এল_এ_ডেইস পর্ব – ২

0
612

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ২
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

যান্ত্রিক দেয়াল ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে, সাতটা বেজে ছয় মিনিট। ছয়টি চেয়ার বিশিষ্ট ওক কাঠের চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিল। মার্কিন মুল্লুকে আলাদা ডাইনিংয়ের বালাই নেই। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া ডাইনিং। ড্রইংরুমে পাশে কাঁচের থাই গ্লাস দেওয়া স্লাইডিং ডোর। এ পথ একাধারে খিরকিজানালা এবং বাগানে যাওয়া রাস্তা। আজ তিন বছর পর একটি পরিবার পুনরায় একত্রিত হয়েছে একই ছাদের নীচে। এই পরিবারে কারোর মধ্যে দূরত্ব কোনো কালেই ছিলো না। শুধু ছিলো স্থান ও সময়ের দূরত্ব। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল স্নিগ্ধ সকাল। তবে পৃথিবীর এক গোলার্ধের সময়, পরিবেশ, সংস্কৃতি ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য গোলার্ধে এসে পরায় এই তিনজন মানুষের শরীর ও মন কোনোটাই মানিয়ে নিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যাটা সময়ই করছে। কী অদ্ভুত নিয়মে চলে এই সময়। এখানে যখন আমেরিকানরা সূর্যের আলো গায়ে মাখে তখন অন্ধকারাবৃত বাংলাদেশে মানুষ টুপ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।নাস্তার টেবিলে বসেও ওদেরও সেই একই অবস্থা। মন মস্তিষ্ক ঘুম ঘুম করে। নাইম এবং মিসেস নাসরিনকে ঘুমের চক্করটা একটু বেশিই অসুবিধায় ফেলেছে। মাহীনের আবার এক অদ্ভুত গুন রয়েছে বা অভ্যাস রয়েছে। তা হলো ও অনায়সে যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পরতে পারে। ঠিক তেমনিই রাতে ঘুমনোর সময় অর্থাৎ বাংলাদেশে যখন দিনের আলো ছিলো সেই সময় ও আরামসে ঘুমের পাটটা চুকিয়ে ফেলেছে। তবুও এখনো ঘুমের রেশটা হালকা টানে ধরে রেখেছে ওকে। নাস্তায় বেশি কিছু করেননি মিসেস নাসরিন। টোস্ট এবং ডিম পোঁচ ও চা। মাহীন ও নাইম ভিন্ন মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ চা নিয়ে বসেছেন। মাহীন কখনো চা ছুঁয়েও দেখে না। ওর চাই শুধু কফি। এবং নাইমের ভাগ্যে জুটেছে এক গ্লাস সাদা দুধ। তাই তো ওর যত আপত্তি।সে হরলিকস খেতে অভ্যস্ত। কাজেই শুধু দুধেই চলবে না। মিসেস নাসরিন বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললেন,
“তুই আর কবে বড় হবি নাইম? অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছিস এবার। এই বয়সে কে হরলিকস দিয়ে দুধ খায়?”
