অনুভব
৬ষ্ঠ পর্ব
অর্ণব বেশ অবাক হল স্ক্রীনের নাম্বারটা দেখে, এত সুন্দর সকালে এমন একজনের নাম্বার দেখবে সেটা কখনও ও আশা করে নাই। এত দিন পরে কেন আবার কল এলো এই নাম্বার দিয়ে। ছিল তো ভালই ও কেন আবার এই দমকা বাতাসের ঝলক। অর্ণব কিছু না বলেই চুপ করে ফোন কেটে দিল। ঝিলমিল ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। বাহ এখন ওর ফোন পর্যন্ত ধরার প্রয়োজন মনে করে না অর্ণব। রাগে যেন ও হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য হয়ে সামনে রাখা ফুলদানিটা চরম আক্রোশে টুকরো টুকরো করে ফেলল। অর্ণব ওকে ঘৃণা করে সেটা ও ভাল করেই জানে তাই বলে ফোনটাও ধরবে না ও… চোখ দিয়ে রাগে ক্ষোভে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল ঝিলমিলের, এই অপমানের চরম মূল্য দিতে হবে অর্ণবকে।
অর্ণব কোন কথা না বলে সোজা হয়ে উঠে বসল, তারপর মেহুলকে বলল,
___ ” রেডি হয়ে নেও নয়টায় গাড়ি আসবে, বের হয়ে আগেই নাস্তা করে নিতে হবে।”
___ ” কে ফোন করেছিল?”
অর্ণবের কথার মাঝেই বলে উঠলো মেহুল। এবার অর্ণব বেশ ঝামেলায় পড়ল, মেহুলকে কিভাবে ও বলবে কে ফোন দিয়েছিল। একবার ভাবল মেহুলকে ঝিলমিলের কথা বলে দেবে৷ কিন্তু পরোক্ষনেই ভাবলো যদি মেহুল ভুল বোঝে, আর অতীতকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকারই বা কি।
___ ” আরে আমি জিজ্ঞেস করেছি কে কল দিয়েছিল,আপনি তো পুরো ভাবনার সমুদ্রেই ডুব দিয়েছেন আমার কথা শুনে!”
মেহুলের কথায় চিন্তার ঘোর থেকে ফিরে এলো অর্ণব।
___ ” তেমন কেউ না আমার এক পরিচিত লোক।”
এটুকু বলেই অর্ণব বিছানা থেকে উঠে গেল। অর্ণব রেডি হয়ে বের হতেই দেখল মেহুলও রেডি হয়ে গেছে। জিন্সের উপরে সাদা হুডিতে মেহুলকে যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে, এক ঘোর লাগা সৌন্দর্য্যের আবেশ চারিপাশে। মেহুল অর্ণবের দিকে তাকাতেই ও চোখ সরিয়ে নিল। লজের রেস্টুরেন্টেই ওরা নাস্তা করে নিল। ঠান্ডার মধ্যে গরম গরম ম্যাগী আর ধোঁয়া ওঠা কফি। ওরা খেতে খেতেই ওদের গাড়ি চলে এলো।
___ ” আজকে সারাদিন কি এই গাড়িতে থাকতে হবে?”
মেহুল গাড়িতে বসেই প্রশ্ন করল।
___ ” না গাড়িতে না বসলেও চলবে, তুমি হেঁটে হেঁটে ট্যুর করতে পারো। আচ্ছা যাই হোক তোমার কি হাইট ফোবিয়া আছে মেহুল?”
___ ” কিসের মধ্যে কি পান্তাভাতে ঘি। হঠাৎ আমার হাইট ফোবিয়ার পিছনে পড়লেন কেন?”
___ ” এমনিতেই।”
___ ” শোনেন আমার কোন ফোবিয়া টবিয়া নেই। আমি পারফেক্ট মেয়ে মানুষ। ”
___ ” আচ্ছা আচ্ছা আমার ভুল হইছে আপনার মতন পারফেক্ট মেয়ে মানুষরে খোঁচানো উচিত হয় নাই।”
মেহুল হাতের চকলেট শেষ করেই গাড়ির জানলা খুলল প্যাকেটটা বাইরে ফেলার জন্য, অর্ণব খপ করে হাত চেপে ধরল ওর। মেহুল বেশ অবাক হয়েই বলল,
