এল এ ডেইস পর্ব – ১

0
1644

এল এ ডেইস
পর্ব – ১
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাড়িঘর, গাছপালা,গাড়ি,ফ্লাইওভার, রাস্তাঘাট সহ আর্কিটেক্টের মিনি মডেলের মতো দেখতে লাগছে গোটা শহরটিকে।পরন্ত বিকেলের সুপ্ত রোদে মুখরিত হয়ে রয়েছে শহরের কোণা কোণা।কিয়ৎ দূরে মস্ত প্রগাঢ় নীল রঙা জলরাশি রোদের আলোয় মেখে কমলাটে রঙ ধারণ করেছে। দেখতে দেখতে বিমান অগ্রসর হচ্ছে লস এঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে। মিনিট খানেক হতেই দেখা গেল মস্ত বৃহৎ এক চতুর্ভুজ আকৃতির ভূমি। খন্ডে খন্ডে বিভক্ত প্রতিটা অংশ। মাঝের একটি অংশে দেখা গেল কতগুলো গুঁড়ি গুঁড়ি গাড়ি। দুপাশের মস্ত ময়দান গুলোয় অসংখ্য বিমান স্থবির দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার কতগুলো রানওয়ে ধরে ছুটতে ছুটতে উড়াল দিচ্ছে আকাশপথে। আবার কতগুলো নেমে আসছে মাটিতে।
কিছুক্ষণ পূর্বেই দেখা মিলছিল ক্যালিফোর্নিয়ার নজর কারা সব পর্বত সারির। সাদা মেঘ রাশি ভেদ করে গাড়ো সবুজ পাহাড় গুলো দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। কিছুক্ষণ পূর্বে আরোও দেখা মিলেছিল সমতল ভূমির ওপর লস এঞ্জেলস শহরের মাঝে এক গুচ্ছ সুউচ্চ দালান পাশাপাশি ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে কিছুটা দূরে সবুজ পর্বত সারি। সেই লস এঞ্জেলসের বিখ্যাত উঁচু দালান গুলোকে মুগ্ধ চোখে দেখছে মাহীন। বিমানের পাইলট স্পিকারে ল্যান্ড করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে নাইম পুনঃরায় ছটফট করতে আরম্ভ করল। উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগল,
“মা এবার প্লেন ক্রাস করবে! মা আমি হার্ট এটাক করবো! বাম পাশে বসে চরম বিরক্ত হচ্ছে মাহীন। জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে বাইরের নজর কারা দৃশ্য মনোযোগ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তবে নাইমের অস্থিরতায় বিঘ্ন ঘটছে বারংবার। মিসেস নাসরিন সান্তনার স্বরে বললেন,
” কিছু হবে না বাবা। দোয়া দরুদ পরতে থাক।” বিমান এখন নিচের দিকে মাথা ঘুরিয়েছে। মাহীনের মনে হলো যেন ও উন্মুক্ত আকাশে উড়ে যাচ্ছে। ও সামনের দিকে হেলে পরলেও ওর হৃদয় এবং শরীরে ভেতরের কলকব্জা পেছনের দিকে ঠেলে যেতে চাইছে। নাইম
পুনরায় একই স্বরে বলল,
“আহা মনে নেই গতবার কক্সবাজার যাওয়ার সময় আমাদের প্লেনটার চাকা খুলছিল না। এবারও এমন কিছু হলে?” ওরা তিনজন মা ছেলে মেয়ে ডান পাশের তিনটি আসন বিশিষ্ট সারিতে বসেছে। মাহীন অবশেষে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,
“ওই ঘটনা গতবারের না ভাই। ওটা তিন বছর আগের কথা। যখনই প্লেন চরবো ওই একই ঘটনার কথা টেনে আনতে হবে?”