নাইমের তীব্র কন্ঠে বলল,
‘অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছি এটা কি প্রতি কথায় মনে করিয়ে দিতে হবে? আমার তো এখনো উনিশ বছর বয়স। আর বড় হওয়ার এই এক জ্বালা। যত বড় হবা তত রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলতে হবে কেন?’ শেষের কথাটা বলার সময় ওর মুখের বিরক্তি প্রকাশ পেল। মি.মোর্শেদ মুখের সামনে পেপার মেলে ধরে আছেন। মাহীন চুপচাপ নিজের টোস্টে পিনাট বাটার লাগাতে ব্যস্ত। মিসেস নাসরিন বললেন,
“মাহীনকে দেখ। কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা করেনা। যা দেই খেয়ে নেয়। আর তুই, এখনো সবকিছু নিয়ে ঢং করিস।”
নাইম লম্বা এক শ্বাস নিল। এবার নিজেকে প্রস্তুত করল কিছু বলার জন্য। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিজ্ঞের মতো বলতে শুরু করল,
“মা সব মানুষের পছন্দ অপছন্দ একই রকম হয়না। আর ধরো সত্যিই যদি পৃথিবীর সব মানুষের পছন্দ একই রকম হতো তাহলে কি হতো। সাপোস সব মানুষের গণহারে সাইন্স বিষয়টা পছন্দ হয়ে গেলো। এখন সবাই সাইন্স পড়তে লাগলো। আর কোনো সাবজেক্টই কারোও পছন্দ হচ্ছে না। তাহলে আর্টস, কমার্স এবং অন্যান্য বিষয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এবং সবাই সাইন্স পড়ে ধরো বিজ্ঞানী হতে চায়। এখন পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষই যদি সাইন্স পড়ে।তাহলে অন্যান্য কাজ কে করবে? খাদ্য উৎপাদন কে করবে? অন্যান্য ব্যবসা বানিজ্য কে করবে? আর হ্যা এই সাইন্স পড়ানোর জন্য টিচারও তো প্রয়োজন।সবাই বিজ্ঞানী হলে টিচার কে হবে? আর…।”
ওর কথার মাঝখান দিয়ে মিসেস নাসরিন অতিষ্ঠ কন্ঠে বললেন,
‘থাম! এক্ষুনি থাম। আমার মনে হচ্ছে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। তুই একদিন আমাকে মানসিক রোগী বানিয়েই ছাড়বি।’ বলে তিনি ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগলেন। কপালের কোণে জমা হওয়া সামান্য ঘামটুু হাত দিয়ে মুছে ফেললেন। বোধহয় প্রকৃতপক্ষেই তার মস্তিষ্কের কোষগুলো নাইমের অর্থহীন প্যাচালো কথার প্যাচে পরে গিয়েছে। মাহীন চাঁপা হাসছে। মি.মোর্শেদ পেপারটা ভাজ করে রাখলেন। তার ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।তিনি আমুদে কন্ঠে বললেন,
“আচ্ছা নাইম তোর গত বছর কক্সবাজারের ঘটনাটা তো শোনা হলো না।ওটা বলতো।’ ওনার কথা শেষ হলো কি হলো না, দেখা গেলো নাইমের সম্পূর্ণ মুখ মন্ডল টমেটোর মতো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে মুখে কেমন জানি এক বিব্রত ভাব। মাহীন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। দুষ্টুমির করে বলল,
” ভাইয়া তোর মুখটা তো একদম ঠিক এক ছোট পলিথিনে টমেটো সস ভরলে যেমন লাগে তেমন হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এক প্যালেট ব্লাস নিজের মুখের ওপর ঢেলে দিয়েছিস।”
নাইম ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি হানলো। মনে হলো চোখের দৃষ্টি দিয়েই ও মাহীনকে ভস্ম করে দিতে চাইছে।
মাহীন বাবার দিকে তাকাল। এবার হাসাহাসি বাদ দিয়ে কন্ঠে কিছুটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল,
‘বাবা আমি বলছি ঘটনাটা।’
নাইম সাথে সাথে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“খবরদার যদি মুখ খুলেছিস তাহলে তোর একদিন কি আমার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন।”
মাহীন ওর বড় বড় ধারালো নখ দিয়ে নাইমের হাতে আঁচড় দিতেই ও ঝট করে হাতটা সরিয়ে মাহীনকে মুক্ত করে দিলো। মাহীন এবার ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“তোর সাহস তো কম না আমার মুখ বন্ধ করতে যাস। ঘটনাই এমন ঘটেছে যে আমি আর কি বলবো।” নাইম ওর হাতের যেই জায়গাটায় আঁচড় লেগেছে সেখানে অপর হাত চেপে ধরে মুখ কুঁচকে বলল,
“ইশ আমার হাত ভয়ংকর জ্বালা করছে। জঙ্গলি মেয়ে একটা। নিজেকে মোগলি ভাবিস? কে রাখে এত বড় বড় ধারালো নখ।”
মাহীন ভেংচি কেটে বলল,
‘তোর জ্বালায়ই এত বড় বড় নখ রেখেছি। নাহলে তোকে খামচি দিতাম কি করে। আর আমি মোগলি হতে যাব কেন? আমি আরোও ভয়ংকর বেলাট্রিক্স ল্যাস্ট্রেঞ্জ।’
মি. মোর্শেদ বিস্ফারিত চোখে এতক্ষণ ওদের দুজনকে পরক্ষ করছিলেন। এবার শুধু মিসেস নাসরিনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,
“তারমানে তুমি ফোনে যেইসব ঘটনা আমাকে বলতে সেইগুলো সত্যি ছিল?”
