এল_এ_ডেইস পর্ব – ১২

0
330

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১২
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

বড় লোহার গেটটা হাট করে খুলে রাখা। বেশ কিছুক্ষণ পর পর একেকজন শিক্ষার্থী ভেতরে প্রবেশ করছে। এখন পৌণে আটটা বাজে। ক্লাস শুরু হয় সাড়ে আটটায়। সুতরাং স্কুলের গেটে শিক্ষার্থীদের ঢল নামতে দেড়ি আছে। পরিষ্কার নীল আকাশে পাতলা পেলব সাদা মসলিনের মতো মেঘের চাদর। মেঘের এই অদ্ভুত গড়ন কদাচিৎ দেখা মেলে। গেটের থেকে কয়েক গজ দূরে একটা সাইকেল বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রায়েদ মাদিহ মাঝ রাস্তায় সাইকেলে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। চেহারায় গম্ভীরতার ছাপ। চোখে আনমনা ভাব। সে ভাবছে, ওফ এর আগে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এত ভাবতে হয়নি যতটা এটা নিয়ে ভাবছি। এমনতেই আজ এপ্রিলের এক তারিখ অর্থাৎ এপ্রিল ফুল ডে। স্কুলে আজ পাগলামি চরম পর্যায় উঠবে। এই এপ্রিল ফুল একদম ভিত্তিহীন একটা জিনিস। তার ওপর আজই আবার ইভেন্টের প্রাইজ গিভিং সেরেমনিটা ফেলসে। কিন্তু আমি এখন কি করবো। স্কুলের সামনে পর্যন্ত তো এসেই পরেছি। এখন ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না। ভেতরে গেলেই আমি ফেঁসে যাবো। খুব ভালো করে জানা আছে। এই সেরেমনির ভিড়ভাট্টার মাঝে মাহীন আমাকে টানাটানি করে নিয়ে যাবেই। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু একটা আছে। ওকে দেখলেই কী বলবো আর কীরকম আচরণ করব সব গুলিয়ে যায়। অন্যদের ওপর খাটানো কৌশল ওর ওপর খাটে না। তার ওপর আরেকটা সমস্যা হলো ওর সান্নিধ্যে থাকলে হৃদয় বুঝি অন্য কোনো গ্রহের আইনে চলে। ওকে একটুও বুঝি না বাবা! ওফ প্রথম থেকেই ওর সাথে অন্যদের মতই কঠোর আচরণ করা উচিৎ ছিলো। কিন্তু সেটাও কেন হয়ে উঠল না তা আমার বোঝার বাইরে। একবার একটু স্বাভাবিক আচরণ করেছি শুধু আর ব্যাস! আমাকে আর ওইভাবে ও দেখেই না যেভাবে অন্যরা দেখে। ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ঠিক আছে যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখন ও আমাকে সবার মাঝে সেরেমনিতে নিয়ে গেলে, তখন তো আর তা সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওখানে ওর বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পরিবার সবাই থাকবে। কিন্তু আমি কিছুতেই এসবের ভেতর যাবো না। এসবের মাঝে যাওয়াটা আমার মানায় না। কিন্তু সেটা ও কিভাবে বুঝবে? আমি জানি ও যাই করার যেভাবে চেষ্টা করছে সেটা এই পর্যায় এসে পারবে না। এতদিন আমি বুঝতে পেরেও ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করেছি কারণ এতে না কেউ কিছু জানছে, না সকলের কাছে আমার চিরচেনা খারাপ চিত্রে কোনো প্রভাব পরছে। মাহীন যেকোনো কারণেই হোক এসব কিছু সকলকে বলে বেড়ায় না। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা আমি এমন কেন? কেন এমন আচরণ করি? কেন সকলের কাছ থেকে দূরে থাকি? এবং কিছুদিন পর পর কোথা থেকে মারামারি করে আসি? কি এমন ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। এসব কিছুই সকলের প্রধান প্রশ্ন। কারোও সাথে এইজন্যেই স্বাভাবিক আচরণটাও করি না। কারণ করলেই তারা এসব প্রশ্ন করা শুরু করবে। অথচ মাহীন এখন পর্যন্ত একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেনি!’
” মর্নিং।” হঠাৎ কারোও কন্ঠে রায়েদ চমকে উঠল। ডান দিকে ফিরে চাইলো। মাহীন সাইকেল নিয়ে এসে ওর পাশে থেমেছে। বলল,

“তুমি এই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?…আচ্ছা কোনো ভাবে তুমি স্কুলে না যাওয়ার কথা ভাবছো না তো?”