___ ” কি ব্যপার এমন করলেন কেন?”
___ ” ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন ম্যাডাম আপনি এখন বাংলাদেশে নেই গ্যাংটকে আছে। আর এখানের আইন হল যদি কেউ ময়লা ফেলে রাস্তা ঘাটে তাহলে নগদ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা প্লাস ছয় মাসের জেল। ”
___ ” এক দুই মাসের জেল হলে রিস্ক নেওয়া যেত বাট ছয় মাস সে অনেকদিন। তাইলে থাকুক প্যাকেটটা আমার ব্যাগে।”
অর্ণব আবার অবাক হয়ে তাকালো মেহুলের দিকে, মেয়েটা বলে কি এক মাসের জেল হলেও সে রিস্ক নিত। মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথা পরিষ্কার করার ট্রাই করল ও।
___ ” আচ্ছা আমরা এসেছি কোথায়?”
মেহুল চোখ ছোট ছোট করে সন্ধিগ্ন দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল অর্ণবকে।
___ ” প্যারাগ্লাইডিং করতে এসেছি।”
অর্ণব সোজা স্বরে উওর দিল।
___ ” প্যারাগ্লাইডিং মানে… ওই যে পাহাড়ের পর থেকে ছাতা পেটে সাথে বাইন্ধা লাফ দেয়৷”.
মেহুলের কথা শুনে অর্ণবের খুব হাসি পেল। হাসিটা চেপে গিয়েই বলল,
___ ” ওটা ছাতা না গ্লাইডিং প্যানেল।”
মেহুলের গলা এবার শুকিয়ে আসতে লাগল। এই লোক কি পাগল না ছাগল কি কি জুটিয়ে নিয়ে এসেছে। সব প্রোসেসিং শেষে মেহুলকে যখন অর্ণবের সামনে সেফটি বেল্ট বাঁধতে নিয়ে এলো মেহুলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বেশ বড় বড় ভাষন দিলেও মেহুল এত এত উচ্চতাকে সেই লেভেলের ভয় পায়। ওরা যখন গ্লাইডিং শুরু করল মেহুলের চিৎকার যেন আর থামেই না। প্রায় ২২০০০ ফুট উপরে উঠার পরে মেহুল বেশ জিদ করেই বলল,
___ ” যদি আমারে ভালই না লাগছে তাহলে বলতেন আমি চলে যেতাম, এমন করে আকাশে উঠিয়ে মারার কি দরকার ছিল।”.
___ ” আমি তোমাকে আগেও প্রশ্ন করেছিলাম যে হাইট ফোবিয়া আছে কি না। তখন তো চওড়া স্বরে বলেছিলে মুই কি হনুরে।”
অর্ণব বেশ ঠেস দিয়েই কথাটা বলল। মেহুল কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
___ ” ও আল্লাহ গো আমি মরে গেলে আমার আব্বুরে কে দেখবে। আর শোনেন যদি ভাবছেন আমি মরে গেলে আবার বিয়ে করবেন সে আশা বাদ দেন মরার পরে ভুত হয়ে আপনারা পাহারা দেব এই বলে দিলাম।”
___ ” আবার বলে বিয়ে?.. ”
অর্ণব বিড়বিড় করে বলল।
লিপি বেগম যেন খুব উতলা হচ্ছেন বারেবারে৷ কেন জানি না মনে হচ্ছে খুব বড় অশুভ কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু এমন মনে হওয়ার কারণটা কি। শেষ মেষ থাকতে না পেরে চললেন শাশুড়ীর কাছে। লিপি বেগম যখন খুব ছোট ছিলেন তখন এসেছিলেন এই সংসারে। হাসনাহেনা বানুই তাকে হাতে করে সব কিছু শিখিয়েছে। শাশুড়ী ছেলের বউয়ের চেয়ে তাদের সম্পর্কটা বান্ধবীর মতন অনেকটা। লিপি বেগম ঘরে ঢুকেই দেখেন তার বড় বউ দাদি শাশুড়ীর পায়ে তেল মালিশ করছে। শাশুড়ীকে দেখেই ডেইজী নিরবে একটা হাসি দিল। শাশুড়ীর পাশে বসেই লিপি বেগম নরম সুরে বলল,
