#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১৩
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন
“না না না না না, মিসেস রে। আমি এবার কিছুতেই যাবো না। আপনারা আমাকে কি পেয়েছেনটা কি বলুন তো? প্রতিবার সব আমার ওপরই কেন চাপিয়ে দেন? পার্টনারদের ফোন করতে হবে তো আরেকবার মনিটর বলে ছাত্রের বাড়িতে অভিযোগ পত্র পাঠাতে হবে। আমি পারব না এসব করতে!”
শীতল কন্ঠে বলল মাহীন। মিসেস রেয়ের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। আশেপাশে আর কেউ নেই। অতি দরকার না হলে মিসেস রেয়ের কাউন্টারের ত্রিসীমায় কারোও ছায়াও চোখে পরে কদাচিৎ। মিসেস রে কাউন্টারের অপর পাশ হতে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“দেখো মাহীন আমি মোটেও সব কিছু তোমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না। লিমকে তো ওর অনারেবল পেপার আমিই দিয়েছি। আর রায়েদ ফোন তুলছে না বলেই তোমাকে বলছি।”
মাহীন তিক্ত কন্ঠে বলল, “ওহ তাই। আর আমার কি দায় পরেছে যে আমি সেখানে যাবো? ঠিক আছে বুঝলাম রায়েদ ফোন ধরছে না। তো কি হয়েছে। আপনি যান। মনিটরকে পাঠান। আমাকেই কেন যেতে হবে? মানে আমাকেই প্রতিবার হ্যাংলার মতো ওখানে যেতে হবে? রায়েদ নিজে থেকে কয়বার এসেছে আমার সাথে কথা বলতে?”
হঠাৎ করেই মাহীনের মধ্যে এক গাদা সাহস এসে জমা হয়েছে। মিসেস রেয়েকেও আর ভয় লাগছে না। বরং এই মহিলার সাথে আজ একটা বিহিত না করলেই নয়।
মিসেস রে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি যেতে পারব না। আর ডেক্সটারও কোথায় গিয়ে ডুবে মরসে ওই জানে। আর দেখো ডিয়ার তুমি তো অন্যদের মতো না। আজ কত বছর পর কেউ আবার ওর সাথে পার্টনার হিসেবে কাজ করল। এবং এত ভালো একটা পজিশনে আসল।”
মাহীন তীব্র কন্ঠে বলল, “দেখেন আমি অবশ্যই অন্যদের মতো না। এজন্যেই হয়তো ওর সাথে কাজ করেছি। শুধু নিজে নয় লিম জুকে দিয়েও কাজ করিয়েছি। কিন্তু আমার ওর পিছে লেগে থেকে কি লাভ? আর এটা ওর অনারেবল পেপার। সুতরাং এটা ও পেলো কি পেলো না সেটা ওর মাথা ব্যাথা। আমার নয়।”
মিসেস রে আবার কিছু বলার পূর্বেই মাহীন চোখ সরু করে চাইল ওনার দিকে। তারপর সন্দেহ জড়ানো কন্ঠে বললো, “আপনার মতলবটা কি বলুন তো? কি চান টা কি আপনি? আমি ওখানে গেলে কি হবে? আমার পেছনে লেগে আছেন কেন? পরিষ্কার করে বলুন।”
মিসেস রে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন,”ঠিক আছে শোনো। রায়েদকে কি তোমার খারাপ মনে হয়েছে?”