“আরেহ দেখ… ওর কথার মাঝখান দিয়ে বিমান ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। নাইম চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। দরদর করে ঘামছে ও। মাহীন ও মিসেস নাসরিন নাইমের এইসব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে ভ্রক্ষেপহীন। প্রতিবার প্লেনে উঠলে এসব নাইমের চিরাচরিত কর্মকাণ্ড। নাইম বিড়বিড় করে কিছু বলছে। বিমান এবার নিচে নেমে এসেছে। মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। মুহুর্ত খানেক হতেই সজোরে ঝাঁকি খেলো বিমান। বিকট ঘড়ঘড় শব্দ হতে লাগলো, যখন বিমানের চাকা মাটি স্পর্শ করল। নাইম রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বাদে বিমান মাটিতে স্থির হয়ে দাঁড়াল। নাইম হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। মাহীন ও মিসেস নাসরিনও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

বিমানের প্রবেশদ্বার হতে সবুজ গ্লাসের লম্বা করিডোর ধরে যাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে এন্ট্রেন্সের দিকে। মাহীন নিজের মিনি ব্যাগপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে। এত লম্বা প্লেন জার্নির পর সকলের শরীরই বিশ্রামের জন্য হাহাকার করে। প্লেনের সেই ছোট আশনে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা।না যায় সোয়া, না শান্তিতে বসা যায়।’
নাইমের আধমরা অবস্থা প্রায়। বড় দুই পাল্লা বিশিষ্ট প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলো। সেখানে দরজার ওপর বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ” টম ব্র্যাডলি টার্মিনাল”। লস এঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হলো পৃথিবীর পঞ্চম ও ইউনাইটেড স্টেটসের দ্বিতীয় ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। এখানে মোট আটটি টার্মিনাল রয়েছে। ওরা আরেকটি সাইনবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে ডান দিকে ইঙ্গিত কারী অ্যরো দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘ব্যাগেজ ক্লেইম’। অর্থাৎ এখান থেকেই যাত্রীরা নিজের মালপত্র সংগ্রহ করবে। সেই করিডর ধরেই এগিয়ে গেল ওরা। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল এক মস্ত বিশাল হলরুম। হলের মাঝে একটি বড় ব্যাগেজ করোস্যাল রয়েছে। যা মালপত্র নিজের ওপর চাপিয়ে ধীর গতিতে বৃত্তাকারে ঘুরেই চলেছে। যার মালপত্র সামনে আসছে সে সেটা ততক্ষণাৎ সংগ্রহ করে নিচ্ছে। মাহীন ও মিসেস নাসরিন করোস্যালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। নাইমের বমি বমি ভাব লাগছিল বলে রেস্টরুমের দিকে গিয়েছে।
ওদের লাগেজ গুলো ধীর গতিতে যখন সামনে থেকে যাচ্ছিল তখন ওরা সেগুলো আঁকড়ে ধরলো। এবং করোস্যাল হতে নামিয়ে আনলো। এরপর লাগেজ ট্রলি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নাইমও এসে যোগ দিল বোন এবং মায়ের সাথে। এবার যেই বড় গেটের ওপর এক্সিট লেখা সেখান দিয়ে প্রস্থান করলো। বাইরে প্রচুর ভিড়। ভেতরেও কম ভিড় ছিলো না। যেহেতু এটা পৃথিবীর পঞ্চম ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট, কাজেই প্রতি মুহুর্তেই বিমান অবতারণ করছে আবার আকাশে উড়াল ভরছে। বাইরে ভিড়ের মধ্য থেকে মিস্টার মোর্শেদকে খুঁজে বের করতেই অতিবাহিত হলো প্রায় ছয় সাত মিনিট। এর মাঝে সাদা, কালো, শ্যামলা চামরার কত দেশের কত ধরনের মানুষকে ব্যস্ত পায়ে সামনে দিয়ে চলাচল করতে দেখা গেল।মি.মোর্শেদ হাসি মুখে এগিয়ে এসে নাইমকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে মাহীনকে জড়িয়ে ধরলেন। ওদের চারজনের মুখেই হাসি। আনন্দের তীব্র অনুভূতি ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরে যেতে দিচ্ছে না। পুরো তিন বছর পর বাবার সাথে দেখা হচ্ছে বলে কথা। মিস্টার মোর্শেদ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। তবে কোনো চাকরিতেই মন থিতু হয়না তার। তাই শেষে ব্যবসায় নামলেন। তবে বাংলাদেশে বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলেন না। পরে পাঁচ বছর পূর্বে পুনরায় ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসেন। এখানেই ব্যবসা শুরু করেন। তবে নিজের বাড়ি কেনার মতো অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত পরিবারকে এখানে আনেননি। মাহীন ওর বাবার হাত শক্ত করে ধরে হেঁটে চলেছে বাইরের দিকে। ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেশ যেন ওঠে না। মনে মনে ভাবছে, ‘অবশেষে আমার স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। এ যেন এখনো অবিশ্বাস্য। এই স্বপ্ন যেন ঘুমের মাঝে আগমন ঘটা সেই স্বপ্ন যা ঘুম ভাঙলেই ভেঙে যাবে। আমাদের নিজের বাড়িতে থাকবো এবার। এতদিন পর এখন থেকে আমরা সম্পূর্ণ পরিবার একসাথে থাকবো ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।’এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই দেখা গেল সামনে একটা নীল রঙের নজরকাঁড়া গাড়ি। মাহীন মুদ্ধ দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল গাড়িটির আগাগোড়া। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“বাহ বাবা তুমি ক্যাডিলাক সেডান কিনেছ?”