রায়েদ আত্মাসংযম করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“মোটেও না। আমার পা ব্যাথা করছিল তাই একটু দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

মাহীন ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”ওহ আচ্ছা। তাও ভালো তোমাকে এখানে দেখা পেলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম তুমি আজ স্কুলে আসবাই না।”

রায়েদ বলল,”তার কারণ?”

“ওই যে আজকের সেরেমনি। যাবে তো তাই না?”

“না, আমি ওমন সেরেমনিতে যাই না। আজকেও যাবো না।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে যেও না। অন্তত এখন স্কুলের ভেতর চলো।” রায়েদ কিছুটা অবাক হয়ে চাইল ওর দিকে। তবে কিছু বললো না। ওরা দুজন সোজা পার্কিং লটে গিয়ে নিজেদের সাইকেল রেখে আসল। তারপর বড় গেট দিয়ে প্রবেশ করল। দুজনই নিশ্চুপ ভাবে হেঁটে চলেছে।
মেয়েটার পাশে পাশে হাঁটতে রায়েদের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। ইদানীং নতুন কিছু অনুভূতিরা মনের আঙ্গিনায় এসে হানা দিয়ে যায়। যারা একেবারেই নতুন। এসব অনুভূতির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় রায়েদ। ঠিক চত্ত্বরের কাছাকাছি এসে রায়েদ বাম দিকের পথ ধরলো। সবসময়ের মতই ও লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে। মাহীন পেছনে আবার ছুটে আসল ওকে ডাকতে ডাকতে। রায়েদ মনে মনে ভাবলো,’ওফ তাই তো অবাক হচ্ছি ও কিভাবে আমার সেরেমনি জয়েন করার ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বললো না। এইযে এখন ঠিকই বলবে।’ মাহীন এসে ওর সামনে দাঁড়াল। রায়েদ বিরক্ত কন্ঠে বলল,

“দেখো একবার বলেছি যে সেরেমনিতে…ওকে থামিয়ে দিয়ে মাহীন বলল,
“এক মিনিট আমি তো সেরেমনির কথা বলতে আসিনি।”

“তাহলে?”

“আমি বলছি যে তোমার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম,টুইটাট, অথবা তোমার নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ আছে?”

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। বলল,”তুমি হঠাৎ এসবের খোঁজ করছো কেন? কি করবা?”

“আহা থাকলে আমাকে তোমার আইডি দাও, আমার দরকার।”

রায়েদ কঠোর গলায় বলল, “দেখো মাহীন এসব নিয়ে যদি কোনো গোলমাল করেছো এবং কাউকে দিয়েছো তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। এবং আমার থাকলেও আমি দিবো না।”

মাহীন বলল,”আহা আমি এখন পর্যন্ত তোমার সাথে সম্পর্কিত কোনো কিছু নিয়ে গোলমাল করেছি? বলো করেছি? আর তুমি না আমাকে থ্রেট দিয়েছিলা যে তোমার নম্বর যেনো অন্য কারো কাছে না যায়। সুতরাং সেটা তো রেখেছি। নম্বর আর কারোও কাছে যায়নি।”

“ঠিক আছে মানলাম সেই কথা রেখেছ। কিন্তু এখন এসব দিয়ে কি করবা?”

“ওফ এত প্রশ্ন করো না। আজকেই জানতে পারবা আমি কি করবো। এবং এতে কোথাও কোনো ঝামেলা হবে না, তোমার আইডি লিকও হবে না এবং এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানবেও না।”

রায়েদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আমি এসব কিছু চালাই না।”
“নাহ বিশ্বাস হলো না। একবিংশ শতকে কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকে?অন্তত ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের কোনো একটা আছে?”

“না, এগুলোয় শুধু সময় নষ্ট।”

“টুইটারও না?”
‘না।’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘হোয়াটসঅ্যাপ?’