মিসেস নাসরিন অবাক কন্ঠে বললেন,
“এই ছিলো তোমার মনে এতদিন! আমার একটাও কথা বিশ্বাস করতে না তুমি? তুমি ভাবসো তোমার দুই ছেলে মেয়ে ধোয়া তুলসি পাতা? এবার বিশ্বাস হচ্ছে ওরা আসলে একজন রাশিয়া আরেকজন ইউএস। কখন কে কার ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।”
মি.মোর্শেদ নিঃশব্দে হেসে উঠে বললেন,
“যাক তাহলে এবার আমার বাড়িটায় ওদের দুজনের মধ্যে যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থার জন্য একটা টান টান উত্তেজনা ভাব থাকবে।
.
.
.
নাস্তা শেষ হওয়ার পরই মি.মোর্শেদ মাহীনকে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। মাহীন নেভি ব্লু রঙের একটা কুর্তি সঙ্গে জিনস পরল এবং গলায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে নিল।ওর লং বব ছাটে কাটা চুলগুলো ছেড়েই রাখলো। শ্যামলা গড়ন ও ওভাল আকৃতির মুখ। হৃদয় আকৃতির ঠোঁট ও কাঠ বাদামের মতো কাজল কালো মনি বিশিষ্ট নয়ন। প্রশস্ত নাক ও চিকন থুতনি। দেখতে খুব সুন্দরও বলা যায়না আবার অসুন্দরও বলা যায়না। মোটামুটি মিষ্টি একটা মুখ। চোখে কখনো একটান কাজল দিতে ভোলে ও। মাহীন তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসতেই মি.মোর্শেদ মাহীনকে নিয়ে তাদের নীল ক্যাডিলাক রাস্তায় নামালেন। এখান থেকে স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল এতটাই কাছে যে হেঁটেই অল্প কিছুক্ষণে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। মাথার ওপর বিস্তৃত পরিষ্কার নীল আকাশ। রাস্তায় নেই কোনো ধুলাবালি। রোদের আলোয় মেখে রুপালি রাস্তা চকচক করে। চলাচলরত গাড়িগুলোও রোদে চিকচিক করে।
গাড়িতে মন থিতু হওয়ার পূর্বেই ওরা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। মাহীনের মনে উচ্ছাস যেন ধরে না। লস এঞ্জেলসে তো এসে পরেছে, এবার এখানকার হাই স্কুলেরও সদস্য হতে চলেছে ও। অর্থাৎ বলা যায় পাকাপোক্ত ভাবে এল এ সিটিজেন। যদিও গ্রিন কার্ড পেতে দেরি আছে। গাড়ি থেকে নেমে সামনে বড় গেট। তার ওপর ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা “স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল”। সংক্ষেপে “সামোহি (SAMOHI)”। মাহীনের শিরদাঁড়া বেয়ে আনন্দের শ্রোত বয়ে গেল। বাংলাদেশে থাকতেই গুগলে এই স্কুল সম্বন্ধে সার্চ দিয়ে দেখেছে। তখন থেকেই উদগ্রীব হয়ে আছে সচক্ষে স্কুলটা দেখার জন্য। মি.