ওর কথা সমাপ্ত হতে না হতেই নাইম ঈষৎ হেসে বলল,
“দাঁড়াও আমি বলছি। এটা ক্যাডিলাক সেডান CT4 – V মডেলের গাড়ি।” মিস্টার মোর্শেদ শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন,
“বাপরে বাপ জানতাম না তো গাড়ি সম্বন্ধে এত ভালো ধারণা তোর। এক দেখায় মডেল বলে দিলি।” নাইম এবার লাজুক হাসলো। আরোও কিছু বলতো হয়তো তার পূর্বেই মিসেস নাসরিন হেসে বললেন,
“সারাদিন গাড়ি নিয়ে পরে থাকলে তো হবেই এমন।” মাহীন ফিচেল হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো,
“মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ভাইয়া গাড়িকেই বিয়ে করে ফেলবে বুঝি।” নাইম ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে চাইল। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ শব্দ করে হেসে উঠলেন। তারপর ওরা গাড়িতে চরে বসলো।
মিস্টার মোর্শেদ গাড়ি স্টার্ট দিলেন। ফ্রন্ট সিটে বসে আছেন মিসেস নাসরিন। ব্যাক সিটে নাইম ও মাহীন। মাহীনের দৃষ্টি জানালার বাইরে নিবদ্ধ। আধুনিক ধাঁচের দোকান পাট পেরিয়ে সা সা করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ পর পর চোখে ধরা দিচ্ছে তাল গাছ। গোটা ক্যালিফোর্নিয়া জুরে অসংখ্য তাল গাছের বিস্তার। তাল গাছ গুলো ছাড়া হয়তো ক্যালিফোর্নিয়া অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। ঘড়ির কাটা সাতটা ছুঁই ছুঁই করছে। এখনো সূর্যের ক্লান্তি আসেনি। সে এখনো বহালতবিয়তে দিপ্তি ছড়িয়ে চলেছে। ঢাকা থেকে লস এঞ্জেলস পর্যন্ত আসতে বাইশ ঘন্টা লেগেছে। মাঝের কানেক্টিং এয়ারপোর্ট ছিল টার্কিশ এয়ারলাইনস। নীল ক্যাডিলাক সেডান ছুটে চলেছে স্যান্টা মনিকার দিকে। আবারও জানাল দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেরাল। তবে এবার কোনো দৃশ্যাবলি দেখার সুযোগ হলো না। ওদের গাড়ি মাঝ রাস্তায় জামের মধ্যে পরেছে। মিসেস নাসরিন ক্লান্ত স্বরে বললেন,
‘ঢাকার জামের কথা তো আর বলার মতো না।’ এখানেও তাই বলে এত জাম?”
মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
‘তা বৈকি। লস এঞ্জেলসের জাম ঢাকার জাম থেকে কিছু কম নয়। তারওপর এখন রাশ আওয়ার। এইসময় প্রচন্ড জাম থাকে রাস্তায়।’
মাহীন কিছুক্ষণ জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘বাবা ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের স্লোহগান কী ‘ইউরেকা’?’
মি.মোর্শেদ বললেন,
‘হ্যা।’
‘কিন্তু ইউরেকা মানে কী?’ জিজ্ঞেস করল নাইম।
মি.মোর্শেদ বললেন,
‘কোনো কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দটাকেই ইউরেকা বলে। এবং এটা ক্যালিফোর্নিয়ার স্লোগান হওয়ার কারণ, যখন এখানে গোল্ডরাশ হয়েছিল সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর মানুষ ছুটে এসেছিল সোনার খোঁজে। এবং সেই সম্পদ এখানে এসেই খুঁজে পাওয়ার আনন্দকে ইউরেকা বলে প্রকাশ করা হয়।’
মাহীন ও নাইম সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
এরপর মাহীন ক্লান্তিতে বড় দেখে একটা হাই তুলে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে রইলো।
নাইম জিজ্ঞেস করলো,
‘আমাদের বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া কত দূর হবে?’