এবার রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,’আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। হ্যা আমার আছে হোয়াটসঅ্যাপ।”

মাহীন বিজয়ির হাসি হেসে বলল,’তোমার নম্বরেই তো?’
‘হ্যা। তবে মনে রেখো আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমাকে কখনো ফোন করবে না। কখনো না মানে কখনো না। তাহলে তুমি আমার হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে করবাটা কি?’

মাহীম বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে বললো, ‘আবার তোমার ওভার থিংকিং তোমাকে পেয়ে বেসেছে। আমি কখন বললাম আমি তোমাকে ফোন দিবো? শুধু স্কুল ওয়াইফাই খোলা রেখো।’ বলেই হাঁটতে লাগল।

রায়েদ উচ্চস্বরে বলল,’ওয়াইফাই কেন খোলা রাখব? এর মানে তো এটা দাড়াচ্ছে তুমি আমাকে ফোন দিবা।…মাহীন!’ ততক্ষণে মাহীন দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে রায়েদ থেকে পনেরো গজ দূরে এগিয়ে গিয়েছে। আর পেছনে ফিরে চাইলো না। রায়েদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। তারপর ঘুরে আবার লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। লাইব্রেরি তে প্রবেশ করে নিজের অন্যান্য বই খাতা বের করে রাখল। আজকে কোনো ক্লাস নেই। এবং স্কুল বিল্ডিংয়ে শিক্ষার্থীদের পাওয়াও যাবে না। সকলেই এখন স্কুল অডিটোরিয়ামে রয়েছে। সেরেমনি নয়টার সময় শুরু হবে। রায়েদ ওর পড়ালেখা নিয়ে বসল। কিছুক্ষণ ফিজিক্স পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না। ফিজিক্সের কনসেপ্টগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এরপর ইংলিশ খুলে বসল। কিন্তু সেটাতেও মন বসানো সম্ভব হলো না। যেই ভাষায় প্রতিনিয়ত কথা বলছে তাও যেন অতি দূরবদ্ধ ঠেকল। অবশেষে বইখাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। বারবার ওই মেয়েটা মাথার মধ্যে হাজির হয়ে বিরক্ত করছে। দূরে থেকেও পিছুই ছাড়ছে না। বড় মুশকিল তো! বই ভড়া সেলফগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল এবং ভাবতে লাগল, মাহীন আবার আমার হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে কি করবে? আমাকে কেন ফোন করবে ও? যেভাবে বলল, ফোন করবে না সেটা স্রেফ এমনিই বলেছে। আসলে ও ফোন ঠিকই করবে। ওইদিনও ওই একই সুরে বলেছি যে, “কে বলেছে আমি তোমার জন্য আইসক্রিম আনতে যাচ্ছি?” অথচ কি করলো। ওফ আল্লাহ জানে এই মেয়েটা আমাকে কি ঝামেলায় ফেলবে। কিন্তু আমি শুধু ওয়াইফাই অফ রাখলেই কাজ শেষ। ফোন আসবে না। কিন্তু তখন আবার এমনি ফোন দিবে। সেখান থেকেও তো আর ওকে ব্লক করে দেওয়া যায়। তবে তা ভালো দেখাবে না। আর সেইদিন যেটা হলো। অবশ্য সেই ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো রহস্যই আছে যে, যেদিন প্রথম ও আমাকে ফোন দিয়েছিল তখন