অনুভব
২য় পর্ব
ও দেখল মেহুল বাচ্চাদের মতন ওর বুকের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে ঘুমিয়ে আছে, শুধু আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগেই নেই সে কি করে যেন অর্ণবের টিশার্টের মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়েছে। এর মধ্যেই অর্ণব টের পেল দরজাতে অলরেডি ঢাকির ঢোল পিটানোর মতন কারা যেন টোকা দেওয়া শুরু করেছে। এবার ও একরকম দিশেহারা হয়ে গেল, মেহুলকে আস্তে আস্তে ডাকা শুরু করল,
___ ” এই মেহুল, মেহুল….উঠো তাড়াতাড়ি, আরে উঠো পরে আগে আমার টিশার্ট থেকে বের হও তাড়াতাড়ি। ”
কিন্তু মেহুলের যেন কোন ভাবন্তরই হল না ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অর্ণবকে। ঘুমালে নাকি মেয়েদের মায়াবতী লাগে আর মেহুলের মধ্যে তো মায়া যেন উপচে পড়ছে। অর্ণবের বুকের উপরে মেহুলের উষ্ণ শ্বাস পড়ছে, হঠাৎ ওর যেন সারাশরীরে এক অন্য আবেশ ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণবের মনে হল থাকুক না আর একটু সময় বুকের মধ্যে, মন্দ তো লাগছে না। কিন্তু দরজা ভাঙ্গার মতন করে যে হারে আঘাত করছে তাতে দরজা না খুললে ভাঙতে বেশি সময় লাগবে না বাইরের পার্টিদের। এত শব্দের মধ্যে মেহুল যে কি করে ঘুমিয়ে আছে সেটাই বুঝতে পারতেছে না অর্ণব। যাই হোক খুব কসরত করে টিশার্ট থেকে ও নিজেই বেরিয়ে এলো। খালি গায়ে চলল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই যেন অর্ণব এক বিশাল স্রোতের মুখে পড়ল, গলগলিয়ে পানি ঢোকার মতন এক ঝাঁক মানুষ ঢুকে পড়ল ওর রুমে। মেহুল তখনও ঘুমে বিভোর। স্কার্টটা হাঁটুর উপরে উঠে আছে ওর, টিশার্ট এর অবস্থাও বেশি সুবিধার না। অর্ণব বেশ লজ্জায় পড়ল, ওর ফুফাতো বোন সোহেলি ওদের বাসায় থেকেই পড়ে, অর্ণব কখনও ওকে ফুফাতো বোন মনেই করে না, সবসময় আপন ছোট বোনের মতন আদর করে। সোহেলি মুখে হাত বাঁধিয়ে বেশ চিন্তিত মুখ করে বলল,
