তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (১১)

0
501

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (১১)

সকালে নবনীর তিন ফুফু এলো নবনীদের ঘরে। বারান্দার চৌকিতে বসে তিন জন মিলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সবার এক কথা,তাদের ভাই তাদের পর হয়ে গেছে। কোনোদিন ভাইয়ের থেকে তারা কোনো আর্থিক সাহায্য পায় না।

নবনীর ছোট ফুফু হাফিজা বানু চৌকিতে শুয়ে বিলাপ করে বললেন,”বাপ মা মইরা যাওনের পরে এই ভাই আছিলো আমাগো তিন বোইনের গার্জিয়ান।হেই ভাইয়ে আমাগো কোনো দায়িত্ব পালন করে নাই।আমার বড়ো পোলা মাজিইদ্দারে বিদেশ দেওনের সময় এই ভাইয়ের কাছে আইছিলাম ৫০ হাজার টাকার লাইগা।এই ভাইয়ে আমারে ২০ হাজার টাকা দিছে।এই নি আছিলো ভাইয়ের দায়িত্ব আপনেরাই কন গো?
এতো ঈদ যায়,কোনো দিন আমাগো পোলা মাইয়ারে একটা কাপড় কিন্না দেয় না।নিজের পোলা মাইয়ারে ঠিকই দেয়।বড় কেলাশে পড়ায়।আমাগো বেলায় খালি অভাব দেহা দেয়।”

চৈতালী নবনীকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,”আপা,গার্ডিয়ান হবে নাকি গার্জিয়ান হবে শব্দটা? ”

নবনী কটমট করে তাকালো বোনের দিকে।চৈতালী হেসে চলে গেলো।

মেজো ফুফু কাপড়ের আঁচলে নাক মুছে বললো,”আমার মাইয়া সুমিরে বিয়া দেওনের কালে এই ভাইয়েরা কতোবার কইরা কইলাম মাইয়ার বড় ঘরে বিয়া হইতাছে।স্বর্ণের চেইন যেনো আমার জামাইরে দেয়।এই ভাইয়ে দিলো না।আমার মাইয়ার জামাইরে একটা হাতের আংটি দিয়া আইছি।আমার মুখ ছোট কইরা দিছে।”

নবনী আঁতকে উঠলো এসব শুনে। তার বাবার যেই আর্থিক অবস্থা তাতে ফুফুদের জন্য এটুকু করতেও তার বুকে মাটি লেগে যাওয়ার কথা। নবনীর ভীষণ কান্না এলো।

কান্না এলো হাশেম আলীর ও।বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে বললো,”সবাই আমার বিরোধিতা করতে আসছে।অথচ আমার বোইনেরা সবার অবস্থা ভালা।সবার এখন পাকা বাড়ি।আমার অবস্থা গেরামের মানুষ সবাই তো জানেন।কই,কোনোদিন তো আমার একটা বোইনে আমারে জিগাইলো না ভাই,আইজকে কি খাইছস?
আমি যে পোলা মাইয়া লইয়া দিনে একবেলা খাইয়া দিন কাটাইছি,কেউ একদিন খবর লইতে আসে নাই।বোইনে গো কথা কতো মনে পরতো।না,বোইনে গো টাকা পইসার জন্য না।এমনেই মনে পরতো।এক মায়ের পেটের ভাইবোন তো।বোইনেগো রে ফোন করতাম মাঝেমাঝে। কেও আমার ফোন ধরতো না।হয়তো মনে করতো গরীব ভাই,যদি টাকা পয়সা চায়।
বোইনেগো বিয়ে দেওনের সময় আব্বায় ম্যালা জায়গা জমি বিক্রি করছে। এই ভিটামাটি আর রাস্তার উলটা পাশের জমি ছাড়া কিছুই ছিলো না।তারপরও আমি আব্বায় মারা যাওনের পরে বোইনেগোরে জমি ভাগ কইরা দিছি রাস্তার ওই পাড় দিয়ে।অথচ আব্বায় আমারে বোইনেগো সামনে কইয়া গেছে এইখান থাইকা বোইনেগো রে আর যেনো কোনো জমি না দিই।

আমি দিছি,বোইনেরা যাতে কোনোদিন না কইতে পারে ভাইয়ে তাদের ঠকাইছে।ওর পোলারে বিদেশ দেওনের সময় আমি বিশ হাজার টাকা দিছি,আর ফেরত নেই নাই।
এই যে হাবিবা,এর জমি কিননের সময় তিরিশ হাজার টাকা ধার কইরা দিছি,ফেরত দেয় নাই এ ও আর।আমি ও চাই নাই।
আমি আর কি করতাম আপনেরা কন তাইলে?”