ফোনটা রিসিভ করা হয়েছিলো। তাহলে কেন ও সবসময় বলে যে আমি এবং লিমের মধ্যে কেউই ফোন ধরিনি? আমার ফোন, আমি জানি ফোন রিসিভ হয়েছে। কমপক্ষে চার পাঁচ সেকেন্ড লাইনে ছিল। তারপরও মাহীনের মুখ থেকে একবারও এটা বের হয়নি যে আমি ফোন ধরেছিলাম। আসলেই কি তার কারণ এটা যে, ও জেনে শুনেও আমাকে জিজ্ঞেস করতে চায়নি যে, ওই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দটা কিসের ছিলো। ফোন ধরেছি এটা বললেই তো প্রসঙ্গটা চলেই আসত। অথচ ও খুব সাবধানে সেটা এড়িয়ে গেছে। ও আসলে কি ভেবে এরকম অদ্ভুত কিছু কাজ করে সেটা তো শুধু ওই বলতে পারে।’ কতক্ষণ পায়চারী করার পর আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তারপর নিজের সেল ফোনটা বের করে ওয়াইফাই অন করল। যদিও ওর অফ রাখার কথা ছিলো। তারপর সেল ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। মনের ভেতর থেকে এক অচেনা কন্ঠস্বর কিছুতেই ওয়াইফাই অফ রাখার অনুমতি দিল না।ভাবল, দেখা যাক ওর মাথায় কি চলছে। সেরেমনি হয়তো এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।’ এরপর প্রায় আধাঘন্টার বেশি পার হল। হঠাৎ রায়েদের সেল ফোনটা বেজে উঠল। রায়েদ দেখল, হোয়াটসঅ্যাপে “দ্যা স্ট্রেঞ্জ গার্ল” নামে সেভ করা নম্বর থেকে ভিডিও কল আসছে। মাহীনকে ফোন নম্বর নিয়ে যাই বলুক না কেন নিজে নম্বরটা ঠিকই সেভ করে রেখেছে। রায়েদ কিছুটা অবাক হয়ে সঙ্গে কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভাবল, কি ব্যাপার এখন ও আবার আমাকে ভিডিও কল করছে কেন? আসলেই পাগল না তো মেয়েটা। একই জায়গায় আছি। কিছু বলতে হলে তখনই বলতে পারত, এখনো এসে বলতে পারে। আমি হাজার বার মানা করার পরও কল করছে তাও আবার ভিডিও কল। তাও যা ভালো আমি এখন এখানে আছি। বাসায় থাকা অবস্থায় যদি কল দিতো তাহলে কখনোও ওকে মাফ করতাম না। কিন্তু আমি এখনো ফোন ধরবো না।’ ফোনটা বেজেই চলেছে। কিন্তু কল আর কাটে না। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, ‘সমস্যাটা কী? এই কল ইগনোর করলে কি বেশি সময় ধরে বাজে নাকি? কাটে না কেন? আর না কাটা পর্যন্ত কেমনটা যে লাগে, যে অপর পাশ থেকে কেউ অপেক্ষা করে আছে আমার ফোন ধরার আর আমি দেখেও ফোন তুলছি না।…ওফ কি মানসিক টর্চার!
ফোনটা বাজতে বাজতে শেষ পর্যন্ত কাটল। রায়েদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কী ফেললো না তার আগেই
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পুনরায় বাজতে লাগল। রায়েদ বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর কল রিসিভ করে ক্যামেরা অফ করে দিলো। কিন্তু অপর পাশের ক্যামেরায় মাহীনকে দেখা গেলো না। তার বদলে দেখা গেল, সারি সারি ছোট ছোট চেয়ার। তার সামনে বড় একটা স্টেজ। আশপাশ থেকে শিক্ষার্থীদের সোরগোল শোনা যাচ্ছে। রায়েদ বলল,