“না”। এক মুহূর্ত দেরি না করেই বলল মাহীন।
“অবশ্যই না। ও তেমন না যেমনটা ও দেখায়। আমি ওকে এগারো বছর ধরে চিনি। এবং সবসময় ওর ভালো চাই। তুমি জানো আমি ওকে কতদিন হাসতে দেখি না। সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সবকিছু! ওর কোনো বন্ধু নেই এটাও তুমি জানো নিশ্চয়ই। কিন্তু একসময় ছিলো। তাদের সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন আর কেউ নেই। কিন্তু ওর সত্যিই দরকার। এবং আমি এতদিন অন্য কেউ যেন ওকে খোঁচাতে না যায় সেদিকে কড়া নজর রাখতাম। কারণ অন্যরা সেভাবে ব্যাপারটাকে নিজের মধ্যে রাখতে পারে না যেভাবে তুমি রাখো। কিন্তু কেউ এমন একজন যদি ওর বন্ধু হয় যে ওকে বুঝবে এবং ওকে ওর মতোই থাকবে দেবে। ওকে খোঁচাবে না এমন কাউকেই তো প্রয়োজন। এবং সেটাই তোমার মধ্যে দেখতে পেয়েছি এই কয়দিনে। হয়তো তুমি ওর বন্ধু হতে পারলে ও ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নিজেকে হয়তো সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখবে না। আড়াল করে রাখবে না। যদিও এর জন্য প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন। একটা মানুষকে বিশ্বাস করে তার সাথে ফ্রি হতে ওর অনেক সময় লাগবে কিন্তু তা অসম্ভব নয়।”
মাহীন হা করে চেয়ে আছ। স্তব্ধ হয়ে গেছে। কথাগুলো হঠাৎ ওর মনের ভেতরে সেই অন্যরকম অচেনা অনুভূতিগুলোকে নাড়া দিয়ে গেল যেন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল,
“ওর সাথে আসলে হয়েছেটা কি? আমাকে নিয়ে যখন এত আশা আপনার তখন এতটুকু কি আমার জানার অধিকার নেই?”
মিসেস রে ইতস্তত করে বললেন, “আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি বলতে পারবো না। মাফ করো। রায়েদ তোমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতে পারলে তো ও নিজে থেকেই বলবে। আমার তোমার ওপর আস্থা আছে।”
“আচ্ছা অন্তত এটা বলুন আপনি সেদিন রাতে আমাকে কেন বলেছিলেন ওকে ফোন করতে? যেখানে আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ওকে ফোন করলে ও কতটা বিরক্ত হয়।”
“আমি জানি। তখন দরকার পরেছিলো বলেই বলেছিলাম। এমনিতে স্কুলে থাকা অবস্থায় ওকে ফোন করলে ও তেমন একটা কিছু মনে করে না। কিন্তু অন্য সময় ওকে কখনো ফোন দিও না।”
মাহীন সায় জানিয়ে আলতোভাবে মাথা ঝাকাল। মিসেস রে জিজ্ঞেস করলেন, “তো তুমি যাচ্ছো?”
মাহীন নিশ্চুপ রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। কিন্তু এরপর আর কখনো কোনো কিছুর জন্য কিন্তু ওইখানে যাবো না আমি। যদি না ও নিজে আমার সাথে কথা বলতে আসে। এই আপনাকে বলে রাখলাম।”
মিসেস রে মুচকি হেসে বললেন,”আমার মনে থাকবে।”
মাহীন অনারেবল পেপারটা নিয়ে গোমড়া মুখে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। এখান থেকে সোজা লাইব্রেরিতে গেল। সকাল বেলা হলেও খুব অদ্ভুত ভাবে এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে। মাহীন লাইব্রেরি তে পৌঁছে সরাসরি না গিয়ে সেলফের গলি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সেলফ ঠাসা বইগুলো দাঁড়িয়ে শুধু দেখতেও ভালো লাগে। মাহীন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কোণার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু সেলফের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বেই দুটো কন্ঠস্বর শুনতে পেল। ফলে থমকে দাঁড়ালো ও। দুটো ছেলের কন্ঠ। একজন তো অবশ্যই রায়েদ এবং অপর জনের কন্ঠটা চেনা চেনা লাগলেও ধরতে পারল না মাহীন। হয়তো বুঝতে পারতো যদি তারা ইংলিশে কথা বলতো। কিন্তু ওরা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলছে। মাহীন সাবধানে সেলফের আড়াল থেকে উঁকি দিলো সেদিকে। দেখতে পেলো রায়েদ যথারীতি নিজের চেয়ারে বসে আছে এবং ওর পাশের চেয়ারে বসে আছে র্যবিট। মাহীন আবার ভেতরে এসে দাঁড়াল। ভাবতে লাগল, র্যবিট? মানে র্যবিট রায়েদের সঙ্গে কথা বলছে। তাও আবার টার্কিশ ভাষায়। রায়েদ আবার টার্কিশ পারে। ওহ হ্যা রায়েদ তো মুসলিম। তো এটা অসম্ভব নয় যে ও আসলে টার্কিশ। কিন্তু রায়েদ আর কারোও সাথে কথা বলে না সেখানে স্কুলের টপ ফাজিলের সঙ্গে কথা বলছে। তাও আবার দুজনই অন্য একটা ভাষা পারে।’ র্যবিট উচ্চস্বরে কিছু একটা বলে উঠতেই মাহীন চমকে উঠল। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে আবার উঁকি দিলো সেদিকে। র্যবিট কিছু একটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলছে এবং রায়েদের ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। মাহীন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ভাবতে লাগল, ওরে বাপরে সম্পর্ক তো মনে হয় খুব ভালো দুজনের। আজ পর্যন্ত আমার সামনেই হাসতে দেখলাম নাহ। মিসেস রে তো বললেন, রায়েদের কোনো বন্ধু নেই। তাহলে উনি কি র্যবিটের কথা জানেন না? যাই হোক উনি যেটা বললেন সেটা অবশ্য খুব একটা ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু এটা বলতে সমস্যা কি ছিলো যে রায়েদ এমন কেন? ঘটনা টা কি? তাছাড়া এখন বুঝলাম ওনার রায়েদের প্রতি এত সহানুভূতি কেন। উনি সবই জানেন ওর সম্পর্কে। আর রায়েদ যেমন বেশির ভাগ সময় অথবা সবসময় খিটমিটে মেজাজে থাকে তেমনি মিসেস রেও সবসময় তিরিক্ষ মেজাজে থাকেন। কিন্তু এখন এটা বুঝতে পারলাম যে মিসেস রেয়ের দুনিয়ার দয়া,স্নেহ, ভালোবাসা সব রায়েদের জন্য। আর আমি রায়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করি। অন্যদের মতো আচরণ করি না বলেই উনি আমাকেও পছন্দ করেন। এবং আমার কাছে দেখি ওনার অনেক আশা।’ হঠাৎ কাঠের চেয়ার নাড়াচাড়ার শব্দ ভেসে এলো ওপাশ থেকে। র্যবিট এতক্ষণে ইংলিশে বিদায় জানাল। ওর হেঁটে যাওয়ার পদশব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আরোও পাঁচ ছয় মিনিট মাহীন সেলফের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর এমন ভাবে বেরিয়ে আসল যেন ও মাত্র এসেছে। রায়েদ নিজের সেলফোন হাতে নিয়ে গম্ভীরমুখে বসেছিল। র্যবিট চলে যেতেই মুখে গম্ভীরতা টেনে নিয়েছে যেন। মাহীন অনারেবল পেপারটা টেবিলের ওপর রাখল। মনে মনে ভাবল, আচ্ছা মুশকিল তো। রায়েদকে দেখলেই স্নায়ুর ওপর এতো চাপ পরে কেন? এত অদ্ভুত লাগে কেন? আবার ওর আশেপাশে থাকলে ভালোও লাগে।’
রায়েদ এদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, “ওহ থ্যান্কস্।”
মাহীন মুখভঙ্গি ভাবলেশহীন রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
“প্লেজার”।
বলেই মাহীন চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই রায়েদ বলল,” কি ব্যাপার আজকে কি তোমার মুড অফ? কোনো কথা না বলেই চলে যাচ্ছো যে?”