‘এই ধর চৌদ্দ পনেরো মিনিট।’
নাইম অবাক কন্ঠে বলল,
‘তুমি আমার সাথে মজা করছো? তাই বলে এতটা কাছে?’
মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
“হ্যা। তুই প্রথম দুই তিন দিন আশপাশে ঘুরে বেরিয়ে দেখ সবকিছুই কাছাকাছি। এমনকি বেভার্লি হিলস ও হলিউড ও এখান থেকে ত্রিশ পয়ত্রিশ মিনিট দূরে।” নাইমের মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ লেগে আছে। দেখতে দেখতে ওরা স্যান্টা মনিকায় চলে এসেছে। মন্টানা এভেনিইউ এ এসে থামল গাড়ি। মাহীন ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে নাইম বলল,
‘মা মাহীন কে এখানেই রেখে গেলে হয় না? ঘরে এসে ঝামেলা করবে।’ মিসেস নাসরিন ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
‘ফাজলামো করিস না। চুপচাপ ওকে ওঠা।’
নাইম বাধ্য ছেলের মতো মাথা উপরে নিচে ঝাঁকাল। তারপর ওর মাথায় আগমন ঘটলো এক দুষ্টুমি বুদ্ধির। মুহুর্তেই মাহীনকে ঘুম থেকে উঠানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরল নাইম। সাবধানে মাহীনের কানের কাছে মুখে নিয়ে গিয়ে জোড়ে চিৎকার দিল নাইম। মাহীন চমকে উঠে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে গাড়ির সিলিংয়ের সঙ্গে মাথায় বাড়ি খেলো। তারপর মাথা চেপে ধরে মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। এবং এবার সিটে এমন ভাবে হেলে পরলো যেন ওর জ্ঞান নেই। নাইম হাসছে। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ দুজনেই গাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মিস্টার মোর্শেদ ডিকি থেকে মালপত্র বের করতে ব্যস্ত ছিলেন। ছেলের চিৎকার শুনে ছুটে এসে দরজা খুললেন। মিসেস নাসরিনও অপর দিকের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মি.মোর্শেদ বললেন,
‘কার কি হয়েছে?’
মিসেস নাসরিন বললেন,
“কি সমস্যা তোর?চিৎকার করছিস কেন? আর ও এখনো ঘুম থেকে উঠেনি কেন?”
মিস্টার মোর্শেদ মাহীনের বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন,
‘মা ওঠ, আমরা বাড়ি চলে এসেছি।’
কিন্তু মাহীনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। নাইম এবার কিছুটা ভিত সন্ত্রস্ত হয়ে পরলো। মিসেস নাসরিন বললেন,
‘কি হলো ও উঠছে না কেন? আই নাইম তুই কি করেছিস?’
নাইম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘মানে আসলে ওকে উঠানোর জন্যেই আমি চিৎকার করেছিলাম।’
মিস্টার মোর্শেদ বললেন,
“তারপরও উঠলো না।”
বলে আবার মাহীনের হাত ঝাঁকি দিলেন। এবারও মাহীন নিথর নিশ্চুপ পরে রইলো। নাইমের কপালে চিন্তার ভাজ পরেছে। সে উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
“এবং আমার চিৎকার শুনে ও চমকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথায় বারি খেয়েছে। এবং বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে।”
ওর কথা শেষ হওয়া মাত্র মিসেস নাসরিন নাইমের কান মোচড়ে ধরে গাড়ি থেকে বের করে আনলেন। এবং ঝাঁঝাল কন্ঠে বললেন,
“ফাজিল ছেলে একটা! তুই যে ওর বড় ভাই সেদিকে কোনো হুস আছে! এখন ওর মাথায় গুরুতর আঘাত লেগে থাকলে কি করবো আমরা?” মি.মোর্শেদ চিন্তিত স্বরে বললেন,
“নাসরিন শান্ত হও। আমি মাহীন কে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছি। তারপর দেখি কি হয়েছে।”