মোর্শেদ সামনে এগিয়ে যেতেই মাহীন তার পেছন পেছন এগিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করেই আরোও বিস্মিত হলো। স্কুল ক্যাম্পাসটাকে ছবিতে যত বৃহৎ দেখিয়েছিল, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি বড়। মাহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে পরোখ করতে করতে ধীর পদক্ষেপে হাঁটছে। স্কুল বিল্ডিং সম্পূর্ণ হালকা বাদামী রঙের। চারটি তলা রয়েছে। ডান দিকের বিশাল মাঠটা কম করে হলেও সত্তর আশি ফিট লম্বা তো হবেই। বাম দিকে গোল মতো একটা চত্ত্বর। তার এক পাশে বড় বড় অক্ষরে হলদে রঙের “সামোহি” লেখাটির স্ট্যাচু বানিয়ে রাখা। মি. মোর্শেদ গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মূল প্রবেশ দ্বারের সামনে অন্তত তিন ফুট উঁচু লালচে ইটের সিঁড়ি দেয়া। মাহীন ও মি.মোর্শেদ ভেতরে প্রবেশ করেই একদম সোজা করিডোর ধরে হেঁটে গেলেন। ডান দিকে একটা বাক ঘুরতেই একটা কাঠের দরজার সামনে এসে থামলেন মি.মোর্শেদ। তারপর দরজায় টোকা দিলেন। ভেতর থেকে এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো,
“কাম ইন।” উনি দরজাটা এবার খুললেন। ভেতরে প্রবেশ করার পর মাহীনও ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে ওক কাঠের তৈরি ডেস্কের ওপাশে এক কৃষ্ণ কালো মধ্য বয়সি লোক বসে আছেন। তিনি হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে মি.মোর্শেদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর বললেন, “তাহলে ওই আপনার মেয়ে ম্যহিন।” কথাটা বলেই উনি মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,
“হাউ আর ইউ মাই গার্ল?” মাহীন মি.মোর্শেদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তরে হালকা হেসে বললা,
“আই এম ভেরি ফাইন স্যার, থ্যাংক ইউ।”
মি.মোর্শেদ বললেন,
“ওহ হ্যা পরিচয়ই তো করিয়ে দেইনি। উনি এই স্কুলের প্রিন্সিপাল ডক্টর এন্টোনি সেলটন। প্রিন্সিপাল সেলটন বললেন,
“তাহলে চলেন আগে ওর ভর্তির কাজটা সেরে ফেলি। তারপর আপনার সঙ্গে অনেক কথা হবে।” তারপর মাহীনের দিকে ফিরে বললেন,
“তো মিস মাহীন ফারুকী আপনি চাইলে ততক্ষণে স্কুলটা ঘুরে ফিরে দেখতে পারেন কোনো সমস্যা নেই। আটটা থেকে ক্লাসের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসা শুরু করবে। তখন ভিড় বেড়ে যাবে।”
মাহীন অবাক কন্ঠে বলল,
“আমি এখনই স্কুলটা ঘুরে দেখতে পারবো?”