মাহীনের হৃদপিণ্ডে হৈচৈ পরে গেল। আরোও বেশি অস্বস্তি হতে লাগল। আবার ঘুরে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল,”তোমার কিছু বলার থাকলে বলো।”
“নাহ আমার কি বলার থাকবে। এখানে এসে কখনো কথা না বলে চলে যেতে দেখিনি তাই বললাম আরকি।”
মাহীন টেবিলের ওপর হাতের তালু ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। হাতটা সরাতেই একটা পেন্সিল নিচে পরল। মাহীন বলল, “ওহ না। আমি তুলে দিচ্ছি।” বলে নিচে ঝুঁকল।
রায়েদ তড়িঘড়ি বলল,”এই না দরকার নেই।”
কিন্তু মাহীন পেন্সিলটা খুঁজবে কি তার বদলে চোখে পরল রায়েদ ওর জুতা খুলে রেখে পা দুটো টেবিলের কাঠের তক্তার ওপর তুলে রেখেছে। এবং ওর ডান পায়ের পাতার পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে। যেন কোনো ধারাল বস্তু দ্বারা বেশ গভীরভাবে আঘাতটা বসেছে। এবং দেখে মনে হলো না কোনো ঔষধ লাগানো হয়েছে। খুব অযত্নের সঙ্গে শুধু রক্তটা মুছে ফেলা হয়েছে। বাকি রক্তটুকু শুঁকিয়ে গিয়েছে। এ দৃশ্য দেখে খারাপ লাগা থেকে মনকে সংযত রাখতে পারল না মাহীন। রায়েদ মূহুর্তেই ওর পা নামিয়ে ফেললো এবং জুতা পরতে ব্যস্ত হলো। বলল,
“পেন্সিল খুঁজতে গিয়েছো না গুপ্তধন? এত সময় নিয়ে কী করছ। খোঁজার দরকার নেই।”
মাহীন তাড়াহুড়ো করে টেবিলের নিচে থাকা অবস্থায় উঠতে গিয়ে মাথায় বারি খেলো। রায়েদ উৎকন্ঠিত গলায় বলল,
“ইয়া আল্লাহ! তুমি কি করছোটা কি?”
মাথার যেখানে লেগেছে সেখানে হাত দিয়ে হালকা মালিশ করে মাহীন উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে ফার্স্টএইড বক্স বের করল। হাতে থাকা সেল ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। এরপর টেবিলের অপর পাশে রায়েদের চেয়ারের সামনে এসে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর ফার্স্টএইড বক্সটা খুলে তুলা ও সেলাইন সলিউশন বের করল। মনের মধ্যে উদ্বিগ্নতার দারুন উদ্রেক ঘটল মাহীনের। রায়েদ ভারি কন্ঠে বলল,
“দেখো মাহীন এসব করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার পা যেমন আছে ঠিক আছে।”
মাহীন কোনো কথা বলছে না। রায়েদ ফট করে উঠে দাঁড়াতে যেতেই মাহীন কঠিন স্বরে বলল,”খবরদার উঠবে না! তুমি নিজেকে ভাবোটা কি হ্যা? কোনো ঔষধ ছাড়াই তোমার আঘাত ঠিক হয়ে যাবে? যেন তোমার কোনো বিশেষ শক্তি রয়েছে। তা তো হবে না, হবে ইনফেকশন।”
হঠাৎ করেই মাহীনের বড্ড রাগ হলো। কেনো হলো তা ও নিজেও বলতে পারবে না। রায়েদ উঠতে গিয়েও উঠলো না। বাধ্য ছেলের মতো বসেই রইল। মাহীনের এরূপ আচরণে রাগ হলো না। বিরক্তও হলো না। বরং অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি তিরতির করে মনের আঙ্গিনায় ছড়িয়ে যেতে লাগল। মাহীন রায়েদের পায়ের পাতা শক্ত করে ধরে সেখানে সলিউশনটা ছোঁয়াল। রায়েদ নড়ে উঠলো।
মাহীন জিজ্ঞেস করল,”ব্যাথা লাগছে?”
রায়েদ ইতস্তত করে বলল, “না”।
“তাহলে নড়ছো কেন?”
“আমার..কাতুকুতু লাগে।” মিনমিন করে বলল রায়েদ।
মাহীনের হাসি পেল। কিন্তু ও হাসি চেপে গিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি বজায় রাখল। শুঁকিয়ে যাওয়া রক্তগুলো পরিষ্কার প্রায় হয়ে এসেছে। রায়েদ এমন সময় জিজ্ঞেস করল,
“তুমি জানো সকলে আমাকে কোন চোখে দেখে?”