বলেই সাবধানে মাহীনকে পাঁজা কোল করে তুলে নিলেন। এবং সামনের বাগান পেরিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মি.মোর্শেদের ইশারায় নাইম ছুটে গিয়ে তার পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুললো, এবং উনি মাহীনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ওদের নতুন বাড়ি স্প্যনিশ ধাঁচের। কনক্রিটের টালি দেওয়া কমলা রঙের ডরমার ধাঁচের ছাদ। সামনে দিকের দ্বিতীয় তলার পাশাপাশি দুটো জানালার উইন্ডোশীল থেকে পেতুনিয়া ফুলের ঝাড় ঝুলে রয়েছে। সামনেই বড় বাগান। এবং দরজার পোর্চের সামনাসামনি একটা বড় স্যাকামোর গাছ। মিসেস নাসরিনও লাগেজ বাইরে ফেলে রেখেই ভেতরে ছুটে গিয়েছেন। মাহীনকে দ্বিতীয় তলায় ওর জন্য নির্ধারিত কামরায় নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন মি. মোর্শেদ। নাইম তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে পৌঁছে ফ্রিজ হাতড়িয়ে আইস ব্যাগ নিয়ে আসল। তারপর ধুপধাপ পা ফেলে আবার কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে গেল। মাহীনের কামরায় গিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিলো বরফে ভরা নীল রঙের ব্যাগটা। মিসেস নাসরিন মাহীনের পাশে বসেছেন। চুল সরিয়ে মাথার উপরি ভাগে ব্যাগটা ধরে রাখলেন। মি.মোর্শেদ শান্ত কন্ঠে বললেন,
“মাথায় বারি লাগার কারণে বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে। চিন্তা করোনা তাড়াতাড়ি জ্ঞান এসে পরবে। তবুও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য আগামীকাল ওর এডমিশনের পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো ওকে।”
মিসেস নাসরিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
“তাই ভালো হবে। ইশ মেয়েটা কি ক্লান্ত, খাওয়া দাওয়াও হয়নি এখনো।” তারপর নাইমের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কঠোর গলায় বললেন,
“আর তুই। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠলি এবার অথচ একটুও জ্ঞান বুদ্ধি হলো না। তোর জন্য মেয়েটার গুরুতর কিছু হয়ে গেলে কি হতো! কবে বড় হবি তুই? তোর থেকে মাহীনও যথেষ্ট ম্যাচিউর।”
মিস্টার মোর্শেদ বললেন,
“আহা নাসরিন এখন এসব বাদ দাও না। পরে যা করার করো। তোমরা দুইজনও লম্বা পথ জার্নি করে এসেছ। তোমাদেরও বিশ্রামের প্রয়োজন। যাই আমি লাগেজগুলো গাড়ি থেকে বের করে আনি।” বলেই উনি কামরা হতে বেরিয়ে যেতে যেতে আবার থেমে গেলেন। পেছনে ঘুরে বললেন,
” আমি বাইরে থেকে খাবার এনে রেখেছি। তোমার কোনো কষ্ট করা লাগবে না।” বলেই উনি এবার প্রস্থান করলেন। মিসেস নাসরিন উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন,
“আমি নিচে যাচ্ছি খাবারগুলো বের করতে। এবং তোকে পরে দেখে নেব।”
নাইম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিসেস নাসরিন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে কঠোর গলায় বললেন,
“আর ভুলেও যদি দ্বিতীয়বার ওকে বিরক্ত করেছিস তাহলে শাস্তি কাকে বলে তুই দেখবি।” বলেই উনি চলে গেলেন।
নাইম এবার হাফ ছেড়ে বাঁচল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে মাহীনের বিছানার একপাশে বসে পরলো। তারপর মাহীনের দিকে স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ম্লান কন্ঠে বলল,
” আমি এতটাও খারাপ ভাই নই বোন। তোকে তো শুধু চমকে দিতে চেয়েছিলাম। সেখানে আমি নিজেই চমকে গেলাম। মা কি বলল, সেসব নিয়ে আমার চিন্তা নেই। আমার চিন্তা তোর কিছু হয়ে গেল কিনা সেটা নিয়ে।”‘ বলে মাথা নত করে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কেউ শব্দ করে হেসে উঠলো। নাইম হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দেখে মাহীনের ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি লেগে রয়েছে। এবং ও ড্যাব ড্যাব চোখে নাইমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নাইম হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। মাহীন মাথার কাছ থেকে আইস ব্যাগটা সরিয়ে রেখে দু’হাতে বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসলো। তারপর বলল,
“কি গো ভাইয়া, চরম ছ্যাকা খেলি দেখছি?”
মাহীনের কথাগুলো নাইমের মস্তিষ্কের কোষে গিয়ে পৌঁছতে কিছুটা সময় নিল। ব্যপারটা বুঝে উঠতেই নাইমের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। তারপর অবাক কন্ঠে বললো,
“তারমানে তুই জ্ঞান হারাইস নি? এইসব নাটক ছিলো?” মাহীন বাঁকা হেসে বলল,
“তো আর কি? আমি কি কোনো দুর্বল কচু পাতা এতটুকু বারিতেই বেহুস হয়ে যাবো? আর হ্যা আমার অ্যক্টিং স্কিলস কিন্তু গোল্ডেন গ্লোব পাওয়ার যোগ্য।”
নাইম এবার ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো,
“তুই কচু পাতা কেন হতে যাবি,তুই তো নিজেই আস্ত একটা কচু। আর তোর অ্যক্টিং, পুরাই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। মঞ্চ নাটকই করতে পারবি কিনা না সন্দেহ আবার গোল্ডেন গ্লোব। কেন করলি এসব?”
মাহীন এবার একই রকম বাঁকা হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে বলল,
“বাহ রে তুই আমার ঘুমের মধ্যে কানের কাছে চিৎকার চেচামেচি করবি। তোর জন্য আমার মাথায় বারি লাগবে আর আমি প্রতিশোধ নিবো না? তোর কি মনে হয় তুই যেমন ভাবে ইচ্ছা আমাকে বিরক্ত করবি আর আমি কচি খুকির মতো সব সহ্য করবো? নাহ, আমার সাথে ঝামেলা করতে আসলে তোকে তোর মস্ত বড় কচু পাতা হওয়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দেব।”
নাইম প্রতুত্তরে মুখ খুলতেই যাচ্ছিল তখনই নিচ থেকে ভেসে আসলো মিসেস নাসরিনের কন্ঠস্বর। তিনি নাইমকে ডাকছেন। নাইম তিক্ত স্বরে বলল,
“তোর সাথে আমি পরে বোঝাপড়া করবো”।
বলে কারমা হতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। মাহীন আবারও আপন মনে হেসে উঠলো। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর কামরাটা বেশ বড়। ছোট একটা টেবিলের ওপর ওর হ্যামস্টারের খাঁচাটা রাখা আছে।বিছানার ডানদিকে বড় জানালা। জানালায় বসার জন্য রয়েছে উইন্ডোশীল। স্লাইডিং গ্লাসটা খোলাই ছিলো। মাহীন উইন্ডোশীলে পা উঠিয়ে বসলো এবং জানালার বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সামনেই বাগানে থাকা স্যাকামোর গাছের বিস্তর প্রসারিত ডালপালা চোখে ধরা দিল। সামনে বাগান পেরিয়ে রাস্তা। রাস্তার অপর পারেও সারি সারি বাড়ি। এদিকের সব বাড়িই স্প্যানিশ ধাচের। তবে প্রতিটা বাড়ি স্প্যানিশ ধাচের হলেও নকশা ভিন্ন। ইতিহাস ঘাটলে হয়তো দেখা যাবে এই জায়গা কোনো কালে স্প্যানিশ কলোনি ছিল। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু একই সমান বাড়িঘর ও দোকানপাট। দূর আকাশে সবেমাত্র ক্লান্ত সূর্য তার কিরণ ছড়ানোর কাজে ক্ষান্ত দিয়ে পৃথিবীর বুকে ডুবে যাওয়ার পায়তারা করছে। মাহীন অবাক হয়ে ভাবলো, ‘কি আশ্চর্য একদিন পূর্বে আমি ছিলাম পৃথিবীর আরেক গোলার্ধের, বাংলাদেশে। আজ আমি সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ইউএসএ তে। এবং একই পৃথিবী হওয়া সত্ত্বেও এখানে যখন মাত্র সন্ধ্যা নামছে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ভোর হচ্ছে। ওহ হ্যা এক কথায় বলা যায় ক্লান্ত সূর্য এখান থেকে বিদায় নিয়ে আবার পূর্ণ উদ্যমে এশিয়ায় উদয় হবে। সর্বপ্রথম জাপানের মানুষ সেটা দেখতে পাবে।’ ভেবেই আনমনে মুচকি হাসলো মাহীন।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here