“মাহীন তুমি…ওর কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বলল,

‘আমি মাহীন না। আমি লিম জু। দেখো মাহীন যাচ্ছে স্টেজের দিকে। আর কিছু মনে করো না। আমি কিন্তু কল দেইনি। মাহীন কল দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে গেছে।’

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে চাইল। ভাবল, তাহলে এই ছিলো ওর মনে। এই ভাবে আমাকে সেরেমনির সঙ্গে কানেক্ট করার জন্য এত কিছু করলো। তবুও আমাকে সশরীরে না হলেও ভার্চুয়ালি ঠিকই সেরেমনি তে নিয়ে গেলো। এই মেয়ের বুদ্ধির তুলনা হয় না।’ আনমনেই হালকা প্রসারিত হলো ঠোঁট।

লিম জু বলল,
” ওহ এটা তো বলিইনি। যে আমাদের আর্টিকেলটা তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে! ওফ প্রথমবার আমার তৈরি কিছু এই পর্যায় পৌছাল। মাহীন স্টেজের দিকে গেছে। আমি যাইনি। আমার নার্ভাস লাগে।” রায়েদ বেশ অবাক হলো, সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হলো। তবে মুখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘কংগ্র্যাটস’। লিম জুকে কিছু বলতে শোনা গেলো না। মাহীনকে দেখা গেলো স্টেজের ওপর উঠছে। প্রিন্সিপাল সেলটন কিছু একটা বলে মাহীনকে একটা ম্যাডেল পরিয়ে দিলেন। তারপর মাহীন মাইক হাতে নিয়ে হাসি মুখে বলল,
‘আমি এই স্কুলে নতুন… ছাত্রী। এখানে এসেছি তার এক মাসও না হতেই এমন কিছু একটা পেয়ে যাবো ভাবতেও…এর ভালো ভাবে শোনা গেল না। আবার মৃদুভাবে শোনা গেল, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশে করতালির শব্দ শোনা গেল।মাহীন স্টেজ থেকে নেমে গেলো। সেখান থেকে সোজা ও ভিড়ের মধ্যে চেয়ার টেবিলগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। লিম জু সেদিকে পুরপুরি ক্যামেরা ঘুরালো না বলে ভালো ভাবে দেখা গেল না। এবং সম্ভবত লিম জু মোবাইল হাতে নিয়ে তালি দিচ্ছে ফলে সব ঝাকানাকা দেখা যাচ্ছে। রায়েদ ভাবল, ওহ হ্যা আমি ঠিকই ধরেছিলাম! মাহীন এই স্কুলে নতুন। হয়তো ও আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেই না। অথবা শুধু মুখে মুখে শুনে অতটা পাত্তা দেয়নি। নাহলে কেউ আমার সাথে কাজ করতে কেন রাজি হতো।’ ভাবতে ভাবতেই মাহীনের কন্ঠস্বর শোনা গেল। রায়েদ চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মাহীন খুব সম্ভবত পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, বলছে,
“লিম লিম আমাকে মোবাইলটা দাও।” লিমের কন্ঠ শোনা গেল,
“হ্যা নাও। আমি যাই ওখানে গিয়ে বসছি। দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যাথা করছে।” ক্যামেরাটা নড়াচড়া হলো এবং খট খট শব্দ হলো। তারপর মাহীনকে দেখা গেল। মাহীন হাসি মুখে বলছে,
“তোমার মেডেলটা মিসেস রেয়ের কাছে আছে। আমাকে দিতে বললাম, দিলো না।”

ওপাশ থেকে রায়েদ বলল,
“সমস্যা নেই। উনি আমাকে পরে দিয়ে যাবেন।” মাহীন একটু দূরে খোলা করিডোরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ভিড় এবং হৈচৈ কম।
মাহীন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“হুম। আচ্ছা দেখলা তো তোমাকে কিভাবে সেরেমনি এটেন্ড করালাম। তোমার লাইব্রেরিতে বসেই। কেউ কিছুই জানল না। কেমন লাগল আমার আইডিয়াটা?”

রায়েদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“হুম ভালোই।”

মাহীনের মুখ হাসি উধাও হয়ে গেল। বিরক্ত কন্ঠে বলল,
“ধ্যাৎ! তুমি ” ভালো” ছাড়া আর কোনো কমপ্লিমেন্টারি ওয়ার্ড পারো না? নাকি চার বছর ধরে ব্যবহার না করতে করতে ভুলে গেছ?” রায়েদ আর কিছু বলার পূর্বেই লাইন কেটে গেল। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসল। মনে অনেক কিছুই আসে কিন্তু মুখ পর্যন্ত সেসব কথা আসে না। সেল ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। তারপর ভাবতে লাগল, এক মিনিট ও শেষ কথাটা কি বললো? চার বছর ধরে কমপ্লিমেন্টারি ওয়ার্ড ব্যবহার না করতে করতে ভুলে গেছি? চার বছর? চার বছর বললো কেন ও? ওহ না। মাহীন তো নিজের বন্ধুদের কাছ থেকে এসব জানতেই পারে। যারা এখানে আট নয় বছর ধরে পড়াশোনা করছে তাদের কাছে তো কোনো কিছু অজানা নয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here