___ ” ভাইয়া ভাবিরে কি মাইর টাইর দিছ নাকি এমন করে পড়ে আছে কেন?”
___ ” আরে ভাইয়া মাইর দেয় নাই ভাবির দিকে রাগি একটা লুক দিছে তাই দেখেই ভাবি ফিট পড়ছে।”
পেছন থেকে আরেক চাচাতো বোন শায়লা টিপ্পনী কেটে বলল। শায়লার ছোট বোন শারমিন আরো এক কাঠি এগিয়ে সে বলল,
___ ” আরে ভাইয়া কান্দে না রে ভাইয়ার চেহারাই এমন। ভাইয়া নরমাল ভাবে তাকানোই রাগি রাগি আর কি। ভাবি নতুন তো তাই অভ্যাস হয় নি আর কি।”
___ ” থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে তোদের সব গুলোর দাঁত ফেলব আমি। বেশি পাকনা হয়েছিস না। সোজা প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে নীল ডাউন করে দাঁড় করিয়ে রাখব বলে দিলাম।”
অর্ণব বেশ রাগি স্বরে বলল। সোহেলি বিটলা মার্কা হাসি দিয়ে বলল,
____ ” ভাইয়া আমরা তোমার সৈনিক না বুঝেছ। বেশি ঝামেলা করলে নানুমনিকে বলব তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
এবার অর্ণব নরম হল,
___ ” দেখ আমি অনেকবার ডেকেছি তোদের গ্যাঙ্গের এই নতুন সদস্যকে বাট আই এম ফেল। সে ওঠেই নি। এখন তোরা ট্রাই করে দেখ পারিস নাকি।”
এই বলেই অর্ণব চলল ওয়াশরুমের দিকে, মাঝ পথেই দরজায় এসে হাজির হল ওর বড় ভাবি ডেইজী। এত গুলো বাচ্চাকাচ্চা রুমে দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
___ ” সাত সকাল বেলা পোলাপানের দল সব এখানে কি করিস, যা যা সব গুলো বের হ রুম থেকে।”
অর্ণব এবার হাফ ছাড়ল বড় ভাবি এসেছে মানে সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। এত হৈচৈ শুনে মেহুল চোখ ডলতে ডলতে খাটের উপরে উঠে বসল। ওর বড় সমস্যা হল ঘুম থেকে উঠলে বেশ কিছুসময় ও যেন জিরো হয়ে যায় মাথাই কাজ করে না। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে ভাবল আসলে ও আছেটা কই? সোহেলি, শায়লা আর শারমিনের শত ইচ্ছা থাকলেও বড় ভাবি সোজা বের করে দিল রুম থেকে। মেহুলকে উঠতে দেখেই খাটের উপরে যেয়ে বসল ও। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
___ ” যাও মেহুল উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেও। সবাই অপেক্ষা করতেছে তোমার জন্য নাস্তার টেবিলে।”
___ ” আচ্ছা আপনি কে? আমি আছিটাই বা কোথায়?”
মেহুলের প্রশ্ন শুনে বড় ভাবি হাসতে শুরু করল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
___ ” তুমি তোমার বাড়িতে, যাও যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও।”
এটুকু বলেই বড় ভাবি দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। মেহুল ওর এলোমেলো চুলে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে মনে করতে চেষ্টা করল যে ও আছেটা কই। এমন সময় অর্ণব বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ওকে দেখেই মেহুলের মনে পড়ল, আরে ওর তো কালকে বিয়ে হয়েছে। আছে শশুড়বাড়ি, এমন সময় হঠাৎ ওর চোখ পড়ল অর্ণবের উপরে। ভেজা চুলের আগায় শিশিরের মতন পানি জমে আছে। টাওয়াল নাভির বেশ খানিকটা নিচে জড়ানো। বুকের ভেজা পশমগুলো লেপ্টে আছে বুকের সাথে, পায়ের পশমগুলোও সেই লেভেলের। পেটানো শরীর যেন চোখ ফিরাতেই পারছে না মেহুল। অর্ণব মাথা মুছতে মুছতে বলল,
___ ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও দিদুন টাইমলি খাবার খায়। দেরি হলে কিন্তু ঝামেলা।”
মেহুল সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো চুল গুলো কেমন জানি কারেন্টে শর্ট খাওয়া মানুষের মতন দেখাচ্ছে। বার বার ও ওর বাবাকে বলেছিল পার্লারে সাজার দরকার নেই, কিন্তু কিসের কি, পার্লারে না সাজলে নাকি মানসম্মান থাকে না। তাই মানসম্মান রাখতে যেয়ে চুল কারেন্টের শর্ট খাওয়া মানুষের মতন হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হল মেহুল। কিন্তু রুমে এসেই দেখে অর্ণব নেই তাই টিশার্ট খুলে ও ব্লাউজ পরে নিল। পেটিকোট পরে শাড়িটা হাতে নিতেই মেহুলের পেটের মধ্যে মোচড় দিতে আরাম্ভ করল ভয়ে। আসলে ও তো কখনও পরে নি শাড়ি একা একা এখন কি হবে। বড় বড় ঢোক গিলতে লাগল ও, এমন সময় অর্ণব এসে হাজির রুমে। মেহুল শাড়ি বুকের কাছে চেপে ধরে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। অর্ণব এবার বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” তুমি শাড়ি পরে নেও আমি পরে আসছি। ”
___ ” শোনেন প্লিজ যাবেন না। ”
মেহুলের কণ্ঠে যেন অনুনয় ঝরে পড়ল। অর্ণব এবার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল,
