#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (০৫)
তামিম ছুটে এসে হামিদুর রহমানের পা চেপে ধরলো। মৃদু স্বরে বললো,”প্লিজ বাবা,কিছু বলবেন না নিতুকে।অফিসে আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে।আমি নিজে নিতুর সাথে সম্পর্ক যতো দ্রুত সম্ভব শেষ করে দিবো।বাবা এভাবে আমাকে অপমানিত কইরেন না।”
হামিদুর রহমান সাহেব নবনীর দিকে তাকালো। নবনীর দুই চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে আছে।হামিদুর রহমানের ভীষণ মায়া হলো নবনীর জন্য। পা ঝাড়া দিয়ে তামিমকে সরিয়ে দিয়ে বললো, “আমি হামিদুর রহমান। তামিমের বাবা।”
নিতু আবারও সালাম দিয়ে বললো, “কেমন আছেন বাবা?তামিম আপনাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছে তাহলে?”
হামিদুর রহমান জবাব দেয়ার আগে তাহেরা এসে ফোন কেড়ে নিলো।কল কেটে দিয়ে হামিদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো,”লজ্জা করে না তোমার ছেলের মান সম্মানের কথা না ভেবে এই মেয়েকে কল দিয়ে সব বলতে যাচ্ছিলে যে?”
হামিদুর রহমান হেসে বললো,”লজ্জা আমার কেনো করবে?
লজ্জা তো তোমার গুণধর ছেলের করা উচিৎ। ঘরে বউ থাকার পরেও অফিসের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়েছে।ওকে এখনো আমি জুতাপেটা করি নি এই তো ওর জন্য ঢের।”
তাহেরা চেঁচিয়ে বললো,”এই ছোট লোকের মেয়েকে আমি কখনোই ঘরের বউ বলে মানি নি,মানি না,মানবো না।আমার ছেলেও মানে না।আমার ছেলের যাকে পছন্দ তাকেই সে বিয়ে করবে।এই মেয়ে সতীনের সাথে সংসার করতে পারলে ভালো নাহলে চলে যাক।”
হামিদুর রহমান রেগে গিয়ে স্ত্রীর গালে কষে থাপ্পড় দিতে গেলেন।কিন্তু নবনী শ্বশুরের হাত চেপে ধরে ফেললো। তাহেরা ফোসফাস করে বললো,”এই ছোট লোকের মেয়ের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে এসেছিলে?
আজ একটা এসপারওসপার হতে হবে এর।নয়তো আমি তাহেরা তোমার ভাত খাবো না।”
নবনীর আর এসব স্ট্রেস সহ্য হলো না। মাথা ঘুরতে লাগলো। ধপ করে নবনী সোফায় বসে পরলো।তাহেরা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ননদদের,বোনদের কল দিলো। তারপর সবার কাছে বানিয়ে বানিয়ে হামিদুর রহমান আর নবনীর নামে বিচার দিলো।এবং শেষ সিদ্ধান্ত নিলো হয় নবনী থাকবে এই বাসায় আর নয়তো তিনি থাকবেন।
তাহেরার কথা শুনে দিশা বললো,”মা না থাকলে আমিও থাকবো না বাবা।”
লুবনা বললো,”মা যেখানে যাবে আমি ও সেখানে যাবো।”
হামিদুর রহমান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,”সিনেমা পাইছো তোমরা আমার লগে?সিনেমা দেখাইতে আসছো না?নবনী এই বাসায় থাকবে এখানেই থাকবে।তোমাদের জন্য সদর দরজা খোলা আছে,বের হয়ে যাও।”
তামিম মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিম নিশ্চুপ। ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ অসুখী সামিম এজন্য বাসা থেকে দূরে থাকে।নিজে ইচ্ছে করে পোস্টিং ঢাকা থেকে ট্রান্সপার করিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে গেছে।আবেগে পড়ে দিশা কে বিয়ে করাটাই সামিমের জন্য সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।অল্প বয়সে ঠিক ভুল বুঝার আগেই মায়ের বুদ্ধিতে বিয়ে করে ফেললো।তার উপর বাসায় প্রতিদিন মা বোনের এসব ড্রামা দেখতে দেখতে সামিম বিরক্ত। মাঝেমাঝে সে অবাক হয় বড় ভাইয়ের নির্বুদ্ধিতা দেখে।সামিম মাঝেমাঝে ভাবে তামিম কি আসলে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো মানুষ!
তাহেরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে বোরকা গায়ে দিলেন।নবনীর মনে হচ্ছে জাহান্নামে আছে সে যেনো।১৫ দিন পরে হামিদুর রহমান চলে গেলে তার অবস্থা এরা সবাই মিলে কি করবে তা ভাবতেই নবনী শিউরে উঠলো। তাহেরা বেগম বের হতে যেতে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,”আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে মা,আপনি কোথাও যাবেন না।আপনার সংসার আপনার সব।আমি তো দুদিনের অতিথি এখানে।যেতে হয় আমি যাবো।আপনি তবুও যাবেন না মা।”
হামিদুর রহমান ধমক দিয়ে বললো,”বাজে কথা বলো না নবনী,তুমি কোথাও যাবে না।”
নবনী শ্বশুরের সামনে গিয়ে দুহাত জড়ো করে বললো,”প্লিজ বাবা,এবার ক্ষান্ত হোন।আপনি একবার ভেবে দেখুন না বাবা,আমি এই বাসায় কার কাছে থাকবো?বিয়ের পর একটা মেয়ের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয় তার স্বামী।তার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ায় তার স্বামী। স্ত্রীকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করে স্বামী।কিন্তু আমার কে আছে বাবা?
যেখানে আমার স্বামী আমার নেই সেখানে বেহায়ার মতো মাটি কামড়ে পড়ে থাকবো কেনো আপনি বলেন আমাকে? যেখানে আমার জন্য আমার স্বামীর ভালোবাসা নেই,সম্মান নেই সেখানে আমি কিভাবে থাকবো?আপনি আর আমাকে আটকাবেন না বাবা।আপনি যদি একবারের মতো আমাকে নিজের আপন কেউ ভেবে থাকেন,তবে আপনার কাছে অনুরোধ আমাকে এখানে থাকতে বলবেন না।আমাকে যেতে দিন।”
হামিদুর রহমান বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। নবনী রুমে গিয়ে একটা পাঞ্চ ক্লিপ চুলে আটকে এসে বললো,”আমি যাই বাবা,আপনি পারলে আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসুন।”
হামিদুর রহমান নবনীকে দাঁড়াতে বলে নিজের রুমে গেলেন।তারপর ফিরে এলেন একটা বড় হরলিকসের কৌটা হাতে নিয়ে।নবনীকে সোফায় বসতে বলে,কৌটা থেকে গহনা বের করে একটা রুমালে নিলেন।তাহেরা,লুবনা,দিশা সবার চোখ কপালে উঠে গেলো সব গহনা দেখে।
হামিদুর রহমান বললেন,”এগুলো তোমার বিয়ের গহনা,আমি তোমার জন্য এনেছিলাম।তুমি নিজের কাছে রাখো নি।তোমার শাশুড়ির কাছে রেখে দিয়েছিলে,তোমার সব গহনা তুমি নিয়ে যাবে।আর এই যে হার,কানের দুল,চুড়ি দেখছো?এখানে সাড়ে আট ভরি সোনা আছে।আমি এগুলো এবার দেশে আসার সময় এনেছিলাম।ভেবেছিলাম আমার ঘরের নতুন অতিথি আসার খবর পেলে এগুলো তোমাকে দিয়ে যাবো তাকে দেওয়ার জন্য আমার পক্ষ থেকে।এগুলো ও এখন তোমার।”
নবনী চমকে গিয়ে বললো,”না বাবা।এগুলো একটাও আমি চাই না।পৃথিবীতে নারীর সবচেয়ে বড় অলঙ্কার হলো তার স্বামী।আমার সেই অলঙ্কার যখন নেই,এই সোনার অলঙ্কার আমার কি হবে বাবা?”
হামিদুর রহমান বললেন,”এগুলো তোমার এই বাবার পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার। অথবা ধরে নাও তোমার জীবনের যে ৩ বছর আমার জন্য নষ্ট হয়েছে তার
জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য ক্ষতিপূরণ। জানি,হাজার ভরি সোনা দিলেও সেই ক্ষতিপূরণ হবে না।তবে তুমি এগুলো ফিরিয়ে দিলে আমি ভীষণ কষ্ট পাবো।”
নবনী দুহাত পেতে নিলো সব।হামিদুর রহমান নবনীর হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। হামিদুর রহমান নবনীকে নিয়ে বের হয়ে যেতেই তাহেরা বুক চেপে ধরে সোফায় বসে পড়লো।তামিম,লুবনা,দিশা ছুটে এলো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লাগলো সবাই।সামিম দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায়। শুধু অপেক্ষা করছে ভোর রাতের,কখন বাস ধরবে আর এসব ড্রামা থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে যাবে।
তাহেরা কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমার কতোবড় সর্বনাশ হয়ে গেলো। তোর বাবা ওই মেয়েরে সব সোনার গহনা দিয়ে দিলো।ওখানে মোট ১৫ ভরি সোনা ছিলো।হায় হায় আল্লাহ,এই আমার কি সর্বনাশ হলো!”
দিশা হেসে বললো,”মা এতো ভাবছেন কেনো?আপনার চোখের বালি যে দূর হয়ে গেলো এক উছিলায় তার জন্য অন্তত খুশি থাকেন।”
তাহেরা ফোসফাস করে বললো,”কি বলছো তুমি এসব দিশা?১৫ ভরি সোনার দাম জানো তুমি?নাহলে ও তো ৯-১০ লাখ টাকার গহনা ওখানে।এতো টাকার গহনা আমার।ওই ফকিন্নির মেয়ে নিয়ে গেলো!আমি মামলা করবো। তোর শ্বশুর যাক খালি দেশ থেকে।আমি গিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে আসবো এসব।”
তামিম নিজের রুমে চলে গেলো। তামিমের পিছনে সামিম ও গেলো।বিছানায় সটান হয়ে শুতেই সামিম বললো,”কাজটা কি ঠিক হলো ভাইয়া?”
তামিম জবাব দিতে পারলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”আমি এখনো বুঝতে পারছি না কি থেকে কি হয়ে গেলো। অথবা আমার কি করার উচিত এখন! ”
সামিম হেসে বললো, “খাঁটি সোনা চিনলি না ভাইয়া। ভাবীর মতো চমৎকার একটা মেয়েকে এভাবে মায়ের কথা ধরে ছেড়ে দিলি ভাইয়া?”
তামিম জবাব দিলো,”আমার সমস্যা তুই কি বুঝবি।তোর শ্বশুর বাড়ির মতো তো আমার শ্বশুর বাড়ির অবস্থা ভালো না।প্রতিদিন মায়ের কতো অভিযোগ থাকে।মায়ের কান্না আমার সহ্য হয় না।তাও যদি নবনী দিশার মতো হতো।”
সামিম হেসে বললো,”দিশার মতো হলে তুমি আরো আগে আত্মহত্যা করতে ভাইয়া।দিশা আমার গলার কাঁটার মতো বিঁধে আছে।না পারছি গিলতে আর না পারছি ফেলতে। তুমি জানো ভাইয়া,প্রায় দেড় বছর হতে চললো দিশার সাথে আমি ঘনিষ্ঠ হই না।মা দিশার পরিবার সম্পর্কে জানার পর পাগল হয়ে গেছে দিশাকে বিয়ে করার জন্য।২২ বছর বয়সে নয়তো আমার মতো ছেলে বিয়ে করে!আমি তো দিশাকে ভালো করে বুঝে উঠতেই পারি নি,তার আগে বিয়ে করে ফেললাম।তোমার বিয়ের আগে নিজে বিয়ে করে নিলাম।কতো বড় নির্লজ্জ হলে এমন কাজ কেউ করে ভাইয়া!
দিশা আমার কোনো কথাই শোনে না ভাইয়া।পুরোপুরি আমার কন্ট্রোলের বাহিরে।আজ এই ফ্রেন্ডের বার্থডে তো কাল আরেক ফ্রেন্ডের পার্টি,পরশু হ্যাং আউট এসব করে ও দিন কাটায়।একটাই পাওয়ার ওর,ওর বাবার অনেক সম্পদ আছে।দুই ভাইয়ের আদরের বোন একজন ও।আমি কিছু বললেই মা পারে না আমাকে গুলি করে। আচ্ছা তুমি বলো ভাইয়া,দিশার বাবার সম্পদ দিশা পেলে তাতে আমার কি লাভ?মায়ের কি লাভ?
মা’কে কি দিশা দিয়ে দিবে সব?তবে কেনো মা এসবের লোভে পড়ে এরকম করে? দিশা কি আজ পর্যন্ত মা’কে এক কাপ চা বানিয়ে খাইয়েছে?বাবাকে একবার খাবার বেড়ে দিয়েছে?
কি করেছে ও?তবুও মায়ের কাছে ও ভালো কারণ ওর বাবা ধনী। অথচ ভাবী যে সকাল থেকে রাত অবদি খেটে যায় তার কোনো দাম নেই।কেনো মায়ের মেন্টালিটি এমন?
তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে তোমার স্বভাব কেনো এমন আমি তাও জানি না।এটুকুই বলবো,অনেক বড় ভুল করেছো তুমি।”
সামিম চলে যাওয়ার পর তামিম উঠে বসে বসে ভাবতে লাগলো সব কিছু নিয়ে। কিন্তু ভেবে পেলো না তার এখন কি করা দরকার।
গাড়িতে বসে নবনী একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। যতো দ্রুত সম্ভব তামিমকে সে ডিভোর্স দিবে।নিজের ক্যারিয়ার এমনভাবে গড়ে তুলবে যেনো তাহেরা বেগম একদিন তার কাছে আসতে বাধ্য হয়।আর পিছনে ফিরে তাকাবে না সে।সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে।
চলবে……..
রাজিয়া রহমান