প্রিন্সিপাল সেলটন হেসে বললেন,” অবশ্যই, তবে তার আগে একটি কাগজে তোমার সই লাগবে। সেটা করে যেও।”
মাহীনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
“আবার হারিয়ে যাইস না।”
মাহীন বলল,
“না বাবা কিছু হবে না।”
তারপর প্রিন্সিপাল সেলটন ড্রয়ার হতে একটা কাগজ বের করে সেখানে মাহীনের সাক্ষর নিলেন। তারপর মাহীন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল। আনন্দে নেচে উঠতে ইচ্ছে করলো। ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেশ মুছছেই না যেন। মাহীন হাটতে হাটতে গেটের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। একবার ভাবলো ভেতরে যাবে। আবার ভাবলো নাহ বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। শেষে গেটের বাইরেই বেরিয়ে গেল। এইসময় কড়া রোদ উঠেছে। স্কুল প্রাঙ্গন রোদে রৌদ্রজ্জ্বল। দেখা গেল সামনের বড় গেট হতে একে একে ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। মাহীন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। কেউ কেউ সাদা চামড়ায় মোড়া সোনালি কিংবা বাদামি কেশ ধারী। কেউ কেউ শ্যাম গড়নের আবার কেউ কেউ কৃষ্ণ বর্ণের। কারোও চোখের মণি নীল, কারোও সবুজ, কারোও আবার ধূসর কিংবা বাদামি। দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক পরখ করতে লাগলো। কেউ কেউ একা একা আসছে আবার অন্যরা দল বেঁধে হৈচৈ করতে করতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মাহীনের মনে এতক্ষণ যেই আনন্দ বয়ে বেড়াচ্ছিল, মুহূর্তেই যেন সেগুলো মিলিয়ে গেল। এক অজানা অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। এতগুলো ছেলেমেয়ে, তাদের আলাদা আলাদা পার্সোনালিটি, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। হ্যা এখানকার যেই উচ্ছন্নে যাওয়া সমাজরীতি তাতে বাংলাদেশের যেকোনো রক্ষণশীল পরিবাবের ছেলেমেয়েই সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না। মনে মনে ভাবল,
আমি এখনো এই স্কুলের অতিথি মাত্র। নতুন দেশ ও নতুন সংস্কৃতি। এখানকার ছেলে মেয়েদের চাল চলন চিন্তা ভাবনা অন্য রকম। এদের সাথে তাল মিলিয়ে কিভাবে চলবো আমি? এবং আমি ভর্তি হচ্ছি দশম গ্রেডে। আগামী মাত্র দুই বছর অর্থাৎ টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্তই এখান কার যাত্রা। তাছাড়া গত দশ বছর ধরে যারা এখানে পড়াশোনা করছে সকলেরই নিজের বন্ধু বান্ধব, অথবা বন্ধুমহল রয়েছে। আমি নতুন এসে কিভাবে মিশবো ওদের সাথে?’ এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ওর কপাল কুঁচকে গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। ধীর পদক্ষেপে গোল চত্ত্বর ধরে হাঁটছে ও। কিছুটা আনমনা। হঠাৎ সামনে দেখলো ওর থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে দুজন ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া এবং ফ্যাকাসে দেখতে। এবং মেয়েটার ততটাই শীর্ণকায় শরীর। মেয়েটাও যথেষ্ট ফ্যাকাসে দেখতে এবং সোনালি চুল। মেয়েটা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে তাহলে আমি আজ আসছি। আর হ্যা ভুলেও সিগারেট ধরলে তোমার খবর আছে”। ছেলেটা মুখ টিপে হাসলো। বলল,
“আহা আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি প্রমিজ। তুমি এত চিন্তা করো না।”
মেয়েটা চিন্তিত চিত্তে বলল,
“জানি কিন্তু তবুও বলছি। এমন কিছু করলে আমিও মেনে নিবো না তোমার মাও মেনে নিবে না। মনে রেখ।” বলেই পেছন ঘুরে চলে গেল। মাহীন মুখ বাঁকা করল। ভাবল, ‘এ কোথায় এসে পরলাম আমি। এদের কালচারের উচ্ছন্নে যাওয়া দিকটার কথাও মাথায় রাখতে হবে।’ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। ছেলেটা চত্ত্বরের অপর দিকে অগ্রসর হলো। মাহীন অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পেছন ফিরলো আবার স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। তখনই দূর থেকে দেখল সেই ছেলেটার হাতে কি থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে। কৌতুহল বসত কয়েক পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে বুঝল সেটা সিগারেট। মাহীন ভাবল, কি আশ্চর্য ফাজিল একটা ছেলে! এখনি গার্লফ্রেন্ড কে প্রমিজ করলো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে বাহ! হঠাৎ কি মনে হতেই জিনসের পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করলো। এবং ক্যামেরা অন করে স্ক্রিন জুম করে ছেলেটার ভিডিও করলো। বেশ কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও করে বন্ধ করে দিলো। তারপর আনমনে বাঁকা হাসলো এবং ভাবলো,
‘কখনো না কখনো কাজে লাগবে তোমাকে শায়েস্তা করতে।’ভেবেই গেটের দিকে এগিয়ে গেল। তবে গেটের ভেতর পুনরায় প্রবেশ করার আগেই মি.মোর্শেদকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতে কয়েকটা ভাজ করা কাগজ। তাকে দেখে মাহীন থমকে দাঁড়ালো।
মি.মোর্শেদ হাসি মুখে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোর এডমিশন হয়ে গেছে। এখন পুরো দমে ক্লাস চলছে। তুই আগামীকাল থেকেই স্কুলে আসতে পারবি।” মাহীন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“আল্লাহ আমি কালকেই আসতে পারব?”
“হ্যা।তুই এখন সফোমোর। দশম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের সফোমোর (Sophomore) বলে।” মাহীন ঈষৎ হাসলো। তারপর মি.মোর্শেদ বড় প্রবেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হলেন। মাহীন ওনার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। বড় গেটের দুটো পাল্লাই একদম হা করে খোলা। এইসময় শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার ঢল নেমেছে যেন। ভীড় পার করে বাবা ও মেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা একদম গেটের সামনেই পার্ক করার অনুমতি নেই। স্কুলের পার্কিং রয়েছে। আবার মাহীন ও মি.মোর্শেদ গাড়িতে চড়ে বসলেন। উনি গাড়ি স্টার্ট দিতেই মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা এবার কি আমরা সোজা বাড়ি যাবো?’

‘না তোর ফোনের সিম কার্ড ও নম্বরটা পাল্টাতে হবে।’ মাহীনের এতক্ষণ মনে পরলো যে ওর বাংলাদেশী সিম কার্ড ও নম্বর এখানে কাজ করবে না। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মাহীন বলল,
‘এবং মা ও ভাইয়ার নম্বর?
মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
“চিন্তা করিস না,তোর মা এবং নাইমের মোবাইল আমি সাথে এনেছি।” তারপর একটু থেমে বললেন,
“আচ্ছা তোকে সাইকেল কিনে দিলে কেমন হয় বলতো?”
মাহীন অবাক কন্ঠে বলল,
“সাইকেল! সত্যি!
মি.মোর্শেদ বললেন,
“অবশ্যই। দুইটা সাইকেল কিনবো তোর জন্য একটা, নাইমের জন্য একটা। কারণ আমি কাজে ব্যস্ত থাকবো সবসময় তোদের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হতে পারব না। তবুও এটা ক্যালিফোর্নিয়া। এখানে সাথে কোনো ট্রান্সপোর্ট না থাকলে চলা মুশকিল।” মাহীন উপরে নিচে মাথা ঝাকিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেরাল। এখন দিনের উজ্জ্বলতার ছোঁয়ায় শহরটিকে দেখতে পাচ্ছে আরোও গভীর ভাবে। মনে মনে ভাবলো, আহা আরোও ভালো ভাবে শহরটাকে দেখতে পাবো যখন আমি রাস্তার পাশের সাইডওয়াক গুলো ধরে ভীড়ের মাঝ থেকে হাঁটব। এইসব দোকান গুলোর মাঝে যেটায় ইচ্ছা সেখানে ঢুকে মন মত কিছু কিনতে পারবো। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবো। এই সুন্দর শহরের যত্নে থাকা এখানকার অপরুপ প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখতে পারবো। এবং সাইকেল চালিয়ে হাওয়া খেতে খেতে গোটা শহরটাকে চোষে বেড়াতে পারবো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here