___ ” আমি না শাড়ি পরতে পারি না, আমাকে একটু শাড়ি পরিয়ে দেবেন। ”
___ ” শাড়ি পরতে পারো না? তো কালকে পরেছিলে কি করে?”
অর্ণব বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। এবার মেহুল চোখ মুখ কুঁকড়ে বলল,
___ ” লেফট রাইট বলতে বলতে মেজর সাহেবের কমন সেন্স মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে তাই না। কালকে শাড়ি পার্লার থেকে পরেছিলাম। আজকে আপনি পরিয়ে দেবেন।”
___ ” আমি তো শাড়ি পরাতে পারি না।”
___ ” ইন্টারনেট নামক একটা জিনিস আছে ওখান থেকে দেখে দেখে পরিয়ে দেন। ”
___ ” আচ্ছা এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই, আমি দেখছি কি করা যায়।”
এই বলেই অর্ণব শাড়ি হাতে নিয়ে এক পাশ ধরে বলল,
___ ” এটা কোমরে গুজে নেও।”
___ ” এভাবেই শাড়ি পরায়, একবার ভার্সিটির প্রোগ্রামে আমার আপু পরিয়ে দিয়েছিল শাড়ি এভাবে।”
কোমরে শাড়ি গুজতে গুজতে মেহুল উচ্ছাসিত হাসি দিয়ে বলল। অর্ণব বেশ বিরক্ত হল একেতো সকাল বেলা বিশাল এক কাহিনি হল তার উপরে এখন আবার লেট হচ্ছে। নিচে গেলে যে কি হবে সেটা ভেবেই ও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। আর তার উপরে এই মেয়ে বকবক করেই যাচ্ছে। অর্ণব গলার স্বর শান্ত রেখে বলল,
___ ” কথা কম বলে কাজে মন দেও, এই পাশটা ধরো আমি কুঁচি ঠিক করে দিচ্ছি।”
অর্ণব শাড়ির কুঁচিগুলো ঠিক করে মেহুলের হাতে দিতে যাবে এমন সময় ও দেখল মেহুল দুহাতে শাড়ি সামলাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত একটু আমতা আমতা করে ও বলেই ফেলল,
___ ” কুঁচিটা এবার গুজে নেও।”
___ ” কেন আপনি পারেন না বুঝি গুজাতে পারেন না। আমার হাত দুটোই আর দুই হাতই আটকা আপনি পরিয়ে দেন শাড়ি। ”
এবার তো অর্ণব পড়ল মহা বিপদে। হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে মেহুলের ফর্সা পেটের দিকে তাকাতেই ওর যেন সারা শরীর ধরে ঝাকি দিয়ে উঠল। চোখ মুখ খিচিয়ে শাড়ির কুচি গুলো গুজে দিতেই ওর চোখে পড়ল পেটের উপরের কালো তিলটার দিকে। অসম্ভব সুন্দর একটা তিল, অর্ণবের বুকের মধ্যেটা যেন শুকিয়ে যেতে লাগল, জোর করে চোখ ফিরাতেই দেখল দরজা খুলে বড় ভাবি ঢুকছে রুমে। অর্ণবকে মেহুলের সামনে এমন করে বসে থাকতে দেখে উনি ঠোঁট চেপে হাসি আটকালেন, তারপর বললেন