উপস্থিত উৎসাহী জনতারা এসব শুনে চলে যেতে লাগলো। নবনীর ফুফুরা সবাই দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলো।
উৎপাত শুরু হলো তার দুদিন পর থেকে।আশেপাশের সবাই সারাদিন এসে জিজ্ঞেস করতে থাকে নবনীর ডিভোর্স হয়েছে কেনো।
হাশেম আলীর দোকানে চা খেতে খেতে লোকে জিজ্ঞেস করে, “কি মিয়া,মাইয়ারে খেদাইয়া দিলো ক্যান? শুনছি মাইয়ার না-কি কার লগে লাইন আছিলো।”

হাশেম আলী রেগে যান এসব শুনে,মানুষের সাথে ঝগড়া লেগে যায়।

গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সেলাই কাজ শিখানো হচ্ছে। নবনীও সেখানে সেলাই শিখে।বিকেলে শুরু হয়,সন্ধ্যায় শেষ হয়। এলাকার ছেলেরা নবনীকে দেখলে শিস বাজায়।
সেদিন বিকেলে একজন নবনীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলছিলো,”আরে,আমাদের গ্রামের মিস বিউটিফুল যাচ্ছে দেখ।”
একজন বললো,”মিস না মিসেস?”

সবাই হাসতে লাগলো। পরদিন আবার নবনী আসার সময় একজন গান ধরলো,”বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক,তোমার সাথে গল্প করবো আমি সারা রাত।”
পাশ থেকে অন্যরা বললো,”আমরা সবাই মিলে গল্প করবো।”

তারপর দিন যাওয়ার সময় একজন মিনার কার্টুনের মতো করে নবনীকে বললো,”নবনী, আমাগো লগে কথা কইবা না নবনী?”

নবনীর বুক ফেটে কান্না এলো। চোখ মুছে নবনী আজ ফিরে দাড়ালো।এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”মেয়ে মানুষ দেখলে মুখ ভীষণ চুলকায় এসব অসভ্যতা করার জন্য?”

সবাই মিলে হাসতে লাগলো নবনীর কথা শুনে।একজন বললো,”শুধু মুখ না তো সুন্দরী, সারা শরীর চুলকায়। ”

নবনীর ভীষণ ঘৃণা হলো এদের এরকম বাজে অঙ্গভঙ্গি দেখে।দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসতে নিতেই একজন পিছন থেকে শিস দিয়ে বললো,”পাখি তো পোষ মানতে রাজি আছেরে।”

একজন বললো,”গতি কি আমরা ছাড়া,এঁটো হয়ে গেছে না? ”

নবনীর এসব কথা সহ্য হলো না আর।ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা চড় বসালো ছেলেটার গালে।তারপর আর দাড়ালো না।ঘৃণায় সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গেছে তার।

সন্ধ্যায় বের হতেই দেখে সবগুলো ছেলে স্কুলের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। নবনীর ভীষণ ভয় হলো।বাড়িতে যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে চারদিকে। নবনীর কলিজা শুকিয়ে গেলো। সাব্বির কে কল দিলো নবনী। সাব্বির মসজিদের দিকে যাচ্ছিলো।নবনীর কল দেখে রিসিভ করলো। সব শুনে নবনীকে দাঁড়াতে বললো সাব্বির,ফরজ তিন রাকাত নামাজ পড়ে সাইকেল নিয়ে ছুটলো সে বোনের জন্য।

নামাজ পড়ে সাব্বির স্কুলের সামনে যেতে ১০ মিনিট লাগলো। এসে দেখে নবনী নেই স্কুলের সামনে। ফোন দিলো,কিন্তু ফোন অফ।হন্তদন্ত হয়ে নবনীকে খুঁজতে লাগলো সাব্বির। আশেপাশের দোকান সব বন্ধ,চারটের সময় দোকান এগুলো বন্ধ হয়ে যায় । নবনীর কথা জিজ্ঞেস করার মতো তেমন কাউকে পেলো না সাব্বির।

একটু পরে দেখলো স্কুলের ভেতর থেকে কয়েকটা ছেলে বের হয়ে আসছে।সাব্বির এদের চিনে।এলাকার ছেলে এরা।দিনে কেউ রাজমিস্ত্রী কেউ মেকানিকের কাজ করে,একজন মেম্বারের ছেলে,ভাগিনা। রাত হলে জুয়া,গাঁজার আসরে বসে।
সাব্বির দেখলো একজনের চোখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। যার চোখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে সে মেম্বারের ভাগিনা।সবাই তাকে নিয়ে দ্রুত ছুটছে।সাব্বিরের ভীষণ দুশ্চিন্তা হলো।ছুটে গেলো স্কুলের দিকে।

কোথাও নবনীকে খুঁজে পেলো না। নবনী বের হয়ে এলো বাথরুমের পেছন থেকে সাব্বিরের ডাক শুনে।এসেই ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। সাব্বির কিছু না জিজ্ঞেস করে বোনকে ধাতস্থ হতে দিলো।তারপর সাইকেলে বসিয়ে অন্য পথে বাড়িতে নিয়ে গেলো।
নবনী কারো সাথে কোনো কথা বললো না। রাতে নবনীর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।জ্বরের ঘোরে নবনী নানান আবোলতাবোল বলতে লাগলো।

সাব্বির সারারাত বোনের মাথায় পানি দিলো,জলপট্টি দিলো।
বাবা মা ভাই বোন সবাই সারারাত জেগে রইলো। রাবেয়া দু রাকাত নফল নামাজ পড়লেন মেয়ের সুস্থতার জন্য।

নবনীর জ্বর নামলো সকালে। এক রাতের জ্বরে নবনীর চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেলো।

নবনীর মুখ থেকে সবাই সব শুনলো। ঘটনাটা ঘটেছে এরকম,নবনী সাব্বিরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। ছেলেগুলো দু মিনিট দাঁড়িয়ে চলে গেলো। নবনী ভেবেছিলো ওরা চলে গেছে।

নবনী একটু সামনে যেতেই ওরা বেরিয়ে এলো।আশেপাশে দু চারজন মানুষ যা ছিলো তারাও মসজিদে চলে গেলো।কেউ কোথাও নেই।নবনী ভয়ে স্কুলের দিকে ছুটে গেলো।ছয় সাতজন ছেলে ওরাও গেলো।

নবনী এক ক্লাসে ককশীট দিয়ে বানানো বেগম রোকেয়ার ছবির পিছনে লুকালো।ক্লাস রুমে আর লুকানোর মতো জায়গা নেই।নবনী বুঝলো এখানে সে ধরা খেয়ে যাবে তাই বের হয়ে যেতে নিলো।মেম্বারের ভাগিনা তখন নবনীকে দেখতে পেলো। নবনীকে খাপ করে ধরতেই নবনী বিপদ বুঝে ছেলেটার চোখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিলো।

ছেলেটার চিৎকারে সবাই আসতে লাগলো। নবনী গিয়ে টয়লেটের পেছনে লুকালো।নবনীকে আর না খুঁজে ওরা তখন বের হয়ে গেলো।

হাশেম আলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো,”আর লাগবো না মা সেলাই শিখতে যাওনের।”

নবনী ও মেনে নিলো।জীবনের এই দিক নবনীর কাছে এতোদিন সম্পূর্ণ গোপন ছিলো।নবনী কখনো ভাবে নি জীবনে এসব ও হতে পারে। আজ নিজের সাথে হওয়ার পর হতবিহ্বল হয়ে গেলো নবনী।মনে হলো তার মতো অসহায় আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়।

পরের দুই দিন স্বাভাবিকভাবেই কাটলো। কিন্তু দুদিন পর মেম্বার এলো নবনীদের বাড়িতে। নবনীকে তার ছেলের বউ করে নেয়ার জন্য। সোজাভাবে হাশেম আলীকে ধমকে বললো,”আমার পোলার গালে থাপ্পড় দিছে তোর মাইয়া।আমার ভাগিনার চোখে সমস্যা দেখা দিছে তোর মাইয়ার জন্য,ও এখনো হাসপাতালে। তোর এই মাইয়ারে আমার পোলার বউ কইরা নিমু আমি।কতো তেজ আছে সব বের করমু তার পরে।আমি সুলেমান মেম্বার এক কথার মানুষ। ”

গ্রামের সবাই জানে সুলেমান মেম্বার কতো নিকৃষ্ট লোক।তার ভয়ে কেউ তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে দাঁড়ায় না।সবাই তাকে ভয় পায়।এলাকার চেয়ারম্যান ও তাকে সমঝে চলে। তার নজর যখন পড়েছে তখন আর রক্ষা নেই।তার ছেলে সুমন এলাকা গাঁজার ব্যবসায় করে সবাই জানে।

নবনী বুঝতে পারলো তার মাথায় কতোবড় বিপদ ঝুলে আছে। সেই রাতেই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো গ্রামে আর থাকবে না।নবনীকে মেম্বারের হাত থেকে বাঁচাতে হলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে খুব শীঘ্রই।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

(কারেন্ট না থাকায় গল্প দিতে দেরি হলো।আর দয়া করে কেউ ছোট বলে রাগ করবেন না।রেগুলার গল্প দিতে একটু কষ্ট হয়।তবুও ছোট হলেও লিখছি আপনাদের জন্য)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here