এই একটি মাত্র কথা মাহীনের মনে নাড়া দিলো। রায়েদের কন্ঠে অন্যরকম কিছু ছিলো বোধহয়। হৃদয় এলোমেলো ভাবে চলতে শুরু করেছে। ওর পায়ের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই গাঢ় কন্ঠে বলল,
“জানি। তাতে কি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে?”
“তাতে কি কোনো পার্থক্য হয়েছে?”
মাহীন এবার মাথা উপরে তুলে রায়েদের দিকে চাইল। বলল, “দৃষ্টিভঙ্গি চাইলেই বদলানো যায়। সকলে যেভাবে তোমাকে দেখতে চায় সেভাবেই দেখে। কিন্তু আমি অন্য সকলের মতো করে দেখতে চাই না।”
“তাহলে তুমি আমাকে ভালো মনে করো?”
“না করার কোনো কারণ আছে?”
“ঠিক আছে নাহয় তাই মনে করো। কিন্তু তবুও আমি তো আর বদলে যাইনি। এতে তো কোনো পার্থক্য হলো না। হয়েছে?”
মাহীন হালকা ভাবে বাঁকা হাসল। বলল, “কি পার্থক্য জিজ্ঞেস করছ? তাহলে শোনো। অন্য যারা তোমাকে খারাপ মনে করে, এড়িয়ে চলে। তারা হঠাৎ করে তোমার কাটা স্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিতে চাইলে, তুমি দিতে?”
রায়েদ নিশ্চুপ রইল। তারপর মৃদুভাবে না সূচক মাথা ঝাকাল।
মাহীন বলল, “এটাই পার্থক্য যে আমাকে কেন দিলে তা একটু ভেবে দেখ।”
বলে আবার দৃষ্টি নিচে ফিরিয়ে বক্স থেকে নিওস্পোরিন বের করল। এবং কাটা স্থানে লাগাতে ব্যস্ত হলো। রায়েদ আর কিছু বললো না। মনের মধ্যে গভীর উথাল-পাথাল। সবসময় গুছিয়ে চিন্তা ভাবনা করে ও। সেটাও কেমন ভাবে এলোমেলো হয়ে গেলো নিমিষেই। হঠাৎ মনে হলো, নাহ মাহীনকে আমি কেনোই বা আমার এত কাছে চলে আসার অনুমতি দিলাম? কী আছে ওর মধ্যে? কত দিন পর কেউ আমার জন্য কেয়ার করছে সেটার লোভই কী ছাড়তে পারলাম না? তবে শুধু এতেই এমন অদ্ভুত অনুভূতির কারণ কী? আগে যখন অন্যরাও আমার যত্ন করত তখনো ভালো লাগত। তবে এ ভালো লাগা এবং সে ভালো লাগার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ তীব্র ভালো লাগায় অস্থিরতা রয়েছে।’ মাহীন ওর পায়ে ঔষধ লাগানো শেষ করে ব্যান্ডএইড দিয়ে কভার করে দিলো কাটা স্থান। এরপর ফার্স্টএইড বক্সটা গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর গিয়ে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। রায়েদ বলল, “সেদিন লিম জুই তোমাকে ফোন করেছিলো তাই না?”
মাহীন ভ্রু কুঁচকে চাইল। বলল, “কোনদিন?”
“সেদিন যখন তুমি একটা আইসক্রিম রেখে গিয়েছিলা।এবং যাওয়ার একটা বাহানা খোঁজার জন্য লিম জুকে বলেছিলা কল দিতে তোমাকে। তাই নয় কি?”
মাহীন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়াল। তারপর আবার এদিকে ফিরে বলল, “আহ! কে বললো ও ফোন দিয়েছে। আর তোমার এমন কেনোই বা মনে হলো?”
রায়েদ বলল, “আমার যতদূর মনে হয় তোমার মোবাইলে যেই কলটা এসেছিলো সেটা লিম জু দিয়ে সেভ করা আছে। আমার অর্ধেকটা চোখে পরেছিলো।”
“আরেহ ওটা তো অন্য কিছুও হতে পারে। আর আমি কেনোই বা ওর ফোনের বাহানায় সেখান থেকে বের হবো? আর আইসক্রিমটা ভুলবশত ফেলে গিয়েছিলাম।”
মাহীনের সেল ফোনটা এখনো টেবিলের ওপরই রাখা আছে। রায়েদ সেটা ফট করে হাতে নিয়ে বলল,
“সেদিনের কল লিস্ট দেখলেও বোঝা যাবে।”
মাহীন বাঁকা হেসে বলল, “দেখতে পারলে দেখো।”
রায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাহীনের সেল ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখল। কিছুক্ষণ পর মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“আরেহ আমার ফোন তো লক করা। তুমি করছোটা কী?”
রায়েদ নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল, “দশ বার ভুল পাসওয়ার্ড দিলে ফোন পার্মানেন্টলি লক হয়ে যায়। এইতো আটবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলাম। এখন…ওর কথার মাঝখান দিয়ে মাহীন উৎকন্ঠিত গলায় বলল,
“এই না! একদম আমার ফোন পার্মানেন্টলি লক হলে কিন্তু ভালো হবে না।”
বলে জানালার সামনে ছুটে গেল। কিন্তু রায়েদের হাত থেকে ফোনটা নেওয়ার পূর্বেই রায়েদ ফোন শুদ্ধ হাত জানালার বাইরে বের করে ধরল। মাহীন উদ্বিগ্নভাবে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আরেহ আমার ফোন পরে যাবে তো! এটা যদি কিছু হয় না তাহলে মা আমাকে আর কোনো মোবাইল কিনে দিবে না। দয়া করে ছেড়ো না। আমার আইফোন!” রায়েদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“আইফোন লেটেস্ট মডেল থার্টিন ম্যাক্স প্রো? তাই ফোনের প্রতি এত ভালোবাসা?”
মাহীন কঠোর গলায় বলল, “ধ্যাৎ আইফোন বলে কথা না। যেকোনো ফোনই তো আর নদীতে শতসহস্র শাপলার মতো ভেসে থাকে না।” বলে রায়েদের অপর হাতের বাহু ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
রায়েদ বলল,”আরেহ মাহীন এমন ঝাকাঝাকি করো না। তোমার মোবাইল এমনিই পরে যাবে আমার হাত থেকে।”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে গেল। তারপর মুখ গোজ করে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মানছি আমিই লিম জুকে বলেছিলাম আমাকে ফোন করতে। শান্তি?”
রায়েদ মুচকি হাসল এবং হাতটা ভেতরে ফিরিয়ে এনে মোবাইলটা মাহীনের হাতে তুলে দিলো। মাহীন নিজের মোবাইল হাতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর মুখ ভারি করে বলল, “তুমি খুব খারাপ কিন্তু”।
রায়েদ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই বলল, “জানি।”
মাহীন বলল, “তুমি সবকিছু এতো নজরে রাখবা আমি ভাবিই নি।”
রায়েদ বলল, “আসলে এটা তোমাকে কখনো বলিনি কিন্তু তুমি আমার দেখা সবচাইতে অদ্ভুত মেয়ে। একটা আইসক্রিমের জন্য কত কি কান্ড করলা।”
মাহীন হাসল। আরেকবার অদ্ভুত ভালো লাগাটা খেলে গেল মনের অন্দরমহলে। রায়েদের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবল, আহা রায়েদের ডায়মন্ড আকৃতির চেহারা। ঠিক রবার্ট পেটিনসনের মতো। ওহ হ্যা হাসলে তো ওকে অমনই লাগে। বাহ আগে তো খেয়াল করিনি।’ ভেবে হালকা হাসল। রায়েদ সেটা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে বসে তুমি এমন কী ভাবো বলোতো যেটা তোমাকে এত হাসায়।’
‘তুমি রবার্ট পেটিনসনের মতো দেখতে ‘ ফট করে বলে ফেললো মাহীন। রায়েদের চেহারায় হালকা হাসি হাসি একটা ভাব ফুটে উঠলো। মাহীন ভাবল, আমি কি ওকে এখন এটা জিজ্ঞেস করব? ফিফটি ফিফটি চান্স আছে উত্তর পাওয়া আর না পাওয়ার। থাক করেই দেখি। যেহেতু ওর মন মেজাজ এর চাইতে ভালো থাকতে আর কখনো দেখিনি।’ মাহীন ধীরে ধীরে সাবধানে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা রায়েদ।”
রায়েদ নিজের চেয়ারে বসে বলল, “হ্যা?”
মাহীনও অপর পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল,
“পরশু দিনের বাস্কেটবল ম্যাচেও কি আসছো না?”
রায়েদের মুখমণ্ডল থেকে যেন হাসিখুশি ভাবটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। তবে শান্ত কন্ঠে বলল, “না। এসব কোনো স্কুল ইভেন্টই আমি এটেন্ড করি না।” মাহীন শুধু উপরে নিচে মাথা ঝাঁকাল।
রায়েদ বলল,”আর দয়া করে অদ্ভুত কোনো কান্ড করে বসো না আমাকে ম্যাচ এটেন্ড করানোর জন্য।”
মাহীন বলল,”নাহ এখানে আমি আবার কিই বা করতে পারি।”
রায়েদ বলল,”তোমার কোনো ভরসা নেই। এর আগে এই একই সুরে দুই বার মুখে বলেছো এক কথা, কাজে করেছো আরেক।” তারপর ভাবতে লাগল, ‘ঠিক আছে আমার জন্য এত কিছু যখন করলা হয়তো এরপর আর কোনো কিছুতে ইনভাইট করলে আমি মানা করবো না। অন্তত কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে হলেও একবার তোমার কথা রাখবো।’ মাহীন ওর ব্যাগটা খুলে ভেতরে ফার্স্টএইড কিটটা খুললো এবং নিওস্পোরিন মলমটা বের করল। তারপর রায়েদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আর দয়া করে দিনে তিনবার করে তোমার কাটা স্থানে নিওস্পোরিন লাগিয়ে নিও যতক্ষণ না ক্ষতটা ঠিক হচ্ছে।”
রায়েদ বলল, “হুম তোমার দেখছি আমার ক্ষত নিয়ে আমার থেকে বেশি চিন্তা। তাহলে তুমিই এসে লাগিয়ে দিয়ে যেও তিন-তিনবার। আমার এসব ঔষধ টোষধ ভালো লাগে না।”
মাহীন গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “এবার তো শুধু আমার চোখে পরে গিয়েছিলো বলে লাগিয়ে দিলাম। আমার চোখে না পরলে কারোও জন্য কিছু করে দেইনা। আর চোখে পরবেও না কারণ আমি এখানে আর আসব না।”
এই কথাটা দমকা হাওয়ার ঝাপটার মতো আলোড়ন ফেললো রায়েদের হৃদয়ে। রায়েদ অবাক হয়ে বলল,
“ওহ তাই। আর না আসবার কারণ?”
“কি আবার কারণ? এখানে কেউ আসলে ব্যাপারটা তোমার ভালো লাগে না তাই। আর এই কয়েকদিনে প্রতিবারই প্রয়োজনে এসেছিলাম। এখন তো আর মনে হয় না কোনো প্রয়োজন পরবে।” মুখে এই কথা বললেও চিনচিনে ব্যথার এক তীব্র অনুভূতি স্নায়ুতন্ত্রের শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে গেল। রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে পানসে কন্ঠে বলল,
“হুম তাও ঠিক।”
মাহীন উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা কাধে নিয়ে বলল,”আচ্ছা যাই। বোধহয় আমার এবং তোমার দুজনেরই কোনো একটা ক্লাস মিস হয়ে যাচ্ছে।”
রায়েদও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বলল, “ওহ হ্যা আমারও তো ক্লাস আছে।”
মাহীন চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। একটা কথাই মাথায় আসল, এখানে না আসলে যদি আর ওর দেখা না মেলে। কাজেই সাহস করে পুনরায় পেছনে ফিরে বলল,
“আচ্ছা চলো আমরা একসাথে যাই।”
রায়েদ নিজের ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বলল, “হ্যা চলো।”
চলবে ইনশাআল্লাহ।