___ ” আগে নাস্তা তো করে আসো রোমান্সের টাইম অনেক পাওয়া যাবে।”
___ ” বড় ভাবি কি যে বলেন, রোমান্স আর মেজর সাহেব…. দুইটা দুই দিকের বাসিন্দা।”
মেহুল শাড়ি ঘুরিয়ে আঁচল টেনে দিতে দিতে বলল ডেইজীকে। অর্ণব কিছু না বলেই চোখ কুঁচকে তাকালো মেহুলের দিকে। কিন্তু মেহুলের সে দিকে কোন খেয়ালই নেই সে তার মতন করেই বকবক করেই চলেছে,
___ ” জানো ভাবি কালকে রাতে তার একটা টিশার্ট চেয়েছিলাম এমন করে তাকিয়ে ছিল যেন আমি তার কিডনীই চেয়ে ফেলেছি। ”
এবার বড় ভাবির চাপা হাসি অট্টহাসির রুপ নিল, আর অর্ণব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল মেহুলের দিকে। ” এই মেয়েকে এখনই থামাতে হবে না হলে আরো কি কি যে বলে বসবে সেটা উপরওয়ালাই ভাল জানেন” বিড়বিড় করতে করতে বলল অর্ণব। তারপর ও মেহুল আর বড় ভাবিকে এক পর্যায়ে ধরে বেঁধেই নিয়ে আসল নিচে ডাইনিং রুমে।
অর্ণবদের বাসায় ওর মা লিপি বেগম, দাদি হাসনাহেনা বানু, ফুফাতো বোন সোহেলি আর বড় ভাই ভাবি থাকেন। লিপি বেগম আর হাসনাহেনা বানুর সম্পর্ক অনেকটা বাচ্চাদের মতন, দুজন দুজনের পেছনে লেগেই থাকেন আবার একজনকে ছাড়া আরেকজন থাকতেই পারেনা। হাসনাহেনা বানু মানে অর্ণবের দিদুন কানে খুব কম শোনেন এটাই হল ঝামেলা। দেখা যাচ্ছে কেউ বলল যাচ্ছে উনি শুনছেন খাচ্ছে। সবাই ঘুরে ডাইনিং টেবিলের পাশে বসে আছে। মেহুল আর অর্ণব আসতেই হাসনাহেনা বানু ওকে বললেন,
___ ” আমার নাত বউ আমার পাশে বসবে, এসো ভাই আমার পাশে বসো।”
___ ” হ্যাঁ হ্যাঁ বউ তো শুধু আপনার একার আর আমরা তো সবাই ফুটো কড়ি “।
লিপি বেগম বেশ ঠেস দিয়ে বললেন। দিদুন এবার বেশ রেগে লিপি বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
___ ” তুমি ফুটো ঘড়ি? এ আবার কেমন কথা বউ মা “।
___ ” মরন আমার আমি বলি কি আর আমার সারিন্দা বাজায় কি? ”
মুখ বেঁকে উওর দিল লিপি বেগম। সোহেলি কপালে হাতের চাপড় দিয়ে ওর মাকে বলল,
___ ” সামলাও তোমার মা আর ভাইয়ের বউকে। সারাদিন আমি আর ভাইয়া যত ঝগড়া না করি এরা দুই বউ শাশুড়ী তার চেয়ে বেশি ঝগড়া করে।”
___ ” আরে এটা উনাদের খুনসুটি বুঝবি না তুই।”
বেনু হাসতে হাসতে উওর দিল। বড় ভাবি তার শাশুড়ী আর দাদি শাশুড়ীর মধ্যে কথা কাটাকাটি থামাতে বলল,
___ ” মা দিদুন অনেক হয়েছে এবার দুজনে খাওয়া শুরু করেন, মেহুল তুমিও খাও। অর্ণব আর কিছু দেব তোমাকে।”
অর্ণব উওর দেওয়ার আগেই টের পেল হাঁটুর উপর দিয়ে…..
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর