থাকে কিন্তু সোহা এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এখন প্রায় রাত ৯টা বাজে। কিন্তু সোহার কান্না এখন পর্যন্ত এক মিনিটের জন্য কমেনি। অনেক চেষ্টা করেও কেউ সোহার কান্না থামাতেই পারেনি। এবার শানেরও মায়া হতে লাগলো সোহার উপর। শান ভেবেছিলো কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে থেমে যাবে কিন্তু এই মেয়ে টমিকে না পেলে সারাজীবনই কেঁদে যাবে। শান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে একবার সোহার রুমে চক্কর দিয়ে দেখলো সবাই এখনও সেখানেই বসে আছে। শান ধপাধপ পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে গ্লাভস আর মুখে রুমাল দিয়ে বাধা অবস্থায় টমিকে কোলে নিয়ে চুপিসারে নিজের রুমে ঢুকে গেলো।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here