____ ” আম্মা কি ঘুমিয়েছেন।”
___ ” না ঘুমাই নি কি ব্যাপার লিপি?”
হাসনাহেনা বানু চোখ খুলেই প্রশ্ন করলেন লিপিকে।
___ ” আম্মা আমার না কিছু ভাল লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে অশুভ কিছু একটা হবে।”
হাসনাহেনা বেগম তার চোখ মেলে তাকালের লিপির মুখের দিকে। ছেলের বউটা তার একটু বোকা কিন্তু খুব লক্ষী একটা বউ। মেয়ের মতন ভালবাসেন তিনি কিন্তু সবসময় একটা অদেখা শাষনের মধ্যে রেখে এসেছেন তিনি লিপিকে। যে অভ্যাস এই আশির কোঠায় পা দিয়েও ছাড়তে পারেন নি হাসনাহেনা বানু।
___ ” হঠাৎ এমন কথা কেন বলতেছ বউমা। বলেছি না বেশি বেশি একদম চিন্তা করবা না।”
___ ” আম্মা আপনি অযথা কেন চিন্তা করে প্রেশার হাই করতেছেন বলুন তো।”
ডেইজী হাসনাহেনা বানুর পায়ে তেল মালিশ করতে। করতে লিপি বেগমকে বলল।
___ ” আমার যা মনে হচ্ছে আমি তাই বললাম, কিছুতেই যেন মন দিতে পারতেছি না।”
___ ” কি দিতে পারতেছ না,?”
___ ” মন দিতে পারতেছি না মন, বুঝেছেন!”
এবার বেশ জোরেই শব্দ করে বলল লিপি। হাসনাহেনা বানু মুখ বাঁকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
___ ” শুনেছ বড় নাত বউ তোমার শাশুড়ী নাকি মন লাগাতে পারতেছে না কাজে৷ আচ্ছা কবেই বা তুমি মন লাগিয়ে কাজ করেছ শুনি একটু।”
___ ” আমি তো ভালোই না, যদি আপনার ছেলে বেঁচে থাকতো তো বলতাম যেন আরেকটা বিয়ে করে ভালো কাউকে নিয়ে আসে।”
মেজাজ খারাপ করেই কথা গুলো বলল লিপি বেগম। হাসনাহেনা বানু আবার চোখ বুজতে বুজতে বললেন,
___ ” আহারে সত্যিই যদি খোকাটা থাকত।”
প্যারাগ্লাইডিং শেষে অর্ণব আর মেহুল চলল বানজাকি ফলস দেখতে। ওখানে থেকে ওরা চলল আরেকটা ভিউ পয়েন্ট তিশা পয়েন্টে৷ মেহুলের মনে হল আর লাইফে কি প্রয়োজন, সামনে বিশাল পাহাড়ের ঢাল,সূদূরে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করা পাহাড়ের চূড়া। আকাশে সাদামেঘের ভেলা। কোথাও কোথাও যেন মেঘ আর কুয়াশা একত্রে এক অদ্ভুত রংয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অর্ণবও মূকের মতন এই বিস্তৃত পাহাড় আর মেঘের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। নিজেকে খুব নগন্য মনে হয় প্রকৃতির এই বিশালতার কাছে। আসলেই পৃথিবীটা খুব সুন্দর। দুপুরের রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহুলের ফর্সা গালটাকে। অর্নবের কাছে মনে হল প্রকৃতির মাঝে যেন মিলে গেছে মেহুল। ওর কোমলতা যেন আরো বেড়েছে প্রকৃতির মাঝে এসে। অর্ণব হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল মেহুলকে। এবার মেহুল অবাক হয়ে তাকালো অর্ণবের দিকে। ওর চোখ যেন সব বাদ দিয়ে শুধু মেহুলকেই দেখছে। এ যেন এক ঘোর লাগা দৃষ্টি, যেখানে আছে শুধুই ভালবাসার আর্দ্র পরশ। মেহুলের কানের পেছনের চুলরের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসল ওকে অর্ণব। আবেশের ঘোরে চোখ বন্ধ করে নিল মেহুল। অর্ণবের ঠোঁট মিশে গেল মেহুলের ঠোঁটের সাথে। দুজনের নিঃশ্বাস যেন একাকার হয়ে মিশে যেতে লাগল। এই ভালবাসার স্বাক্ষী হয়ে রইল এই বিস্তৃত প্রকৃতি, রঙ্গীন মেঘের আকাশ আর এই দুই মানব মানবী।
গনেশ টকে আসা পর্যন্ত মেহুল আর কোন কথাই বলে নি অর্ণবের সাথে৷ সারা রাস্তা মাথা নিচু করে রেখেছে। বারবার লজ্জায় যেন ফর্সা গালে রক্ত জমেছে। অর্ণব নিজেও সানগ্লাস পরে নিয়েছে। আর আড়চোখে বারবার দেখছে মেহুলকে। গণেশ টকে নেমেই বিশাল এক সুভেনির দোকানে ঢুকলো ওরা। মেহুলকে অর্ণব বলল,
___ ” তোমার যা যা পছন্দ কেনাকাটা করো আমি একটু কল করে আসি।”
মেহুল মাথা নেড়ে সায় দিয়েই দেখতে লাগল কি কি কেনা যায়৷ বেশ কিছুক্ষন পরে দোকান থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই যেন মেহুলের চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। ও যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না নিজের দুই চোখকে। এ কি করে সম্ভব,……
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর